• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

দীপালির আলোকে নজরুল সঙ্গীত

খেয়ালে উঁচু দরের কাব্য নেই। আর রাগপ্রধান গান রাগসঙ্গীত হয়েও কাব্যসঙ্গীত বাংলা গান। বাংলা গান চিরকালই কাব্যপ্রধান, কিছু সরগম ও সুন্দর ছন্দের বোলতান, ক্ষেত্রবিশেষে রাগপ্রধান গানে ব্যবহার করা যেতে পারে।

কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন বিশেষ ধরনের একজন রবীন্দ্র- অনুরাগী অথচ নিজের সৃষ্ট, ভাব-ভাষা-সুর-তাল-লয়ে— তিনি স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে আপন বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। সঙ্গীতস্রষ্টা কাজী নজরুল যে সঙ্গীত সৃষ্টি করেছিলেন সেই সঙ্গীত সুরের মায়াজালে আচ্ছন্ন।
কাজী নজরুল ইসলাম রচিত সঙ্গীত মূলত শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের দ্বারা প্রভাবিত। একাধিক রাগের ছায়ায় সৃষ্ট হয়েছে তাঁর গান, এইসব গানের উপর প্রভাব বিস্তাঁর করেছে উত্তর ভারতের খেয়াল, ঠুমরি, টপ্পা, গজল, কাওয়ালী, লাউনি প্রভৃতি এমনকি লোকগীতির ধারাও। মূলত খেয়াল ও ঠুমরি গানের প্রতি কাজী নজরুলের ছিল গভীর অনুরাগ। তাঁর রাগাশ্রয়ী গানগুলি ও মিশ্র রাগের গানগুলি বিশ্লেষণ করলে যে বৈশিষ্ট্যগুলি প্রধানত দেখা যায় তা হলো— (১) প্রচলিত রাগাশ্রয়ী গান (২) মিশ্র রাগের গান (৩) প্রচলিত রাগের পুনরুদ্ধার (৪) নব রাগ সৃজন (৫) লক্ষণ গীতের বাংলা রূপায়ন (৬) বিভিন্ন প্রদেশের এবং দুই বাংলার আঞ্চলিক লোকগীতির সুর সঞ্চয়ন (৭) বাংলা গানে বিদেশি সুরের প্রয়োগ ও রূপান্তর। এছাড়াও হিন্দি খেয়াল গানের সুরের প্রয়োগ করে বাংলা গানে নতুনত্বের আবির্ভাব ঘটিয়ে ছিলেন তিনি। রবীন্দ্রনাথের ভাঙাগান-এ যেমন দেখা যায় রবীন্দ্রনাথ নিজের রচিত গানে হিন্দি খেয়াল গানের সুরের প্রয়োগ করেছেন, অনুরূপভাবে নজরুলও তাঁর অনেক গানে হিন্দি খেয়াল ও ঠুমরি সুর ব্যবহার করে তাঁর রূপান্তর ঘটিয়েছেন।

নজরুল প্রথম জীবনে নানা ধরনের গান ও তাঁর বিচিত্র সুর-লহরী আয়ত্ত করেছিলেন। তাঁর সঙ্গীতে পরবর্তীকালে তিনি যথাযথভাবে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের অনুশীলন করে, তাঁর রীতি-নীতি, পদ্ধতি সম্পর্কে অভিজ্ঞ হয়ে ওঠেন এবং সঙ্গীত সমাজের গুণীজনদের নিকট সমাদৃত হয়েছিলেন।
আগ্রা ঘরানার বিখ্যাত ওস্তাদ বাদল খাঁ সাহেব ছিলেন সমকালীন উস্তাদদের মধ্যে অগ্রণী। খাঁ সাহেবের সুযোগ্য শিষ্যদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায় ও উস্তাদ জমিরুউদ্দিন খাঁ। এঁদের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন স্বয়ং নজরুল। এছাড়া এই ঘরানার উস্তাদ দবির খাঁ সাহেব, মঞ্জুসাহেব, মস্তানা গামা প্রভৃতি বিশিষ্ট গুনীজনের সান্নিধ্য লাভ করেছিলেন কবি। তবে গুরু হিসাবে জমিরুদ্দিন খাঁ সাহেবের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেছিলেন এবং তাঁর প্রমাণ-স্বরূপ দেখা যায় কবি তাঁর ‘বনগীতি’ সঙ্গীতগ্রন্থটি তাঁর প্রিয় উস্তাদ জমিরুদ্দিন খাঁ সাহেবকেই উৎসর্গ করেছিলেন। কবির সঙ্গীত জীবনের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখতে পাই, কবি ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রথম পাঠ নিয়েছিলেন আগ্রা ঘরানার উস্তাদদেরই কাছে।

এই ঘরানার মহান শিল্পী ছিলেন উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ। যৌবনে উস্তাদ ছিলেন বরোদার সভা-গায়ক। তিনি অনেক খেয়াল ও ঠুমরির বন্দিশ রচনা করেছিলেন এবং সেই বন্দিশে নিজেই সুরারোপ করেছিলেন বিভিন্ন রাগে। তাঁর ছদ্মনাম ছিল ‘প্রেমপিয়া’। তাঁর রচিত গানে তিনি এই ছদ্মনাম ব্যবহার করেছেন। তাঁর অনেক বন্দিশে দেখা যায় উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সনাতনী হয়েও তাঁর নিজের পরিবেশিত খেয়াল ও ঠুমরিতে সামান্য বদল করতে দ্বিধা করেননি, তাকে তাই বলা হত ‘নিও-ক্লাসিস্ট’। তাঁর সময়েই তিনি হয়ে উঠেছিলেন সর্বশ্রেষ্ঠ।

উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের প্রিয় শিষ্য ছিলেন বিদূষী দীপালি নাগ (তালুকদার)। ইনি আগ্রা ঘরানার শিল্পী ছিলেন। দীপালি কাজী নজরুলের সান্নিধ্যে এসেছিলেন ১৯৩৮ সালে।
নজরুল সঙ্গীতের বিপুল ভাণ্ডারটি সমৃদ্ধি লাভ করেছিল কবির রচিত সুর ও বাণীতে; আবার তাঁর রচিত গানে সেই সময়ের বিভিন্ন শিল্পীর সূরারোপের মাধ্যমে। যে সকল সঙ্গীত শিল্পী তাঁর গানে সুরারোপ করেছিলেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম বলা যায় বিদূষী দীপালি নাগকে।

যে সময় দীপালি সঙ্গীত সাধনায় রত হন ও কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন তখনকার সঙ্গীত রসিক মহল ও পরিবেশ ছিল একালের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা। তখনকার অভিজাত ঘরের মেয়েদের সহজাত প্রতিভা থাকলেও সর্বসমক্ষে তাঁদের সঙ্গীত পরিবেশন করার রীতি সেকালে প্রচলিত ছিল না, যদিও দীপালি সৌভাগ্যবশত এমন একটি স্বতন্ত্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন ও লালিত পালিত হন যেখানে অনায়াসে অপ্রতিহত গতিতে তাঁর সঙ্গীত জীবন সার্থকভাবে বিকশিত হয়ে উঠেছিল।

শিল্পী দীপালি (তালুকদার)-র জন্ম ১৯২২ সালে ২২ ফেব্রুয়ারি দার্জিলিঙে। তাঁর পিতা জীবনচন্দ্র তালুকদার ও মাতা তরুলতার অতি আদরের জ্যেষ্ঠা কন্যা দীপালির শৈশব আগ্রায় অতিবাহিত হয়, কারণ জীবনচন্দ্রের কর্মস্থান ছিল আগ্রা। সেখানকার সেন্ট জন্স কলেজের তিনি ছিলেন খ্যাতনামা ইতিহাসের অধ্যাপক, অবশ্য তাঁদের আদি নিবাস ছিল পূর্ব বাংলার ঢাকা জেলার (বর্তমানে বাংলাদেশে) কুমারভোগ অঞ্চলের কাজির পাগলা গ্রামে।

শৈশবেই দীপালি গান বাজনার প্রতি বিশেষ এক ধরনের আকর্ষণ অনুভব করতেন। তাঁর পিতাও ছিলেন একজন সঙ্গীতানুরাগী, নিজেও তিনি ভালো গান গাইতেন। তাঁর বাড়িতেই মাঝে মাঝে নামকরা উস্তাদেরা এসে নিয়মিত সঙ্গীত পরিবেশন করতেন। মাঝে মাঝে আবার পুরনো দিনের বাংলা গানের জলসাও বসত।

দীপালির ছোটবেলা অতিবাহিত হয়েছিল সেই সঙ্গীতমুখর পরিবেশের মধ্যে, তাই তখন স্বাভাবিকভাবে তাঁর মধ্যে সঙ্গীত প্রতিভার স্ফুরণ ঘটেছিল। ক্রমশ কৈশোর উত্তীর্ণ হয়ে যৌবনে পদার্পণ করলেন তিনি, পরে বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলেন। যে দুটি বিষয়ের প্রতি তাঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল তা হল সঙ্গীত ও অঙ্কন, এই দুটি বিষয় তখন আগ্রা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠক্রমে অন্তর্ভুক্ত ছিল না। তাই বেনারসের হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি পরীক্ষা দিলেন, সে বছর সঙ্গীত ও চিত্রাঙ্কনে সমস্ত পরীক্ষার্থীদের মধ্যে চতুর্থ স্থান অধিকার করেছিলেন।

দীপালি পড়াশোনার সঙ্গে সঙ্গে এরপর সঙ্গীত সাধনাতে মনোনিবেশ করলেন। সেকালের প্রসিদ্ধ উস্তাদদের কাছে তাঁর রীতিমতো তালিম নেয়া শুরু হল। প্রথমে তিনি এই আগ্রা ঘরানারই উস্তাদ তসদ্দুক হুসেন খাঁ ও উস্তাদ বসির খাঁ-এর কাছে তালিম নেন। কিছুদিন পর তসদ্দুক খাঁ সাহেব তাঁর পিসতুতো ভাই ভারতের দিকপাল সঙ্গীতশিল্পী উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেবের সঙ্গে দীপালির পরিচয় করিয়ে দেন। উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ ছিলেন তখন বরোদার সভা-গায়ক। জীবনচন্দ্র তালুকদার মহাশয়ের উৎসাহ ও আগ্রহে ১৯৩৮ সালে উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ সাহেব স্বয়ং তাঁর বাড়িতে আসেন এবং কন্যা দীপালিকে সঙ্গীতের তালিম দেয়া শুরু করেন। খাঁ সাহেব যতদিন আগ্রায় থাকতেন ততদিন নিয়মিতভাবে তালিম দিতেন দীপালিকে। যখন তিনি বরোদায় চলে যেতেন তখন আবার উস্তাদ তসদ্দুক হুসেন খাঁ এবং উস্তাদ বশীর খাঁ-এর নিকট তালিম নিতেন দীপালি।

সেকালে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে পারদর্শী বাঙালি মেয়ের সংখ্যা ছিল মুষ্টিমেয়, সম্ভ্রান্ত ঘরের বাঙালি মেয়েদের উচ্চাঙ্গ সঙ্গীত শোনবার সুযোগ তেমন ছিল না। অল্প কিছুদিনের জন্য প্রবাস থেকে কলকাতায় এলে দীপালি কোনও কোনও ঘরোয়া আসরে গান শোনাবার জন্য আমন্ত্রিত হতেন। সম্ভবত সেই সালটি ছিল ১৯৩৮ সাল। পিতার সঙ্গে দীপালিও সেবার কলকাতায় এসেছিলেন। সেই সময় কবি ও নাট্যকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের পুত্র খ্যাতনামা সঙ্গীতশিল্পী দিলীপ রায়ের বাড়িতে একটি গানের আসরে দীপালি আমন্ত্রিত হন। সেখানে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেন। অন্যান্য অনেক গুণীজন ও সমঝদার শ্রোতাদের সঙ্গে সেদিন এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এইচ.এম.ভি র বড়কর্তা হেম সোম মহাশয়। তিনি দীপালির গান শুনে খুব খুশি হন, বলেন যে তিনি কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গে দীপালির পরিচয় করিয়ে দেবেন। যেমন কথা সেই মতো কাজ। পরের দিনই হেমবাবু দীপালিকে নলিনী সরকার স্ট্রিটে গ্রামোফোন কোম্পানির অফিসে যেতে বলেন।

যথাসময়ে দীপালি তাঁর বাবার সঙ্গে গ্রামোফোন কোম্পানির অফিসে উপস্থিত হলেন। হেমবাবুই প্রথম কাজী সাহেবের সঙ্গে দীপালির পরিচয় করিয়ে দিলেন। কাজী সাহেব যখন শুনলেন দীপালি আগ্রায় থাকেন, তখন তিনি দীপালিকে জিজ্ঞাসা করলেন যে তিনি বাংলা জানেন কি না। দীপালি মাথা নেড়ে ছিলেন কেবল। এরপর কবি গান শুনতে চাইলেন দীপালির। ওই সময় দীপালি তাঁর উস্তাদজি ফৈয়াজ খাঁর কাছে সদ্য তালিম নিচ্ছেন। সেই সময় উস্তাদজি তালিম দিচ্ছিলেন তাঁরই রচিত বিখ্যাত জয়জয়ন্তী রাগের বন্দিশ। উস্তাদজিরই রচিত বন্দিশ—
রাগ— জয়জয়ন্তী
কথা ও সুর— উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ
স্থায়ী—
‘মোরে মন্দির অবলে নেহী আয়ে
কা এসী চুকপরী মোরী অলি।।’
অন্তরা—
‘প্রেম পিয়াকী আঁখিয়াঁ তরস গই
কৌন সোতন বিলমা রহেপ্যারী।।’
কথা প্রসঙ্গে বলি— এই বন্দিশটিতে অন্তরাতে দেখা যাচ্ছে উস্তাদজি তাঁর ‘প্রেমপিয়া’ ছদ্মনামটি ব্যবহার করেছেন।
আবার ফিরে আসি আগের প্রসঙ্গে। ‘জয়জয়ন্তী’ রাগের ওই খেয়াল দিয়েই সেদিনের অনুষ্ঠান শুরু করেছিলেন কাজী নজরুলের সামনে। দীপালির গান শুনে আনন্দিত কাজী সাহেব হঠাৎ দীপালির গানের খাতাটি টেনে তৎক্ষণাৎ লিখে দিলেন ইতিহাস-প্রসিদ্ধ তাঁর বিখ্যাত গান—
‘মেঘ মেদুর বর্ষায় কোথা তুমি
ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভূমি।।
ঝুরে বারি ধারা ফিরে এসো পথহারা
কাঁদে নদী তত চুমি।।

কবি বললেন দীপালিকে, গানটিতে তুমি নিজেই সুর করে নিয়ে এসো। ঘটনাটি স্বয়ং দীপালি নাগের কাছেই শুনেছি।
কাজী সাহেব রচিত গানটি দীপালিদি সুন্দর করে উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ রচিত জয়জয়ন্তী রাগে রচিত বন্দিশের সুরে বাংলা কথাগুলি সাজিয়ে কাজী সাহেবকে শোনালেন। কাজী সাহেব খুব খুশি হয়ে গেলেন। ইতিহাস-প্রসিদ্ধ প্রথম দীপালি তালুকদারের রেকর্ড প্রকাশিত হলো এইচএমভি কোম্পানি থেকে। এর অপর পিঠে ‘রুম্ ঝুম্ ঝুম্ নূপুর বোলে’।
নজরুল রচিত গানে দীপালিদি সুর বসালেন আগ্রা ঘরানার ‘নট বেহাগ’ রাগের বন্দিশ—
‘ঝন্ ঝন্ ঝন্ ঝন্ পায়েল বাজে
জাগে মোরী সাস ননদীয়া
ঔর দোরনীয়াঁ হাঁরে জেঠনীয়া।’
অন্তরা—
‘অগর শুনে মোরা বগর সুনে গো জো
সুন পাবে সদা রংগীলে জাগে
মোরী সাস ননদীয়া
ঔর দোরনীয়াঁ হাঁরে জ্যেঠনীয়া।।’
কাজী নজরুল রচিত বাংলা গীতিকবিতাটি—
‘রুম ঝুম রুম ঝুম নূপুর বোলে
বনপথে যায় সে বালিকা
গলে শেফালিকা
মালতী মালিকা দোলে
চম্পা মুকুলগুলি
চাহে নয়ন তুলি
নাচে বিহাগ নিশি তরুতলে
গলে শেফালিকা
মালতী মালিকা দোলে।’

কাজী নজরুল ইসলামের রচনাতে দীপালির সুর দেওয়ার হাতে খড়ি থেমে যায়নি সেদিন। তারপর নজরুলের রচনার পরপর সুর থেকে সুরে রূপান্তরিত করেছেন বেশ কয়েকটি গান এবং সেই গানগুলি গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে রেকর্ড বেরিয়েছিল। দীপালির কন্ঠে কাজী সাহেবের তত্ত্বাবধানে প্রথম রেকর্ড ‘মেঘমেদুর বরষায়’। দীপালি তালুকদার রাতারাতি একজন জনপ্রিয় শিল্পী হয়ে উঠলেন। মেঘমেদুর গানটি তখন লোকমুখে চারিদিকে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল সেই সময়।…
এই বার চলে আসি অন্য প্রসঙ্গে। আমি ২০০০ সালে দীপালি নাগের কাছে তালিম নিতে আসি। দিদির কাছে তালিম নিয়েছিলাম তাঁরই সুরারোপিত গান, যে গানগুলি তিনি আগ্রা ঘারানার সুরে নজরুল ইসলামের গানগুলি রূপান্তরিত করেছিলেন। আগ্রা ঘরানার খেয়ালের বন্দিশগুলো দিদির কাছে শিখে, সেই খেয়ালের সুরে, সুরারোপিত কাজী সাহেবের গানগুলি ২০০২ সালে দিদির তত্ত্বাবধানে এবং দিদিরই নামকরণ ‘আমার মনের বেদনা’ গানের অ্যালবাম বিটফেন গ্রামোফোন কোম্পানি থেকে দিদি নিজ হাতে মিউজিক ওয়ার্ল্ড থেকে প্রকাশ করেন। উনি যে গানগুলি কাজী সাহেবের তত্ত্বাবধানে গেয়েছিলেন ১৯৩৮ সাল থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে, সেই গানগুলি থেকে আটটি গানের অ্যালবাম বের হয়।

এই অ্যালবামের একটি গান দিদি গেয়েছিলেন কাজী সাহেবের তত্ত্বাবধানে তিনটি লাইন। গানটি—
‘ফিরে নাহি এলে প্রিয় ফিরে এলো বরষা।’
কিন্তু দিদির খাতাতে কাজী সাহেবের হস্তাক্ষরে ছিল পাঁচ লাইন। নজরুল সঙ্গীতের বইয়ে দিদির গাওয়া রেকর্ড অনুযায়ী তিন লাইন দেখা যায়। দিদি আমাকে দিয়ে ২০০২ সালে গাওয়ালেন, কাজী সাহেবের রচিত দুই লাইন যোগ করলেন, গানটি সম্পূর্ণ হল। ওই গানটির যে দুটি লাইন যুক্ত হলো, আমিই প্রথম গাইলাম— গানটি সম্পূর্ণ হল। কথাপ্রসঙ্গে দিদির কাছে জানতে চেয়েছিলাম গানটি তখন কেন উনি সম্পূর্ণ গাননি! কথাগুলো ছিলোই, দিদি বললেন, তখন গান রেকর্ডের একটা সময় বাঁধা থাকতো। সময় বেশি হয়ে গেলে কেটে দিত। সেই জন্যই তখন উনি তিন লাইন গাইতে পেরেছিলেন। দিদি গানটি রেকর্ড করেছিলেন ১৯০৮ সালে।
আগ্রা ঘারানার মূল হিন্দি গান—
‘মোরি আলি পিয়া নাহ
কাহে মেঘ বরষে।’
নজরুল ইসলাম রচিত গান—
‘ফিরে নাহি এলে প্রিয়
ফিরে এলো বরষা।’
রাগ— গৌড় মল্লার (ত্রিতাল)। রেকর্ড নং— N-২৭০ ৭৩ জানুয়ারি ১৯৪১।

এরপর আমি আমার শ্রদ্ধেয় গুরুমা দীপালি নাগের তত্ত্বাবধানে কাজী নজরুল ও আগ্রা ঘারানার উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁকে নিয়ে গবেষণা কাজটি সম্পন্ন করি। আমার গ্রন্থ ‘ফৈয়াজী আলোকে নজরুলগীতি’ প্রকাশিত হয় ২০০৭ সালে। আমার বইটিও প্রকাশ করেন আমার গুরুমা। গবেষণার কাজটি করতে গিয়ে আমি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত ১৮টি গানের হদিস পাই। সেই গানগুলি প্রত্যেকটি সুরই আমার গুরুমা রূপদান করেছিলেন আগ্রা ঘারানার বিভিন্ন রাগের বন্দিশের উপর।
কাজী নজরুল ইসলামের গানে আগ্রা ঘারানার সুরের প্রভাবে সৃষ্টি হল একটি নতুন ধারার গান, যে গান আগ্রা ঘারানার সুরে ও ছন্দে প্রভাবিত। নজরুল সঙ্গীতে এল একটি নতুন শৈলী। শুধু তাই নয় এই নতুন ধারা বাংলা গানের সম্ভারকে সমৃদ্ধ করে দিল এবং কাজী নজরুলের গানে একটি নতুন ধারা সংযোজিত হল। এই কাজটি সম্পূর্ণ দিদির তত্ত্বাবধানেই করেছিলাম।

আমার গুরুমা বিদুষী দীপালি নাগের কাছেই আমার শেখা এবং জানা। উনি বলেছেন আগ্রা ঘারানার বৈশিষ্ট্য, গানের মধ্যে ‘বোল বানানা’। এই বোল বানানা দীপালি নাগ আনেন প্রথম বাংলা গানে তো বটেই এবং কাজী নজরুল ইসলামের গানে। সেই কারণে নজরুল ইসলাম রচিত বাংলা গানগুলি আগ্রা ঘরানার গায়কির প্রভাবে বাংলা গানে নতুনত্বের স্বাদ নিয়ে আসে এবং নজরুল সঙ্গীতকে সমৃদ্ধ করে তোলে একটি সম্পূর্ণ আলাদা শৈলীতে।

এই প্রসঙ্গে দীপালি নাগ বলেছেন, ‘খেয়ালে উঁচু দরের কাব্য নেই। আর রাগপ্রধান গান রাগসঙ্গীত হয়েও কাব্যসঙ্গীত বাংলা গান। বাংলা গান চিরকালই কাব্যপ্রধান, কিছু সরগম ও সুন্দর ছন্দের বোলতান, ক্ষেত্রবিশেষে রাগপ্রধান গানে ব্যবহার করা যেতে পারে। কিন্তু এদের ব্যবহারে সাবলীলতার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আর বর্জন করতে হবে সব রকমের অতিশয্য, কী গানের ভঙ্গিতে, কী প্রয়োগ পরিমাণে। কাজী সাহেবের এই গানগুলি এইভাবে উচ্চারিত হলে গানের শুদ্ধতা এবং রূপ যথাযথ ভাবে বজায় থাকবে।’

ইতিহাস পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে কাজী নজরুল আগ্রা ঘরানার গায়নশৈলী তাঁর গানে সাদরে গ্রহণ করেছেন। আমার মহীয়সী গুরুমার অনেক কাহিনী আমার জীবনে স্মরণীয় হয়ে আছে। তাঁর যথাযোগ্য মর্যাদা আমরা এখনও দিতে পারিনি, আজ এখানে তাঁর নাম স্মরণ করে তাঁকে সশ্রদ্ধ প্রণাম নিবেদন করে আমি ধন্য হলাম।

কাজী নজরুল ইসলামের লেখা অনেক গানই এখনো পর্যন্ত শ্রোতাদের কাছে অশ্রুত। তেমনি রেকর্ডে অপ্রকাশিত গান— ‘হে শ্যাম কল্যাণ দাও’ গানটি আমি গুরুমার কাছে শিখি ২০০৭ সালে। এই গানটি আমার সংগ্রহে ছিল। ১৯৩৮ থেকে ১৯৪২ সালের মধ্যে নজরুলের তত্ত্বাবধানে তাঁরই লেখা প্রায় ১৮টি গানে সুর দিয়ে গান করেন দীপালি নাগ। তাঁর গানের খাতায় সেসব গানের হদিস পাই। দিদির তত্ত্বাবধানে আমার গবেষণা গ্রন্থ ‘ফৈয়াজী আলোকে নজরুল গীতি’ বইয়ে এই অপ্রকাশিত গানটি প্রকাশ করি। দিদির কাছে জেনেছিলাম কাজী সাহেবের লেখা এই গানটি তিনি কাজী সাহেবের তত্বাবধানে গেয়েছিলেন।

‘হে শ্যাম কল্যাণ দাও’ গানটি দীপালি নাগের সুরে ও কন্ঠে সে সময় গ্রামোফোন কোম্পানিতে রেকর্ড হওয়া সত্ত্বেও, কোনও এক অজানা কারণে রেকর্ডটি প্রকাশিত হয়নি। এখনো পর্যন্ত নয়। কিন্তু আনন্দের বিষয় এই গানের বাণী দিদির নিজের হাতের লেখায় রাখা ছিল দিদির একটি গানের খাতায়। সেই পাণ্ডুলিপি আমার কাছে রক্ষিত। দিদি এই গানটির রূপদান করেছিলেন তাঁর গুরু উস্তাদ ফৈয়াজ খাঁর নিকট শেখা আগ্রা ঘরানার একটি বন্দিশ শ্যামকল্যাণ রাগ ও ঝাঁপতালে নিবদ্ধ। আগ্রা ঘরানার মূল বন্দিশ রাগ শ্যামকল্যাণ, তাল ঝাঁপতাল।

স্থায়ী—
‘জাত উমরিয়া অব নেহি ধ্যান
চেত অচেতন মুখর কাহাঁ মানে।।’
অন্তরা—
‘ঘড়ি ঘড়ি পল পল বাকো সুমর জ্ঞান
কব হে রাহা ন ওমান সম্পদ জ্ঞান।’
এই বন্দিশের সুরেই নজরুল রচিত ‘হে শ্যাম কল্যাণ দাও’ গানটির সুরের রূপটি নেন।
এই অপ্রকাশিত গানটি সম্প্রতি আমার কণ্ঠে রেকর্ডে প্রকাশিত হল জীবনস্মৃতি আর্কাইডের উদ্যোগে কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫ তম জন্মবর্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য রূপে অরিন্দম সাহা সর্দারের ভাবনা ও রূপায়ণে এটি একটি সঙ্গীত-দৃশ্য উপস্থাপনা।