দুটি কবিতা
জয়ন্ত সরকার
ঝরাপাতার ডায়েরি
ঝরাপাতা হতে চাই বলে শীতের
দপ্তরে বার্তা পাঠিয়েছি
কুয়াশায় বিলীন হয়ে নির্ঝর করব প্রাণ
যদি দেখি তুমি আজও বনগর্বী
সবুজের প্রান্ত জুড়ে আমি
মুঠো-মুঠো কথা ঝরাব শুধু
তখন বাতাস লেগে পাতারা হবে সমূহ চঞ্চল…
আত্মকথা
যতটুকু ঝুঁকে বাঁচা যায়
নতমুখ হওয়া বড় কিছু নয়
ভাব ও ভাবনার মিলমিশে
চেনা যায় কিছু পরিচয়
চেনা যায় ব্যর্থ খেতাব
কিছু কথা আর পরিহাসে
সামাজিক করতে নিজেকে
উদ্বেগ ঝরে চলে নিরালম্ব
নিজেকেই খুঁটে-খুঁটে চিনি
এই জন্ম, এই পরাজয়
আজও মুগ্ধ হয়ে ফোটে
যেহেতু আমি ঝুঁকতে শিখিনি…
আলাপ
মধুছন্দা মিত্র ঘোষ
দু’পাশে আবছা হয়ে আসা
নীরবতা পাঠাচ্ছে সৌহার্দ্য প্রস্তাব
কৃষ্ণচূড়া-শিমুল-পলাশ
নানাবিধ কোলাহলে মুখিয়ে রইল
আলাপের ইচ্ছে নিয়ে
আমিও সে কথা জেনে তখন
রোদ মাখছি, কখনও বৃষ্টি, কখনও ফাগুন
অদ্ভুত মনস্কতায় এক একটি বিন্যাস
মিলেমিশে যাচ্ছে অন্য বাঁকে
সন্তোষজনক প্রবণতায়
দ্বিপাক্ষিক ইশারার ডাকবাক্সে
হলুদ খাম, ভরে রাখে
কমলা বিকেলের রঙ…
নির্জন তারার কবিতা
স্বপ্ননীল রুদ্র
পাহাড়ি পুঁইলতার মাচা। তলে বেড়ে ওঠা ঘাসে
এইমাত্র রুপোর রঙের যে ফড়িঙটি জুত করে
বসেই দুলিয়ে দিল ঘাস, তার প্রেমে পড়ি আমি।
শিরশির করে ওঠা এক নাম না পাওয়া শিহরণ
অদূরে উড়ন্ত মেঘে চেপে অতলান্ত খাদে ভাসে।
নিঃসীম শূন্যতার ভিতরে একটি মৃদু কুয়াশার
পিয়ন ক্রমে এগিয়ে আসে, উপুড় করা ঝোলায়
কিলবিল করে সাদা খাম— ভেজা ভেজা চিঠি থেকে
শব্দ বর্ণ রেফ ও অক্ষর পাকদণ্ডি বেয়ে ওঠে;
উঠে, জিগমে তামাঙের চায়ের দোকানের উনুনে
সেঁকে নেয় যাবতীয় শীত। আমি নিঃসঙ্গ দোকানে
বিকেলের সুরা পান করি। আকাশের গায়ে আঁকা
ফেরা পাখিদের দ্রুত গতি পাইনের ঘন বন
ধীরে ধীরে শ্লথ করে নেয়। অলক্ষ্যে হঠাৎ ওই
জেগে ওঠা নির্জন তারাটি যেন আমার ঠাকুমা—
রোববারের ভাঙা গ্রাম্য হাটে সন্ধ্যায় একা দাঁড়িয়ে…
ঝুলে থাকার গল্প
রাজীব পাল
আমরা ছিটকে গিয়ে একটু অন্ধকার খুঁজে দাঁড়ালাম,
আলো কিছুটা হাতড়ে হাতড়ে চোখ নামিয়ে নেয়
অক্ষমতুল্য, পাড়াতুতো জেঠুসুলভ…
সামান্য আঁধার অথচ কেমন জমাট বেঁধে বসে গেল
তোমার গালের কোথাও খুঁজে আমার চোখ ভীষণ ভিড়
বাসের দরজা ধরে বিপজ্জনক ঝুলে রইলো…
এখন যেখানে যেখানে যাবো এই ঝুলে থাকারই গল্প
এবং অর্জনটুকু বয়ে বয়ে বেড়ানো বুক পকেটও ভারি
ভারি ভাব অন্ধকার খুঁজে পেলে কি আবার দাঁড়াবো?
ভয়
প্রাণজি বসাক
ছোঁয়াচে বলে ভয় যদি এসে যায় অবিরাম বৃষ্টির শব্দ
আচ্ছা কান্নারও কী শব্দ হয় অথবা ভয়-লুকানো মুখ
পর্দা টেনে দিলে রোদ থেমে থাকে ভয়ার্ত থাকে ছায়া
যদি ঢুকে পড়ে সে-শব্দ আনচাহা কবিতার পঙ্ক্তিতে
প্রার্থনায় অনুক্ত উচ্চারণ স্থবিরতা এসে দাঁড়ায় কাছে
শব্দ আর ভয় লুকিয়ে থাকে সুযোগের অপেক্ষায়—
কার কথা শোনাব তাকে… কার কাছে তুলব আক্ষেপ
এখন শিশির পড়ে টুপটাপ ভোরের কোল ঘেঁষে কান্না
মানুষ দিনের জন্য উঠে দাঁড়ায় হাতে রাখে মুক্তনক্ষত্র
নানান শব্দে ঘেরাও মানুষ দূরে থাকে ছোঁয়াচে বলে…
কখনো কবিতা লিখিনি
উৎপলেন্দু পাল
আমি কখনো কবিতা লিখিনি
মাটির গন্ধ মেশানো বাতাস লিখেছি
আলোর চুমু মাখা আকাশ লিখেছি
পশুর গন্ধ মাখা মানুষ লিখেছি
মানুষের খোলস পরা দানব লিখেছি
প্রলয়ের চিহ্ন আঁকা সৃষ্টি লিখেছি
প্রেমের মুখোশের আড়ালে ঘৃণা লিখেছি
ধর্মের আবডালে রাজনীতি লিখেছি
পবিত্র পট্টবস্ত্রের নীচে যৌনতা লিখেছি
আতরের ভাঁজে ভাঁজে দূর্বাস লিখেছি
সত্যের মোড়কে ঠেসে অসত্য লিখেছি
শুধু কখনো কবিতা লিখিনি।
ছায়াজীব
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়
ছায়ার উপর রোদ এসে থেমে যায়, শূন্যকথা ফুটে ওঠে
ছুঁয়ে যায় হিম, সমস্ত অধিকরণ। প্রহরীরা রাত বোনে
ঘোড়ার নালের মতো। অশ্বরব ছুটে চলে উপাস্য ক্ষুধায়
ইস্তেহার লেখে কিলবিল জ্যান্ত শব্দ। আত্মমগ্ন বেহিসাবি
পাতা ঝরে পড়ে মুষলধারার, জলের বিহ্বল-রসাতল।
শায়িত পাখির ডানা তুলে আনি, প্রতিবিম্বে কুণ্ডজল ছুঁড়ি
নিরীহ বাতাস আসে তাকে খেয়ে ফেলি প্রতিবেশীর মতন।
ছায়াজীব আশ্রয় চায়, নাগরিক শব্দের কোলাহল টেনে
নদীতীরে ফিরি, সুতোহীন ক্রমশ আলোর যোগসূত্র খুঁজি
রহস্যের শামুক ভাঙি, ভেঙে দেখি শরীরময় অন্ধকার!
ক্লান্তিহীন
গৌতম সমাজদার
দেখছো, শব্দেরা ছুটে চলেছে
কখনো দুলকি চালে, কখনো মেঠো সুরে
ছুটেই চলেছে, অবিরাম, অবিশ্রান্ত
কখনো ছুটে চলেছে, দুদ্দাড় বেগে,
কখনো আবেগমথিত হয়ে।
কখনো শ্রমিকের ক্লান্ত পায়ে
কখনো রাষ্ট্রশক্তির ভারী বুটের বিরুদ্ধে
কখনো বা নৈঃশব্দ্যে নৈবেদ্য সাজিয়ে
তবু ওরা ছুটছেই, অণু, পরমাণুর বেগে
শব্দেরা কবিতা লেখে,
ভেঙ্গে ফেলে বাধার প্রাচীর।
কৃষকের লাঙলে, শ্রমিকের হাতুড়িতে।
শব্দ গর্জে ওঠে, লাল চোখের বিরুদ্ধে।
শব্দেরা ক্লান্তিহীন, জেগে থাকে রাত
জাগিয়ে রাখে আমাদের সত্তা—