পড়ার ঘরে রবীন্দ্রনাথ

সুব্রত চৌধুরী

গত ক’দিন ধরেই কাঠফাটা গরম পড়ছে, তার ওপর বিদু্যতের লুকোচুরি খেলা৷ ছাতিফাটা গরমে টিকে থাকাটাই দায় হয়ে পডে়ছে৷ ঘরে ঢুকতে ঢুকতেই অন্ত্ত ঘেমে নেয়ে উঠেছে৷

অন্ত্তর আজকে স্কুল ও কোচিং সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে৷ পড়ালেখার চাপে তার জেরবার অবস্থা৷ বাসায় ফিরে নাকে মুখে কিছু গুঁজেই আবার পড়ার টেবিলে৷ ক্লাসের ফার্ষ্ট বয় বলে কথা৷ কোথাও একটুকুন ফাঁক রাখার সুযোগ নেই৷ একটু ফাঁকি দিলেই চোখের পলকেই সব ফসকে যাবে৷
আর মার যা পুলিশী তদারকি, ফাঁকি দেওয়ার সুযোগই নেই৷তাই সব সময় তাকে দৌডে়র ওপর থাকতে হয়৷ পড়ালেখার পাশাপাশি সৃজনশীল কর্মকান্ডেও তার সক্রিয়তা কারো অজানা নয়৷ শহরের তুখোড় বিতার্কিক, আঁকিয়ে হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছে অনেক আগেই, গানের গলাও মুগ্ধতার আবেশ ছড়ানোর মতো৷ বিশেষ করে রবীন্দ্র সংগীতটা সে বেশ ভালোই গায়৷


স্কুলের হোমওয়ার্ক শেষ করতে করতে ঘডি়র কাঁটা দ্রুত এগিয়ে যেতে থাকে৷ গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ঢং ঢং শব্দে রাত নিশুতির কথা জানান দেয়৷ অন্ত্ত ঘন ঘন হাই তুলতে থাকে, চোখ দুটোর পাতা মুদে আসে৷হঠাৎ কাঁধে কারো হাতের ছোঁয়া পেয়ে সে পেছনে ঘাড় ফিরিয়ে তাকায়৷অন্ত্ত নিজের চোখকেও যেন বিশ্বাস করতে পারে না৷ প্রথমে সে ভেবেছিল ঘুম ঘুম চোখে ভূল দেখছে না তো! ভালো করে চোখ দুটো রগড়িয়ে নেয় ৷ না ঠিকই তো , লম্বা জোব্বা গায়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার দিকে তাকিয়ে মিটিমিটি হাসছেন৷

অন্ত্ত অবাক চোখে জিজ্ঞেস করে, রবিদাদু তুমি?
: হ্যাঁ, বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি?
– সত্যিই দাদু বিশ্বাস হচ্ছে না৷
: বিশ্বাস না হবারই কথা৷
– পাশের চেয়ারটাতে বসো রবিদাদু৷
: তা এতো রাত পর্যন্ত কী পড়ছো? চেয়ারে বসতে বসতে রবি দাদু জিজ্ঞেস করেন৷
– স্কুলের হোমওয়ার্ক রেডি করছি৷
: তাইতো দেখছি, গাদা গাদা বইতে টেবিল তো ভর্তি করে রেখেছো৷
– বেশিরভাগই তো দাদু রেফারেন্স বই৷
:তাই!
-হ্যাঁ দাদু৷
: বইয়ের পড়া পডে় কী কেউ সত্যিকারের মানুষ হয়েছে খোকা?
-তাহলে?
: ইন্দ্রিয়চর্চা করতে হবে৷
-কীভাবে ইন্দ্রিয়চর্চা করবো?
: ইন্দ্রিয়চর্চার জন্য যেখানে খুশি ঘুরে বেড়ানো, ঘোড়ায় চড়া, মাছধরা, নৌকা বাওয়া, লাঠি-সড়কি খেলা, সাঁতার কাটা, ঘর গোছানো, রান্নায় সহযোগিতা করা ইত্যাদি বিষয়ে মনোযোগী হওয়ার কোনো বিকল্পই নেই৷
-বেশ ইনটারেস্টিং তো! কিন্ত্ত শহরে এগুলো কোথায় পাবো?
: তাইতো বলি সুযোগ পেলেই তোমাকে গ্রামে যেতে হবে৷ শহরের ছেলেমেয়েদের চেয়ে গ্রামের ছেলেমেয়েদের ইন্দ্রিয়ানুভূতি তুলনামূলকভাবে প্রবল হয়৷ কারণ, ব্যতিক্রমহীনভাবে তারা ওই অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়েই বেড়ে ওঠে৷
-হুম৷
: তাছাড়া …
-কী দাদু?
: তোমরা তো প্রকৃতি থেকে শিক্ষা পাও না৷
-ঠিক বলেছো দাদু৷
: প্রকৃতি থেকে শিক্ষা নিলেই সত্যিকারের মানুষ হতে পারবে ৷
– তাই!
: হ্যাঁ ৷ তুমি শিলাইদহ কখনো গেছো?
-কুঠিবাড়ির কথা বলছো?
:হ্যাঁ ৷
-বছর দুয়েক আগে মার সাথে রবীন্দ্র জয়ন্তী পালন উপলক্ষে
শিলাইদহ গিয়েছিলাম৷
: কুঠিবাড়ির পশ্চিমদিকে যে পুকুরটি আছে সেটা দেখেছো?
-হ্যাঁ দেখেছি৷ পুকুরপাড়ের শান বাঁধানো ঘাটে বেশ কিছুক্ষণ বসে কাটিয়েছি৷
: পুকুরপাড়ের সেই শান বাঁধানো বকুলতলার ঘাটে ফুলের সৌরভে ও পাখির কলরবে গান ও কবিতা লিখতাম৷
-শান বাঁধানো ঘাটটি আমারও খুব পছন্দ হয়েছিল৷ সেই ঘাটে বসে আমি তোমার অস্তিত্ব অনুভব করেছিলাম৷যেদিকেই তাকাচ্ছিলাম দেখতে পাচ্ছিলাম যেন ‘তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা৷’ আর কানে বাজছিল তোমার গানের সেই সুমধুর সুর “যখন পড়বে না মোর পায়ের চিহ্ন এই বাটে”৷
: পদ্মার বুকে যে বোটে আমি ভেসে বেড়াতাম সেই পদ্মাবোট তো নিশ্চয় দেখেছো৷
– হ্যাঁ দেখেছি৷
: ওই পদ্মাবোটে পদ্মার বুকে চড়তে চড়তেই তো গীতাঞ্জলি কাব্যসহ অন্যান্য কাব্য রচনা করেছি৷ শিলাইদহেই আমি গীতাঞ্জলি কাব্যের ইংরেজি অনুবাদ শুরু করি৷
-আর সেই গীতাঞ্জলি কাব্যের জন্যই তো তোমার নোবেল পুরস্কার পাওয়া৷
:ঠিক বলেছো৷
-তোমার গর্বে আমরা দু’বাংলার বাংগালিরা গর্বিত রবিদাদু৷ তোমার জন্য বিশ্বসভায় আজো আমরা মাথা উঁচু করে চলি৷
:শান্তিনিকেতন গেছো কখনো?
-না,যাওয়া হয়নি, তবে যাওয়ার খুব ইচ্ছে আছে৷
কথা বলতে বলতে গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটা ঢং ঢং শব্দে
রাত নিশুতির কথা জানান দিতেই থাকে৷ আর তা শুনে রবিদাদু বলেন, কালকে সকালে তো তোমার স্কুল আছে, তাই না?
-হ্যাঁ ৷
: এখন ঘুমোতে যাও৷
-ঠিক আছে৷
: আমি আসছি৷
-তোমার সাথে কথা বলে আমার খুব ভালো লেগেছে রবিদাদু৷
: আমারও,আসি৷
-আবার এসো রবিদাদু ৷
হঠাৎ মার গলার শব্দে অন্ত্ত সম্বিৎ ফিরে পায়৷
:কিরে রাত ক’টা বাজে খেয়াল আছে? এখনো ঘুমোতে যাসনি?
-যাচ্ছি মা৷
:এতোক্ষণ কার সাথে কথা বলছিলি?
-কই! কারো সাথে না তো৷
: আমি তোর ঘরে ঢুকতে ঢুকতে শুনতে পেলাম তুই কারো সাথে কথা বলছিস৷
-রবিদাদুর সাথে মা৷
: কী! তোর কী মাথা টাথা খারাপ হয়ে গেছে?
-মাথা খারাপ হবে কেন মা?
: কবিগুরু সেই কবে মারা গেছেন! আর তুই বলছিস কিনা…
-সত্যি মা, রবিদাদুর সাথেই কথা বলছিলাম৷
: সত্যি! মা ভেংচি কাটতে কাটতে বলেন৷
-‌ে তামার বিশ্বাস হচ্ছে না মা?
: আর বিশ্বাস করতে হবে না৷যা, এখন ঘুমাতে যা, অনেক রাত হয়েছে৷ আমি দরজাটা বাইরে থেকে ভেজিয়ে দিচ্ছি৷
অন্ত্ত খাটে শুতে গিয়েই হঠাৎ তার চোখ আটকে যায় পড়ার ঘরের দেওয়ালে ঝুলানো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবির ওপর৷ কবিগুরুর ছবিটার ওপর তাজা ফুলের মালা ঝুলছে, মা কখন যে পরিয়ে দিয়েছেন৷ রাত পোহালেই তো রবীন্দ্র জয়ন্তী৷
ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যেতে যেতে অন্ত্তর কানে বাজতে থাকে, “আমার প্রাণের মানুষ আছে প্রাণে…, আছে সে নয়নতারায় আলোকধারায় …৷”