শামীম হক মণ্ডল
আমাদের টাকার (ভারতীয় রুপি) মূল্য আমেরিকান (ডলার) ও ইউরোপিয়ান (ইউরো) টাকার তুলনায় অনেক কম, আবার উপমহাদেশের অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি। কেমন হতো, যদি সব দেশের মানুষ একই রকম টাকায় লেনদেন করতেন? কী ভাবছেন, তা আবার হয় নাকি? যদি পারস্পরিক বিনিময় হতো শক্তির এককে, মানে এই ধরুন আর্গ, কিংবা জুলে। আদতে সেটাই কিন্তু সত্যি! শক্তিই এই পৃথিবীর গ্লোবাল কারেন্সি বা বিশ্বজনীন মুদ্রা।
আগুনের ব্যবহার যেদিন থেকে মানুষ শিখল সেদিন থেকেই সে খোঁজ করে আসছে হরেক রকমের জ্বালানির। মানে কাঠ, কয়লা, খনিজ তেল প্রভৃতি। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ক্রমশ ফুরিয়ে আসছে। বিকল্প সন্ধান যে বিশ্ববাসী করেনি তা নয়, কিন্তু পরিবর্তে যেগুলি পেয়েছে (যেমন জলবিদ্যুৎ, বায়ু শক্তি, সৌর শক্তি), তা থেকে চাহিদা মত শক্তি পাওয়া কঠিন। বিশ শতকের গোড়ার দিকে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেন পদার্থের ক্ষুদ্রতম একক, অর্থাৎ পরমাণুর বিভাজনে বিপুল শক্তি পাওয়া যায়। বিজ্ঞানীদের হিসেব অনুযায়ী, ১ কেজি ইউরেনিয়াম থেকে দু’হাজার টন কয়লার সমান শক্তি মেলে!
এই বিভাজনের ক্ষেত্রে একটি ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াসকে হাল্কা পরমাণুর নিউক্লিয়াস দিয়ে আঘাত করলে, ভারী পরমাণুর নিউক্লিয়াসটি ভেঙে যায়, সঙ্গে উদ্গীরণ করে এক অমিত শক্তি। এই ঘটনার পোশাকি নাম নিউক্লিয় বিভাজন। লিসা মাইটনার নামক এক ক্ষণজন্মা মহিলা বিজ্ঞানী প্রথম এই বিভাজনের গাণিতিক ধারণা দেন। তিনি অঙ্ক কষে দেখান যে একটি উত্তেজিত নিউট্রন, একটা ভারী ইউরেনিয়ামের কেন্দ্রককে (যার মধ্যে ১৪৬টি নিউট্রন আছে) ভেঙে দেওয়ার ক্ষমতা রাখে।
এখন আমাদের জানতে হবে— এ শক্তি আসছে কোথা থেকে? আসলে যাদের ধাক্কার জন্য এই বিক্রিয়া হলো, বিক্রিয়ার পর উৎপন্ন পদার্থের ভর, তাদের চেয়ে সামান্য কম। না, এই মহাবিশ্বে তো হিসেবের গরমিল হওয়ার জো নেই। যেটুকু ভরের পার্থক্য হলো, পদার্থবিজ্ঞানের পরিভাষায় তাকে বলে ‘ভর ত্রুটি’, বা ‘মাস ডিফেক্ট’। আইনস্টাইন ততদিনে হিসেব কষে ফেলেছেন, এই বাড়তি ভর থেকে কী পরিমাণ শক্তি নির্গত হবে। আইনস্টাইনের নাম শুনে যতই বিষম লাগুক না কেন, তার ফর্মুলাটা কিন্তু বেশ সোজা— মানে ওই যে ভর ত্রুটির কথা বললাম, তাকে দু’বার আলোর বেগ দিয়ে গুণ করতে হবে আর কি! এই বিশাল শক্তিরই দুর্ভাগ্যজনক আত্মপ্রকাশ পরমাণু বোমা!
নিউক্লিয় বিভাজনের আবিষ্কারের বেশ কিছু বছর পর পদার্থবিদরা জানতে পারেন, শুধু বিভাজন নয়, হাল্কা মৌলের পরমাণুগুলো জুড়েও শক্তি পাওয়া যায়, তার নাম দেন নিউক্লিয় সংযোজন। এ ক্ষেত্রে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ আগের থেকে অনেক গুণ বেশি।
সাধারণত প্রকৃতির সবচেয়ে হালকা মৌল হাইড্রোজেন, যার কেন্দ্রে থাকা সবেধন নীলমণি একটা মাত্র প্রোটনকে ঘিরে ঘুরপাক খাচ্ছে একটাই ইলেক্ট্রন। হাইড্রোজেনের আরও দু’টি আইসোটোপ আছে— একটার নাম ডয়টেরিয়াম আর অন্যটা ট্রিটিয়াম। এই ডয়টেরিয়ামের কেন্দ্রে থাকে একটা নিউট্রন আর ওদিকে ট্রিটিয়ামের কেন্দ্রে থাকে দুটো। যদি কখনো দুটো ডয়টেরিয়াম মিলে যায়, তাহলে তৈরি হয় হিলিয়াম ও প্রচুর শক্তি। এই নিউক্লিয় সংযোজন বিক্রিয়াতেও দেখা যায় ভর ত্রুটি, যা প্রচন্ড শক্তির উৎস।
ডয়টেরিয়াম সমুদ্রের জলে পাওয়া যায়। মাঝারি আকারের এক বালতি জলে যে পরিমাণ ডয়টেরিয়াম থাকে, তা থেকে দু’টন পরিমাণ কয়লার সমতুল্য শক্তি পাওয়া যায়! আর এই ধরার এতো বিপুল সামুদ্রিক জলরাশিতে কী পরিমাণ আছে এই ডয়টেরিয়াম? বিজ্ঞানীদের অনুমান যে পরিমাণ ডয়টেরিয়াম মজুত আছে, তাতে এই অধুনিক সভ্যতা এখনও ৫০০০ কোটি বছর হেসে খেলে কাটিয়ে দেবে। ভাবা যায়!
কী করে জোড়ে ডয়টেরিয়াম বা অন্যান্য হাল্কা পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলো— যেখানে ওদের কেন্দ্রে আছে ধনাত্মক আধান বিশিষ্ট প্রোটন, যারা পরস্পরকে বিকর্ষণ করে প্রতিনিয়ত? সহজে এ কাজ হওয়ার নয়। অতি উচ্চ তাপমাত্রায় প্রায় কুড়ি কোটি ডিগ্রি সেলসিয়াসে দুটি ডয়টেরিয়ামের কেন্দ্রক তাদের ভিতর কাজ করা কুলম্ব বলকে উপেক্ষা করে কাছাকাছি আসে। এই তাপমাত্রায়, তাদের চেহারা আর আস্ত থাকে না, বাষ্পীভূত হয়ে পরিণত হয় প্লাজমায়। কী এই প্লাজমা? কঠিন তরল গ্যাসের মত এটি পদার্থের একটা বিশেষ অবস্থা, যাতে মিশে থাকে ইলেকট্রন, নিউট্রন, নিউক্লিয়াসের কণিকা, এমনকি পরমাণুর আস্ত নিউক্লিয়াসও। এ বিষয়ে পরে বিশদে আলোচনা করা যাবে। উচ্চ উষ্ণতার গতিশীল কণাগুলোকে আটকে রাখা যাবে কীকরে? বিজ্ঞানীরা সাহায্য নিলেন চুম্বক ক্ষেত্রের। আমরা পড়েছি, একটা দণ্ডের বাইরে চুম্বক বলরেখা বিদ্যমান থাকে, তারা চুম্বক বলরেখা থেকে বেরিয়ে এসে ঢোকে। যেন অদৃশ্য এক বেড়াজাল। হ্যাঁ, এই অদৃশ্য শক্তি রেখা, তথা চুম্বক বলরেখার বেড়াজালকেই বিজ্ঞানীরা ব্যবহার করলেন এই উত্তপ্ত আহিত কণা, নিউক্লিয়াসের টুকরোগুলোকে আটকে রাখতে। এই প্রক্রিয়ার পোশাকি নাম ম্যাগনেটিক কনফাইনমেন্ট বা চুম্বকীয় আবদ্ধকরণ। তীব্র চুম্বকীয় চাপের দরুণ ডয়টেরিয়াম নিউক্লিয়াসগুলি কাছাকাছি আসে এবং একে অপরের সঙ্গে ধাক্কা খায় ও পরস্পর মিলিত হয়ে নতুন মৌলের জন্ম দেয়, সেইসঙ্গে উদ্গীরণ করে বিপুল পরিমাণ শক্তি।
বিজ্ঞানীরা টোকাম্যাক নামে এক অত্যাধুনিক যন্ত্র ব্যবহার করেন, যার কেন্দ্রে সৃষ্টি করা হয় দুই কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা। এর ভেতরেই চলতে থাকে এই সমস্ত বিক্রিয়াগুলি। যে শক্তি উৎপন্ন হয় তার থেকে খরচের পরিমাণ যদিও বেশি কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে কম খরচে প্রচুর শক্তি উৎপন্ন করা যাবে।
আসলে প্লাজমাকে নিয়ন্ত্রণে রাখা খুবই দুরূহ একটা ব্যাপার। যতই চুম্বকীয় বলরেখার বেড়াজালে তাদের আবদ্ধ করে রাখা যাক না কেন, ফাঁকফোকর পেলেই অমনি বহির্মুখে যাত্রা শুরু করে। তখন পুরো পরিশ্রমটাই মাটি। সেজন্য বিজ্ঞানীরা নতুন এক কায়দা বার করেছেন। সাধারণত ডয়টেরিয়াম সমৃদ্ধ জলকে বলা হয় ভারী জল। এই ডয়টেরিয়াম পরমাণু সম্পৃক্ত ভারী জলের এক ফোঁটাকে অত্যন্ত কম উষ্ণতায় ঠান্ডা করা হয়। এক সময় সেটি ঘনীভূত হয়ে খুব ছোট্ট বরফকণার আকার ধারণ করে। যেন ছোট্ট আলপিনের মাথায় একফোঁটা বরফ। ভারী জলের এই বরফকণার উপরে ফেলা হয় অতি শক্তিশালী লেজার রশ্মি। এই লেজারের আঘাতে ভারী জলের ঘনীভূত কণাটি উত্তপ্ত হয়ে ওঠে এবং এর মধ্যে থাকা ডয়টেরিয়াম পরমাণুর নিউক্লিয়াসগুলি মিলিত হয় ও শক্তি উদগীরণ করে। এরপর লেজার রশ্মির নিচে রাখা হয় আর একটা ঘনীভূত ভারী জলের কণাকে। মূলত আবার হয় একটা ছোট বিস্ফোরণ। এভাবে একটার পর একটা ভারী জলের ঘনীভূত কণার জন্য ক্রমান্বয়ে একটার পর একটা বিস্ফোরণ হতেই থাকে। প্রতিটি বিস্ফোরণে অল্প শক্তি পাওয়া গেলেও একসঙ্গে মেলে প্রচুর শক্তি। বিজ্ঞানীরা একটা হিসাব করে দেখেছেন, পর্যাপ্ত পরিমাণ শক্তি পেতে হলে প্রতি সেকেন্ডে কমপক্ষে বিশটা ঘনীভূত ভারী জলের কণার বিস্ফোরণ জরুরি। এই তাপ দিয়ে তরল লিথিয়ামকে উত্তপ্ত করা হয়। লিথিয়াম এক বিশেষ প্রকার ধাতু। এই উত্তপ্ত লিথিয়াম থেকে তাপ সরবরাহ করা হয় জলে, ফলত জল পরিণত হয় বাষ্পে, আর সেই বাষ্প ঘোরায় তার কণাগুলিকে। এই জল, থুড়ি ভারী জল থেকেই মেলে শক্তি। মনে পড়ে যায় বিশিষ্ট কবি হেলাল হাফিজের একটা কাব্যগ্রন্থের নাম, ‘যে জলে আগুন জ্বলে’।
প্রবল অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও উচ্চ উষ্ণতার দরুন হালকা মৌলের কেন্দ্রকে যে মিলন, পদার্থবিদ্যার পরিভাষায় তার নাম ‘থার্মো নিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাকশন’। ২ কোটি ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় ঘটে এই ফিউশন রিঅ্যাকশন! আন্দাজ করা যায় তাপমাত্রাটা! থার্মো শব্দটি আসলে একটি ল্যাটিন শব্দ, যার মানে উত্তপ্ত। সত্যি এটি উত্তপ্ত সংযোজন বিক্রিয়া বটে।
কী ভাবছ, আধুনিক বিজ্ঞানের অগ্রগতির ফলেই জানা গেল এই ফিউশন রিঅ্যাকশনের কথা? একেবারেই না। পৃথিবীবাসী এই নিউক্লিয়ার সংযোজন বিক্রিয়ার সুবিধা ভোগ করে আসছে সেই আদিকাল থেকে। হ্যাঁ, প্রতিদিন অকাতরে তাপ ও আলো দান করে আসছে যে সূর্য, তার জ্বালানির ইন্ধন আসছে এখান থেকেই। বছরভর তার কেন্দ্রে সংঘটিত হচ্ছে এই থার্মোনিউক্লিয়ার বিক্রিয়া, আর শক্তি পাচ্ছি আমরা। শুধু সূর্যই নয়, মহাকাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এরকম অসংখ্য প্রাকৃতিক থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাক্টর। হ্যাঁ, ওই যে রাতের আকাশে মিটমিট করা তারাদের কথাই বলছি। দূরত্বের কারণে যদিও তাদের শক্তি আমাদের কাছে পৌঁছয় না, তবুও তাদের হেঁশেলের ইন্ধন যোগায় এই থার্মোনিউক্লিয়ার রিঅ্যাকশন।
শুধুই কি বিপুল শক্তি? না, নির্ভেজাল শক্তির কারণেই এই থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাকশন আরো বেশি টানছে বিজ্ঞানীদের। সচরাচর যে সমস্ত জ্বালানি ব্যবহার করে আমরা আমাদের দৈনন্দিন প্রয়োজন মেটাই, উপরি পাওনা হিসেবে মেলে প্রচুর বর্জ্য পদার্থ। আর কয়লা হোক বা খনিজ তেল কোনোটাই তো অফুরন্ত নয়। মনে পড়ে যায় কালজয়ী রসায়নবিদ, পর্যায় সারণির স্রষ্টা মেন্ডেলিভের সেই বিখ্যাত উক্তি- ‘পেট্রোল বা ডিজেল দিয়ে মোটর চালানোর অর্থই হচ্ছে টাকা দিয়ে আঁচ ধরানো।’ সত্যি তাই। যে খনিজ তেল দিয়ে আমরা বিভিন্ন ব্যবহারযোগ্য জিনিস তৈরি করতে পারতাম, সেগুলো আমরা ব্যয় করে ফেলছি ট্রাক্টর চালাতে, স্টিমার চালাতে, হরেক মেশিন চালাতে। এক কথায় আমাদের বেশিরভাগ সঞ্চিত খনিজ ব্যয় হয়ে যাচ্ছে জ্বালানি হিসেবে।
সেই জ্বালানি সংকট থেকে পরিত্রাণ পেতে আধুনিক পদার্থবিজ্ঞানীরা বদ্ধপরিকর। তাঁরা গবেষণা করে দেখেছেন নিউক্লিয় সংযোজন এক্ষেত্রে সন্তোষজনক ভূমিকা রাখতে পারে। ল্যাবরেটরিতে কণা ত্বরক যন্ত্রে (পার্টিকল অ্যাকসিলারেটর) সংযোজন ঘটিয়ে শক্তি তাঁরা উৎপন্ন করতে পেরেছেন। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, এক্ষেত্রে উৎপন্ন শক্তির পরিমাণ ব্যবহৃত শক্তির থেকে কম। যে উদ্দেশ্যে এত আয়োজন, তাতে ভাটা পড়লে তো সমস্যা। তাই হয়ত বিজ্ঞানীরা চিন্তা করে দেখলেন এমন একটা নিউক্লিয়ার সংযোজন বিক্রিয়া দরকার যেখানে বিক্রিয়া একবার শুরু হলে আর বন্ধ হবে না, স্বয়ংক্রিয়ভাবে চলতে থাকবে। যেটা কিছুটা দেখা যায় হাইড্রোজেন বোমায়, যার শক্তি কল্পনাতীত। বিজ্ঞানীরা চাইছেন, কন্ট্রোল ফিউশন reactor বা নিয়ন্ত্রিত সংযোজন চুল্লি বানাতে। আরো স্থূলভাবে বললে, বলা যায় তাঁরা চাইছেন পৃথিবীতে এক টুকরো সূর্য সৃষ্টি করতে। শক্তি উৎপাদনের পাশাপাশি, সেই কৃত্রিম সূর্য থেকে জানা যাবে নক্ষত্রের হেঁশেলে প্রতিমুহূর্তে ঘটে চলা বিভিন্ন থার্মোনিউক্লিয়ার ফিউশন রিঅ্যাকশনের কথা।