সুদীপ ওম ঘোষ
আজ একটুও টুবুনের মন বসছে না ইস্কুলে৷ মনটা যে পড়ে আছে ওর বাড়িতে৷ না, বাড়িতে বিশেষ কেউ আসেনি৷ বিশেষ কোন পদ রান্নাও হচ্ছে না৷ কিন্ত্ত তবুও টুবুন ভাবছে কখন স্কুল ছুটি দেবে! ওর বন্ধুদের সাথেও আজ বিশেষ কথা বলছে না৷ মনে মনে শুধু প্ল্যানিং চলছে৷ বন্ধুদের সাথে অবশ্য ও কথাটা শেয়ার করেনি৷ কিন্ত্ত পরে অবশ্যই করবে৷
বুদ্ধিটা ওর মাথায় আসে গত তিনদিন আগে৷ ওর বাপি টিভিতে নিউজ দেখছিল৷ তখন নিউজের দিকে নজর যায় টুবুনের৷ মনে মনে প্ল্যানটি করেই ফেলে৷ টুবুনের ভালো নাম অর্কজিৎ৷ ওর বন্ধুরা ওকে বলছে, অর্কজিৎ তুই কদিন খুব চুপচাপ আছিস৷ আমাদের সাথে ঠিকমতো কথাও বলছিস না৷ কোন প্রবলেম?
‘না, না৷ নো প্রবলেম৷’
তবুও কিছুই শেয়ার করেনি টুবুন৷ সব কিছুই গোছগাছ করা আছে৷ শুধু বাড়িতে গিয়েই কাজে লেগে পড়বে৷ দুটো মানুষেরও যদি উপকার হয় মনে মনে অনেক খুশি হবে টুবুন৷ টুবুনের বাবা প্রস্তাবটা শুনে খুবই খুশি৷ সব রকম সাহায্য করেছে টুবুনকে৷ টুবুন জানতো ওর বাবা ওকে সাহায্য করবেই৷ সব ভালো কাজেই ওর বাবার প্রচণ্ড উৎসাহ৷ ভয় পাচ্ছিল মায়ের৷ কিন্ত্ত ওর মা সবকিছু শুনে ওকে সাহায্য করেছে৷ টুবুন একটা জিনিস খুব ভালো বুঝতে পেরেছে, ভালো কাজ করলে সবাই পাশে থাকে৷ আর খারাপ কাজ, যে কাজে সমাজের ক্ষতি হয় মানুষের ক্ষতি হয় পরিবেশের ক্ষতি হয় সেই কাজে কেউই সাপোর্ট করে না৷ ওর বাবা একটা কথা প্রায়ই বলে, মানুষ মানুষের জন্য জীবন জীবনের জন্য৷ এই কথাটাকে টুবুন মেনে চলার চেষ্টা করে৷
‘কী ব্যাপার অর্কজিৎ তোমার মন কোথায়? আমি কী পড়িয়েছি তুমি শুনেছ?’
সম্বিৎ ফেরে টুবুনের৷ জিওগ্রাফি স্যার ক্লাস নিচ্ছেন!
আমতা আমতা করে টুবুন বলে, ‘সরি স্যার৷ আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম৷ সরি৷ আর হবে না স্যার৷’
‘কোন প্রবলেম?’
‘নো স্যার৷ জাস্ট আমি একটু অন্যমনস্ক হয়ে গেছিলাম৷ আর এমন হবে না… প্রমিস করছি স্যার৷’
‘ইট’স ওকে…’
স্যার আবার পড়ানোয় মন দিল৷ একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে স্যারের দিকে মন দিল টুবুন৷
শেষমেশ ইস্কুল ছুটি হল৷ টুবুন দ্রুত ওর পুলকারে গিয়ে বসল৷ চড়চড় করে রোদ বাড়ছে৷ যত বেলা হবে তাপমাত্রা তত বাড়তে থাকবে৷ মানুষজন যেন তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকতে পারলেই বাঁচে৷
টুবুন বাড়ি ঢুকেই মাকে বলল, ‘তোমাকে যেগুলো করতে বলেছিলাম করেছ তো?’
ওর মা একগাল হেসে বলল, ‘তুই আমাকে বলেছিলি মাটির কলসিটা পরিস্কার করে রাখতে৷ আমি রেখেছি৷ আর কিন্ত্ত কিছু বলিসনি৷’
ড্রেস চেঞ্জ করতে করতে টুবুন বলল, ‘আর জল ভরে দিতে!’
‘হুম৷ সেটাও রাখা আছে৷’
দ্রুত ফ্রেস হয়ে হালকা কিছু খেয়ে বাইরে বেরিয়ে এল টুবুন৷ ঘর থেকে একা একাই বেঞ্চটা নিয়ে এল৷ ছোট বেঞ্চ তারপর পোষ্টারটা ঘর থেকে নিয়ে এলো৷ ও নিজে হাতেই বানিয়েছে পোষ্টার৷ ওদের পাঁচিলে পোষ্টারটা একটা ছোট ইঁট নিয়ে চেপে দিল৷ ওর মা কলসিটা বেঞ্চে রেখে গেল৷ সঙ্গে একটা থালা৷ তাতে লাল বাতাসা৷ ওর বাবা মার্কেট থেকে বাতাসা এনে দিয়েছে৷ বলেছে, আরও লাগলে এনে দেবে৷
যাওয়ার সময় টুবুনকে বলল, ‘টুলটা নিয়ে আয়৷’
টুবলু ঘর থেকে টুলটা এনে বসে রইল৷ চোখ রাস্তায়৷ আগামী সপ্তাহে আরও গরম পড়বে৷ নিউজ বলছে চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশ ডিগ্রি৷ ওদের বাড়ির সামনের রাস্তা দিয়ে অনেক পথ চলতি লোক যাতায়াত করে৷ সাইকেল চালিয়ে কেউ যায় আবার কেউ কেউ হেঁটে৷ কেউ বা মোটর বাইকে৷ টুবুন নিউজটা দেখার পর সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জলছত্র করবে৷ তৃষ্ণার্ত পথিক জল পাবে৷ আর সাথে গুড়ের বাতাসা৷ এই কদিন সেই মতোই ওর প্রস্তুতি চলছিল৷ আজ শেষ পর্যন্ত ও সফলভাবে সবকিছু করতে পেরেছে৷ প্রতিদিন দুপুর দুটো-আড়াইটে পর্যন্ত ও জল আর বাতাসা নিয়ে পথচারীদের জন্য অপেক্ষা করবে৷ একটা আর্ট পেপারে ও লিখেছে ‘দাঁড়াও পথিক বর’
বিশুদ্ধ পানীয় জল পান করুন৷ একটু রেস্ট নিন৷’
‘খোকন একটু জল হবে?’
টুবুন তাকিয়ে দেখে একজন বৃদ্ধ দাঁড়িয়ে আছে৷
‘আপনি এখানে বসুন৷’ টুবুন একটা ছায়া জায়গায় বসতে বলল৷
জল আর দুটো বাতাসা একটা প্লেটে নিয়ে ভদ্রলোকের মুখের সামনে ধরে টুবুন বলল, ‘এই নিন৷’
বয়স্ক ভদ্রলোক জল আর বাতাসা খুব তৃপ্তি ভরে খেল৷ তারপর কিছুক্ষণ রেস্ট নেওয়ার পর উঠে চলে গেল৷ খুব ভালো উদ্যোগ বলে টুবুনকে আশীর্বাদ করে গেল৷
খুব আনন্দ পেল টুবুন৷ একটা ভালো লাগা কাজ করছে৷ ওর কাজ সাকসেস৷ আগামীকাল ইস্কুলে গিয়ে এবার ওর বন্ধুদের বিস্তারিত সব বলবে৷ এই গরমে পথচারীদের জন্য ওর এই আয়োজন৷ যেটা নিয়েই ও কদিন মনে মনে বিচলিত ছিল৷ টুবুনের এখন খুব হালকা লাগছে৷ ভালো কাজ করলে যে এতটা আনন্দ পাওয়া যায় সেটা জানতো না টুবুন৷