শ্রীকান্ত অধিকারী
‘PUSH’ লেখা দরজায় আলতো করে চাপ দিল তান৷ নিঃশব্দে হাট হয়ে গেল পার্লারের ভেতরটা৷ সঙ্গে সঙ্গে ছলকে এলো চামেলি ফুলের সুগন্ধি মাখানো শীতল হাওয়া৷ শরীর মন উথলে উঠে তানের সঙ্গে সঙ্গে পালিকেও চুম্বকের মত টেনে ভেতরে ঢুকিয়ে দিল৷ পালি আশ্চর্য হয়ে থমকে দাঁড়াল৷ কি নেই! —বিশাল আয়না, আয়নার দু পাশে দুটো ওয়াল শো কেস, কাচ দেওয়া৷ বাইরে থেকেই চোখে পড়ল হাজারো মেকআপ কসমেটিক্সের সাজানো সম্ভার৷ দোকানে যা থাকে তার চেয়েও বেশি৷ দু-একটার সঙ্গে অল্পস্বল্প পরিচয় হলেও বেশির ভাগই কস্মিনকালে দেখেনি৷ নামই শোনেনি৷ দেয়ালের এক কোণে একটা সবুজ রঙের বেড৷ সেখানেও একজন উপুড় হয়ে শুয়ে৷ মাথার দিকে আরেকটা আয়না৷ দুদিকে ঘাড় উঁচু করা গদিময় চারটে বড় চেয়ার৷ তিনটেতে কাস্টমার আধশোয়া৷ সবার মুখগুলো বাদামী রঙের ঘন প্যাকে ঢাকা৷ দু’জনের চোখে চাকা চাকা শসার টুকরো৷
খসটে সবুজ জিন্স আর মেরুন রঙের টি-শার্ট পরা ঝকঝকে এক মহিলা মাপা হাসিমেখে বলে, —এসো৷ তোমাদের জন্যই অপেক্ষা করছি৷ পিছনে একটা নোটিশ— আপনি সি সি টিভির আওতায়৷ তার পাশেই অভিনেত্রী মালাইকার বিগ ফ্রেমের লাস্যময়ী ছবি৷ ইশারায় ফাঁকা চেয়ারে বসতে বলে রিমোটের বোতাম ছুঁয়ে মিউজিক সিস্টেমে একটা ইংরেজি গান চালিয়ে দিল৷
ইংরেজি গান ভালো লাগে৷ কিন্ত্ত এখানে ওর আজ প্রথম৷ তাহলে এই মহিলা জানল কী করে! নিশ্চয় তান আগে থেকেই জানিয়ে দিয়েছে৷ তবে যাই হোক, ঠান্ডা ঘরে এইরকম মিষ্টি আমেজ বেশ লাগছে৷ পালি ভাবে, তানকে থ্যাঙ্কস জানাতেই হয়৷ তানের কানের কাছে মুখটা এনে বলে থ্যাঙ..কু!
তান ওর একমাত্র বন্ধু৷ বাকিরা ক্লাসমেট৷ তানকে সব কিছু বলা যায়৷ মনের কথা আবেগের কথা এমনকি বাড়িতে মায়ের সঙ্গে রাগ করে দু-একদিন না খেয়ে কলেজে এসেছে সেটাও বলা যায় এবং তান ওকে মাথার দিব্যি দিলে তানের টাকায় কলেজ ক্যান্টিনে খাওয়াও যায়৷ আসলে যেদিন গ্রাম থেক শহরের কলেজে দুরুদুরু বুকে প্রথম পা দিয়েছিল, দেখেছিল তানকে৷ তানই এগিয়ে এসে বলেছিল, বেঙ্গলি? ফার্স্ট ইয়ার!
কী নেবে ভাই? হোল বডি? নাকি শুধু ফেস, আইপ্যাচ রিমু্যভ? পেডিকিউর ম্যানিকিউর? —মহিলা গ্লাভসে ভরা হাত দুটো একবার গুছিয়ে নেয়৷
পালি এমন সব প্রশ্ন বাপের জন্মে শোনেনি৷ বেশ হকচকিয়ে একটা ল্যাজেহজে অবস্থায় পড়তে যাচ্ছিল, তান দ্রুত পাশ থেকে বলে, না না সোমাদি, ও তো প্রথম৷ শুধু ফেসটা একটু ওই আর গালের পাশের লোমগুলো, অ্যা মা— কী বিচ্ছিরি দেখাচ্ছে৷ গাঁইয়া ভূত৷ দাও নাকের ডগায় ব্ল্যাক হেডসগুলোও তুলে দাও৷
—ভেগান অ্যান্ড অরগ্যানিক ব্র্যান্ডস? সোমাদি ভ্রূ তুলে জিজ্ঞেস করে৷
সেই শুরু৷ মেজে ঘষে অ্যাকুপ্রেশার বডি মেসেজ মেসিনে চামড়ায় হালকা মেসেজ দিয়ে ডলে ডলে ঘন্টা খানেকের কসরত শেষে পালি যখন চোখ খুলল, স্তব্ধ হয়ে নিজেকে নিজেই দেখতে থাকল৷ মনে মনে এটাই কি সে চেয়েছিল! নিজের চেহেরার এমন সিনেমাটিক পরিবর্তন! নিজেকে দেখতে এত মগ্ন হয়ে পড়ল যে, ওর খেয়ালই হল না কখন সোমাদির হাতে তান চারটে পাঁচশ টাকার নোট ধরিয়ে দিল৷ পেমেন্টের ব্যাপার মাথায়ই এলো না৷ বাইরে বেরিয়ে এসে খুশিতে বলেই ফেলল, —কী খাবে বলো? আজ ক্যান্টিনে যা হবে তাই খাওয়াব, বিরিয়ানি তো বিরিয়ানি, নইলে মটন চিলি, আইসক্রিম যেটা তোমার পছন্দ৷
—দেখিস দেখিস! সব উচ্ছ্বাস শেষ করে দিস না৷ তান বলে, —পরে কাজে লাগবে৷
গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে ফোর পর্যন্ত৷ পরে গ্রাম ছেড়ে বড় গঞ্জে হাইস্কুল৷ পড়াশুনো ছাড়া কিছুই ভাবা যেত না৷ স্কুল আর ঘর৷ তাও সাইকেলে বন্ধুদের সঙ্গে৷ পড়াশুনোর সঙ্গে জীবনে আরও কিছু যে আছে শহরের কলেজে না এলে বুঝতেই পারতাম না৷ হয়তো তাতে আংশিক স্বাদ পেতাম, সেন্ট পারসেন্ট উপলব্ধি করলাম তোমার আসার পর৷ —কলেজের পুব পাশে ইউনিয়ন লাগোয়া শিরীষ গাছটার তলে বসে বসে পালি আর তান গল্প করছিল৷
তান বাম ভ্রু তুলে বলে, তাই নাকি! বেশ বেশ অত গুণ গাইতে হবে না৷ ওই দ্যাখ পলাশ বিট্টুরা আজ তোর বার্থডে উইশ করবে৷
—জন্মদিন! পালি অবাক হয়ে তানের দিকে তাকায়৷
—ফেসবুকটা একবার দেখ৷ চারদিকে ঢ্যাঁড়া পিটোচ্ছে! আমরা বন্ধুরা ঠিক করেছি আগেভাগে তোকে উইশ করব না৷ একেবারে সামনা-সামনি সারপ্রাইজ! কেক কাটব গোল্ড ফিনিশ ক্যান্ডেল দিয়ে৷ সঙ্গে স্ট্রিং লাইট৷ ওহ্! জমে যাবে৷
কই বাড়িতে পায়েস টায়েস তো হয়নি৷ মা ভুলেই গেছে৷ অভিমানে পালির বুক গুমরে ওঠে৷ তানের কাছে প্রকাশ করে না৷ মুখে ফিকে হাসি এনে বলে, বাড়িতে যে বলা হয়নি৷ রাত হলে বাবা মা চিন্তা করবে৷
—আচ্ছা বোকা তো তুই, ফোন আছে না! মিষ্টি করে কল করে দিবি, ‘মা আজ তান কিছুতেই ছাড়ল না৷ ওর বাড়িতেই থাকব৷’ দরকার হলে আমি ফোন করে কাকিমাকে জানিয়ে দেব৷
—তুমি থাকছ তো? পালি ভীতু ও লাজুক চোখে তাকিয়ে থাকল তানের দিকে৷ তান পালির চকচকে গালে টোকা দিয়ে বলে, জানিস তোর এখন বিয়ে করার বয়স হয়ে গেছে৷ দু’দিন পর বর তোকে নিয়ে দুষ্টুমি করবে৷ আর এখন দেখ, তুমি থাকছ তো! লজ্জাবতী লতা! তান গলা ভেঙচিয়ে বলে৷
—ওই জন্য আজ এমন জমকালো ড্রেস!
—এটা রুশড মিডি করসেট৷ আমার আরও আছে, তোকে একটা দেব৷ তান পালির হাত ধরে বলে, ওঠ তো এখন৷ যো হোগা দেখা যায়েগা৷ তার আগে একবার সোমাদির কাছে যেতে হবে৷
—কিন্ত্ত, পালি কাঁচুমাচু হয়ে বলে, আমি তো অত টাকা আনিনি গো৷
—তোকে টাকা এখন চেয়েছে কে? আয় তো৷
—আজ কী দেব, তান? ম্যানিকিউর, পেডিকিউর, হোল বডি নাকি ফেস উইথ নেক আর্ম রুট? সোমাদি হাসি মুখে উত্তরের অপেক্ষায় না থেকে আলট্রা একটা প্যাক বের করে বলে, এইটা নতুন এসেছে তানিয়াদি৷ ইম্পোর্টেড৷ দেব নাকি? সিমপ্লি একটু প্রাইসড৷ তবে একবার ইউজ করলেই পার্টি জমে ক্ষীর! ঝরঝর করে সোমাদি ওর প্রোডাক্টের আগাপাশ বলে গেল৷
পালি নির্বিকার৷ তান জিজ্ঞেস করে, কী রে চলবে নাকি? একবার নিয়ে তো দেখ, বার্থডে বেবি— বলেই তান মুচকি হাসে৷ পার্টিসাটি বলে কথা৷
নতুন নতুন প্রোডাক্ট নিতে পালির মন চায় না তা নয়, কিন্ত্ত পার্সে সে রকম নেই৷ মায়ের ওপরে রাগ হল, কালকেই গোল্ডেন ব্যাঙ্ক থেকে লাখ দুয়েক টাকা লোন করেছে কী একটা করবে বলে, ওকেও জানায়নি৷ সেখান থেকে হাজার দশেক দিলে কি খুব কম পড়ত? মুখে কিছু না বলে তানের দিকে তাকিয়ে নরমভাবে চোখের ইশারা করে বুঝিয়ে দেয়, তুমি যদি কন্ট্রিবিউট কর তাহলে আমার নিতে কোনও অসুবিধা নেই৷
আজ অবশ্য পার্লারের ভেতর তেমন ভিড় নেই৷ শুধু তান আর পালি৷ কিন্ত্ত বাইরে অনেক জুতো ছিল, পুরুষদের৷ পালি বেশি মাথা ঘামাল না৷ চেয়ারে হেলান দিয়ে রইল৷ ধীরে ধীরে সোমাদির পালকের মত আঙুলগুলো ওর মাথা কানের গোড়া, ঘাড়— ঘাড় থেকে শিরদাঁড়ার নীচে চলে যাচ্ছিল, আর ওর চোখ দুটো ভারী হয়ে এলো৷ এক সময় পরম সুখে চোখ বঁুজল৷
আজ আবার ওরা কলেজের সেই শিরীষতলায়৷ তান চুপ মেরে আছে৷ কলেজ আসতে চাইছিল না, শুধু পালির তাগাদাতেই কলেজে এসেছে৷ তাও বাড়িতে কিছুই খাওয়া-দাওয়া করেনি, এমনকি সেনান-টেনানও করেনি৷ কাল রাতে পালির বাড়িও যাওয়া হয়নি৷ পার্লারে সোমাদি অনেকটা সময় খেয়ে নিয়েছিল৷ প্যাক লাগিয়ে মালাইকার ছবি ঠেলে কোথায় যে গিয়েছিল, এলো সেই আধ ঘণ্টা পর৷ ততক্ষণে তানই ওর চোখে মুখে কোল্ড ওয়াটার স্প্রে করছিল৷ কেননা প্যাক লাগিয়ে খুব বেশি ক্ষণ রাখা যায় না, তাতে হিতে বিপরীত হয়৷ চামড়ার ক্ষতি করে৷ তান ওকে শিখিয়েছিল৷ ফিরে এসে সোমাদি অবশ্য খোস মেজাজে এক্সট্রা কাজ করে দিয়েছে৷ তার দাম নেয়নি৷ কিন্ত্ত ততক্ষণে পালির গাঁয়ে ফেরার বাস চলে গেছে৷ তান কথা রেখেছে৷ পালির মাকে বেশ গুছিয়ে গল্প করে ওদের বাড়িতে পালির থাকার কথা জানিয়ে দিয়েছে৷ তবে পার্টিতে যাওয়ার কথা বলেনি৷
পালি থ’ হয়ে গেছিল রাতের পার্টিতে৷ তানেরই একটা পার্টি-কামিজ পরেছিল৷ হতবাক হয়ে হোটেলের ব্যাঙ্কোয়েট হলের আয়নায় বার বার ঘুরে ফিরে নিজেকে দেখছিল৷ দেখেছিল শহরের জৌলুস! নাই বা হোক সবাই ওর ক্লাসমেট৷ তানের পরিচিত তো বটে৷ তবু একদম অপরিচিত, কেমন কেমন লাগে না? তান ওকে সবার সামনে নিয়ে যেতে যেতে বলেছিল, সারা জীবন গাঁইয়া হয়েই থাকবি? তুই আমার বন্ধু৷ স্মার্ট হতে হবে না! এই দ্যাখ এ হল রবিন, এর বাবা এই শহরে দুটো পেট্রল পাম্পের মালিক৷ এই হল সূর্য৷ মর্ডান ডাইগোনিস্ট সেন্টারের আসলি হকদার৷ আর এই দ্যাখ বুনো, বাইপাসের ধারে যে পরপর রাম-শ্যাম দু’ভাইয়ের মত দুটো বার আছে দুটোই ওদের৷ আজ দুটোই বুকড নইলে ওখানেই এই পার্টিটা হতো৷ তবে ও পুষিয়ে দিয়েছে৷ এই হোটেলের সমস্ত ফিনানশিয়াল ব্যাপারটা ও নিজের দায়িত্বে নিয়েছে৷ এক্কেবারে নো টেনশন!
কোঁকড়া চুলের টিলটিলে ছেলেটা চাপা হাসি এনে বলে, অলওয়েজ ওয়েলকাম অ্যাট মাই থ্রি স্টার! হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করেছিল সূর্য৷ পালি মোমের মত গলে গিয়েছিল৷ সেই ঠান্ডা ঘরে দরদর করে ঘামছিল৷ পালির মনে হয়েছিল, শহরের ছেলেমেয়েরা অনেক বেশি ফ্র্যাঙ্ক, ফ্রি এবং অনেক বেশি উদার৷ আজকের দিনটা সে কোনোদিন ভুলবে না৷ ভাগ্যিস তানের মত বন্ধু ওর কপালে জুটে ছিল৷
তান এখনও চুপ করেই আছে৷ ভীষণ ভীষণ রকমের মনমরা৷ পালি গত রাতের ভিডিও ক্লিপিংগুলো দেখাচ্ছিল৷ বন্ধুরাও অনেকেই এসে এই আড্ডায় অংশ নিতে চাইল, কিন্ত্ত তানের নির্বিকার ভাবের জন্য আড্ডাটা বেশিক্ষণ জমল না৷ এক সময় ঝেড়েফুরে উঠে বসল তান, —চল আজ আর কিচ্ছু ভাল্লাগছে না৷ মাথাটা যাচ্ছেতাই রকমের জ্যাম৷
পালি বিড়বিড় করে— তবে আনন্দটা জীবনে ভুলব না, তান৷
—বিয়ারটা বেশিই নেওয়া হয়ে গেছিল৷ একটা স্লিপিং পিল না নিলে হবে না দেখছি৷
সেদিন পালির বাড়িতে গোল্ডেন ব্যাঙ্কের লোক এসেছে৷ বেশ হম্বিতম্বি করছে, ই এম আইটা গত দু মাস ধরে ডিউ— কেন? ইন্টারেস্ট চোঁ চোঁ করে বেড়ে যাচ্ছে৷ তখন মেটাতে গিয়ে কান্নাকাটি করলে ব্যাঙ্ক শুনবে না৷
পালির মা শরবতের গ্লাসটা ওদের হাতে তুলে দিয়ে চুপ করে থাকে৷ পরে মিনমিন করে বলে, আলুগুলা স্টোরেই থেকে গেল৷ বাজার পেল না গো৷ মিটিয়ে দেব৷ ঠিক মিটিয়ে দেব৷
পালি ওর মায়ের মাথা নুইয়ে পড়া দেখেই প্রচণ্ড বিরক্ত হয়ে যাচ্ছিল৷ কেবলই মনে হচ্ছিল, কেন যে লোন নিয়ে আলু চাষ করতে গিয়েছিল বাবা কে জানে৷ এমন বোকামি কেউ করে৷ জমি ঠায় পড়ে থাকলে সরকার এমনি এমনিই টাকা দেবে৷ কৃষকবন্ধুর টাকা৷ কিছু বলতে যাচ্ছিল,তার আগেই ফোন৷ তানের— সোমাদি একবার দেখা করতে চাইছে৷
পালির মুখে এসেই গেছিল, কী করে যাব বল, ঘরে আলু সরষে ডিঙলে নিয়ে কুকুরকেত্তন চলছে৷ কিন্ত্ত তানকে বলল, শিগগিরই সোমাদির কাছে যাব৷ মুখটা কেমন ম্যাড়মেড়ে হয়ে গেছে৷ ফোন কাটতে যাচ্ছিল, ও প্রান্ত থেকে বলে উঠল, এবার কিছু মাল বেশি করে আনিস৷
তখন ঠিক দুপুর দুটো৷ পার্লারের দরজা খুলে দেখে কাস্টমার একেবারে নেই৷ রুমে ঢুকতেই আকর্ণ হাসি ছড়িয়ে দিয়ে সোমাদি ডাকে— এসো এসো, কিন্ত্ত তারপরেই ঘিনঘিনে মুখে বলে, অ্যা মাগো মুখটাকে পুড়িয়ে নিয়ে এসেছো৷ একেবারে ট্যান পড়ে গেছে৷ পরক্ষণেই গদগদ হয়ে বলে, পুরনো জেল্লা ফিরিয়ে আনতে সময় লাগবে৷ ভাগ্যিস তানিয়া এই সময়টায় আমাকে বুক করেছিল৷ তাই কাউকে ঢোকায়নি৷
এত দিনে বুঝে গেছে পালি৷ এটা সোমাদির বিজনেস ট্যাকটিক্স৷ কেউ এলে ছাড়ত নাকি! কিন্ত্ত পালি দেখেছে দরজার বাইরে বসার ধারির নিচে এক জোড়া পুরুষের জুতো৷ এই কথাটায় বলতে যাচ্ছিল পালি, কিন্ত্ত তার আগেই সোমাদির সঙ্গে তানের কী একটা ইশারা হল৷ পালি যেখানে বসে আছে ঠিক তার পিছন দেয়ালে যেখানে মালাইকার লাস্যমুখের ছবি সাঁটানো আছে, তাকে ঠেলে আরেকটা ঘরে ঢুকে গেল তান৷ ঢোকার আগে অবশ্য পালির চোখে অদ্ভুত ফিচেল হাসি ছুঁড়ে দিয়ে গেল৷
পালির পুরুষ্টু উন্মুক্ত গ্রীবাদেশে মৃদু গোলাপ জল স্প্রে করে সোমাদি বলে, বলো পালি, কী দিয়ে আবার সেই আগের মত চেহারায় আগুন ঝরাবে? ডোন্ট মাইন্ড, দুটো শিফটেই তুমি আবার অ্যাট্রাক্টিভ হয়ে যাবে৷ বলেই সোমাদি শো-কেস থেকে তার সৌন্দর্য বাড়ানোর জাদুমালা বের করে মেকআপ টেবিলের ওপর রাখে৷ দীর্ঘ কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো সরিয়ে দেয়৷ উন্মুক্ত গ্রীবাদেশ থেকে বাহুমূলের দিকে সোমাদির আঙুলগুলো চলে যাচ্ছে৷ জেগে উঠছে পালির শরীরে আলাদা শিহরণ৷ অথচ চোখের পাতা নেমে যাচ্ছে ক্রমশ৷ এবার সে তন্দ্রালু হয়ে পড়বে৷ ঠিক তখনই সোমাদি আলতো স্বরে বলে— পালি, আর তো ডিউ ফেলে রাখতে পারছি না৷ এবার পেইড করে দিতে হবে৷
পালি চমকে ওঠে৷ রিল্যাক্স মুড ফেলে দিয়ে কাঠ হয়ে হাজার জিজ্ঞাসা নিয়ে সোমাদির মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে— পুরনো ডিউ! আমার তো কোনো ডিউ নেই সোমাদি৷
—এই দ্যাখো! বোকা মেয়ের কাণ্ড দেখো, সব ভুলে মেরে দিয়েছে৷ গত এক বছর ধরে আমার কাছে ফেশিয়াল, ম্যানিকিউর, পেডিকিওর, হোল বডি মাসাজ, হেয়ার স্টিম করিয়েছ৷ মনে নেই? সব তো তুমি ইম্পোর্টেড প্রোডাক্ট দিয়ে কাজ করিয়েছ৷ এখন ভুলে গেলে! সোমাদির শেষের দিকে কথাগুলো কেমন কর্কশ শোনাল৷ গত এক বছর দেখে আসা সেই চেনা মিষ্টিমুখী সোমাদি তো নয়!
এক মুহুর্তে মনে হয় দড়ি ছিঁড়ে দরজা ভেঙে দেয় ছুট৷ কিন্ত্ত ততক্ষণে কষে বেঁধে ফেলেছে৷ হাঁড়িকাঠে মাথা গলানো ছাড়া উপায় নেই৷ সারা মুখে কোকপ্যাক লেপ্টে মুন্ডুটাকে চেয়ারে সিঁটিয়ে দিয়ে দুই হাতে চেপে ধরে আছে সোমাদি৷ ধীরে ধীরে ঠান্ডা জল হেলানো ঘাড়ে মাখিয়ে দিচ্ছে৷ অসহ্য! খুব অসহ্য লাগছে— তান! তানিয়া, কোথায় তুই! গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছে হয় পালির৷
না, তান পালির কোনো কথা শোনেনি৷ বরঞ্চ উলটে বলেছে, আগে ভাবা উচিত ছিল৷ তুই তো কচি খুকি নোস৷ টাকাটা যত তাড়াতাড়ি পারিস ফেরত দিস৷ মহিলাটা কিন্ত্ত সাঙ্ঘাতিক!
কী সাঙ্ঘাতিক সেদিনই টের পেয়েছে পালি৷ সোমাদির পায়ে ধরেছে টাকাটা মকুব করে দেওয়ার জন্য৷ —এত টাকা কোথায় পাব দিদি!
—সে আমি কী করে জানব৷ তোমার বিল দ্যাখো৷ বিশাল আয়নার সামনে মেকআপ টেবিলে সারা বছরের বিলের গোছাটা আছড়ে পড়ল, যেন হূৎপিণ্ডটাই শরীর থেকে খসে পড়ল৷ —বড় হয়েছ, যেমন করে পারো জোগাড় করো৷
—কিছুতেই পারব না দিদি৷ মায়ের কাছে চাইতে পারব না৷ আর বাবাকে বলতে পারব না৷ মরে গেলেও না৷
—বালাই ষাট! মরতে তোমায় কে বলছে! চিকনি মেয়ে, তুমি বড় হয়েছ গায়ে গতরে খেটে দাও৷ মার্কেটে কলেজ-গার্লের এখন মাচ ডিম্যান্ড৷ আহা কী ফিগার!
—মানে? পালি আঁতকে ওঠে৷
—তান আছে না, সব বুঝিয়ে দেবে৷
পালি হতবাক! তার জীবনের গোপন দরজাটা কে যেন এইমাত্র ঠেলে খুলে দিল৷