সুব্রত সরকার
‘ওরে কালোর মা, গোয়াল ফাঁকা কেন রে! বাড়ির দরজা কে খুলে দিল্য রে কালোর মা!’ বুক চাপড়ে চাপড়ে হরি মাড্ডি উঠোনে লাফাচ্ছে। পুবের আকাশ ফর্সা হতে এখনো দেরী আছে। রাত ফুরোনোর আগেই হরির চোখে পড়ে যায়, গোয়ালে ধান-চাল নেই!… বাড়ির সদর দরজা হাট করে খোলা। সাধের বলদ দুটা নাই!…
রাতে এক দু’বার হরি ওঠে প্রতিদিনই। বাইরে গিয়ে জল ছেড়ে আসে। ঘরের কাছে নিজেদেরই বাঁশবাগান, সেখানে একটা ছোট্ট বাথরুম আছে। কিন্তু হরি সেটা ব্যবহার করে না। জল ছাড়ে বাঁশবাগানের এক কোণেই। স্নান করে গাঁয়ের নন্দীপুকুরে। বাড়ির বাথরুমটা শুধু ব্যবহার করে হরির বউ লতা।
লতা হরির চিৎকারে শীতের বিছানা ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে এসে দেখে সত্যিই তো গোয়াল একদম ফাঁকা। বলদ দুটা নাই! ওরা ভালোবেসে ওদের নাম রেখেছিল ধান-চাল। বলদদুটো বেশ সাড়াও দিত এই নাম ধরে ডাকলে।
হরি মাঠের সব কাজ এই ধান চালকে দিয়েই করাত। নিজের বাঁশগাড়ির মাথায় ধান চালকে বেঁধে দিলেই হোল, ওরা কত কাজ নীরবে করে যেত। জমিতে লাঙল দেওয়া, সব্জি চাষের মাটি নিংড়ানো, ধান বোঝাই করে মাঠ থেকে আনা, ধান ঝেড়ে আড়তে গিয়ে ধান বেচে আসার সময় বলদদুটোই গাড়িটাকে নিয়ে ক্যাঁচরম্যাঁচর করে মেঠো পথ ভেঙে উঠোনে এসে থামত। হরির বড় আপনজন ছিল বলদদুটো। লতা কত যত্নআত্তি করত। ওদের ছেলে কালো ধান চালকে খেতে দিত। মাঠে বেঁধে দিয়ে আসত ঘাস খাবে বলে। হরি পুকুরে নিয়ে গিয়ে স্নান করিয়ে আনত। বলদদুটোকে দেখলেই সকলের নজর লাগত। যেমন সুন্দর চেহারা, তেমন ওদের কাজকাম। ধান চালকে নিয়ে হরির সংসারে বড় আনন্দ ছিল!…বড় সুখ ছিল!
সেই ধান চাল কোথায় চলে গেল কাল রাত বিরতে! চলে কি গেছে! কেউ লিয়ে পাল্যে গ্যাছে! চুরি হয়ে গেছে হরির বলদদুটো। বাড়ির ছোট পাঁচিল টপকে, সদর দরজা খুলে গোয়াল থেকে ধান চালকে নিয়ে পালিয়ে গেল, একটুও বুঝতে পারে নি হরি, লতা!… এ কি মরণ ঘুম আমাদের কাল হয়েছিল বল রে লতা!… হরি বুক চাপড়ে কাঁদছে। লতা উঠোন বাড়ি করে বেরাচ্ছে কেমন দিশাহারা হয়ে।
আলো ফুটতেই গাঁয়ের লোকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল, হরির বলদদুটো চুরি হয়ে গেছে! হরি সাধের ধান চালের জন্য কেঁদে পাগল হয়ে যাচ্ছে, ‘আমার কি হব্যে গো!… আমার হাত পা দুটাই তো চোর লিয়ে গেল্য। আমি কি করে সংসার চালাব বল্য তুমরা!… ‘অনেকে অনেক সান্ত্বনা দেয়, বোঝায়, কিন্তু হরির কান্না থামে না। তার মধ্যে আবার মনের দুঃখে হরি হাড়িয়া গিলে নিয়েছে মেলা। চোখদুটো লাল হয়ে ফুলে আছে। উসকোখুশকো চুল। হরি টলছে। এতোল বেতোল বকছে। মাটিতে গড়িয়ে পড়ছে। কাঁদছে। লতা সামাল দিতে পারছে না।
এই ভিড়ের মধ্যে অনেকেই আবার ফিসফিস করছে, গাঁয়ে বেচাকেনার দালাল, পাইকারগুলা ঘুরে বেড়ায়! ই উয়াদেরই কাজ বটে। ওরা সব খপর রাখে। কার বাড়ি কেমুন, গোয়াল কুথায়, সদর কেমুন, তাপর রাতবিরতে এসে চুরি করে হাটে লিয়ে বেচে দিবে। কাল তো ননীগঞ্জের হাট। পরশু মাথাভাঙার হাট। হাটে তো মেলা দাম পাবে। অমন সোন্দর বলদ দুটোর দাম কমসে কম সত্তর আশি হাজার টাকা তে পাবেই পাবে! কেউ আবার বলে, ও দুটা কি আর আছে রে। জবাই হয়ে কোতায় চলে গেছে দেখ!… ধুস্ বলদ আবার খায় নাকি!…
সাঁওতাল পাড়ার বড় বুড়া গণশার বাপ এলো হরির কাছে। ওঁকে সোব্বাই মানে। ওঁর কথা শোনে গোটা সাঁওতাল পাড়া। হরির গায়ে মাথায় হাত বুলিয়ে বুড়া বললেন, ‘থাম, থাম রে হরি। এখুন তোর অনেক কাজ। আগে চল মেম্বারের কাছে। পোধানকে জানাতে হবে। তাপর চল তুই থানায়। বড় বাবুকেও এটা জানান দেওয়া করা উচিৎ।’
বুড়ার কথা মেনে হরি মেম্বারের ঘর গেল। মেম্বার পাঁচু বাউরি। পাঁচু সবে তখন ঘুম থেকে উঠেছে। হরি কেঁদে কেঁদে জানাল সব কথা। মেম্বার বলল, ‘তু পোধানকে ফোন কর কেনে। লম্বর দিছি ফোন কর।’
‘পোধান কি ঘুম থেকে উটঠে নাকি এখন?’ মেম্বারের এক সাগরেদ পাশ থেকে বলল।’ ঘুম থেককে উঠার পর পোধান একটো ঘন্টা বাদরুমে থাক্যে। তাপর চা খায়। ইরপর পোধান লুকের ফোন ধরে। হরি তু এখন ঘর যা। দশটার পর ফোন করিস পোধানরে।’
হরি মনমরা হয়ে ফিরে আসে ঘরে। কালোর মা উঠোনে বসে ছিল কেমন আনমনা হয়ে। হরিকে দেখে ফুঁপিয়ে উঠলো। হরি লতাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘অ বউ তুই কাঁদিস কেনে!’ লতা আরও কাঁদতে থাকে। দুই দুঃখী এবার কাঁদছে। উঠোনে তখন এসে দাঁড়ায় সাঁওতাল পাড়ার প্রথম শিক্ষিত ছেলে শান্তি মুর্মু। ও কলেজে প্রথম বছর। হরিকে বলে, ‘খুড়া কেঁদো না। থানায় চলো। চিঠি জমা করে আসি।’
গোলামবাজার থানায় ঢুকে দেখে সামনে এক বড় টেবিলে বসে পুলিশেরই লোক বটে। সে ওদের দেখে বলল, ‘কী জন্য এসেছো বলো?’
শান্তি বলে, ‘এ আমার খুড়া আছে। কাল রাতে খুড়ার বাড়ি থেক্যে দুটা বলদ চুরি হয়ে গেছে।’
অ!… গরু চুরি!…
গরু নয় বলদ আছে।
ঐ হল!… চিঠি এনেছো?
শান্তি এগিয়ে দেয় চিঠিটা। পুলিশ বাবুটি ইবার চিঠিটা পড়ে নিয়ে বলে, ‘দাঁড়াও বড় বাবুকে একবার দেখিয়ে আনি।’
শান্তি, হরি দাঁড়িয়ে থাকে। হরি যেন টলছে। মাথা ঘুরে পরে যাবে মনে হচ্ছে। সকাল থেকে না খাওয়া। পেটে এতটুকু দানাপানি পরে নি। খালিপেটে হাঁড়িয়া গিলেছে বারচারেক। শান্তি হরিকে আগলে রাখে। পুলিশবাবুটি এসে বলল, ‘শোনো, চিঠি লেখাটা ঠিক হয় নি। লেখো তোমাদের গরু দুটো হারিয়ে গেছে কালকে।’
‘হারিয়ে গেছে লিখব কেনে!’ হরি ফোঁস করে ওঠে,‘ চুরি হয়ে গেছে বুলছি তো!…’
‘চুরি হয়েছে লিখলে চিঠি জমা করা যাবে না!…’
‘তার মানে? ‘শান্তি এবার ফোঁস করে, ‘এটা কেমন কথা? বলছি তো বলদ দুটা চুরি হয়েছে, আমরা মিছা কথা কেন লিখব হারিয়ে গেছে!’
পুলিশবাবুটি এবার চেয়ার ছেড়ে সরে যায়। এগিয়ে এসে অন্য একজন বলে, ‘যা বলছে লিখে দাও না!…’
‘না। লিখব না মিছা কতা।’ হরি আরও একবার ফোঁস করে বলে, ‘শান্তি ঘর চল। এ থানা শালা ফালতু আছে।’
হরি ও শান্তি ফিরে আসে সন্ধের মুখে সাঁওতাল পাড়ায়। প্রতিদিনের মতই সাঁওতাল পাড়াটা ঝিমিয়ে আছে। মিটমিটে আলো কয়েকটা ঘরে জ্বলছে। কেমন শান্ত, নিশ্চুপ এক শ্রীহীন সাঁওতালপল্লী।
শান্তি বলে, ‘খুড়া ঘর চলে যাও। আমি পার্টি অফিসে যাব একবার। সব বুলব ওদের।’
হরি নিজের ঘরে না ফিরে পচার ঘরে গিয়ে আবার হাঁড়িয়া গেলে কয়েক বাটি। পচা হরির পেয়ারের দোস্ত। এই দুঃখের দিনে দু’বন্ধুতে বসে নেশা করে খুব। জম্পেশ নেশায় বুঁদ হয়ে হরি বলতে থাকে, ‘শালা পোধানের বাচ্চা, দশটার সময় ফোন ধরবে… ঢ্যামনা মরদ। ঘুম থেক্যে উটঠে এক ঘন্টা হাগু করে।’ বলে আবার এক বাটি হারিয়ে ঢগঢগ করে গিলে নিয়ে ফের বলতে শুরু করে, ‘শাল্লা, পুলিশের পোঁদে গুলি মারব! বুলছি চুরি হয়েছে। তবু শাল্লো বলে, লিখতে হবে হারিয়ে গেছে!… কেন রে বানচোত মিছা কুথা লিখব?’ পচা ওকে থামাতে পারে না। হরি আরও কিছু যেন বলবে। পচা হরির মুখচেপে ধরে বলে, ‘হরি ইসব বুলি থামা থামা।’
‘বেশ করব বুলব।’ হরি মাতব্বরি ঢঙে বলে, ‘আমার শালা দু’দুটা বলদ চুরি হয়ে গেল্য, আর হারামির বাচ্চাগুলা বলে কিনা হারিয়ে গ্যাছে লিখও।’ পচা-হরির এই নেশাকান্ড জমে জমজমাট। চলতেই থাকে হাঁড়িয়া ভক্ষণ!…
রাত অনেক এখন। হরি ঘরে ফেরেনি। লতা চিন্তায় ছটফট করছে। মানুষটা কোথায় গেল!… আজ বড় কষ্ট পেয়েছে ধান চালকে হারিয়ে। কত লোকের কাছে গেল। কত কিছু করল। কিন্তু তেমন আশা কেউ দেখাল না। হরি কেঁদে কেঁদেই পাগল!
লতা অনেক রাতে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে এলো পথে। হরিকে খুঁজতে খু্ঁজতে পেয়ে গেল নন্দী পুকুরপাড়ের ঘাটে। অন্ধকারে হরি বসে আছে। লতা এসে পাশে দাঁড়িয়েছে বুঝতে পেরে হরি করুণ সুরে বলল, ‘লতারে আমাদের কি হব্যে!… আমি কি করে সংসার চালাব বল কেনে!’
লতা পাশে বসে। হরিকে আগলে ধরে বলে, ‘ঘর চলো। আর কেঁন্দো না। আমাদের ধান চাল চুরি হয়ে গেছে। কিন্তু আমরা তো আছি। আমাদের তো কিছু হয় নাই। আমাদের বেটার তো কিছু হয় নাই। আমাদের বাড়ি আছে। উঠোন আছে। জমিটুকুন আছে। ওগুলো তো চুরি হয় নাই। আমরা আবার কাজকাম করব। পয়সা জমাব। বলদ কিনব। চলো, তুমি ঘর চলো।’
হরি কিছু বলে না। বেঁকেচুরে মাটিতেই লুটিয়ে পড়ে থাকে। লতা ওকে অনেক যত্নে মাটি থেকে তুলে বসাতে বসাতে বিড় বিড় করে বলে,
‘কাল মাঠের ধান তুলতে হবে উঠো। ধান চাল না থাকুক। আমাদের বাঁশগাড়িটা তো আছে। কাল তুমি হবে ধান, আমি হব চাল। আর আমাদের বেটা কালো হবে মুনিশ। মাঠের সব ধান আমরা উঠোনে এনে ফেলবই। উঠো। উঠ্ঠোবুলছি!’