দিলীপ কুমার মিস্ত্রী
বাসন্তীপল্লির প্রসঙ্গ উঠলেই সহরের অনেক বাবুরা নাক সিঁটকোয়৷ অথচ বাসন্তীপল্লীতে সহরের বাবুদেরই বেশি যাতায়াত৷ শুধু এই সহর কেন, দূর দূরান্তের সহর-গ্রাম থেকেও বাবুদের আনাগোনা চলে সারা বছর জুডে়৷ বাসন্তীপল্লির খ্যাতি দিনকে দিন যেন বেডে়ই চলেছে৷
ইদানিং পল্লির কিছু ছেলেমেয়েরা স্কুলে যাতায়াত করছে৷ তাদের স্কুলমুখী করতে সহরের কয়েকজন যুবকযুবতী এগিয়ে এসেছে৷ শুরুতে বিস্তর বাধা এসেছিল৷ কিন্ত্ত জাঁদরেল এসডিও দিদিমণি এবং এসডিপিও সাহেবের দাপটে সেসব ধোপে টেকেনি৷ তাই বাসন্তীপল্লির অনেক মায়েদের মনে আজকে নতুন করে আশার আলো উঁকি দিচ্ছে৷
পল্লির দীপ্তিময়ী অত্যন্ত মেধাবী এবং বুদ্ধিমান কিশোরী৷ এবার সে ক্লাস সেভেনে উঠেছে ফার্স্ট হয়ে৷ নিবেদিতা গার্লস স্কুলের ছাত্রী দীপ্তিময়ী ভালো ছবি আঁকে, ভালো আবৃত্তি করে, ছুটতেও পারে ঘোড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে৷ গতবছর জেলাস্কুল স্পোর্টসে সে তিন-তিনটে ইভেন্টে ফার্স্ট হয়েছে৷ নিজের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলকেও জেলা চ্যাম্পিয়ন করেছে৷ বাসন্তীপল্লির দীপ্তিময়ীকে এইমুহূর্তে সহরের এক নম্বর সেলিব্রেটি বলা যায়৷
এক রবিবারের সকালবেলা৷ বাইরে থেকে একটি সমাজসেবী সংগঠনের কয়েকজন কর্মকর্তা বাসন্তীপল্লিতে এসে হাজির৷ তাঁরা পল্লির পড়ুয়া ছেলেমেয়েদের ডেকে নিয়ে এক জায়গায় বসেছেন৷ নিয়মিত স্কুলে যাওয়া-আসা, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে তাদের নানা সমস্যার কথা শুনতে এবং বুঝতে চেষ্টা করছেন৷ নানান কথার মাঝে এসে পড়ল, ছেলেমেয়েদের পরিবারের কথা৷ তাদের বাবা-মা, কাকা-জ্যেঠা, ঠাকুর্দা-ঠাকুমার প্রসঙ্গ৷
সঞ্চিতা দিদিমণি বকুলের কাছে তার বাবার নাম জানতে চাইলে, সে বলল, আমি আমার বাবার নাম জানিনা৷
কাজলের কাছে জানতে চাইলে, সেও বলল, আমি আমার বাবার নাম জানিনা৷
সুজয়ের কাছে তার বাবার নাম জানতে চাইলে, সে বলল, আমি আমার বাবাকে কখনও চোখে দেখিনি৷ মা আমাকে কখনো আমার বাবার নাম বলেনি৷ তাই–অংশুমানকে জিঙ্গেস করতে সে কাঁচুমাচু মুখে বলল, বা-বা, বাবা, না না, বাবার নাম আমার এখন মনে আসছে না৷ মনে পড়লে, পরে বলব৷
এক এক করে আট জনের পালা শেষ৷ কেউ সঞ্চিতাদিদিমণিকে তাদের বাবার নাম বলতে পারল না৷ তাই লজ্জায় সকলের মুখ কালো৷ সবাই মাথা নিচু করে বসে রয়েছে৷ মাঝেমধ্যে আড়চোখে দীপ্তিময়ীর মুখে চেয়ে রয়েছে৷ কারণ শেষ বেলায়, তার পালা৷ এবার সে কী উত্তর দেয়, কীভাবে তার বাবার নাম বলে, সবাই সেটাই দেখতে চাইছে৷ সবাই মনে মনে ভাবছে, তুখোড় বুদ্ধিমতী স্কুলের ফার্স্টগার্ল দীপ্তিময়ী এবার বোধহয় খুব জব্দ হবে৷
দীপ্তিময়ী এদের সকলের চেয়ে বয়সে ছোট৷ দিদিমণি তাকে কাছে ডেকে, আদর করতে করতে বলল, আচ্ছা দীপ্তিময়ী, তুমি কখনো তোমার বাবাকে দেখেছো, তাঁর নাম জানো? বলতে পারবে আমাদের? দীপ্তিময়ী চটজলদি উত্তর দিল, বাবাকে কেন দেখব না৷ তবে আমি তো তখন খুব ছোট৷ তাই তার মুখটা ঠিকঠাক মনে পডে়না৷ সে-তো এখন অনেক দূরে থাকে, আসতেও পারেনা৷ আর নিজের বাবার নাম কেন জানব না৷ তাই কখনো হয়! আমার বাবার নাম, ‘জানিনা’৷
দীপ্তিময়ীর উত্তর শুনে, শুধু সঞ্চিতা দিদিমণি একা নয়, সবাই তার মুখের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল এক অপার বিস্ময়ে৷ কিন্ত্ত দীপ্তিময়ীর মুখে মিষ্টি হাসি৷