• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

রামরহিম বাউল

নিমেষে আসর বদলে গেল আর্তনাদ আর চিৎকার চেঁচামেচিতে। আখড়ার ভিতর বাঁচার আকাশ-বিদারি আর্তি— সাঁই বাচাও!

কালাম শেখ

এলাকায় একটা জনশ্রুতি ছিলই। বুড়িমা- তলায় মানুষের বাস ছিল এককালে।
উঁচু ভিটা, ছড়ানো ছিটানো খোলাম কুচি পাথর দেখে মানুষের দৃঢ় বিশ্বাস এ জায়গা এক সময়ের জনবসতি। কিন্তু কবে ছিল সেই জনবসতি তার সাল তারিখ অজানা।
ঝোপ জঙ্গলে ভরা এক গা-ছমছমে পরিবেশ। বুড়িমাতলার ঝুর দেওয়া বুড়ো বট গাছ। বট গাছকে পেঁচিয়ে উপরে উঠে গেছে লতানো গাছ। গাছের ডালে ডালে রাজ্যের বাদুড়ের বাস। তার বুক কুরে কুরে খেয়েছে কালস্রোত। বট গাছের তলায় বাউলের আখড়া। আখড়ার একটু দূর দিয়ে বইয়ে চলেছে নদী। কত কালের কত যুগের ইতিহাস জমা আছে তার বুকে।
সাঁঝ হলেই বাউল সঙ্গীতের সুর মাধুর্যে উপচে পড়ে এই বুড়িমাতলা। বোল ওঠে ও সাঁই, সাঁই, সাঁই ফকির।
এবার চৈত্র সংক্রান্তিতে সাঁই বাউল ফকিরের মেলার আয়োজন করতে গিয়ে মানুষের সেই বিশ্বাস আরো দৃঢ় হলো।
মেলায় জঙ্গল কাটতে গিয়ে বেরিয়ে পড়েছে একটা পুরাতন বাড়ির চিহ্ন। ছড়ানো ছিটানো খোলাম কুচির মধ্যে খুঁজে পেয়েছে তাদের পূর্ব-পুরুষদের উপসনালয়। তা নিয়ে দু-সম্প্রদায়ের মাঝে চলছে কানাঘুষো।
বাড়ির চিহ্ন, খোলাম কুচি পাথর দেখে দু-পক্ষেরই দৃঢ় বিশ্বাস এটা তাদের ধর্মস্থান। মেলায় এসে কেউ কেউ খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে নিজেদের বিশ্বাসে আবিষ্কার করেছে আপন ধর্মালয়।
—দেখ দেখ এই যে এই পাথরটা মনে হচ্ছে কোনো দেবতার। আহা রে! নাকটা ভেঙে গেছে— না? ওই উঁচু জায়গাটায় মনে হয় বেদি ছিল। চ’ গিয়ে ভালো করে দেখি। আমরা ঠিকই ধরেছি এটি বেদি।
আবার কেউ এসে খোলাম কুচির ভিতর খুঁজে পাচ্ছে তাদের ধর্ম।
—এই পাথরটায় দেখ আরবি লেখা। কী হিজিবিজি লেখা রে! পড়তে পারবি? মনে হচ্ছে আল্লাহু লেখা।
মনে হচ্ছে ওই উঁচু জায়গাটা মেহরাব ছিল।
ওদিকে আখড়ায় জমে উঠেছে আসর। ভবা বাউলের গলায় জাত নিয়ে গানের গাম্ভীর্য আখড়ায় উপচে পড়ছে। কল্কেতে একটান দিয়ে চনমনে হয়ে একতারায় আঙুল চালিয়ে সে গেয়ে চলেছে—
জাত গেল জাত গেলো বলে
এ কি আজব কারখানা—
গানের সঙ্গত দিতে ঝুনু বাউল মাথার লম্বা চুল ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে সুর তুলছে গাবগুবিতে— গুউব গুউব গুউব গুউব।
ভবা বাউল ঢুকে গেছে গানের গভীর। ভাবের ভিতর দিয়ে খোঁজ করছে সাঁইয়ের। মাথায় একটা লাল ফেট্টি বেঁধে মাজায় একটা সাদা কাপড় পেঁচিয়ে হাতের একতারাটা মাথার উপর ধরে পাক মেরে মেরে গাইছে—
ব্রাহ্মণ চণ্ডাল চামার মুচি
একই জলে হয়গো শুচি।
আসার কালে কী জাত ছিলে
আসার পরে কী জাত নিলে— তা না না না।
উস্তাদ— ঠিক আছে তো?
রামরহিম বাউল চোখ বুঁজে ধ্যান মগ্ন। দাড়ি গোঁফে ওর মুখ ঢাকা। গোঁফে হলদেটে ছোপ। হাতের কল্কে থেকে একটা সুরু ধোঁয়া উঠে যাচ্ছে উপরে। গান শুনতে শুনতে সাঁইকে খুঁজছিলো। সাঁই জাতপাত মানে না। মানুষের ধর্ম মানুষকে ভালোবাসা। জীবকে ভালোবাসা। ঘোলাটে ঘুম ঘুম চোখ খুললো।
—সাঁই আমাদের সবাইকে সমানভাবে দেখেন। মানুষের আবার জাত কী? সাঁইয়ের কোনো জাত নেই রে পাগল।
—উস্তাদজী!
—দে টান দে।
ধোঁয়া উঠছে গুব গুব করে। আখড়ার গোল ঘরটা ধোঁয়াময়। মুখ থেকে ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে রামরহিম বাউল খুক খুক করে কেশে জড়ানো স্বরে বলল।
—আর একটা হবে। লে ধর। ঝুনু এবার তু বল।
ঝুনু বাউল এবার সুর তুললো—
—সব লোকে কয় লালন কী জাত এই সংসারে
ফকির লালন বলে জাতের কিরূপ
দেখলাম না এই নজরে
সব লোকে কয় লালন কী জাত এ সংসারে—
মেলার তিন দিন আসর বেশ জমে উঠেছে। এক অলৌকিক আধ্যাত্মিক আবেশে আখড়া জমজমাট। ভাবের জগতে পরম সাঁইকে খুঁজছে ঝুনু বাউলরা। কল্কে সাজিয়ে গানের তালে তালে চলছে কল্কেতে টান আর আবেশের মাধ্যমে সাঁইয়ের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার মহিমা। চোখ বুঁজে মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে গানের তালে তালে দুলছে ঝুনুরা।
—তারে না না না —লালন কী জাত এ সংসারে—।
এ তিন দিনে বুড়িমাতলার খোলাম কুচি নিয়ে মানুষের অন্ধ বিশ্বাস কতটা গভীরে গেছে তা দেখা গেল ভাঙা মেলার শেষ রাতে।
রামরহিম বাউল হঠাৎ ভাবের জগত থেকে জেগে উঠল— এই থাম। দেখ তো বাইরে কোনো বাবাজী আসল কিনা।
—উস্তাদ,চারজন আসছে মনে হচ্ছে। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না ওরা ক’জন আসছে।
রাতের আঁধারে রোষ আছড়ে পড়লো আখড়ায়।
—এই যে গাঁজা বাবা। এই সব ভন্ডামি এখানে আর চলবে না। তুমি জাত নষ্ট করছ। ধর্ম নষ্ট করছ ছেলেদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছ। ওসব আর চলবে না এখানে।
—আমরা তো কারো ক্ষতি করতে যাচ্ছি না বাপু। আমরা আমাদের নিয়ে থাকছি।
—বললাম তো ওসব আর চলবে না এখানে। এটা সরকারি জায়গা। এখান থেকে উঠে যেতে হবে তোমাদের। উঠে না গেলে আখড়া আর আস্ত থাকবে না। পবিত্র জায়গা তোমরা অপবিত্র করছ।
—সরকারের জমি নিয়ে এত মাথা ব্যথা কেন বাপু?
—মাথা ব্যাথা মানে? গাঁজা টানা কোনো ধর্ম? এ গাঁজার আখড়া বন্ধ করতে হবে।
—কেন? বন্ধ করব কেন?
—এই জায়গায় মন্দির ছিল। আমরা এ গাঁয়ে আখড়া-মাখড়া রাখব না। যতসব ভন্ডের দল।
—আরো তো জায়গা আছে। বাপু সে জায়গায় মন্দির বানাও না।
—এখানেই মন্দির হবে। সাত দিনের মধ্যে জায়গা খালি করতে হব। বলে দিচ্ছি।
জমে ওঠা গানের আসরে নিমেষে বিষণ্ণতা নেমে এল। ভবা বাউল গান থামিয়ে অবাক হয়ে শুনছিল। মনে মনে সাঁইকে প্রশ্ন করল, এ কী জাতের মানুষ সাঁই?
—এই এই যে গোঁসাই, খুব সাঁইয়ের ভক্ত— না? গাঁজা টেনে গান গাইলেই সাঁই তোমাকে স্বর্গে নিয়ে যাবে? যত সব গাঁজাখোরের দল।
—আমরা মানুষের ধর্ম বিশ্বাস করি গো। সাঁইয়ের কাছে সব মানুষ সমান। কোনও ভেদাভেদ নেই।
—আবার বড়ো বড়ো কথা। মানুষের ধর্ম করে গো। যতসব ভন্ড গাঁজাখোর।
রামরহিম বাউল বলল, আমরা তোমাদের কী ক্ষতি করলাম বাপু?
—সেটা তোমাকে কৈফিয়ত দিতে হবে? চটি গোটাও। সাতদিনের পর তোমাদের এখানে যেন আর না দেখি।
ওরা চলে যাওয়ার পরেও রামরহিম বাউলের ধন্দ কাটে না। এ আখড়া অনেক দিনের। মাঝে মাঝে এই আখড়ায় বাউলরা জমায়েত হয়। আসর বসায়। গান দিয়ে সাঁইয়ের কাছে ভক্তি নিবেদন করে। চৈত্র সংক্রান্তিতে মেলা বসে। মেলা চলে টানা তিনদিন। বাউল গানের আসর বসে। কেউ এতদিন কোনো প্রশ্ন তোলেনি।
—ভবা!
—উস্তাদ!
—মনে হচ্ছে ভিতর ভিতর আমাদের বিরুদ্ধে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
—উস্তাদ, সবই সাঁইয়ের ইচ্ছে। তার লীলাখেলা।
—কিন্তু আমরা সাঁইয়ের আখড়া কারো হাতে তুলে দিতে পারি না। এ সাঁইয়ের আখড়া রে পাগল।


এলাকার নেতা মহিমবাবু বিষয়টি মিটমাট করার আশ্বাস দিয়ে রামরহিম বাউলকে বিদায় করে রাজনীতির হিসেব কষলেন। কয়েকটা বাউলের জন্য গাঁয়ের সব লোককে তো চটানো ঠিক হবে না। এ গাঁয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু। এদের ধরে রাখতে হবে। আর আখড়ার পাশে বরং মন্দির থাকলে দুই সংস্কৃতির মেল বন্ধন ঘটবে। আখড়া থাকবে। মন্দিরও থাকবে। একদিকে মন্দিরে ঘন্টা বাজবে। আবার আখড়ায় চলবে বাউল সঙ্গীত।
আখড়ার পাশে মন্দির নির্মাণ হবে। এ খবর রাষ্ট্র হতেই টনক নড়লো মুসলিম পাড়ার। বুড়িমাতলার সরকারের খাস জমিতে মন্দির উঠলে ওদেরও অধিকার আছে। ওখানে মসজিদ ছিল। উঁচু জায়গাটা মেহরাব, তা দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। ও জমিতে ওরা কেন মসজিদ গড়তে পারবে না?
একদিন মসজিদ পক্ষও চড়াও হল আখড়ায়।
আখড়া ভিতর থেকে ভেসে আসছে ভবা বাউলের গলা।
—ও মন জানো না
তোমার ঘরে বসত কর কয়জনা।
একজনে একমনে ছবি আঁকে—।
—এই যে ভন্ডের দল, তোরা কী পেয়েছিস? তোরা আল্লা মানিস গাঁজাখোর? এ গাঁয়ে ওসব আউল বাউল আমরা রাখব না। তোদের আখড়া গোটা। নাহলে আমরাই ভেঙে সাফ করে দেব। এ জায়গা তোদের বাপের সম্পত্তি না। গাঁজা খেয়ে ধর্ম! বাপ রে বড়ো সাঁই হয়েছে। এখানে মসজিদ হবে। ভালো চাস তো তোরা দূর হ’ এ গাঁ থেকে।
রামরহিম বাউলের ধন্ধ কাটে না। একদিন হিন্দু শাসাচ্ছে, একদিন মুসলমান শাসাচ্ছে। এরা সবাই এক! এ জমি হিন্দুর না, মুসলমানেরও না। সরকারের জমি। সরকার তো কিছু বলে না। তাহলে ওদের কথায় আখড়া উঠবে কেন?
রামরহিম বাউল প্রশাসনের নজরে আনল সমগ্র বিষয়। পুলিশ অফিসার সরেজমিনে এসে সতর্ক করে গেলেন সব পক্ষকে।
—যেখানে আখড়া আছে সেখানেই থাকবে। আপনাদের এত জায়গা থাকতে মন্দির মসজিদ গড়ার এত শখ হচ্ছে কেন? আর জায়গা পেলেন না? আপনারা মন্দির মসজিদ নির্মাণ করলে করুন। আখড়ায় নজর কেন?
মহিমবাবুকে বললেন, মনে রাখবেন আপনার কাছে সবাই সমান। সব ধর্ম সম্মানের। আমরা সব ধর্ম সম্মান করি।
মহিমবাবু মাথা ঝাঁকালেন।
—আপনি নিশ্চিত থাকুন। আর সমস্যা হবে না। আমি সব পক্ষকে নিয়ে আবার বসব।
কিন্তু মনে মনে আওড়ালেন, আগে দল। কয়েকজন বাউলের জন্য বড়ো গোষ্ঠীকে হাতছাড়া করতে যাব কেন?
মন্দিরের পক্ষ দাবি করলো— সরকারের জমিতে বাউলের আখড়া থাকলে মন্দিরও থাকবে।
মসজিদ পক্ষেরও জোরালো দাবি— মন্দির মসজিদ না থাকলে আমরা বাউলের আখড়াও থাকতে দেব না।
সরকারের জমি সরকারের কাজে লাগুক। জমিতে আখড়া থাকলে মসজিদ থাকবে। মন্দিরও থাকবে। না থাকলে কোনোটাই থাকবে না।
পুলিশ অফিসার বললেন, বাউলের আখড়া তো নতুন নয়। যা জেনেছি অনেক দিন থেকে এখানে আখড়া আছে।
রামরহিম বাউল বলল, হুজুর, আমরা গান করতে পারব তো?
—পারবেন। আপনি প্রতিদিন আমাকে ইনফর্ম করবেন।

মন্দির পক্ষ ও মসজিদে পক্ষ এক হয়ে এবার অভিযোগ করল— আপনি পক্ষপাতিত্ব করছেন স্যার। আখড়া থাকলে মন্দির মসজিদ থাকতে পারবে না কেন? আমাদের কী অপরাধ?
—আপনাদের কোনো অপরাধ নেই। কিন্তু জমি যার দখলে আছে তার অগ্রাধিকার।
অমীমাংসিতভাবে আলোচনা শেষ হলে দু’পক্ষই মহিমবাবুকে চেপে ধরলো।
—আপনি থেকে কী করলেন? পারলেন আখড়া তুলতে? আমরা এবার যা করার করবো। আপনার উপর ভরসা রাখলে না হবে মন্দির, না হবে মসজিদ।
কয়েকদিন পর আখড়ার আসর আবার জমে উঠেছে। পুলিশ অফিসার আশ্বাস দেওয়ার পর আসর আজ আরো জমকালো।
ঝুনু বাউল এবং ভবা বাউলের পর আজ গান ধরেছে রামরহিম বাউল—
—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়।
ধরতে পারলে মনো বেড়ি দিতাম পাখির পায়।
পাখি কেমনে আসে যায়—।
ভবা বাউল মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে। কয়েকজন দোহারা গাইছে।
—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়—
ধরতে পারলে মনোবেড়ি
দিতাম পাখির পায়
পাখি কেমনে আসে যায়।…
আগুন! আগুন! আগুন!
হুলুস্থুল বেধে গেল আখড়ায়। ধোঁয়ায় ঢেকে যাচ্ছে চারপাশ। আগুন ক্রমেই গিলে নিচ্ছে আখড়া। বাঁচাও! বাঁচাও! আগুন! আগুন! সাঁই বাঁচাও! বাঁচাও সাঁই! সাঁই!
নিমেষে আসর বদলে গেল আর্তনাদ আর চিৎকার চেঁচামেচিতে। আখড়ার ভিতর বাঁচার আকাশ-বিদারি আর্তি— সাঁই বাচাও!
বাইরে আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে। সড় সড় শব্দ। ভারি পায়ের দাপাদাপি।
কোনো কথাই ঢোকেনি রামরহিম বাউলের কানে। সে গানের গভীর সাঁইয়ের সঙ্গে একাত্ম। চোখ বুঁজে গেয়ে চলেছে— খাঁচার ভিতর অচিন পাখি কেমনে আসে যায়—।
ঘোর কাটতেই রামরহিম বাউল দেখল চারিদিকে আগুন। লেলিহান আগুন লকলক করছে। ভবা— আ— আ, ঝুনু উউউ। কোথায় তোরা? সাঁই!
—খাঁচার ভিতর অচিন পাখি—
আগুন ক্রমশ ঘিরে ধরছে রামরহিম বাউলকে। বাইরে থেকে একটা অস্পষ্ট ক্ষীণ স্বর ভেসে আসে
—উস্তাদ পালান পালান পালান। আগুন! আগুন! বেরিয়ে আসুন।
রামরহিম বাউলের যেন ডুবে যেতে থাকে ভাবসাগরে। সাঁই বাবা আআআ! আমি—।
মুক্তি পেতে চেয়েছিল রামরহিম বাউল জাতপাত জর্জরিত সমাজের নাগপাশ থেকে। সমাজের সব শৃঙ্খল ভেঙে সে মানবধর্মে দীক্ষা নিয়েছিল। জাতপাতের ঊর্ধ্বে দেখতে চেয়েছিল এই সমাজকে।


সোমার সেই দৃশ্য আর যে যন্ত্রণা আজও বুকে বাজে প্রায় সারাক্ষণ। প্রায় নগ্ন দু’জনকে সারা গাঁয়ে ঘুরিয়ে ছিল সাধু চৌধুরী। মাত্র দুটি পেঁপে পাড়ার অপরাধে। ছিঃ! ধিক্ ধিক্। সাধু চৌধুরী। ধিক্। নরাধম। পিশাচ!
এত কী অপরাধ ছিল! গাছটা তো সরকারি রাস্তার ধারেই ছিল।
সাধু চৌধুরী মানতে নারাজ।
—ছোটোলোক! তোর বাবার জমি? পেঁপে পাড়লি কেন?
—বাবু গাছটা তো সরকারের জমিতে আছে।
—তোর বাবার জমিতে আছে? আমার জমির পাশে। এটা আমার গাছের পেঁপে।
—না বাবু, এটা রাস্তার ধারে ছিল।
—ছোটলোকের বাচ্চা। তোর বাবার রাস্তা?
—বাবু ভুলে হয়ে গেছে। আর কোনোদিন ভুল হবে না।‌
—চুরি করে ভুল! তুই ইচ্ছে করেই চুরি করেছিস। ধাঙড়, ছোটোলোকদের আমি বিশ্বাস করি না।
কোনো অনুনয় বিনয় শোনেনি সাধু চৌধুরী। সোমার রূপ আর শরীরের অহংকার ভাঙতে এ সুযোগ হাতছাড়া করতে চায়নি। ছোটলোকের বউ হয়ে কী অহংকার! বলে কী! বাবু আছেন বাবু থাকবেন। ফের আমার দিকে তাকাবেন তো—
—কী করবি?
—বাড়িতে বউ নেই?
সাধু চৌধুরীর লালসার শিকার হতে চায়নি সোমা।
আর কোনোদিন যায়নি চৌধুরী বাড়ি।
সেই দিনের দৃশ্যটা বারবার ভেসে ওঠে রামরহিম বাউলের চোখে। দুটো পেঁপে পাড়ার অপরাধে কত অপমান হতে হয়েছিল সেদিন!
তাদের প্রায় উলঙ্গ করে চুল কেটে সারা গাঁয়ে ঘুরতে বাধ্য করেছিল সাধু চৌধুরী। উৎসুক গাঁয়ের লোক চারপাশ থেকে দেখছিল। কেউ কেউ হাসছিল দেখে।
ছোট জাত! চোর!
লজ্জা ঢাকতে সোমা সেই রাতেই সরিয়ে নিল নিজেকে। অপমান হওয়ার গ্লানি, সোমাকে হারানোর শোক ভিতরটা তছনছ করে দিয়েছিল। যে সমাজে মানুষের কোনো মূল্য নেই, যে সমাজে মানুষ মানুষকে দূরে রাখে, যে ধর্ম মানুষকে মানুষ থেকে আলাদা করে— সে ধর্ম কী ধর্ম? যে ধর্ম মানুষের মানসম্মান নিয়ে মস্করা করে সে ধর্ম না।
সোমার লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখখানা আবার ভেসে উঠলো। প্রায় নগ্ন দু’জনকে দেখে গাঁয়ের মানুষ হাসাহাসি করছে। চোর! চোর! ছোটোলোক।
সোমাকে দাহ করে এক বুক শোক নিয়ে বলাই আর ফেরেনি গাঁয়ে। ঘুরতে ঘুরতে মানুষের ধর্মে দীক্ষা নিয়ে থিতু হয়েছিল এই সাঁইয়ের আখড়ায়। সাঁইয়ের কাছে সঁপেছিল নিজেকে। যেখানে কেবল মানুষ থাকে ধর্ম থাকে না। আত্মিক টান থাকে সাঁইয়ের কাছে। নাম নিয়েছিল রামরহিম বাউল। এখানেও সেই ধর্মের জবরদস্তি।
আগুন আখড়ার চারপাশে দাউদাউ করে জ্বলছে। আখড়ার ভিতরেও আগুন ঘিরে ধরছে রামরহিম বাউলকে। ধেয়ে আসছে তার দিকে। লকলক করছে আগুনের জিভ।
রামরহিম বাউল চোখ মেলে সামনে দেখল দরজাটা খোলা। ঝুনু, ভবা এ দরজা দিয়ে বেরিয়ে আগুন থেকে নিজেদের বাঁচিয়েছে। সাঁই! ভবা! ঝুনু!
রামরহিম বাউল দরজার দিকে এগিয়ে গেল। ঝুনুর ভবার ডাক কানে ভেসে আসছে তখনও, উস্তাদ! উস্তাদ! বেরিয়ে আসুন। আগুন! আগুন!
রামরহিম বাউল দেখল চারপাশে আগুন। আগুন সর্বত্র। দরজা বাইরে আরেকবার দেখে নিল। বাইরে বেরোতে গিয়ে দরজার কাছে এসে থেমে গেল। ভাবলো কয়েক মুহূর্ত— ধর্ম মানুষকে উন্মত্ত করে।
ভিতর থেকে দরজার আগল তুলে দিল রামরহিম বাউল— সাঁই— সাঁই— তুমি ধর্মের উপরে। সবার উপরে।