• facebook
  • twitter
Friday, 20 September, 2024

একটাই পরিচয়

চণ্ডীচরণ দাস কদিন থেকে টুকাইয়ের চোখে ঘুম নেই৷ কবে যে শনিবারটা আসবে, বাবা ঝুপ করে এসে পড়বে কলকাতা থেকে৷ এমনিতে বাবা প্রতি শনিবারেই ঘরে আসে, কিন্ত্ত এবারের আসাটা একটু অন্যরকম৷ এবারে বাবা তাকে আর মাকে কলকাতায় নিয়ে যাবে৷ তাকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করে দেবে৷ আর সে এখানে থাকবে না, যাবে হাওড়ার পুল পার হয়ে চূড়ায়

চণ্ডীচরণ দাস

কদিন থেকে টুকাইয়ের চোখে ঘুম নেই৷ কবে যে শনিবারটা আসবে, বাবা ঝুপ করে এসে পড়বে কলকাতা থেকে৷ এমনিতে বাবা প্রতি শনিবারেই ঘরে আসে, কিন্ত্ত এবারের আসাটা একটু অন্যরকম৷ এবারে বাবা তাকে আর মাকে কলকাতায় নিয়ে যাবে৷ তাকে কলকাতার স্কুলে ভর্তি করে দেবে৷ আর সে এখানে থাকবে না, যাবে হাওড়ার পুল পার হয়ে চূড়ায় পরী-ওড়া ভিক্টোরিয়ার পাশ দিয়ে বিরাট শহর কলকাতায়, কী মজাটাই না হবে!

বাবা এল শনিবার, পরদিন রোববার টুকাই মা-বাবার সাথে বেরিয়ে পড়ল কলকাতায়৷ খানিকটা হেঁটে গিয়ে বাসে উঠতে হয়৷ যেতে যেতে হঠাৎ দেখে বামুনদাদু, হাতে একটা পিতলের ঘটি, গায়ে নামাবলীর চাদর, আর কাঁধে একটা ঝোলা নিয়ে, লম্বা টিকি দুলিয়ে হনহন করে আসছে৷ তাকে দেখতে পেয়েই বলে

উঠল, “কোথায় চললে দাদুভাই?”
“কলকাতায় দাদু৷ আমি ওখানে নতুন ইস্কুলে ভর্তি হব যে!”
“তাই বুঝি? তা বেশ বেশ৷” বলে বামুনদাদু চলে গেল৷ টুকাইয়ের কলকাতার ব্যাপারে তাকে আরও কিছু জানাবার ইচ্ছে ছিল, কিন্ত্ত সুযোগ হল না৷ মুখ ঘুরিয়ে আবার হাঁটতে শুরু করল৷
হঠাৎ কিছু যেন মনে পড়তেই সে বাবার হাতটা ধরে বলে উঠল, “আচ্ছা বাবা, বামুনদাদুর অত বড় টিকি কেন? তাতে আবার একটা কলকে ফুল বেঁধেছে?”
বাবা মুচকি হেসে বললেন, “বামুন তো, তাই টিকি রেখেছে৷”
“বামুন কী বাবা?”
“যারা ঠাকুরের পূজা করে হিন্দু ধর্মে তাদের বামুন বলে৷”
“হিন্দুধর্ম কী বাবা?”
“আমরা যারা ঠাকুর-দেবতা, দেবদেবীর পূজা করি, সবাই হিন্দু৷”
কথাটা পুরোপুরি টুকাইয়ের বোধগম্য হল না৷ কিন্ত্ত আর কিছু জিজ্ঞেস করারও অবকাশ হল না৷ বাসস্ট্যাণ্ড এসে গিয়েছিল, দৌড়ে গিয়ে বাসে উঠে পড়ল৷

খানিকক্ষণ বাদে একটা জায়গায় বাস দাঁড়াতে টুকাইয়ের নজরে পড়ল একটা উঁচু চূড়াওয়ালা মন্দিরের মত ঘর৷ তার মধ্যে ছোট-বড় অনেক লোক হাতে ছোটছোট বই নিয়ে ঢুকছে৷ সবাই যে যার মত সুন্দর সুন্দর পোষাক পরেছে৷ খোলা দরজা দিয়ে দেখতে পেল একজন লোক ঝোলা সাদা আলখাল্লার মত পোষাক পরে দাঁড়িয়ে আছে৷ টুকাই এসব আগে দেখেনি৷ জিজ্ঞেস করল, “বাবা, এটা কী?”

“ওটা হল গীর্জা৷”
“ওখানে কী হবে?”
“ওখানে সবাই প্রার্থনা করবে বাবা৷ ”
“ভিতরে ঐ লোকটা অমন পোষাক পরেছে কেন?”
“উনি চার্চের ফাদার তো, তাই৷ ওরা সব খ্রীষ্টান৷”
“খ্রীষ্টান কী বাবা?”
“যারা প্রভু যীশুর ভক্ত তারা হল খ্রীষ্টান৷”
“যীশুর ভক্ত হলে আমাদের মত পোষাক চলবে না বুঝি? যীশু মানা করেছে পরতে?”
বাবা নিরুত্তর৷ বাস ছেড়ে দিয়েছিল৷ টুকাই তার প্রশ্নের কথা ভুলে গিয়ে জানালায় মুখ বাড়িয়ে বাইরে দেখতে লাগল৷

আরও খানিক পরে বাসটা এল একটা বিরাট হাটের মাঝখানে৷ চারদিক লোকে লোকারণ্য৷ তাদের অনেকের পরনে লুঙ্গি, মাথায় সাদা টুপি আর মুখে দাড়ি৷ টুকাই আশ্চর্য্য হল৷ এরকম পোষাকের লোক সে আগে তাদের গ্রামে দেখেনি৷ বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “ওরা অমন পোষাক পরেছে কেন বাবা?”

“ওরা মুসলমান তো, তাই৷”
“মুসলমান কী বাবা?”
“যারা হজরত মহম্মদের ভক্ত তাদের মুসলমান বলে৷”
“মহম্মদের ভক্ত হলে ওরকম পোষাক পরতে হয় বুঝি?”
বাবা কী বলবে ভেবে পেল না৷ বিরক্ত হয়ে বললেন, “তুই বড্ড বকাস৷ চুপ করে বোস তো!”
টুকাই বাবার বিরক্তির কারণ বুঝতে পারল না৷ একটু থেমে আবার বলে উঠল, “আচ্ছা বাবা, কেউ দেবদেবীর ভক্ত, কেউ যীশুর ভক্ত, আবার কেউ মহম্মদের ভক্ত কেন?
“ভগবানের আরাধনার জন্যে বাবা৷”
“ভগবানের আরাধনার জন্যে একেক রকম ভক্ত হতে হবে কেন বাবা? কারও ভক্ত না হলে ভগবান রাগ করবেন বুঝি?”

বাবা উত্তর খুঁজে না পেয়ে বিরক্ত হয়ে বললেন, “তোর বকবকানি বন্ধ করতো এবার৷ চুপ করে বোস৷”
স্টেশন আসতে টুকাইরা নেমে পড়ল, উঠল রেলগাড়ীতে৷ টুকাই বসল জানালার ধারে, একমনে আশ্চর্য্য হয়ে দেখতে লাগল কেমন করে মাঠের গাছপালাগুলো শনশন করে উল্টোদিকে ছুটে বেরিয়ে যাচ্ছে৷
ট্রেন থেকে নেমে ট্যাক্সি চড়ে টুকাই বাবা-মায়ের সঙ্গে পৌঁছাল শহরের ঘরে৷ কিন্ত্ত এখানে বনের জঙ্গলের মত খালি ইঁটের বাড়ীর জঙ্গল আর চারদিকে গিজগিজ করা মানুষ দেখে হতভম্ব হয়ে গেল৷
কলকাতায় এসে টুকাই ভর্তি হল স্কুলে৷ জুটল অনেক নতুন বন্ধু৷ নিয়ম করে সে প্রতিদিন মায়ের হাত ধরে স্কুলে যায়, আর ছুটির দিন রোববারে মা-বাবার সঙ্গে বেরিয়ে পড়ে ঘুরতে৷

এক রোববার টুকাইরা গেল সিনেমা দেখতে৷ টুকাই আগে কখনো সিনেমা দেখেনি, তাই সিনেমা দেখার নাম শুনে লাফিয়ে উঠল৷ বিকেলবেলা ভাল জামাকাপড় পরে মা-বাবার হাত ধরে ঢুকল সিনেমা হলে৷ দেখল ছেলে-মেয়ে বাচ্চা-বুড়ো অনেক লোক এসেছে সিনেমা দেখতে৷ তাদের বিভিন্ন রকমের পোষাক, অনেকের পোষাক আবার সে কলকাতা আসার সময় বাসে বসে যেমন দেখেছিল সেইরকম৷

ভিতরে গিয়ে টুকাই বসল মা-বাবার মাঝখানে৷ কিছুক্ষণ পরে সিনেমা শুরু হল৷ পর্দায় নানারকম লেখা, ছবি ভেসে উঠতে লাগল৷ প্রথমে শুরু হল জাতীয় সঙ্গীত, ঠিক যেমন তাদের স্কুলে গাওয়া হয়৷ মা-বাবা টুকাইকে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইতে লাগল৷ টুকাই আশ্চর্য্য হয়ে লক্ষ্য করল হলের সমস্ত লোক উঠে দাঁড়িয়ে একসঙ্গে ‘জনগণমন’ গাইছে৷ গান শেষ হতে সবাই আবার বসে পড়ল৷ টুকাই বাবাকে জিজ্ঞেস করল, “আচ্ছা বাবা, হিন্দু, মসলমান, খ্রীষ্টান সবাই তো বিভিন্ন জনের ভক্ত, আলাদা আলাদা পোষাক পরে৷ তবু সবাই মিলে একসঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে জাতীয় সঙ্গীত গাইছে কেন? ওদের ভগবান রাগ করবে না?”

বাবা মৃদু হেসে ছেলের পিঠে হাত বুলিয়ে বললেন, “না বাবা, রাগ করবে না৷ ভারত মা যে আমাদের সকলের মা, আমরা সকলেই ভারত মায়ের সন্তান৷ আমাদের একটাই পরিচয়, আমরা সবাই ভারতবাসী৷”
টুকাইয়ের হঠাৎ কী হল কে জানে৷ উঠে দাঁড়িয়ে উপরে হাত তুলে জোরে বলে উঠল, “আমিও ভারতবাসী৷”
“কী করছিস? এমন করে সিনেমা হলে কেউ চেঁচায় নাকি? লোকে কী বলবে? চুপ করে বোস৷” বলে বাবা টুকাইয়ের হাত ধরে টেনে সিটে বসিয়ে দিল৷
মুখ তুলে টুকাই দেখে হলের সবাই তার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে আছে৷