সোমনাথ রায়
যদিও পোল্যান্ডের স্লুপস্কের ভালুককে প্রথমে দেখে তোমাদের মনে হবে এটা একটা লোভনীয় নরম, সুস্বাদু জেলি টফি। আসলে এটা কিন্তু প্রায় ৩০০০ বছরের পুরনো অ্যাম্বারের একটা তাবিজ বা লকেট, যেটি ১৮৮৭ সালে পোল্যান্ডের স্লুপস্ক শহরের কাছে একটি জলাভূমির কাঠকয়লার মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছিল এবং এটা এত সুন্দর আর নিখুঁত ছিল যে রাতারাতি এটা সবার মন কেড়ে নিয়েছিল।
মোটামুটি ১৭০০ থেকে ৬৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে এটি তৈরি হয়েছিল বলে মনে করা হলেও কারুর কারুর মতে এটি আরও পুরনো হতে পারে, কারণ একই রকমের অ্যাম্বার প্রাণীর মূর্তিগুলি ডেনমার্কের জুটল্যান্ডে পাওয়া গেছে, যেগুলি বয়েস মেসোলিথিক সময়কালের অর্থাৎ ১২,০০০ থেকে ৩৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে।
১০.২ সেমি লম্বা, ৩.৫ সেমি চওড়া এবং ৪.২ সেমি উঁচু এবং ৮৫ গ্রাম ওজনের এই ছোট্ট ভালুকটি সম্ভবত নব্যপ্রস্তর যুগের কোন ভালুক শিকারীর লাকি চার্ম ছিল যা এরটেবোলে, কঙ্গেমোস বা ম্যাগলেমোসেস সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত।
যেহেতু অ্যাম্বার বা তৈলস্ফটিক একটি নরম, আঠালো গাছের রজন হিসাবে বেরিয়ে আসে, সেহেতু অ্যাম্বারের আঠায় (যা বহু বছর পর জীবাশ্ম হয়) মাঝে মাঝে প্রাণী, কীট, পতঙ্গ এবং উদ্ভিদের বিভিন্ন অংশ আটকে থাকে। সাধারণত কয়লার স্তরগুলিতে পাওয়া অ্যাম্বারকে রিসিনেট বলা হয় আর নিউজিল্যান্ডের কয়লা স্তরগুলির মধ্যে পাওয়া অ্যাম্বারকে অ্যামব্রিট বলা হয়। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ এটির উষ্ণ সোনালি রঙ এবং সৌন্দর্যের প্রশংসা করে আসছে। এটির জাদুকরী এবং রোগ নিরাময়ের ক্ষমতা আছে বলে বিশ্বাস ছিল বলে প্রাচীন মানুষের কাছে এগুলি খুব মূল্যবান ছিল। জেম স্টোন হিসেবে প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে এখনও পর্যন্ত এগুলোকে দামী পাথর মনে করা হয়। অ্যাম্বার বিভিন্ন আলংকারিক জিনিসপত্রে এবং গয়না হিসেবেও ব্যবহৃত হয়। প্রাণীদের মূর্তি তৈরির জন্য শুধু সুন্দর বলে নয়, অ্যাম্বারকে ওই প্রাণীর প্রতীক হিসেবেও ব্যবহার করা হত। অনেক প্রাচীন সংস্কৃতিতে প্রাণীদের নির্দিষ্ট গুণ আছে বলে মনে করা হত এবং তাদের ছোট মূর্তি লকেট বা তাবিজ করে ব্যবহার করলে পরিধানকারী সেই গুণের অধিকারী হবে বলে বিশ্বাস ছিল।
একটি বাল্টিক অ্যাম্বারের স্বচ্ছ, মধু-হলুদ রঙা টুকরোকে খোদাই এবং পালিশ করে মসৃণ এবং চকচকে করে এই ভালুকটিকে তৈরি করা হয়েছিল, যার ছোট ছোট ডেলাগুলি পায়ের কাজ করেছে আর মাথাটিতে স্পষ্টভাবে বোঝা যাচ্ছে দুটি অবিকল কান, নাকের দুটো ফুটো সমেত একটা লম্বাটে মুখ আর গুল্লি গুল্লি দু’টি চোখ।
তাবিজটার পেছনে একটা ফুটো আছে যেটা দিয়ে একটা সুতো গলিয়ে এটা গলায় ঝুলনো যেত। ভালুকটির মাথার কাছে একটি কালচে রঙের হদিশ পাওয়া পাওয়া গেছে, যা থেকে মনে হয় এটার খানিকটা অংশ রঙ করা ছিল। যদিও লকেটটিকে সীল বা শুয়োর বলে অনেকে চিহ্নিত করতে চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু এটির ‘ভালুক’ সনাক্তকরণ সঙ্গে সঙ্গে এবং সবার পছন্দ হয়েছে এবং এখনও সেটাই সর্বপ্রিয়।
আসল মূর্তিটি স্লুপস্কে বেশিদিন থাকেনি, কারণ এটি ছিল পোমেরেনিয়ায় পাওয়া প্রাচীনতম বস্তু, তাই এটিকে তাড়াতাড়ি ঐ অঞ্চলের ঐতিহাসিক এবং পুরাকীর্তি সোসাইটির জিম্মায় দিয়ে দেওয়া হয়েছিল। এই সোসাইটির সংগ্রহগুলি ১৯২৮ সালে প্রতিষ্ঠিত শ্চেচিনের পোমেরেনিয়া রাজ্য জাদুঘরে স্থান পেয়েছিল। এদিকে, সতুপস্ক্-এ অ্যাম্বার নির্মাতাদের গিল্ড ১৯২৪ সালে ভালুকের একটি নকল তৈরি করেছিল, যা ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত শহরে দেখা যেত। তারপর এটি অন্যান্য অ্যাম্বার এবং সোনার গয়নাগাঁটির সঙ্গে হাপিস হয়ে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে, মূল্যবান সংগ্রহের হাতবদলের ফলে, আসল মূর্তিটি পূর্ব জার্মানিতে পাওয়া গিয়েছিল, যেখানে এটি স্ট্রালসুন্ডের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের জাদুঘরে প্রদর্শিত হয়েছিল। অদ্ভুত ব্যাপার, নকলটিও সেখানে হাজির হয়েছিল, যা ২০০২ সালে সবার সামনে প্রদর্শিত হয়েছিল, আর আসলটি নিরাপদে সিন্দুকে রাখা ছিল। কিন্তু ২০০৯ সালে, শ্চেসিনের কর্তৃপক্ষ মূর্তিটি পোল্যান্ডে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয় এবং সেটি এখনও শ্চেসিন জাদুঘরে প্রদর্শিত হচ্ছে। স্লুপস্কে, ভালুকের হুবহু নকল এখনও তৈরি করা হয়, যা টাউন হলে একটি বিশেষ শোকেসে রাখা থাকে। বছরে একবার মূর্তিটি নিলাম করা হয় সংগৃহীত অর্থ সামাজিক কাজে ব্যবহার করা হয়। দারুণ না? আমাদের দেশের অসংখ্য অমূল্য প্রত্নসামগ্রীর মডেল যদি সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া যেত!