রাতের হোটেল

সুদীপ ওম ঘোষ

দূরের পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিনকার মতো চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছে সুবিমল। পাহাড়ের রূপ প্রতিদিন ওর কাছে নতুন লাগে। পাহাড় যেন বহুরূপী। প্রতিদিন রূপ পরিবর্তন করে। সকালের কোমল সূর্যের আলো পাহাড়ের শরীরে ছড়িয়ে গিয়ে পাহাড়কে জীবন্ত করে তোলে। ছোট্ট ব্যালকনিটায় বসে চা খেতে খেতে সুবিমল ভাবছে প্রকৃতির এই অপরূপ মুগ্ধতা যে কখনও দেখেনি তার জীবন সত্যিই বৃথা। মাসখানেক হলো দার্জিলিং এর এই ছোট্ট পাহাড়ি গ্রামটায় চাকরি সূত্রে এসেছে সুবিমল। এখানকার পোস্ট অফিসে সে চাকরি পেয়েছে। দীর্ঘদিনের কঠোর পরিশ্রম আর লড়াইয়ের পর চাকরিটা ও পেয়েছে।

যখনই ও জানতে পারে ওর পোস্টিং দার্জিলিং, দুটো আনন্দ মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছিল। উত্তর কলকাতার ছেলে সুবিমল। পাহাড় ওর বড্ড প্রিয়। বাড়িতে বাবা মা আর ছোট বোন আছে।


এখানে একটা বাড়িতে ভাড়া নিয়ে আছে সুবিমল। বাড়ির মালিক খুব ভালো। রিতেশ নেপালি। স্ত্রীকে নিয়ে থাকে। ওদের কোনও সন্তান নেই। রিতেশ চা বাগানে কাজ করে। ওর স্ত্রী বাড়িতেই থাকে।

সুবিমল তিনবেলা রিতেশের ঘরেই খায়। রিতেশের বয়স বছর পঞ্চান্ন হবে। ওর স্ত্রী হেনা সুবিমলকে ভাই বলে ডাকে। সুবিমলও দিদি বলে। এই কয়েক দিনে ভাই-বোনের খুব মিষ্টি একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। পাহাড়িদের আন্তরিক মিষ্টি ব্যবহার ওকে মুগ্ধ করেছে। সত্যিই পাহাড়িরা পাহাড়ের মতো অনেক বড় আর উদার মনের হয়। বাড়ি থেকে এতটা দূরে থাকতে ওর কোন অসুবিধাই হচ্ছে না। বরং কলকাতার ওই হৈ-হট্টগোলের থেকে বেরিয়ে এসে প্রাণ ভরে বিশুদ্ধ বাতাস নিতে পারছে সুবিমল। আরও মিনিট দশেক চুপচাপ বসে থাকলো। হেনার ডাকে উঠে দাঁড়ালো। অফিস যেতে হবে। দ্রুত রেডি হতে হবে। অফিস এখান থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার। একটা সাইকেল জোগাড় করে দিয়েছে রিতেশ। এটাই সুবিমলের এই পাহাড়ি অঞ্চলের একমাত্র ভরসা। ছুটির দিন সাইকেল নিয়ে নানান জায়গায় ঘুরতে বেরিয়ে পড়ে। অনেক নতুন নতুন জায়গা ও চিনেছে। ঘন্টাখানেকের মধ্যে রেডি হয়ে সাইকেল নিয়ে মুখে একটা প্রিয় গানের কলি ভাঁজতে ভাঁজতে অফিসের উদ্দেশে রওনা হল সুবিমল।

আজ রবিবার সুবিমলের ছুটির দিন। দুপুরে লাঞ্চের পর সাইকেলটা নিয়ে বেরিয়ে পড়ল। আজ একটা নতুন রাস্তায় এগিয়ে চলল। এই একমাসে পাহাড়ি রাস্তায় সাইকেল চালানোয় বেশ পটু হয়ে গেছে সুবিমল।

সন্ধ্যা হয়ে গেছে সুবিমল ঘরে ফিরবে। হঠাৎই ওর চোখ পড়ল দূরের একটা আলো ঝলমলে সাইনবোর্ডে। সাইকেলটা নিয়ে একটু এগিয়ে গেল। সাইনবোর্ডে লেখা ‘রাতের হোটেল’! বেশ অবাক হল সুবিমল। সাইকেলটা রেখে দরজা ঠেলে হোটেলের ভিতরে ঢুকল। হঠাৎই সমস্ত শরীর শিরশির করে উঠল। ক্যাশ কাউন্টারে যিনি বসে আছেন তিনি ভূতের পোশাক পরে! হোটেলের ভিতরে আলো আঁধারি পরিবেশ। হালকা একটা ইংরেজি গানের সুর বাজছে। দূরে একটা টেবিলে মাত্র দুজন লোক বসে কিছু খাওয়াদাওয়া করছে! একজন ওয়েটার খাবার পরিবেশন করছে। তারও ভূতের পোশাক পরা! সুবিমল বুঝতে পারল হোটেলটায় ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। পর্যটকদের আকর্ষণ বৃদ্ধির জন্যেই যে এটা করা হয়েছে সেটা সুবিমল বেশ বুঝতে পারল। একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল সুবিমল। হঠাৎই একজন ওয়েটার যেন উড়ে এল সুবিমলের সামনে। বুক ধড়ফড় করে উঠল সুবিমলের। কেউ তো আসেপাশে ছিল না! এত দ্রুত। যথারীতি ওয়েটারের পুরো ভূতের পোশাক পরা। সুবিমলের সামনে মেনুচার্ট এগিয়ে দিল। সুবিমল নিজেকে সামলে নিয়ে চার্টে চোখ বুলিয়ে নিল। ‘এই হোটেলটা কি শুধু রাতেই খোলে?’ ওয়েটার মাথা নাড়লো। সুবিমল খাবারের অর্ডার দিল। যেমন ভাবে ওয়েটারের আবির্ভাব হয়েছিল ঠিক সেই ভাবেই যেন সে চলে গেল। মনে মনে হাসলো সুবিমল। এতো নিখুঁত কাজ তো সত্যিই দেখা যায় না। এই হোটেলে এলে পর্যটকদের ভালো তো লাগবেই।

খুবই দ্রুত সুবিমলের টেবিলে খাওয়ার চলে এল। ওয়েটারকে আপাদমস্তক পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো সুবিমল। ওয়েটারের হাতের দিকে তাকিয়ে সুবিমলের শিরদাঁড়া দিয়ে হিম শীতল একটা ঠাণ্ডা স্রোত বয়ে গেল! খাবারে কোনও হাত দিচ্ছে না তবুও খাবারগুলো ওর পাতে চলে যাচ্ছে! অদ্ভুত! কোনোদিকে না তাকিয়ে ও দ্রুত একছুটে হোটেলের বাইরে বেরিয়ে এল। সুবিমল বুঝতে পারল পিছনে কেউ তাড়া করেছে! যেন সে হাওয়ায় উড়ে আসছে! সাইকেল নিয়ে যতটা দ্রুত সম্ভব ওই স্থান ত্যাগ করার চেষ্টা করল।

রাত ন’টা বেজে গেছে। ওদিকে রিতেশ আর হেনা বাড়িতে খুব চিন্তা করছে, এখনো ঘরে ফেরেনি সুবিমল। এতটা রাত তো কোনদিনই করে না। কোনও ভুল রাস্তায় চলে যায়নি তো! এটা ভেবেই বিচলিত হচ্ছে দু’জন। হেনা রিতেশকে খুঁজতে পাঠিয়ে দিল। প্রায় মিনিট কুড়ি পর একটা জনমানবহীন রাস্তায় কাউকে পড়ে থাকতে দেখে রিতেশ! পাশে একটা সাইকেল দেখে চিনতে পারে। দ্রুত এসে আবিষ্কার করে অচৈতন্য হয়ে সুবিমল পড়ে আছে! তড়িঘড়ি ডাকাডাকি শুরু করল। কিছুক্ষণের মধ্যে জ্ঞান ফিরে এল সুবিমলের। আস্তে আস্তে পুরো ঘটনা বলল। সব শুনে রিতেশের মুখের ছবি দ্রুত পরিবর্তন হয়ে গেল। ফিসফিস করে বলল, ‘ওটা তো ভূতের হোটেল। প্রতিদিন সন্ধ্যায় খোলে। সারারাত হোটেল চালু থাকে। অনেকেই বলে ওখানে যারা কাজ করে সবাই মানুষ নয়। আমাদের এখানকার লোকজন কেউই ওখানে যায় না। পর্যটকরা শুধু ওখানে যায়।’ কোনও কথা না বলে সুবিমল ভাবতে লাগল, ওর সন্দেহটাই সঠিক ছিল।