বিমলকুমার শীট
এক সময়ে দেশে বিদেশে পরিবহনের অন্যতম মাধ্যম ছিল স্থলপথ ও জলপথ৷ স্থলপথে সড়কই ছিল অন্যতম মাধ্যম৷ কিন্ত্ত ইংল্যণ্ডের জেমস ওয়াট রেলইঞ্জিন আবিষ্কারের পরই রেলপথ পরিবহনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে ওঠে৷ ইংল্যান্ডে প্রথম রেলযান চললেও পরে পরে অন্যান্য দেশে তার প্রসার ঘটে এবং জনমনে তা জনপ্রিয় ও আরামদায়ক হিসাবে স্থান করে নেয়৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বিদেশ ভ্রমণে রেলযান এক বিশেষ স্থান করে নিয়েছে৷ তাঁর অভিজ্ঞতাও হয়েছে বিচিত্র৷ দেশে রেলগাড়িতে চেপে তাঁর প্রথম যাওয়া হাওড়া স্টেশন থেকে বোলপুরে৷ সেদিন তিনি ছিলেন বালক৷ আর যখন বিদেশে গিয়ে রেলগাড়িতে ওঠেন তখন তাঁর বয়স ১৮ বছর৷ অবশ্য যৌবন প্রারম্ভে রবীন্দ্রনাথ একবার রেলগাড়ির পরিবর্তে গোরুর গাড়িতে চেপে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরে কলকাতা থেকে পেশোয়ার পর্যন্ত যাবার পরিকল্পনা করেছিলেন৷ সেদিন অবশ্য পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছাড়া অন্য কেউ এই প্রস্তাবে অনুমোদন দেননি৷
১৮৭৮ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রবীন্দ্রনাথ বিলেত যাত্রা করেন৷ সেই সময়ের লেখার তাঁর রেলভ্রমণের বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়েছে৷ সুয়েজ থেকে সারারাত রেলভ্রমণের পর রবীন্দ্রনাথ সকাল বেলায় আলেকজান্দ্রিয়া পৌঁছান৷ তিনি লেখেন— ‘সুয়েজে আমরা রেলওয়ে উঠলাম৷ এ রেলগাড়ির অনেক প্রকার রোগ আছে৷ প্রথমতঃ শোবার কোনো বন্দোবস্ত নেই, কেননা বসবার জায়গাগুলি অংশে অংশে বিভক্ত৷ দ্বিতীয়তঃ এমন গজগামিনী রেলগাড়ি সর্বত্র দেখতে পাওয়া যায় না৷ সমস্ত রাত্রিই গাড়ি চলেছে, দিনের বেলা যখন জেগে উঠলেম তখন দেখলুম ধুলোয় আমাদের কেবল গোর হয়নি, আর সব হয়েছে৷ চুলে হাত দিতে গিয়ে দেখি, চুলে এমন এক স্তর মাটি জমেছে যে মাথায় অনায়াসে ধান চাষ করা যায়৷ এই রকম ধুলো মাখা সন্ন্যাসীর বেশে আমরা আলেকজান্দ্রিয়াতে গিয়ে পৌঁছলেম৷ রেলের লাইনের দু-পারে সবুজ শস্যক্ষেত্র৷ জায়গায় জায়গায় খেজুরের গাছে থোলো থোলো খেজুর ফলে রয়েছে—৷’
ক’দিন পর ইতালির ব্রিন্দিশি থেকে ট্রেনে উঠলেন রবীন্দ্রনাথ৷ পরের দিন সকালে প্যারিসে পৌঁছলেন৷ প্রায় ষোল সতেরো ঘণ্টার দীর্ঘ রেলজার্নি৷ এই রেলভ্রমণটা কবির কাছে ছিল একটা নতুন কাব্যপাঠের মতই আকর্ষক ও মনোরম৷ রেল শুধু মানুষকে তার গন্তব্য স্থলে পৌঁছে দেয় না৷ তার প্রয়োজন মিটিয়ে প্রভূত আনন্দ দান করে৷ রেলগাড়ির কামরায় যে জানালা তা শুধু যাত্রীর হাওয়ার জন্য নয় চোখের ও মনের খোরাকও বটে৷
ব্রিন্দিশি থেকে ট্রেন যথাসময়ে ছাড়ল৷ তারপর আঙুরের ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে কবির রেলগাড়ি এগোতে শুরু করল৷ চারিদিকের দৃশ্য খুব সুন্দর৷ পর্বত নদী হ্রদ কুটির ক্ষেত্র ছোট ছোট গ্রাম, দূরন্ত নগর তার প্রাসাদচূড়া, তার চার্চের শিখর, ছবির মতো বাড়িগুলি কবিকে মুগ্ধ করল৷ আল্পস পর্বতমালার বিখ্যাত Mont Cenis-এর টানেল অতিক্রম করতে হয়েছিল ব্রিন্দিশি থেকে প্যারিস যাবার এই পথেই৷ এই গহ্বরের ভেতর দিয়ে রেলগাড়ি পার হতে পুরো আধ ঘণ্টা সময় লাগে৷ এই বিশাল রেল-টানেল কীভাবে প্রস্তুত হয়েছিল তাও রবীন্দ্রনাথ জেনে নিয়েছিলেন৷ ‘এই পর্বতের এ পাশ থেকে ফরাসীরা ও পাশে থেকে ইতালিয়নরা এক সঙ্গে খুদতে আরম্ভ করে৷ কয়েক বৎসর খুদতে খুদতে দুই যাত্রীদল ঠিক মাঝামাঝি এসে পরস্পরের সমুখা-সমুখী উপস্থিত হয়৷ এই গুহা অতিক্রম করতে রেলগাড়ির ঠিক আধ ঘণ্টা লাগল৷ সে অন্ধকারে আমরা যেন হাঁপিয়ে উঠছিলেম৷ এখানকার রেলগাড়ির মধ্যে দিনরাত আলো জ্বালাই আছে, কেননা, এক এক স্থানে প্রায় পাঁচ মিনিট অন্তর এক একটা পর্বতগুহা ভেদ করতে হয়— সুতরাং দিনের আলো খুব অল্পক্ষণ পাওয়া যায়৷ ইটালি থেকে ফ্রান্স পর্যন্ত সমস্ত রাস্তা নির্ঝর নদী পর্বত গ্রাম হ্রদ দেখতে দেখতে আমরা পথের কষ্ট ভুলে গিয়েছিলাম৷ এই রাস্তাটুকু আমরা যেন একটি কাব্য পড়তে পড়তে গিয়েছিলাম৷’
রবীন্দ্রনাথের ইংল্যাণ্ডের যে দুটি জিনিস চোখ কেড়েছিল তা হল লোকজনের ব্যস্ততা আর ছোট্ট দেশটা জুড়ে রেলগাড়ির বাহুল্য৷ শহর জুড়ে মাকড়সার জালের মতো রেলপথের বিস্তার৷ পাঁচ মিনিট অন্তর এক-একটি ট্রেন আসছে যাচ্ছে৷ এক-একটা রেলস্টেশনের পাশাপাশি কতশত লাইন৷ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘দেশ তো এই এক রত্তি, নড়ে চড়ে বেড়বার জায়গা নেই, দু-পা চললেই ভয় হয় পাচ্ছে সমুদ্রে গিয়ে পড়ি৷ এখানে এত ট্রেন যে কেন ভেবে পাই না৷’ কবি জানিয়েছেন একবার লন্ডনে যাবার সময় একটুর জন্য ট্রেন মিস করেছিলেন তিনি, কিন্ত্ত সেজন্য তার বাড়ি ফিরতে বিলম্ব হয় নি, আধ ঘণ্টার মধ্যেই আর একটি ট্রেন এসে তাকে তুলে নিয়ে যায়৷
লন্ডনে এক শীতের রাতে রবীন্দ্রনাথের রেলযাত্রা ছিল বড়ই দুর্যোগপূর্ণ৷ তা ছিল এক আশ্চর্য ভ্রমণবৃত্তান্ত৷ ‘সেদিন বড়ো দুর্যোগ৷ খুব শীত, বরফ পড়িতেছে, কুয়াশায় আকাশ আচ্ছন্ন৷ যেখানে যাইতে হইবে সেই ষ্টেশনেই এ লাইনের শেষ গম্যস্থান, তাই নিশ্চিন্ত হইয়া বসিলাম৷ কখন গাড়ি হইতে নামিতে হইবে তাহা সন্ধান লইবার প্রয়োজন বোধ করিলাম না৷’ কিন্ত্ত রবীন্দ্রনাথ যে গাড়িতে উঠেছিলেন তা যে স্টেশনে ছেড়ে গিয়েছিল পরে সেই স্টেশনে এসে থামল৷ তিনি বুঝলেন সেটি খেয়াগাড়ি পারাপার করে৷ তাই ব্যতিব্যস্ত হয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নেমে পড়লেন৷ তিনি মোটা ওভারকোটের বোতাম গলা পর্যন্ত এঁটে স্টেশনের দ্বীপস্তম্ভের নীচে বেঞ্চের উপর বসে স্পেনসরের Data of Ethics সদ্য প্রকাশিত বইটি পড়তে শুরু করলেন৷ সাতটার সময় যেখানে পৌঁছবার কথা সেখানে পৌঁছতে সাড়ে ন’টা হলো৷
দ্বিতীয়বার কবি বিলেত যাত্রা করেন ১৮৯০ সালের ৭ সেপ্টেম্বর৷ ইউরোপের ব্রিন্দিশি বন্দরে পৌঁছে রেলপথে মেলট্রেনে প্যারিস যাত্রা করলেন৷ এই রেলপথে যাবার সময় গাড়ির দু’ধারের প্রাকৃতিক দৃশ্য কবিকে মুগ্ধ করতে করতে চলে৷ দুপুরে খাওয়া গাড়িতেই সারা হয়েছে ডাইনিং কারে৷ রবীন্দ্রনাথের ট্রেন সম্পর্কে বর্ণনা— ‘একটা মস্ত গাড়ি ডাইনে বাঁইয়ে সারি সারি কতকগুলো মকমল মোড়া জোড়া জোড়া মুখোমুখী ছোট seats মাথার উপরে শোবার বন্দোবস্ত লটকানো, বোধ হয় রাত্তিরে টেনে নিয়ে বিছানা করে দেবে৷ গড়িতেই খাবার সেলুন৷ একটা মাত্র নাবার ঘর আছে বোধ হয়— এত লোকে মিলে হাত মুখ ধোওয়া নাওয়া নিয়ে বোধ হয় কিঞ্চিৎ গোল বাধবে৷ যা হোক ট্রেনে চড়ে বসে বেশ নিশ্চিন্ত বোধ হচ্ছে৷’
এবার জানালার পাশে নিজের আসনটিতে এসে বসেছেন আরাম করে৷ রেলওয়ে স্টেশনে এক ইতালীয় যুবতীকে দেখে কবির মনে হয় এই সুন্দরীরা এখানকার আঙুরের মতই নিটোল সুগোল টসটসে এবং যৌবনরসে একেবারে যেন পরিপূর্ণ৷ কিন্ত্ত কিছু দূরে গিয়ে শুরু হয়ে গেল জলপাইয়ের বাগান৷ দেখতে দেখতে চলতে চলতে কখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল নেমে এল৷ শেষ ট্রেন, স্পেশাল ট্রেনে কবি প্যারিস পৌঁছলেন৷ কবির সঙ্গে ছিলেন মেজদা সত্যেন্দ্রনাথ, বন্ধু লোকেন পালিত৷
কবি ফ্রান্স থেকে লন্ডনে এসেছিলেন৷ একবার লন্ডনে তিন সপ্তাহ কাটিয়ে ১৬ এপ্রিল ১৯২১ সালে কবি প্রথম এরোপ্লেনে প্যারিসে এসেছিলেন৷ ডোভার থেকে রেলযান গ্রহণ করে লন্ডনে আসেন৷ সহযাত্রী সোমেন্দ্রচন্দ্রের স্মৃতি কথায় ‘ট্রেন-প্রকোষ্ঠে ইংরাজ যাত্রীগণ স্বদেশী সজ্জায় সজ্জিত রবীন্দ্রনাথের প্রতিভামণ্ডিত সৌম্যমূর্তির দিকে সোৎসুক দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল৷ হঠাৎ একজন ইংরাজ ধূমকেতুর ন্যায় কবির নিকট আসিয়া ভাঙা হিন্দুস্থানীতে অনর্গল বক্তৃতা আরম্ভ করিলেন৷’ কবি নীরবেই এ উৎপাত সহ্য করলেন৷ প্রতু্যত্তরে বললেন— ‘I have the honour to represent the Benglee Race whom you hate most.’ তখন ইংরাজ ভদ্রলোক হতভম্ব হয়ে নিজের আসনে ফিরে গেলেন৷
কলকাতা থেকে থেকে বেরিয়ে বাইশ দিন পর কবি লন্ডনে এসে পৌঁছলেন৷ ভ্রমণসঙ্গীরা ছাড়া কবির সঙ্গে এবার সবচেয়ে যে মূল্যবান সম্পদটি রয়েছে তা হল তাঁর গীতাঞ্জলির ইংরেজি তর্জমার পাণ্ডুলিপি৷ যা বই হিসাবে সাহিত্যে একদিন নোবেল পুরস্কার সম্মানে ভূষিত (১৯১৩) হবে৷ সেই পাণ্ডুলিপিই টিউব-রেলে যাবার পথে পুত্র রথীন্দ্রনাথের হাত থেকে হারিয়ে গিয়েছিল৷ গন্তব্যে পৌঁছে ট্রেন থেকে স্টেশনে নামার সময়ে ব্যস্ততার মধ্যে ওই মহামুল্যবান অ্যাটাচিটাই কবিপুত্র নামাতে ভুলে যান৷ রেলগাড়ির ইতিহাসে এটি সবচেয়ে বড় দুর্ঘটনা৷ পরেরদিন রেলস্টেশন থেকে সেই দুর্মূল্য পাণ্ডুলিপিখানি ফিরে পাওয়া গিয়েছিল৷ আর রবীন্দ্রনাথ শেষবার ইউরোপে যান ১৯৩০ সালে৷
বিশ্বকবি দেশে-বিদেশে বেশ কয়েক লক্ষ মাইল রেলপথে ভ্রমণ করেছিলেন৷ বিদেশে রেলগাড়িতে তার ভ্রমণে বিচিত্র অভিজ্ঞতার আস্বাদন পাওয়া যায়৷ পৃথিবীর যাত্রীবাহী রেলগাড়ির ইতিহাসে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল সকলের থেকে আলাদা৷ কেবল গন্তব্যে পৌঁছনো নয়, তার চেয়ে অনেক বেশি৷