কোহরা-নগর
সুপর্ণশু
১
খেয়ে ফেলছে ধীরে ধীরে ঘুণ
অর্কিডে ছড়িয়ে আছে অলীক জ্যোৎস্নার জল, আগুন।
২
কথার ঝাঁকে লুকিয়ে থাকে আকাশ
আলো- আঁধারি প্রচ্ছদ,
ক্ষতবিক্ষত চিত্রখণ্ডের ব্যঞ্জনা…
৩
মৃত স্বপ্নেরা ঘুরে বেড়ায় প্রেতের মতো,
বিষাদের রঙ এখানে সেপিয়া
মাঝরাতে বধ্যভূমিতে— পুড়তে পুড়তে খসে পড়ে কত পৃথিবী
জানে শুধু অলীক মানুষ।
৪
এখানে বসন্ত বড়ো প্রলুব্ধ
মায়াজাল বিছিয়ে রাখে উদ্বেল রোদে, আনমন জ্যোৎস্নায়,
শিকড়ে শিকড়ে রাখে প্রাগৈতিহাসিক সনাতনী আগুন…
৫
এ বিদর্ভ নগর জানে— ক্ষমতার বলয় কখন ত্রাস নয়,
নান্দনিক সৌন্দর্যের বিরল বয়ান…!
৬
যৌনতার নীল আস্বাদি দ্রব মিশে
গোপন আকাশে ফোটে মেকি প্রেমের জমকালো রঙ…
প্লাস্টিকের ফুল কিংবা কাগজ-ফুলের এখন চাহিদা ভীষণ!
৭
অন্তরালে বৃক্ষেরা পোড়ে
তারপর—
বিভূতি হয়ে উড়ে যায় হতচকিত হাওয়ায়…
হৃদয়স্পর্শী শব্দেরা মিশে থাকে শুধু ধুলোর সংসারে।
৮
কখনও ভেঙে পড়ে শ্যামা আকাশ;
অনন্ত গভীরে বাঁক নেয় নরকপথ
নরখুলি,পশুর কঙ্কাল নিয়ে চলে যজ্ঞ, ভন্ড আচার…
সারা শরীরে ক্ষত, ধ্বংস চিহ্ন নিয়ে বসে সব দ্যাখে, রাতের পৃথিবী।
৯
এ যে রুক্ষ, বন্ধ্যা…
হেরে যাওয়া তারাদের আর্তনাদ-কান্না-গ্লানিতে ভারী হয়ে থাকে স্থানীয় বাতাস…
১০
কথারা এখানে একান্তে পুড়তে পুড়তে হয় ভস্ম: শোনার সত্তারা বিলুপ্তপ্রায়!
নিজের জগতে মজে থাকে খণ্ড-ক্ষুদ্র পৃথিবী…
ছাইপাহাড়ের পাশে— মেঘ নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে অচেনা আকাশ।
১১
অলিতে গলিতে শীর্ণ ছায়া…
বীতশ্রদ্ধ হাসির সোঁতা…
কুয়াশার চিঠিতে লেখা দিন রাতের সমাচার
যতদূর দেখা যায় শুধু রণভূমি।
১২
মরচে পড়া আলোয় এখানে বড়ো আবছা লাগে পথ…
ডানা ঝেড়ে ফেলে ধুলো…
মোছা কি সহজ হবে তবু— …নারকীয় সঙ্গমের বিব্রতকর স্মৃতি !
আঁধারি গন্ধ,জন্মান্ধ শব্দের দাগ…
১৩
এ নগর জানে, জীবন নিয়ন্ত্রিত শুধু সংগ্রামী শর্তে…
বাকি সব মিথ্যে; ভনিতামাত্র।
১৪
আলোর ভেতরেও রিরংসার রঙ বোনা…
পাতালে নিখোঁজ হয় সর্বভুক আগুন
পাতা, ফুল খসে রহস্য সংকেতে…
বাকি,সবটুকু ভ্রম !
১৫
এখানে ফিনিক্স পাখির মতো পোড়ে ক্যালেন্ডারের তারিখ…
আগুনের কোলাহলে চাপা পড়ে থাকে স্বর…
১৬
জুলুম নামের মেটাফোর শব্দটার মহিমা
এ বৈকুন্ঠনগরও জানে ,
যেমন তুষের আগুন জানে— শব্দেরা হতে পারে কতটা বিস্ফোরক।
১৭
সস্তা কথার ভারে নুইয়ে পড়ছে প্রাজ্ঞ আকাশ,
ভাঙা শিরদাঁড়া নিয়েই বাঁচে সপ্তর্ষি থেকে কালপুরুষ…!
১৮
অন্ধকার অশান্ত সমুদ্রের মতো যদি ধেয়ে আসে
গিলে খাবে উপকূল ,জানে সবাই-
পৃথিবীর হিংস্র জিভের স্বাদকোরকেরা যেমন জানে
নোনারক্তের স্বাদ তার কতটা পছন্দের…!
১৯
ভাঙা যন্ত্রাংশ শরীরের আঁকেবাঁকে থিক থিক করছে অন্ধকার।
আহত শব্দের ক্রুদ্ধ আগুনে শাণিত হচ্ছে অস্ত্রেরা।
২০
নগরের প্রতিটা দিন রাত বুঝে গ্যাছে এতদিনে—
রঙিন মাছেদের ধড়, মাথা, খুবলে খায় কেন রাক্ষস…
কথার গন্ধে মিশে থাকে কেন প্রতিশোধের উত্তাপ…
তামাটে রঙের বিকেলে আলোর দেবতারা নামে
ওঁদের ঠোঁটে ও প্রস্ফুটিত হয়ে আছে জবাব।
দুটি কবিতা
সুমিত্রা পাল
একাকিত্ব
একাকিত্ব খোদাই করি মনের মন্দির গাত্রে
একাকিত্ব যন্ত্রণার নয় বরং স্বস্তির!
বিপদসীমা থেকে নিজেকে নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে রাখার
এক অভিনব চাবিকাঠি,
অথবা মরণ ভুলে আবার বেঁচে ওঠার জিয়নকাঠি।
একাকিত্বের প্রতিটি কক্ষে, অলিন্দে
মহাপুরুষদের অমৃত বাণী,
উদাসী বাউলের গাবগুবি ধ্বনি…
বর্তমানের প্রতিটি ঠিকানায় রেখে যায়
ভবিষ্যতের যোজন ব্যাপী দুরত্ব।
একাকিত্ব মানে নিজের সঙ্গে নিজের একান্ত অভিসার
একাকিত্বের জন্য আমি নিজের অজানা
প্রতিটি আমি’র সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংবদ্ধ;
সারাজীবন তাই আমি ইচ্ছাকৃত একাকিত্বে আত্মমগ্ন।
উপসংহার
নিজের মতো করে নিজেকে খুঁজতে গিয়ে
কান পাতি ঝরা পাতার মর্মর ধ্বনিতে,
যেখানে শুধু অব্যক্ত কথার প্রতিধ্বনি।
খিড়কি থেকে সিংহদুয়ারের সংকীর্ণ পথ জুড়ে
একদিন লিখে রেখেছিলাম
ঝড়-ঝঞ্ঝা উপেক্ষা করা যে দুর্দম অভিযাত্রীর
বিরামবিহীন রোজনামচা—
তাতে যতই থাকুক শুঁয়োপোকা থেকে প্রজাপতির রূপান্তরণ,
লোদ্রভা থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার
শ্বেত-শ্যাম অবগাঢ়তা;
সময়ের নিরিখে তা শুধুই সাময়িক প্রতিবেদন।
আগামীতে সেই স্থানটুকু জুড়ে থাকবে
ধূসর রঙের উপসংহার!
পা
শক্তিপ্রসাদ ঘোষ
আরাম করে পা রাখতেই
কেঁপে উঠলো বন
জল খাবার গ্লাস ভেঙে চুরমার
নাচন থামতে শিশিরবিন্দু
কেঁদে ওঠে
ঝরা পাতার গান
ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে রাত জাগা
আমি বাইরে পা রাখি।
দুটি কবিতা
শুভজিৎ বসু
ছুঁয়ে যায় শহর
শুকনো আদরে কীকরে শহর ভিজবে
কালো দিগন্ত কীভাবে পুড়বে জীবনের তাগিদে!
না, কেউ একদিন উপড়ে ফেলবেই শহরের জ্যোতি,
শহরের দৃষ্টি ধূসর হলেই তো সব কিছু শেষ হয়ে যাবে আস্তে আস্তে,
এভাবেই তো পুঁতে দেবে ওরা পাড়া, গ্রাম, শহরের গায়ে ক্রীতদাসের বীজ।
সকাল হলেই যেখানে নারী-পুরুষরা অলস হয়ে যাবে,
দুপুর নামলেই হত্যার ক্রোধ মানুষকে অন্ধ করে দেবে,
ছদ্মবেশী হাতগুলো মন্দিরের থেকে ছিনিয়ে নেবে কৃপার আঁচল,
ভ্রান্ত ইশারায় দুনিয়া চিবিয়ে খাবে পুষ্পিত অন্ধকার।
মৃত্যু ছায়ার চিত্রিত বাদলে ভালবাসা ফিরে যাবে আপন নীড়ে,
দুঃখের বিপুলতা ছুঁয়ে যাবে শহরের সব জানালাকে,
খরস্রোতা-শরীর হয়ে ভেসে যাবে শহরের সব ঠিকানা,
অবরোধের তিমিরে শহরের গায়ে শেষ ছন্দ দেবে মৃত্যু।
দার্জিলিং
হোটেলের ধারের রেলিংটা ছুঁয়ে জেগে ওঠে সকাল
সাদাটে মেঘ নেমে আসে ম্যালের সিঁড়ি বেয়ে,
আমি বেরিয়ে পড়ি জানালা দিয়ে পাহাড়ের নীরব দেশে,
সেখানে লুকোচুরি খেলে তীব্র সুখের ভেঙে যাওয়া বিবাদ।
চিত্তরঞ্জনের ‘স্টেপ অ্যাসাইড’ স্মৃতির চিৎকারে ধূলো ওড়ায়,
দুপুরের মন স্টেশনে ‘রায়ভিলা’ খুলে দেয় অপত্য স্নেহের দরজা,
পাহাড়ের রানি শ্যামলী জোছনায় চাঁদের রঙ মাখে শহরে,
ঘুম স্টেশনের ফ্যাকাসে রোদে বুকে জন্ম নেয় পৃথিবী।
কাঞ্চনজঙ্ঘা হাত বাড়িয়ে ডাকে মধ্য দুপুরের সবুজ প্রান্তরে,
আমি গুছিয়ে নেই স্বপ্ন, মেঘে মিশে যায় ফূর্তির আনন্দ-রঙ।
শীতের চাদর উড়িয়ে দিনের মধ্যিখানে প্রকৃতি সেরে নেয় স্নান,
গভীর পাওনায় গান ও কবিতা হয়ে ওঠে দার্জিলিংয়ের দু’পাশের সৌন্দর্য,
ভানুভক্ত হাতে বই নিয়ে ঐতিহ্যের আলোয় ভালবাসা বিলিয়ে যান অবিরাম,
শীতল শিশির রোপওয়ের গা ভিজিয়ে দেয় পাহাড়ের পেলব উল্লাসে,
পুরো দার্জিলিং শহরকে মনে হয় মিকেলাঞ্জেলোর ক্যানভাস।
গানশূন্য
হাবিবুর রহমান
পাখিরা নেচে উঠতে পারছে না এখন
নরম চাদর বিছানো বিছানায় গোলাপগুচ্ছের কাঁটা ফুটে আছে
এখানেই ঝরে পড়েছিলো একসময় মুক্তোর হাসি
আমার হাতে
একতারা ছাড়া আর কোনো বাদ্যযন্ত্র নেই
এখন গান গাইতে পারি না বসন্ত কোকিলের
মধ্যরাতে শহরগুলো
খুব অসুস্থ হয়ে পড়ছে
যদি দুঃখ কিনে নিয়ে যাও ফুল দিয়ে
বেআব্রু রাতে গান শোনাবো তোমাকে
ধূসর এই পৃথিবী যখন গানশূন্য।