দুপুরের খর রোদেও যেন মেঘভাঙা বৃষ্টি নামল সুমনার চোখে। বাড়িটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে আছে সুমনা। কাল বিতান ফোন করেছিল। বাড়ির দরকারি ডকুমেন্টগুলো নিয়ে যাবার জন্য। প্রোমোটারের সঙ্গে সব ডিল ফাইনাল হয়ে গেছে। কয়েকদিনের মধ্যেই বাড়িটার আর কোনও অস্তিত্ব থাকবে না। সেই সঙ্গে শেষ হয়ে যাবে সুমনার জীবনের একটা অধ্যায়।
এ বাড়িতে যখন প্রথম এসেছিল, অবাক হয়ে গিয়েছিল। সাবেক আমলের বাড়ি। ওপর নিচ মিলিয়ে দশখানা ঘর। লাগোয়া বারান্দা। ঢুকেই মস্ত উঠোন। দুর্গা দালান। এ বাড়ির মালিক ব্যবসায় প্রচুর মুনাফা করে এই বাড়ি বানিয়ে ছিলেন। এখন অবশ্য সে জৌলুস নেই। আভিজাত্য আছে। সুমনা কোনোদিনও এবাড়ির দোল দুর্গোৎসব দেখেনি। তবে আঁচ করতে পারে। এখন এই বাড়িটা আর কিছু সম্পত্তিই শুধু আছে। এদের কোনও আত্মীয় পরিজনকেও সুমনা দেখেনি। চারজন কাজের মানুষই নিত্যদিন যাতায়াত করে। সব ঘরদোর খোলাও হয় না। তালা বন্ধ পড়ে থাকে। এই বাড়ির মধ্যেই আটকা পড়ে আছে সুমনার জীবনের বহু স্মৃতিচিহ্ন এবং ক্ষতচিহ্ন।
সদর দরজার তালা খুলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। একদিন এই দরজা দিয়ে বধূবেশে ঢুকে ছিল সুমনা। গাঁটছড়া বাঁধতে হয়েছিল অমনোমত পাত্রের সঙ্গে। অনাড়ম্বর অনুষ্ঠান। বরণ করে ঘরে তোলার মতো কেউ ছিল না।
ফোনটা বাজছে। বিতান। ‘হ্যাঁ, বলো।’ ‘তুমি কোথায়?’ ‘আমি আমাদের বাড়িতে এসেছি। কাল বললে যে।’ ‘ঠিক আছে। আমি তোমাকে মনে করিয়ে দিলাম। তোমার কি মন খারাপ লাগছে?’ ‘তা তো একটু লাগবেই। এখানে যে আমার ভালো মন্দ বহু স্মৃতি তালা বন্ধ হয়ে পড়ে আছে।’ ‘হ্যাঁ, তা ঠিক। তবে শোনো, বাড়ির সব দেখাশুনা তুমিই করবে। আমি অফিশিয়াল দিকটা সামলে নেব।’
ফোনটা রেখে সুমনা বাড়ির ভেতর দিকে পা বাড়ায়। পায়ে পায়ে জড়িয়ে ধরতে থাকে পুরনো কথা। বাড়ির ইঁট কাঠ পাথরও বোধ হয় আপনজন খোঁজে। নিঃসঙ্গ এই বাড়িটা আজ সুমনাকে পেয়ে বলতে চাইছে অনেক কথা। বাড়িটা যেমন ছিল, তেমনই আছে। পাল্টায়নি কিছু। পাল্টেছে শুধু সময় আর সম্পর্ক। আসবাব সমেত পুরো বাড়িটাই প্রোমোটারকে বেচে দিয়েছে বিতান। ভালোই করেছে। ধুয়ে মুছে যাক সব আবর্জনা।
এটা সুমনার ঘর। ঘরে ঢুকতেই একটা ক্লেদাক্ত অনুভূতিতে শরীরটার ঘিন ঘিন করে উঠলো। যাকে দেবু কাকা বলে ডাকত, মালাবদল হলো তার সঙ্গেই। আলমারিটা খুলতেই গোলাপি বেনারসিটা ঝপ করে কোলে এসে পড়ল। এই সব দুঃখ যাপন ওর একার। অল্প বয়সে অনেক স্বপ্ন দেখে মেয়েরা। ফুল-মালা, চন্দন, সানাই, তার সঙ্গে রাজপুত্রের মত বর। সুমনার জীবনের সে স্বপ্ন অন্ধকারে হারিয়ে গেল। বাবার বন্ধুস্থানীয় দেবু কাকার সঙ্গে কাগুজে বিয়ে হয়ে গেল।
সুমনাদের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো ছিল না। তার সঙ্গে ওর বাবার জুয়া ও মদের নেশায় খাওয়াও জুটত না মাঝে মাঝে। তখন এই দেবু কাকা অর্থ সাহায্য করে বাঁচিয়েছে ওদের সংসার। অঢেল পয়সা, বউ নেই। একটি মাত্র ছেলে। বাড়িতে মন টিকত না। তাই সুমনাদের বাড়িতে প্রায়ই আসতো। সুমনা সুন্দরী আবার কলেজে পড়ে। ওর টানেই যে আসতো সেটা তখন বোঝেনি। সুমনার দিকে কদর্য দৃষ্টিতে তাকাতো। সুমনা মাকে বলেও ছিল সে কথা। মা খুব একটা আমল দেয়নি। সামনে যেতে চাইত না। একদিন চা দিতে গিয়ে এমনভাবে হাত ধরে টেনে ছিল, ভয় পেয়ে গিয়েছিল সুমনা। মা শুনে হেসে বলেছিল ‘তুই ভুল ভাবছিস। উনি তোকে স্নেহ করেন। তাই আদর করতে চেয়েছিলেন।’ সুমনা আশ্চর্য হয়েছিল মায়ের এই নিরুত্তাপ কথায়। বলেছিল ‘আমাকে আর চা দিতে পাঠাবে না।’
এই ঘরেই ফুলশয্যা। দেবু কাকার সঙ্গে। সুমনা ভয়ে সিঁটিয়েছিল। দেবু কাকার চোখে তখন ক্ষুধার্ত নেকড়ের দৃষ্টি। সুমনা ভয় পেয়ে বলেছিল ‘আপনি আমাকে ছেড়ে দিন। শরীরটা আজ ভালো নেই।’ দেবু কাকা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সুমনার উপর। ‘অনেকদিন ধরেই অপেক্ষা করেছি এই দিনটার জন্য। আজ তো কোন কথাই শুনবো না।’ সুমনা আর্তনাদ করে উঠলো। দেবু কাকা তখন পিশাচের মত সুমনার শরীর খাবলাচ্ছে। ভোররাতে নরপিশাচ যখন ক্লান্ত হয়ে ঘুমোচ্ছে। রক্তাক্ত সুমনা তখন নিজেকে সামলানোর চেষ্টা করছে চোখের জলে।
রাগে দুঃখে গলায় দড়ি দিতে ইচ্ছে করতো সুমনার। প্রতি রাতের এই অত্যাচার অসহ্য হয়ে উঠেছিল। বাবার পাপের প্রায়শ্চিত্ত করতে হচ্ছে সুমনাকে। কী উদ্দেশ্যে যে বাবাকে অর্থ সাহায্য করেছিল, তখন সুমনা বোঝেনি। সুমনা যদি পালিয়ে যেতে পারতো! কিন্তু কোথায় যেতো? ওদের অভাব বলে আত্মীয়রাও মুখ ফিরিয়েছে। সুমনা অনেক ভাবল, কিছু কিনারা করতে পারেনি। তার ওপর বাবাকে পুলিশে ধরিয়ে দেবার ভয় দেখাতো। বাবাকে পুলিশ হাতে দড়ি দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই ছবিটা সুমনা মানতে পারেনি। মা বলেছিল ‘তুই খুব সুখে থাকবি, দেখিস। ওদের তো পয়সার অভাব নেই।’
হ্যাঁ, সুমনা সুখেই আছে। পয়সায় যদি সুখে থাকার একমাত্র চাবিকাঠি হয়, তবে সুমনা সুখেই আছে। মুখের কথা খসার আগেই পছন্দের জিনিস পেয়ে যায়। এত বড় বাড়ি। দাস-দাসী, নিজের খুশি মত থাকা। শুধু কথা বলার মানুষ নেই। বাড়ির কাজের লোকের কাছে শুনেছে, এ বাড়ির ছেলে, ছোট বাবু বাইরে থাকে, কলেজে পড়ে। মাঝে মাঝে আসে। সে কেমন মানুষকে জানে!
এটা বিতানের ঘর। বিতানের পড়ার টেবিল- চেয়ার, শোয়ার খাট। যেমন ছিল, তেমনই আছে। ওর খাটেই বসে পড়ে সুমনা। বিতান যে দিন প্রথম এ বাড়িতে এলো, সুমনা খুশি হয়েছিল। ভেবেছিল বোধহয় এবার একাকীত্ব কাটতে চলেছে। বিতান কিন্তু ওকে দেখেও দেখেনি। সুমনার স্বামী এগিয়ে এসে বলেছিল ‘এই দেখো, এই হচ্ছে আমার ছেলে, বিতান। আর এ হচ্ছে সুমনা। আমি তো তোকে ওর কথা বলেছিলাম।’ বিতান সে কথার জবাব না দিয়ে বলেছিল, ‘আমি এখন বেশ কিছুদিন এখানে থাকবো। আমাকে যেন কেউ ডিস্টার্ব না করে।’
সুমনা আবার নতুন করে গানের অভ্যাস শুরু করেছে। বই তো বরাবরই ওর প্রিয় সঙ্গী। গল্প উপন্যাস কবিতা নিয়েই সুমনার সময় কাটে। কাজ তেমন কিছু নেই। কথা বলার মানুষও নেই। মাঝে মাঝে রান্নার রাধাদি, ঝাড়পোঁছ করার সুধাদি, বাজার করার রঘুদা বা বাগানের মালী রতনদার সঙ্গে গল্প জুড়ে দেয়। ওদের বাড়ির কথা জানতে চায়। ওরা আবেগে ভেসে যায়। বাড়ির কথা বলেই চলে। তখন সুমনারও মন কেমন করে। মা ভাই বাবার কথা মনে হয়। কলেজের বন্ধুদের জন্য প্রাণ কাঁদে। তবু বেরোয় না। এমনকি বাপের বাড়িও যায় না। বাবার অন্যায় ভুলতে পারেনা। মা’র জন্য কষ্ট হয়। কিন্তু একটা প্রচ্ছন্ন অভিমানও আছে। মা কি প্রতিবাদ করতে পারত না! ওদের কথায় এ বাড়িরও অনেক কথা উঠে আসে। ছেঁড়া ছেঁড়া অতীতের টুকরো জুড়ে কোলাজ বানিয়ে নেয় সুমনা।
বরের সঙ্গে সুমনার কোন মানসিক সম্পর্ক তৈরি হয়নি। প্রয়োজন মত কথা বলে। আর রাতের কথা ভাবলে শিউরে ওঠে। তিনি প্রথম দিনই বলেছেন তাঁর পুত্র সন্তান চাই। নয়ত এত সম্পত্তি কী হবে! ভোগ করবে কে!
বিতানের সঙ্গে তখনো আলাপ হয়নি। দূর থেকে দেখেছে। সুমনার ভাবনা অন্যরকম ছিল। ভেবেছিল বিতানের সঙ্গে বন্ধুত্ব হলে ওর একাকিত্ব কিছুটা কাটবে। ওর বর তো গল্প করার মত মানুষই নয়। বাইরেই বেশি থাকে। অবশ্য বেশিক্ষণ বাড়িতে থাকলেও বিরক্তি আসে।
সেদিন কালবৈশাখী ঝড়ে পৃথিবী উত্তাল। ঘন মেঘে কালো হয়ে আছে আকাশ। সুমনা হারমোনিয়াম নিয়ে অন্তর থেকে গাইছে ‘আজি ঝড়ের রাতে তোমার অভিসার, পরাণসখা বন্ধু হে আমার।’ রেওয়াজ শেষ করে দরজা খুলতেই সামনে বিতান। একটু অপ্রস্তত। সুমনা এই প্রথম এত কাছ থেকে বিতানকে দেখলো। বয়স বোধহয় সুমনারই আশেপাশে হবে। ফর্সা চওড়া রোমশ বুকে লাল স্যান্ডো গেঞ্জিটা টানটান হয়ে বসে আছে। বারমুডা প্যান্ট থেকে বেরিয়ে আছে একজোড়া রোমশ পা। হঠাৎ সামনে সুমনাকে দেখে থতমত খেয়ে বিতান বলে উঠলো ‘এই দিক দিয়ে যাচ্ছিলাম।’ মুচকি হেসে সুমনা বলে, ‘তুমি গান শুনতে ভালোবাসো?’ ‘ইয়ে, মানে হ্যাঁ।’ বলে, বিতান পা বাড়ায়। সেই সব কথা ভেবে আজও সুমনার ঠোঁটে এক চিলতে হাসি খেলে যায়।
রান্নাঘরে ঢুকতেই খুব রাধাদির কথা মনে পড়ে গেল। মন খারাপের সময় রাধাদি কত সান্ত্বনা দিতো। বড় ভালো ছিল মানুষটা। সেই যেদিন মাথা ঘুরে রান্নাঘরে পড়ে গিয়েছিল, সেদিন রাধাদিই বিতানকে ডেকে এনেছিল। চোখ অন্ধকার হয়ে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। বিতান ওকে তুলে নিয়ে গিয়ে ঘরে শুইয়ে ছিল। জ্ঞান আসার পর জিজ্ঞাসা করেছিল ‘এখন শরীর ঠিক আছে?’ বিতানের শরীরের গন্ধ ও আজও পায়।
ডাক্তার এলো। রিপোর্টে জানা গেল সুমনা অন্তঃসত্ত্বা। বাবার সঙ্গে বিতানের মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয়ে গেল। ওদের দুজনের মধ্যে তুমুল কথা কাটাকাটি। সুমনার কানে আসে। বিতান বলে ‘আপনাকে আমার বাবা ভাবতে লজ্জা হয়। এত নীচ! একটা মেয়ের বয়সী মেয়ের জীবন নষ্ট করে দিলেন! আপনার লজ্জা করে না?’
সুমনা সেদিন ওদের ঝগড়া থামাতে যায়নি। এবার সুমনা নিজের নতুন অধ্যায়ের জন্য নিজেকে মানসিকভাবে তৈরি করতে থাকে। ওকে ভালো থাকতে হবে। এবার ও বাঁচবে। সব উপেক্ষা করে যে আসছে তার জন্য বাঁচবে।
রান্নাঘরের এটা ওটা নেড়েচেড়ে দেখতে লাগলো। এক একটা জিনিসে একেক রকম মায়া জড়িয়ে আছে। এসব কিছুই থাকবে না। পৃথিবীতে তবে কি ওর মায়া করার কোন জিনিসই থাকবে না! চোখটা ভিজে উঠলো।
দোতলায় ওঠার সিঁড়ির রেলিংয়ে হাত দিয়ে ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল সুমনা। অঘটন এখানেই ঘটেছিল। তিন মাসের অন্তঃসত্ত্বা সুমনা পা পিছলে পড়ে সম্ভাবনার বীজটা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলেছিল। সিঁড়িতেই বসে পড়ে। মনে মনে ভাবে দুটো কচি হাত, একটা নরম শরীর, আর ‘মা’ ডাক। কেমন হতো জীবনটা!
এই অঘটন ঘটে যাওয়ার পর স্বামী আহত বাঘের মত হয়ে উঠেছিল। সুমনাকে অশ্লীল ভাষায় গালিগালাজ করত। এমনকি গায়েও হাত তুলেছে। সুমনার তখন ঈশ্বরের কাছে মৃত্যু কামনা করা ছাড়া কোনো উপায় ছিল না। কিন্তু নিজের অসম্পূর্ণ মাতৃত্বের যন্ত্রণা নিয়ে বেঁচে রইলো সুমনা।
অবশ্য এই দুঃসময়ে বিতান একটু একটু করে কাছে এসেছিল। ও হয়তো বুঝেছিল সদ্য অনাগত সন্তানহারা মায়ের যন্ত্রণা। বিতান ওর বাবার একেবারে বিপরীত চরিত্র। শৈশবে মায়ের ভালোবাসা পায়নি। তাই বোধহয় একটু রুক্ষ মেজাজ। অবশ্য সেটা বাবার কারণেও হতে পারে। ও হয়তো ওর মায়ের মত। সুমনার যখন কিছু ভালো লাগতো না। একা চুপ করে বসে থাকতো। ঘর থেকে বেরুতো না। বিতান একদিন বলেছিল ‘চুপ করে বসে না থেকে গানটা শুরু কর। যা হবার ছিল, হয়েছে। আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে হবে তো।’ এরপর ছোট ছোট ঘটনায় একটু একটু করে ওদের দূরত্ব কমতে থাকে। সুমনা ওকে বলেছিল কীভাবে ওর বাবার আর দেবু কাকার ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে। এটা শোনার পর বিতান বোধহয় ওকে কিছুটা বুঝতে পেরেছে। ওদের বন্ধুত্ব গাঢ় হতে থাকে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক বাঁক বদলায়। অনুভব করে কিন্তু মুখে কেউ কিছু বলে না।
দেবুর চোখে সব পড়ে। দেবু একদিন সুমনাকে বলে ‘তোমরা শুরু করেছো কি? লোক লজ্জার ভয় নেই? বাড়িতে এতগুলো কাজের লোক। কানাঘুষে চলছে।’ সুমনা বলে, ‘লোক লজ্জার ভয়? আপনার আছে? তাহলে আপনি এ কাজ করতে পারতেন?’ বেশ খানিকটা কথা কাটাকাটি হবার পর দেবু চুপ করে যায়।
এই সিঁড়ির প্রতিটি ধাপ ওর কান্নার কথা জানে। আলতো করে হাত ছোঁয়ায় সিঁড়ির ধাপে। এদের যখন ভাঙা হবে সে কষ্ট সুমনার সহ্য হবে তো! উঠে আসে দোতলার ব্যালকনিতে। এই ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে সুমনা প্রথম খবর পেয়েছিল বিতানের চাকরির পোস্টিং হবে জয়পুরে। বিষাদের মেঘে অন্ধকার নেমে এসেছিল মুখে। আবার এই ব্যালকনি দিয়েই ওর স্বামীকে শেষবারের মতো বের করে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। হাসপাতালে যমে মানুষে টানাটানির পর ফেরানো যায়নি। সুমনার মনে সে ঘটনা খুব রেখাপাত করেছে তা নয়। তবে এই ধাক্কাটা বড় অনিশ্চিত করে দিয়েছিল ওর জীবন। কী করবে এরপর!
এই ঘটনার কিছুদিন পর সুমনা বিতানকে বলেছিল ‘তুমি যেখানে চাকরি নিয়ে যাবে, আমিও তোমার সঙ্গে যাবো। আর কোনও পিছুটান রইল না।’ বিতান অবাক হয়ে বলেছিল ‘তা কী করে হয়! নতুন জায়গা। আমাকে গিয়ে দেখতে হবে ওখানে কেমন পরিবেশ। তোমাকে কোথায় নিয়ে যাব?’ এবার আবদারের সুরে বলে, ‘তা হোক, তবু আমি যাব।’ ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বিতান বলে, ‘আচ্ছা সে পরে ভাবা যাবে। এখনো অনেক সময় আছে।’ এগিয়ে চলা বিতানের সুঠাম দেহভঙ্গির দিকে তাকিয়ে সুমনার কপালে ভাঁজ পড়ে। তবে কি…!
ব্যালকনির গা ঘেঁষে ওর গানঘর। হারমোনিয়ামটা নিয়ে গেছে। তবে আজও ঘরের বাতাসে সেই সব সুর ভেসে বেড়াচ্ছে। এই ঘরটা শুধুই স্মৃতি হয়ে থাকবে। এই ঘরেই প্রথম হাতে হাত রেখেছিল বিতান।
ঘুরতে ঘুরতে বসার ঘরে এলো সুমনা। চেয়ারে বসলো। জয়পুর যাবার ঠিক আগে, যে চেয়ার দুটোই ওরা মুখোমুখি বসেছিল। সুমনা স্পষ্ট দেখতে পেল বড় বড় দুটো ট্রলি ব্যাগ দাঁড় করানো রয়েছে সদর দরজার পাশে। এয়ারপোর্ট যাবার জন্য ক্যাব বুক করছে বিতান। সুমনা ক্ষীণ গলায় বলল ‘সে-ই আমাকে নিয়ে গেলে না! আমি যে এখন একদম একা। আমি কী করে থাকবো?’ সুমনার চোখের ধারার দিকে তাকিয়ে বিতান বললো, ‘নিজেকে শক্ত করো। ফোনে তোমার সঙ্গে আমার যোগাযোগ থাকবে। মাঝে মাঝে আসব। গানটা ছেড়ো না। তাছাড়া তুমি যা ভাবছো, তা যে হয় না।’ সুমনার হাতটা ধরে কাছে টেনে নিয়ে ওর ঠোঁটের ওপর নামিয়ে আনে নিজের ঠোঁট। সুমনা দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে বিতানকে। ওর বুকে মাথা রেখে কান্নায় ভেঙে পড়ে।
আজ আচমকা বিতানের স্পর্শ লাগা চেয়ারটায় মাথা রেখে অঝোরে কাঁদতে লাগল সুমনা।।