কবিতা গুচ্ছ

বৃষ্টি পরবর্তী হাওয়া
স্বপ্ননীল রুদ্র

জারুল-ঝরা নীলাভ পথে বৃষ্টি-পরবর্তী হাওয়া
বৃদ্ধার মতন হেঁটে যায়, আত্মমগ্ন সেই যাওয়া

জংলা গন্ধের ছিপিটি খুলে তন্দ্রামগ্নতায় বেলা
কাঁধ এলিয়ে শুয়ে পড়েছে, পাশে ঝরা পুষ্পমেলা


ভেজা সান্ধ্যচাদরের নিচে জলভাঙা মেঘের গান
গুলাম আলির গজলের মতন বিদীর্ণ টান

প্রেক্ষাপটে সারঙ্গীর ছড় তীব্রতর হয়ে ওঠে
জারুল-ঝরা নীলাভ পথে বৃষ্টির কৈশোর ফোটে

শেষ পথবাতিটির পর রাস্তাটি নিয়েছে বাঁক
মিশ্র গন্ধের প্রায়ান্ধকার, শ্রুত স্তব্ধতার ডাক…

 

সমুদ্রপ্রদর্শন
অলিপা বসু

গর্হিত বিক্রমের কপালে কখনো সূর্য আঁকিনি
যতই বল না কেন আমি সঙ্গীতা শঙ্খিনী
কখনো আমার মুখে মেদুরতা খুঁজলে
পেয়ে যাবে অযাচিত বিশল্যকরণীর ছায়া

শেষ না হওয়া পথে
শেষ হয়ে যাওয়া শাঁখা দুটো আজকাল
বড় ভারী লাগে হাতে

গৈরিক পথে
ভালোবাসা পালনের মধ্যে দিয়ে
অলক্ষ্যে কাছে আসে ভাঙা সমুদ্র পথ

ধুলোরও আগে,
পূর্ণতার নীরবে গন্ধরাজ হয়ে ঝরবো বলে
নিঃসীমে ছড়িয়ে দিয়েছি পরমান্ন নিঃস্বতা

 

বোঝাপড়া
মোহনা মজুমদার
শোচনীয় বেঁচে থাকার পাশে
হাঁ-মুখে জীবন উল্টে পড়ে আছে।
এইরকম কি বারবার ক্ষমা করা যায়?
বারবার ভুলে যাওয়া যায়?
প্রলাপ বকতে বকতে ব্যর্থ মানুষটিও
যখন খড়কুটো আঁকড়ে ভেসে যায়,
স্রোতের ওপর দেখে পাখিটির পা রাখা।
সেও এগোয় স্রোতের টানে।
কথা বলতে ইচ্ছে হয় না আর
চুপ করে বসে থাকি
কী ভাবি নিজেও জানি না
অথচ বহুদূর চলে এসেছি মনে হয়
একযুগ পর আজ তোমাকে দেখে
মনে হয় এক যুগ আগে
যেখানে রাস্তাঘাট, বৃষ্টি, মেঘ ছেড়ে এসেছিলাম
সেখানে আজ ভিজে মাটির শরীর আঁকড়ে
বেড়ে উঠেছে নতুন চারা।
আদর পেলে সে নুইয়ে পড়ে আদরের বুকে।
ঘ্রাণ দেয়, আর্দ্র করে যাবতীয় প্রাণবীজ।
ভুলে যাওয়া বা ক্ষমা করা ছাড়া আদতে
কোনো পথ খোলা থাকে না
এই ই তো বোঝাপড়া—
চিরকালীন
শুধু ‘নেই আর নেই’-এর মাঝে চেয়ে চেয়ে
  পাতা নড়া দেখি।

সার্কাসের মেয়ে
সুশান্ত সেন

সার্কাসের মেয়ে চিরকাল থেকেই যায়
সার্কাসের মেয়ে,
সে কি আর বাড়ির ভেতর আসে !

ট্রাপিজের খেলা দেখিয়ে সে ওড়ে
প্রথম বার থেকে দ্বিতীয় বারে
আবার তৃতীয় বারে
যেখানে লুফে নেয় তাকে অনিরুদ্ধ।

সার্কাসের মেয়ে থাকে চিরকাল
সার্কাসেরই মেয়ে,
সে বাড়ির ভেতর আসে না।
ঘোড়ার পিঠে ছুটতে ছুটতে সে
রঙিন পাখা দুলিয়ে মিষ্টি করে হাসে
বা এক বার থেকে অন্য বারে
করে বিচরণ— যন্ত্রণায়।

ফিরে আসতেই
অন্তরা সরকার
তোমার শহরে পা রাখতেই
অতীত কাঁপানো ইতিহাস শীতঘুম ছেড়ে
নেমে এলো মাঝ বরাবর।
দীর্ঘ প্রতীক্ষিত অপেক্ষার অবসানে
কাশ ফুটলো আকাশের গায়ে।
আকন্ঠ তৃষ্ণায় চিরপিপাসিত ঠোঁট খুঁজে নিল
ফুরিয়ে যাওয়া আয়ু।
ধস নেমে যে পথে মৃত্যু লেখা ছিল,
এখন প্যাভিলিয়ন জুড়ে উপচে পড়া আলো।
ডাকবাক্সে জমা ধুলোমাখা কয়েকশ রঙিন চিঠি।
সীমান্তের প্রহরী হয়ে মোহনার কাছে আজও
ঠায় দাঁড়িয়ে তুমি!
তোমার বুকের অভ্যন্তরে নোঙর বাধা নেই।
সদর খোলা।
চোখ ভেসে যায় মুগ্ধতার জলে।

গ্রহণ লেগেছে চাঁদে
মাহমুদ নজির

গ্রহণ লেগেছে চাঁদে
তাই এত অন্ধকার ঘুটঘুটে,
চারিদিকে ঝিমকালো।

কোথাও প্রশান্তি নেই, নেই স্নিগ্ধ ছায়া
ধীরে ধীরে নিভে যাচ্ছে জ্বলে ওঠা—
ছড়ানো ছিটানো স্বচ্ছ আলো।

বাঁচার আশায় দ্রুত ছুটে চলছি পথ
সামনে-পিছনে ভয়, অসংখ্য বিপদ,
ঘিরে ধরে ছদ্মবেশী, পাষণ্ড যমদূত!

পা বাড়ালেই চমকে যাই, থমকে যাই আমি
কোথায় দাঁড়াবো আর কোথায় লুকাবো—
কথা বললেই হয়ে যাই বিপ্লবী, আসামী।

গ্রহণ লেগেছে চাঁদে
তাই এত অন্ধকার আবছায়া,
হৃদয়ের লিপিতে লিখে রাখি মিথ্যা মায়া।

খই
শক্তিপ্রসাদ ঘোষ

পতনের পাশে এসে দাড়িয়ে
উড়ো খই
শেষ চিহ্ন পথে পথে
ফিরে আসবে না জেনে
জড়িয়ে আছি।

 

ফাঁদ
সুমন চট্টোপাধ্যায়

মাঝে মাঝে নেড়ে-ঘেঁটে দেখি
কতটা জনপদ আর কতটা খণ্ডহার আমি
বৈরাগ্যের ইঁট গেঁথে মায়ার বিভ্রম
গড়ে তোলে ধীরে ধীরে অলীক ঘরামি!

অঙ্গ তার পোড়ে কুতূহলে
শ্বাসের গভীরে শ্বাস হয়ে ওঠে ভারি
স্যমন্তপঞ্চক ঘুরে অন্ধ রাজন্
হাহাকারে করে শুধু মৃতের শুমারি!

চৈতালি শব ঘিরে হাওয়ার নাচন
দেহের উল্লাস ক্রমে হয়ে আসে ফিকে
নিহত বিবেক আর আত্মার টোপে
কী এক আশ্চর্য ফাঁদ পেতেছো চারদিকে!

 

জন্মান্তর
গোপাল চক্রবর্তী

এক একটা চলে যাওয়ার দিন মনে পড়ে।
মনে পড়ে মৃত্যুশয্যার রাতগুলো,
তার মৌন পরপার!

মৃত্যুর চেয়েও ঘাতক এই অতিলৌকিক মনে পড়ে যাওয়া—
কে শেষবার দেখেছিল, কে দিয়েছিল জল!

মৃত্যুর চেয়েও ঘাতক মৃত্যুকামনা—
দেহ-ভাষা মুছে যায় অবতীর্ণ অন্ধকারে…

মনে পড়ে কতবার ডুবেছি চিতাগ্নিতে,
স্নান শেষে ফিনিক্স ফিরেছি এক আকাশ মানুষ জীবনে!

 

যাও মেঘ ◆
কালিদাস ভদ্র

যাও মেঘ, শ্রাবণ মেঘ
আজ বিষণ্ণ দুপুরে

ভালোবাসা দাঁড়িয়ে ওই
ঠায় খুলনার খেয়াঘাটে
বৃষ্টি-অক্ষর খোঁজে

সোনালি চিলের থেমে গেছে ঠোঁট
বন্ধ টাবুরে নৌকোর ছলাৎ ছল
কচ্ছপের মৃদু পায়ে ফিসফাস
ঢোল কলমির পাতায়
নীরব কোন মুর্ছনা

যাও মেঘ, শ্রাবণ মেঘ
শুষ্ক কলসি কাঁখে
ভালোবাসা দাঁড়িয়ে ওই
শ্রীরাধার মতো বিরহ সাজায়ে…