এই জন্ম, এই গান
বিশ্বজিৎ লায়েক
যেভাবে তোমাকে পেয়েছি
ওপারে নৌকা যায়নি সেভাবে
এই দোষ আমার ছিল না প্রভু
মিছিমিছি রাগ করে পাকা ধানে দিলেন মই
আমার হাতের কাছে যা কিছু পেয়েছি সব
এবড়ো খেবড়ো নামিয়ে দিয়ে পগারপার
কে কোথায় গেল জানি না
এই বয়সে এতকিছু জানা হল
আর নতুন করে জলের উৎপাত চাইছি না
বরং কিছু গল্প দিও আর গায়ে মাখা গন্ধসাবান
বড্ড বেশি ময়লা জমেছে গাছে গাছে সবুজ পাতায়
তোমার আমার সাদা মনে কালো কালো দাগ
বরং কিছু লবণ দিও আর পুরোনো চশমা
বড্ড বেশি ঝামেলা করছে অর্কদের বেড়াল
ওকে কী দেওয়া যেতে পারে ভেবে দেখো
আমার এখন ঘুমের সময়
রাত্রি এসে লিখছে সাবান জলের ফেনা
আহা মরে যাব, এর বেশি আনন্দ দিও না প্রভু
পারলে গান দিও, গল্প দিও, ঘুমের ট্যাবলেট দিও না
আমাকে আমার কাছে
অরূপ দত্ত
থমথমে স্থির
একটি ছায়ার অবস্থানে আছি,
তাই বলে ছাই-ভস্মে
ওড়াতে পারবো না ভালোবাসা।
যেখানে বিরাজ করে
একটি পাথর, শোক ও ব্যথা
আমাকে সেখানেই থাকতে দাও।
হে ঈশ্বর, চিরঅমরত্ব চাইনা আমার,
বরং আমাকে আমার কাছে ফিরে যেতে দাও।
নেরুদা তোমাকে
সুচরিতা চক্রবর্তী
সে এক আশ্চর্য অপরাহ্ন,
পার্কস্ট্রিটের রাস্তার রোদের সোনা আলো আমাদের পিছু নিল
এবার ডুবতে হবে জেনে কিছুক্ষণ হেঁটেছে আমার আঁচল ধরে—
এতো কোলাহল! একটু নিভৃতি চাই,
এবার ফিরে যাও বিকেলের আলো।
জ্বলে ওঠে টিমটিম ট্রিঙ্কল,
ফেনা ওঠা ঠোঁট ভিজিয়ে দিয়েছে শ্যাম্পেন,
আর কত দূরে আর কত দূরে যাবে এ নদীপথ—
পাশাপাশি একজোড়া-দুইজোড়া-তিনজোড়া চোখ রাখছে হিসেব
অনেক হিসেব কষা ওয়েটার টিপস
ঝিমঝিম পা টলেনি একবার বলেনি অশ্রাব্য কোনো কথা
মহাজাগতিক বিস্ময় ছিলো ওই একজোড়া চোখে
ধ্রুবতারার মতো নিষ্পলক পাশাপাশি যে হেঁটে এসেছিলো
আমার দরজায়।
মহাপ্রস্থানের পথে
সুভাষ সরকার
ভাগ্যবান কেউ আজ মহাপ্রস্থানের পথে।
শুধু হরিধ্বনি নেই আর সাবেক মতন।
পথিক দু’পাশে যারা, কেউ কেউ আজও
তবু প্রণাম করে।
আমিও প্রণাম করি, শবদেহ রিপুশূন্য বলে।
এবং আগামীকাল কিছু মানুষের
পক্ষে বা বিপক্ষে যাবে
এই মৃত্যু তার।
ভাগ্যবান বলে তাকে, এসবের ঊর্ধ্বে যিনি,
যার এই মহাপ্রস্থান।
অতএব আমি তার পুণ্যি দেখি,
আমি তাকে করজোড়ে জানাই প্রণাম।
ও টি
অরুণিমা
খুব আশ্চর্য খারাপ একটা সময়ে দাঁড়িয়ে
যন্ত্রণার কান্না আসছিল কানে,
কখনও নিজের হৃৎস্পন্দনের মতো
কখনও পারিপার্শ্বিক গোলযোগের মতো।
কখনও বা ধাতব শব্দ, কখনও
জীবন-মরণ সীমানায় দাঁড়ানো শেষ মুহূর্ত
আওয়াজ তুলেছে মুহুর্মুহু।
আমাকে সংবেদনহীন করে তোলার
যাবতীয় প্রস্তুতির শেষ পর্যায়ে
একটা ঘোরের মধ্যে ভেসে আসছে
অচেতন করে দেওয়ার সেই গন্ধ।
ঘুমিয়ে পড়ার ঠিক আগের মুহূর্তে
ঈশ্বর আর বিজ্ঞান— আয়ু আর ইচ্ছে—
উচিত আর অনুচিত— ঠিক আর ভুল
সীমানা মুছে দিয়ে তুমি দাঁড়ালে এসে।
আমার সংকীর্ণ শয্যার চারপাশ জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকা
সবুজ বর্মের সৈন্যরা
হাতে ধরা ধাতব অস্ত্রে বাজাল বীণা,
আর শ্রাবণের এই অসময়ে তুমি বসন্তের ফুলে
সাজিয়ে দিলে আমাকে।
হাইফেন
আশিসরঞ্জন নাথ
মাঝখানে হাইফেন দিয়ে যেমন
সম্পর্ক টেঁকে না
হাইফেন ছেড়ে দিলে জীবনও
চলে না।
তোমার-আমার মাঝে হাইফেন আছে কি না
বুঝতে পারি না।
তবু তোমার-আমার মাঝখানে
এক সেতু হয়ে আছে হাইফেন।
কে ধরে রেখেছে হাইফেন
তুমি না আমি
কেউই জানি না
অথচ হাইফেন সেতু হয়ে আছে
দু’জনের মাঝে।
জীর্ণ আলো
নীলিমা সাহা
সবে ঊষা, অনতিআলোয় ঘুমন্ত শহর
হাঁটছি আমি ও পথ
আমি থমকে গেলেও পথ হাঁটে পথের মতন
কুয়াশা… কু-আশাগুলো লটকে দুলছে বেলগাছের কাঁটায়
অদূরেই আলোর ইঙ্গিত, জবাকুসুম রোদ্দুর,
স্রোতমুখে হাওয়া, ঈষৎ কিচিরমিচির
জীর্ণ আলোয় কেউ না-ঘুম কষ্ট আগলে বসে
ধোঁয়াশাপুর— বুঝি দু’ছিলিম শান্তি খুঁজছিল ঘর, বুনছিল
আশায় ডাগর কলমির লতা, জীবনও পেতেছিল আঁচল
দেখতে পাচ্ছি জেগে উঠেছে রোদ— সামনে রোদের সফেদ পা
পিছনে আলোর আদি অন্ধকার
উপেক্ষার জল মুছতে মুছতে কে উঠে গেল উঠোন থেকে বারান্দায়
আমিও হই
সুরভি চট্টোপাধ্যায়
ঐন্দ্রজালিক তুমি
আঁধার খুঁজে এলে
হৃদয়ের অরণ্যপথে…
ও ভোর রাতের মোরগের মতো
আমি ভেবে ফেললাম রাত্রিকাটা সূর্য…
আলো নেই… তবু ওড়ে
লালসার ফুলকি
আর নিত্য নিশায় আমিও হই
অনুতাপের পোড়াকাঠ…
জন্মবৃত্তান্ত
রিয়াদ হায়দার
চৌরঙ্গীর সেই পাগলিটা আজ
সন্তানসম্ভবা!
আমি তার গর্ভ ছেঁড়া সন্তান
দেখতে চাই।
সন্তানের মুখে চুমু খেয়ে বলতে চাই তার জন্মবৃত্তান্ত!
অন্তত একটা প্রজন্ম
তার জন্মের ইতিহাস জানুক…
মেদহীন
শুভদীপ মাইতি
একটি পাতাখসা বিকেলে বিচ্ছেদের শরীরে যখন চলকে ওঠে ঢেউ,
আমাদের মনখারাপের তারায় তারায় ছড়িয়ে পড়ে মৃত আতরের ঘ্রাণ।
আজন্ম শরীর থেকে ঝরে পড়ে মাটি ও মেদহীন মুসাফির আলো
বাজেট
রত্নদীপা দে ঘোষ
প্রতিভাবান পাহাড় এবং পর্বতকে মাসোহারা হিসেবে
নির্মল কলম এবং নিষ্পাপ তুলি।
মালভূমি জেলায় জোনাকি দীঘি পাঞ্চজন্য পুকুর।
উপত্যকার গাছসমাজও পিছিয়ে থাকবে না।
সবুজ পেখমে সাজানো হবে তাদের ভোজসভা।
ক্লোরোফিল উৎপাদনের ক্ষেত্রে কোনোরকম কার্পণ্য করবে না সরকার।
প্রাপ্তিতে ভরে উঠবে গোলাপ বাগিচার এস্রাজ।
বনভোজন আর চড়ুইভাতির সরোদ পনেরো দিনে অন্তত একবার।
এ বছর দাম কমছে মনোহরা কুয়াশার।
দাম বাড়ছে পিলসুজ, প্রেম এবং পাণ্ডুলিপির।
অরণ্যকে নিয়মিত সরবরাহ করা হবে হরিণের মোহনা।
বৎসরশেষে মোহনা ফেরত পাবে কেতকীর জীবনবিমা।
দণ্ডকলসের নক্ষত্র ফিরে পাবে অমৃতকালীন জ্যোতি।
কালপুরুষের বিরহদিশাটি ফিরবে সুদকষার তাঁতঘরে।
পিছিয়ে পড়া নদীরা দেওয়ালগিরির ডানায়!
প্রতিটি পাখিগ্রামের জন্মদিন পালন করবে পঞ্চায়েতের শাখা প্রশাখা।
এই বাজেট মানুষকে উপহার দিচ্ছে স্বাধীন একতারা, ফকিরগুচ্ছ!
মানুষ এখন থেকে সুরধ্বনির সাস্থ্যবিধি, বাউলকবির সঙ্গীত-রচনা।
তুলসীপাতার গন্ধ
লক্ষ্মীকান্ত মণ্ডল
বাঁকের ঝোপ থেকে বেরিয়ে আসছে তুলসীপাতার গন্ধ; সংলগ্ন কোমল রোদে কচুপাতা স্থির, ক্রমাগত ফ্যাকাসে ভবিষ্যতে হারিয়ে যেতে যেতে পুকুরের জলে নড়ছে দু’একখণ্ড মেঘ— কেউ জানতেও পারল না কয়েক শতাব্দী জুড়ে ভালোবাসি বলে সেও আঁচলে মুখ ঢাকতে ঢাকতে অন্ধকার হয়ে যায়; ডানা ঝাপটে ঝাপটে খুঁজে বেড়ায় লুকিয়ে রাখা অর্জুন গাছের ছায়া
আমার যা কিছু প্রকৃত ফুল এবং অন্তহীন পাখির কূজন দীর্ঘকাল ধরে মাটির ক্ষতের দিকে নির্জন নাক বরাবর ময়লা মাখা বলিরেখারা খালধারের অস্তিত্ব নিয়ে পুনরায় জলজ হতে চায়