• facebook
  • twitter
Sunday, 22 December, 2024

কবিতা গুচ্ছ

একটা হাত ক্রমশ এগিয়ে এলো হাতের পিছনে একটা শরীর শরীরের নির্ঘণ্টে বাঁধা মন বা বিপরীত ঋতু। অক্ষরের দিকে যেমন ঝুঁকে আসে কলম অথবা আলোর পানে ছায়া।

কয়েক পঙ্‌ক্তি

গৌতম হাজরা

১.
পর্দা সরালেই অপরাহ্ন, লম্বমান ছায়ার কোলাজ
আকাশমাখা কাকলি, ছলাৎছল কল্লোল
বিকেলের প্রবেশপথে আর এক প্রাক-দুপুর
জল অধ্যায়ে খেলা করে ওই ঢেউচূড়া।

২.
চারপাশে নিখিল আনন্দ আনন্দ
পঙ্‌ক্তিমালার মধ্যে জলছোঁয়া প্রভাত
বয়ে যাচ্ছে জলেরই শূন্যতায়
কেবল দু’পাশে সাদা বালুচর, শীর্ণতোয়া স্রোতাশ্রয়
মাছেদের গান শোনায়!
৩.
এ যেন অবসরকালীন দৃশ্যপিয়াস
অভ্যাস আগলে স্পর্শ
সুখ বলতে এখন মেঠোপথের রতিরঙ আর
টেক্সট বুক জুড়ে শুধু চড়াই উৎরাই!

 

ভিজে মাটি আর ঋতুজল

রবীন বসু

যেখানে বসেছি জল, ভিজে গেছে মাটি
আমার পোশাক ভিজে, তোমার তো ঋতুস্নান!
অপ্রস্তুত দিনমান, বিকেলও মনমরা হল
এ-সময় বসি চল উষ্ণ কোনও কফির ক্যাফে
পুরনো দিনের গন্ধ আর যত স্মৃতি ফালাফালা
ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে আমাদের সাঁতার আলাপ
বিদেশ ভ্রমণে গিয়ে বন্ধুর উৎফুল্ল ফোন
আমার আর্থিক কষ্ট তোমার সাজানো ড্রইংরুম
এই চিত্রলতা, বিফলতা আর সৌভাগ্যের ছবি
বিকেল সহাবস্থানে আছে; যাবতীয় ভুল স্বপ্ন
রাত্রিশেষে উড়ে যাবে গ্রহান্তিক বিন্যাসে—
বিমূঢ় বিষাদ নিয়ে নক্ষত্রেরা আছে ন্যুব্জ
যেখানে বসেছি আমি, তুমিও সেখানে বসে
শুধু ভিজে মাটি আর ঋতুজল সারাৎসার!

 

প্রতিশোধ নেবে

সজল দে

লড়াই শুরু হয়েছে আজ নয়
শেষ হবার কথাও আজ নয়
যতদিন আছে পিশাচেরা,
নরকতন্ত্রের ধারক ও বাহকেরা—
লড়াই চলবে
চলবে প্রতিবাদ

রাজা যাবে
রাজা আসবে নতুন জামা গায়
মন্ত্রী পাল্টাবে, আমলা বদলাবে
বদলে যাবে
প্রহরী-শান্ত্রী-সমাজশাস্ত্রী
পতাকার রঙ হবে কিছু ফিকে

দিকে দিকে
লড়াই চলবে স্বাধীনতার
অধিকারের লড়াই চলবে
যতদিন না
আমার মেয়ের কালশিটে, রক্তদাগ
যথাযথ প্রতিকার পাবে
দুর্দম প্রতিশোধ নেবে

লড়াই শুরু হয়েছে আজ নয়
শেষ হবার কথাও আজ নয়
পিশাচেরা আজও আছে

আশ্রয় 
সুনন্দ অধিকারী  
প্রতিটি ব্যর্থতা আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে
আমারই দিকে,
বুঝেছি মুখোশ কতখানি —
আর কতটুকুই বা মুখশ্রী;
নিজ মুখের আমার।
সুখ্যাতি পেয়ে পা পিছলে পড়তে পড়তে
যে কবিতাটা ফেরত এসেছে,
                    অমনোনীত হয়ে—
বাড়িয়ে দিয়েছে সেই হাত।
সেদিন মর্মোদ্ধার করতে পেরেছি কথা
  ঝরাপাতার:
‘আমিই বৃক্ষকে মৃতসঞ্জীবনী সুধা পাঠাই!’
সেদিন শূন্য এসে বলে গেছে:
‘সবাই তারা আশ্রয়ী এক থেকে নয়,
আমিই আশ্রয়।’

দাম

কিরণময় পাত্র

একটার পর একটা ঘোষণা আসে—
ঘোলা হয় চোখ,
বুকের ভিতরে এও এক শোক।

সময়ের স্রোত বেয়ে ঘোষণা ফুরায়,
বসে থেকে নিরাকার সময়ের কিনারায়।

ঘোষণার ঘূর্ণিতে ঘোলা ভাব কাটে,
আবেশ কাটিয়ে আবারও— সে মাঠে।

শস্য সাজিয়ে ছুটি জীবনের হাটে,
সবাই বাজার দরে—
যে যেমন কাটে!

 

পরমা প্রকৃতি

অমিতাভ দাস

চণ্ডীপাঠের ভিতর থেকে একটা মানুষ
খুঁজে আনছে তাহার অতীত।
তাহার সাদা-কালো পাখির জীবন।
ভোর তাকে অবগাহন শেখায় শ্লোকের মত
ছড়িয়ে যায় বিদ্যা, অবিদ্যার সংসারে।
হূদিপদ্মে বাসনার এক চিলতে মেঘ,
ছিন্ন পোশাকের মায়া নিয়ে দূরগামী অব্যয়…
ধ্যানমুদ্রায় দেখি চরাচর ভাসমান,
ইতি মার্কণ্ডেয় উবাচ অথ সপ্তম অধ্যায়…
ইত্যাদির পর, কী ছিল লীলাময়, যা তুমি
রহস্যে রেখেছো… একটা ট্রেন… একটা মাধবী লতা…
একটা বালক…
একটা কাঁটাতার…
ক্রমশ ইথারে ভাসতে ভাসতে, ভাসতে ভাসতে…
অখিল ব্রহ্মময়ী, পরমা প্রকৃতি, শক্তিভূতা সনাতনী

 

ভাষার উদ্যানে

কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়

আরো একবার জন্ম নিক সাহস
ভীরুতার অন্ধকার ঠেলে আরো একবার
উঠে আসুক সে ঊষা
ভোরাইয়ের সুরে প্রাণ ভরা শুভেচ্ছা জানিয়ে
সূর্যকরোজ্জ্বল একটা গোটা দিন
খেলে বেড়াক দিক-দিগন্তের অন্বেষণে
আমরা কী পারি আরো একবার প্রমাণিত হোক প্রিয়
আরো একবার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠুক
মনোরমা ফুলের সৌরভ
আলোকিত সে ছড়িয়ে যাক
সভ্যতার শিরায় শিরায়
মূক ছেড়ে মুখরের দিকে অনায়াস ভঙ্গিমায়
বাঁচতে ও বাঁচাতে
নির্দ্বিধায় সন্ধে ও সকাল
রাত্রির জটিলতা শেষ করে হিরণ্ময় ভাষার উদ্যানে।

 

ধুলো পড়া প্রেম

অবশেষ দাস

পুরনো চিঠির মতো ধুলো পড়া প্রেম
বর্ষার ঝাঁপি থেকে নেমে যায়, খেয়াঘাটে
প্রেমের কবিতা হয়ে বর্ষাকে সান্ত্বনা দেয়।

পুরনো চিঠির মতো পড়বার সাধ জাগে।
সংসার হাত টেনে ধরে।
বাসের পাদানি ধরে দাঁড়িয়েছে, ধুলো পড়া প্রেম
শহরের জ্যাম ভেঙে হাত ধরে হেঁটে গেছে
পার্কের ভিড়ে।
ধুলো পড়া গল্পের বই খুলে দেখি,
মলাটে লেগেছে ধুলো,বয়সের ছাপ।

ভেতরের পাতাগুলো আলো হয়ে আছে।

 

অতিক্রমণ

দেবার্ঘ সেন

বিরহকে শ্রদ্ধা করি কবিতার মতো
কবিতাকে ভালোবাসি বিরহের মতো।

এভাবেই অক্ষরলাভ করলে জীবন,
হৃদয়ের ভুট্টাক্ষেতে তোমাকে পাই।

রাত্রির আকাশ থেকে, রবিবার ঝোলে
মৌলবাদের আসর ভেঙে
তীব্র উঠে আসি—

জ্যোৎস্না কেটে কেটে, রাস্তা পেরোই
ভালো লাগা না লাগা, একান্তই খুন্তিগত বিষয়।

 

একটা বৃষ্টিভেজা ফুল

বিনীতা দত্ত

একটা বৃষ্টিভেজা ফুল জারুলের গাছ
হাওয়া ছুঁয়ে দিলে কিছু ফুল তার ঝরে পড়ে মাটিতে
কিছু ফুল যত্ন করে ধরে থাকে ডাল।
কখনো তুমি এসে বসো তার নিচে
ফুল নিয়ে ছায়া মেখে
সংগোপনে ফিরে যাও অন্য চেনা পথে;
কখনো আমি গিয়ে বসি তার নিচে
ছায়া মেখে ফুল নিয়ে
গোপনেই ফিরে যাই তোমার ছায়াপথে।

একটাই ফুল জারুলের গাছ
তোমার আমার মাঝে
বেড়ে উঠছে যত্নে অযত্নে স্বপ্নে সংগোপনে।

কোনোদিন একসাথে যাবো ওর কাছে
ছায়া দিতে ফুল দিতে
অন্য সব গাছেদের চোখের সামনে।।

 

ভাসমান

সুকান্ত পাল

উত্তরের জানালার পর্দাগুলো উড়ছে,
নদীর পারের মরা কাশফুল
উড়িয়ে এনে হিমেল বাতাস
আছড়ে পড়ে ঘরের মেঝে জুড়ে।
সেই বাতাসে কি ভাঙনের সুর?
বুঝে উঠতে পারিনি। শুধু দেখেছি
অবাঞ্ছিত ধুলোর‌ নিচে গৃহবাসীদের
ব্যক্তিগত উপাখ্যান সমূহের রক্ত নীল হতে হতে
কালচে হয়ে গেছে অনেক আগেই।
এবং আমি অভিযোগহীন সম্পর্কে
ভেসে থাকি অনায়াসে
মায়াদর্পণে চোখ রেখে।

 

হাত

অয়ন ঘোষ

একটা হাত ক্রমশ এগিয়ে এলো
হাতের পিছনে একটা শরীর

শরীরের নির্ঘণ্টে বাঁধা মন
বা বিপরীত ঋতু।

অক্ষরের দিকে যেমন ঝুঁকে আসে কলম
অথবা আলোর পানে ছায়া।

এগিয়ে আসছে নীরব দ্রুততায়
একটি হনন কাল।
পতঙ্গ জানে এর গভীরতা
নিজের অজান্তেই রেখে যায় একটি কথন—

ভালোবাসার ওপারে আছে মৃত্যু।

আর মৃত্যুর ওপারে এক দীর্ঘ নক্ষত্র জীবন
প্রসারিত করে রেখেছে দুটি অনন্ত হাত।

 

অনুরাগ

বঙ্কিমকুমার বর্মন


প্রার্থনা রেখো দেহে, রেখো অনুরাগী মন
সহজ বাক্য জুড়ে পাখি ডেকেছে তখন
রোদের ফিসফাস, অজস্র অভাবের ঘাম
রঙ মেখে দাঁড়ায় ওবেলা, নয়নাভিরাম
এই নাও শান্তিজল, মাথায় ছিটিয়ে
ফুল ভেবে, ছড়াবে মেঘ তোমাকে পেয়ে।


জানো কতদিন পরে এলো বঁধুয়ার পাখি
বিষণ্ণতা উড়িয়ে শূন্যে এঁকেছে আঁখি
তবু ধীর, যেন উন্মাদ ভোর কল্পনা প্রখর
লিখেছে সে দীর্ঘশ্বাসে— যন্ত্রণার আকর
ফেরানো দায়,‌ সেইসব কথার অভিমান
প্রতিবাদী স্বরে, রেখে যায় সমস্ত প্রস্থান।