• facebook
  • twitter
Monday, 13 January, 2025

কবিতা গুচ্ছ

একএক করে সবাই যখন সরে যায় জলও নেমে যায় আর তখন ফুটে ওঠে পায়ের চিহ্ন কার পায়ের মাপে গোড়ালির গর্তে জমা ঘোলাটে জল কেন চিহ্নিত করে আমার থাবা থেকে কবেই সরে গেছে থাবার নখগুলি একটা কাদার দেয়ালে জুতসই ক্যানভাসে অর্ধসমাপ্ত

প্রতীকী চিত্র

মেঘযুদ্ধ ও দ্রৌপদীর নিঃশব্দ বিলাপ

সুকান্ত মণ্ডল

১.
তোমার দীর্ঘ চুলে জমেছে মেঘ
তাতে লেখা বজ্রকাব্য
আঙুলে জড়িয়ে থাকে শূন্যতার শাদা উল,
হাওয়া ঘুরে ঘুরে খোঁজে শাশ্বত অন্ধকারের শূল।

রক্তের নক্ষত্র দিয়ে আঁকা মহাভারতের গোপন মানচিত্র,
একা একা দাঁড়িয়ে থাকো চিরকালীন আদালতে।

বস্ত্রহরণের প্রতিটি থ্রেডে লেখা থাকে নীরবতার প্রতিবাদ

পাঁচজনের মুখে খুঁজে চলা একমাত্রার শূন্যতা।

২.
যুদ্ধের মেঘ ঘনিয়ে এলে
যে সাদা পায়রাটা উড়তে ভুলে যায়
যুধিষ্টিরের চোখে আজ সেই ক্লান্তি।

পাশাখেলা থেকে জন্মানো মিথ্যার বিষাক্ত ফুলগুলো
হেমন্তের বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে—
চোখে জল, হাতে রক্ত।

ধরিত্রীর কান্নার শব্দে জেগে ওঠে গোপন পরাজয়

পাণ্ডবেরা ভুলে যায় ধর্ম,
আর গঙ্গার বুকে ভেসে যায় বিষণ্ণতা

আজও কোনো দ্রৌপদী খুঁজে পায় না ন্যায়ের শীতলছায়া।

 

সংকলন
সমর সুর
যৎসামান্য বৃষ্টি চেয়েছি
এর বেশী আমি কোনদিন চাইনি।
সে তুমিও জানো, শ্রাবণ জানে।
নিরাময় ডাক্তারের চেম্বার থেকে
বৃষ্টি শুরু হল আজ। জল মহার্ঘ।
আমাদের জীবন সুখী দম্পতির মত মার্বেল দিয়ে ঘেরা।
এখন আর মাটির স্পর্শ পাই না।
বৃষ্টি নামলে মনে পড়ে প্যান্টের পকেটে
ছিল চতুর্দশীর চাঁদ ও ওষুধের প্রেসক্রিপশান।
ঘুণে কাটছে নিমকাঠের আলমারি, ভয় পাই।
তড়িঘড়ি তুলে রাখি
পাঁজরের সেল্ফে ভীষণ প্রিয় পথের পাঁচালী ও
হেডমাস্টারের মেয়ের একমাত্র ছবি।
সোনার গ্রহাণু
সৌমেন্দ্র মুখোপাধ্যায়

ভেসে গেল এসে ভরা কল্লোল
ফেরেনিকো সুখপাখি,
জোছনার রাতে নিশি গেল ডেকে
আগমনী লিপি রাখি।
তুমি বলেছিলে কোনো প্রতিক্ষণে
কারা যেন ফিরে আসে,
বাসনার ছলে নিবিড়ে নিকটে
ঘন মেঘমালা ভাসে।
মেঘমালা ছুঁয়ে উড়ে যায় মন
পরীযান পরীযান,
অচেনা নীহার ছুঁয়ে যায় গাল
দিয়ে অনাহুত ঘ্রাণ।
শূন্যের স্রোতে একা ভেসে ভেসে
আকাশের আরো কাছে,
সোনার গ্রহাণু দূরে সরে থাকে
ভেঙ্গে ফেলি তাকে পাছে।।

ট্রাম
অর্ণব সামন্ত

আজ দুজনেই ইতিহাসের পথে
সূর্যাস্তের লাল রঙ ক্রমশঃ ধূসর
ধূসর পান্ডুলিপির মতো সমস্ত হারায়
বাঙালির নস্টালজিয়া নড়ে ওঠে
হৃৎকমলে রিনটিন রিনটিন মল্লারের সুর
অর্কেস্ট্রার মতো বেজে ওঠে দিবারাত্রির কাব্য
অহংকারকালীন সন্ধ্যা ডুবে যায় গঙ্গাপারে
দু’টির কোলাজ ফুটে ওঠে হৃদয় আর্কাইভে
বিষাদের সুর লেগে থাকা মায়াবিজড়িত
দুই জলছবি জীবনানন্দ ও ট্রাম


কখনো টানাসুরের মতো সে
কোলকাতার হৃদয় এফোঁড় ওফোঁড় করেছে
ভোর দুপুর সন্ধ্যাকে দিয়েছে নান্দনিক ধীরগতি
এই ঘন্টি কৈশোরে বেজেছে স্কুল পিরিয়ডের ফাঁকে ফাঁকে,
প্রেমের সাক্ষাতে বেজেছে যৌবন কলতানে
চিনেবাদাম খাবার ছলে চোখাচোখি, প্রোপোজ
জীবনের পড়ন্ত বেলায়ও বেজেছে এই ঘন্টি
বাউল গেয়েছে, হরি দিন তো গেল সন্ধ্যা হল
এভাবে কত সময় পেরিয়েছে, কত প্রেক্ষাপট বদল হয়েছে
কিন্তু আজ তুমি ট্রাম ডাইনোসোরের মতো অবলুপ্তির পথে
হৃদয়বেদনার ফল্গুস্রোত ভাসাবে বুঝি
কোলকাতার জনারণ্যকে তুমুল সুনামিতে
হায় ট্রাম, তুমি শুধু বেদনা খুঁড়ে খুঁড়ে হৃদয় জাগাও!

স্পৃহা
কৌশিক বন্দ্যোপাধ্যায়

শুদ্ধতার স্বরে আকাশ ডেকে উঠতে
বৃষ্টি এসে পড়ে…
সহসা বদলে যায় মাটি
শুকনো খড়ের বোঝা সামলে নেয় তার সরসতা।
এ পর্যন্ত এসে কোন বিরহী
তাকে আঁকড়ে ধরে উঠতে চায়…
নির্ভরতার গান গেয়ে স্ফূর্তি তার
এক বুক বৃষ্টি আকাশ থেকে নামতে
জলের সমীকরণটুকু
আলাদা করে তোলার কোনও স্পৃহা থাকে না কারও…

 

বাবা
সঞ্জয় সাহা

সূর্য ডুবলে ক্রমে শূন্য হয়ে যাই
শেষ আলো নির্ভর পথ
ফিসফিস করে বলে ‘এসো’
বাবা ভুলে যাচ্ছে
ফেরবার কথা
আফসোস আর চটি পড়ে থাকে
তীব্র সন্ধ্যায়

 

স্বপ্নের আভাস
সুস্মিতা দেবনাথ

জীবন আর মৃত্যুর মাঝে
একটি সাঁকো
একটি নদী
আর মানুষ যে বহমান কাল ধরে
এই সত্য জেনেও সাঁকো পারাবারে
তারা নির্ভীক
জীবন আর মৃত্যুর মাঝে
একটি সাঁকো
সাঁকোর নিচে বহে চলে নদী,
নদীর নীল জলে স্বপ্নের আভাস।

মানুষ জানে—
সাঁকোটি নড়বড়ে,
তবু সে এগোয়,
পা ফেলে অনিশ্চয়তার পথে।

পায়ের তলায় ভাঙনের শব্দ,
তবু সে পা ফেলে
কারণ জানে,
পারের ওপারে অপেক্ষা করে আলো।

নদী গড়ায়,
সময়ের মতোই একমুখী।
মানুষ থামে না,
যেন বয়ে চলে নদীর স্রোতের মতো।

 

দীর্ঘ এক
ক্ষতের কবিতা
হাবিবুর রহমান

আমার কাছে একটি চাঁদ
একটি আলোর পৃথিবী
আলো যখন নুইয়ে পড়ে
ঘুমিয়ে পড়ে রাতের ফুল

উথাল পাথাল শান্ত নদী
পাল ছিঁড়ে যাবে
আকাশ ভেঙে বৃষ্টিও নামবে
আমরা আর্তনাদ করে উঠবো
আর্তনাদ করে উঠবে পাখিরা,

দ্যাখো, আয়নার ভেতর কত জল জমেছে!
শেষরাতের চাঁদ জানে,আমিও জানি
তুমিও জানো

শুধু পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে থাকে
দীর্ঘ এক ক্ষতের কবিতা।

 

জল চুরি
বিধানেন্দু পুরকাইত

নারীর আর এক নাম জল
নাকি জলে গুচ্ছ রঙ দিলে নারী হয়ে ওঠে।

নারীকে যেভাবে আঁকি
রঙ শেষ হয়
নারীকে আঁকতে পারি না
অবয়ব শেষ না হলেও
নারীকে আঁকতে চায় বেহিসেবি মন।

নারী কি জলের এক নাম?
চল জল চুরি করে আনি
এত জল একা ধরে রাখে
সব যদি একা একা মাখে
আমরা যে মরুভূমি হই।

 

নীরাজনা
ঐশী চক্রবর্তী

এমন শীতের দিন ফিরে যায় নির্ঝর, ভ্রমর অবসাদে
পাথরের অন্তরালে আসলে প্রবাল দ্বীপ
সিক্ত সময়েরা আমরণ ছিল সাদা সায়র-গভীরে
সে তো মুক্তোমালা, কালপুরুষের কান্নার জল
নারীর উদাসীনতা, দু’চোখে ভ্রামরী অতল…

কে তাকে ব্যথা দিয়েছে, কে তাকে আবার সুরের
মূর্ছনায় ডুবিয়ে রেখেছে সীমাহীন কাল!
দুজনেই এক, একাধিক রূপে বুঝতে দেয়নি মায়াতত্ত্ব
বিজড়িত সুখ, আসলে দুঃখ তার
নিকষ সরোবরে চন্দ্রের হার!

এত প্রেম, এই নীরাজনা
দ্বিতীয়ার আয়ু ছেড়ে মোহনায় শোকাকুল হাওয়া
এমন রাগিণীতে ভেসে আসে করুণ গন্ধর্বী আলো
আসার ইচ্ছে ছিল না পৃথিবীতে, তবু কার ইশারায়
এই মেধা, আত্মদহন নিরাকার বয়ে যায়…

 

নেমে যাওয়া জলে
প্রাণজি বসাক

একএক করে সবাই যখন সরে যায় জলও নেমে যায়
আর তখন ফুটে ওঠে পায়ের চিহ্ন কার পায়ের মাপে
গোড়ালির গর্তে জমা ঘোলাটে জল কেন চিহ্নিত করে
আমার থাবা থেকে কবেই সরে গেছে থাবার নখগুলি
একটা কাদার দেয়ালে জুতসই ক্যানভাসে অর্ধসমাপ্ত
বাস্তবতা-আঁকুপাঁকু ঢেউ একটা অসুখ ছড়িয়ে গেছে
জোয়ার এলে কিসব কথা বলতে থাকে নদী অবিরত
বুক চিতিয়ে থাকে শূন্য মাঠ সারাটা দিন অপেক্ষায়—
পড়ন্ত দুপুরে একদল মানুষ ফিরে আসে খোঁজে চিহ্ন
কতরকম চমকই ভাষা খুঁজে পায় নেমে যাওয়া জলে