সৈয়দ হাসমত জালাল
সঞ্জয় ঘোষ কবি, কথাকার এবং চিত্রশিল্পী। শিল্পের খুব সহজ, প্রথাগত পথ ধরে তিনি চলেন না। তা কবিতা, উপন্যাস বা চিত্রকলা যা-ই হোক না কেন। তাঁর শিল্পের জগৎ যেমন বর্ণময়, তেমনই বিমূর্ততায় রহস্যময়। বাস্তব-বিবর্জিত একবারেই নয় তাঁর ভাবনা। কিন্তু সেই ভাবনা ক্রমগত ফর্ম ভেঙে, স্ট্রাকচার ভেঙে এগোতে থাকে। অ্যাবসার্ড বা খানিকটা অবাস্তবের জগৎ যেন গড়ে ওঠে তাঁর রূপকল্পে, কিন্তু সেই অবাস্তবকে ছুঁয়ে তা শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে বিমূর্ত শিল্পের জগৎ।
তাঁর লেখা গল্প উপন্যাসেও এর নিদর্শন খুব স্পষ্ট। তাঁর পরীক্ষামূলক উপন্যাস-ট্রিলজিতে সময় ও শূন্যতাকে তিনি ব্যবহার করেছেন নিপুণভাবে।
সঞ্জয় ঘোষের আলোচ্য কবিতাগ্রন্থের নাম ‘ছায়ার ভেতর লাল নীল শব্দ’। তাঁর প্রথম কবিতাগ্রন্থ ‘উদ্বাস্তু’ প্রকাশিত হয় ২০০২ সালে। এরপর একে একে প্রকাশিত হয় ‘রবীন্দ্রনাথের গান বেশ দাহ্য’, ‘পাখিজন্ম’, ‘বাঘ ও মাউথ অর্গান’ এবং ‘বৃষ্টির বাড়ি’।
‘ছায়ার ভেতর লাল নীল শব্দ’ নামটি শুনলেই প্রথাবদ্ধ পাঠকের কাছে এক অবাস্তবতার ধারণা নিয়ে আসতে পারে। বিশেষত, শব্দের বিশেষণ হিসেবে লাল বা নীলকে ভাবলে। কিন্তু কবিতাটি পড়তে পড়তে এক আশ্চর্য সংবেদনাময় জগতে ঢুকে পড়তে হয়। কবিতাটি শুরু হয় এভাবে— ‘ছায়ার ভেতর লাল নীল শব্দ থাকে/বাড়ির দালানে ইস্পাত-ঘেঁষা দীর্ঘশ্বাস/ রেললাইন জলের ওপরে পাতা/শাকসবজি ধুয়ে যাচ্ছে সবুজ বিষে’। কবিতাটি যত এগোতে থাকে, তত এরকম সব রূপকল্প আবিষ্ট করতে থাকে পাঠককে— ‘বাদামি গুহার ভেতরে হিংস্র আলিঙ্গন/বালক বুঝেছিল নগ্নতার বিপন্নতা/বৃষ্টির বড় বেশি আত্মঘাতী প্রবণতা’ কিংবা ‘প্রাচীন গ্রন্থাগারে রাখা থাকে বিচ্ছেদের মায়া/রাজবাড়ির কোষাগারে জমা আছে তীব্র অভিমান/নদীর তীরে ফেলা থাকে অব্যহৃত মৃতদেহ/ দুষ্পাপ্য শীত এসে ঢেকে দেবে আরূঢ় লজ্জা’। বস্তুত স্মৃতি, অভিমান আর বিপন্নতায় গড়ে ওঠা এক জগৎ ভালোবেসে বোধিবৃক্ষ স্পর্শ করার কথা বলে।
খুব সহজ কথায়, সহজ চিত্রকল্পে কিন্তু গাঢ় রঙে ছবি আঁকতে আঁকতে পাঠককে কখনো পরাবাস্তব, কখনো-বা জাদুবাস্তব জগতে পৌঁছে দেন সঞ্জয়। যেমন ‘সাদা শহর কালো শহর লাল শহর’ কবিতায় তিনি লেখেন—‘শহর সাদা থেকে লাল হবে/লাল থেকে কালো হবে/শহর কি একদিন প্রাচীন ঘুড়ির মতো/দুষ্প্রাপ্য আকাশ খুঁজতে উড়ে যাবে?’ আসলে এই শহরে সাদা অ্যাম্বুলেন্স আছে, কালো পুলিশের গাড়ি আছে, গলাবন্ধ লাল স্কুলবাড়ি আছে, কিন্তু কোনও নীল দ্বীপ নেই। এখানে আকাশও তো নেই।
এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাই অত্যন্ত সুচিন্তিত এবং অর্থবহ। জীবন এবং মৃত্যু শব্দটিকে ভিন্ন তাৎপর্যে ব্যবহার করেন সঞ্জয়। জীবনের মধ্যে ফুরিয়ে যাওয়াই কি আসলে মৃতের অনুষঙ্গে আসে, আবার সেই মৃত্যু থেকে ফিরে আসাই বেঁচে থাকা! ‘জীবিত মৃত’ কবিতায় দেখি— ‘একটা লুডো খেলছি তুমি আমি/একটা তাস খেলছি তুমি আমি/আমি মৃত/তুমি মৃত’। কিন্তু ওই কবিতার শেষ স্তবকে দেখি— ‘একটা সোনাঝুরিতে সূর্যডোবা দেখছি তুমি আমি/একটা ডুলুং নদীতে ভাঙা পাথর দেখছি তুমি আমি/আমি জীবিত/তুমি জীবিত।’ একটি আশ্চর্য ভালোবাসার, বেঁচে থাকার, জীবনের ছবি ফুটে ওঠে শেষ স্তবকে। প্রাত্যহিক জীবনের মধ্যেই মিশে থাকে শূন্যতা, মৃত্যুর আবহ আর বহুমাত্রিক বিপন্নতা। এই বহুমাত্রিকতাকে নিজস্ব বাকশৈলী আর বর্ণবিভঙ্গে নির্মাণ করেছেন কবি সঞ্জয় ঘোষ। কিন্তু তাঁর কবিসত্তার মধ্যে শিল্পীসত্তাকে বোধহয় আলাদা করা সম্ভব নয়। তাই তাঁর কবিতার পঙ্ক্তিতে পঙ্ক্তিতে এত রং, এত ছবি। আসলে জীবন আর মৃত্যুর মাঝখানে মানুষের যে শূন্যতা, যে বিপন্নতাবোধ সেসবই সঞ্জয় তুলে এনেছেন, বুঝি-বা কিছুটা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে, কিন্তু সবমিলিয়ে যে জীবন তাকে খণ্ড-বিখণ্ড দেখেও তার সমগ্রতার প্রতি রয়ে গেছে কবির নিবিড় ভালোবাসা।
‘নিজস্ব নীলকণ্ঠ ময়ূর’ কবিতায় এক আশ্চর্য বিষণ্ণতা এবং শূন্যতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে থাকে পাঠক— ‘নৃত্য পরম্পরায় ঘুঙুরের বিষণ্ণ শব্দ ধারণ করতে পারে না/একটা সবুজ আলো বিবর্ণ উঠোনের মেঝেতে ঘোরেফেরে/গুহার ভেতরে একান্নবর্তী গুহা, তার ভেতরে করোটির ভিড়/পাহাড়ের সমস্ত দীপ নিভে গেলে/মানুষের শূন্যতা খাক খাক পোড়ে’।
আলোচ্য কবিতা গ্রন্থের প্রত্যেকটি কবিতাতেই এরকম অজস্র উদ্ধৃতিযোগ্য পঙ্ক্তি পাঠককে, মুগ্ধ করে, বিস্মিত করে। ‘নীল আস্তাবল’, ‘সারি সারি ছবির মৃতদেহ’, ‘দরজা জানলার কঙ্কাল’, ‘জ্যোৎস্নায় মৃত বালি’, ‘নক্ষত্রের ঝলসানো মাংসপিণ্ড’, ‘সবুজ বৃষ্টির মধ্যে অন্ধকার বাংলো’, ‘নৃত্যশীল মমি’— এরকম সব রূপকল্প বুঝিয়ে দেয় কবির সময়চেতনা, শিল্পচেতনার ব্যাপ্তি ও তাকে প্রকাশের সুশিক্ষিত নৈপুণ্য। মাত্র দু’ফর্মার এই কবিতাগ্রন্থটির ব্যাপ্তি এতটাই যে তা বারবার পড়তে হয়, এক-একটি চিত্রকল্প নির্মাণ পাঠকের নিবিড় সংবেদন ও মগ্নতা দাবি করে। গ্রন্থের প্রচ্ছদটিও কবির আঁকা এক বিমূর্ত শিল্পকর্ম, যা গ্রন্থটিকে ভিন্ন মাত্রা দিয়েছে।
ছায়ার ভেতর লাল নীল শব্দ:
সঞ্জয় ঘোষ
প্রকাশক: লুব্ধক। মূল্য: ৭০ টাকা।