১২৫তম জন্মবর্ষে নজরুল, এই সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে কাজী নজরুল ইসলাম

সৈয়দ হাসমত জালাল

কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও তার ঘটনাবলীর কথা স্মরণ করলে, জীবনের এক-একটি পর্যায়ে তিনি যেসব অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন, যেভাবে দেশ ও বিশ্বের প্রতি তাঁর রাজনৈতিক ও মানবতার আদর্শ এবং চিন্তা-চেতনা পরিপুষ্ট হয়েছে, সেসব আমরা উপলব্ধি করতে পারব৷ সাম্রাজ্যবাদী শাসকের অত্যাচার ও শোষণ, ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টির প্রবণতা এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক অসাম্য সৃষ্টি— মূলত এই বিষয়গুলির বিরুদ্ধেই ছিল নজরুলের সংগ্রাম ও দ্রোহ৷

লক্ষ্য করলে দেখব, ওই তিনটি বিষয় আজও এই উপমহাদেশে এবং সমস্ত পৃথিবীতেই প্রাসঙ্গিক৷ এই শোষণ, বিভাজন এবং অসাম্য সৃষ্টিকারী শক্তি আজও পৃথিবীতে প্রবলভাবেই সক্রিয়৷ যে পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে, অসাম্যের বিরুদ্ধে নজরুল তীব্রভাবে উচ্চারণ করেছিলেন— ‘সেই কুৎসিত শ্রীহীন অসুরে তখনই বধিতে চাই,/ মোর বিদ্রোহ সাম্য-সৃষ্টি— নাই সেথা ভেদ নাই৷’


পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থা আজ প্রায় সারা পৃথিবীকেই গ্রাস করে রেখেছে৷ এই শাসনব্যবস্থার স্বভাবধর্মই হচ্ছে, আর্থিক বৈষম্য ও সংকটের মধ্য দিয়ে পুঁজিকে বেডে় ওঠার, আরও বিশাল হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া৷ একধরনের নব্য-উদারবাদী, মুক্ত অর্থনীতির বিশ্বে একদিকে শ্রমজীবী মানুষের অর্থোপার্জনের পথগুলি ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে, অন্যদিকে ফুলেফেঁপে উঠছে বহুজাতিক বাণিজ্য সংস্থাগুলি৷ পৃথিবীব্যাপী করোনা ভাইরাস-জনিত মহামারীর সময়ে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষের এই আর্থিক সংকট আরও বেশি করে চোখে পডে়ছে৷

১৯২৫ সালে কলকাতায় যে মজুর-স্বরাজ পার্টি গঠিত হয়েছিল, তার মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল ‘লাঙল’ পত্রিকা, যা পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন নজরুল৷ কৃষক-শ্রমিকদের সংগঠিত করে তাদের মধ্যে শ্রেণী-চেতনা জাগানোর উদ্দেশ্যে গঠিত হয়েছিল এই মজুর-স্বরাজ পার্টি৷ এই পার্টির প্রথম ইস্তাহারটি প্রকাশিত হয়েছিল নজরুলের স্বাক্ষরসহ৷

এর আগে ১৯২২ সালে ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় কাজী নজরুল ইসলাম সরাসরি সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকারের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন৷ এই পত্রিকাতেই প্রকাশিত তাঁর ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ শীর্ষক কবিতার জন্যে তাঁকে ব্রিটিশ সরকার কারাগারে বন্দী করে রেখেছিল৷ কিন্ত্ত তাতে তিনি হতোদ্যম হননি, বরং নতুন উদ্যমে তিনি ব্রিটিশ শাসকের শোষণের বিরুদ্ধে কলম ধরেছিলেন৷ এবার ‘লাঙল’ পত্রিকার মাধ্যমে কৃষক-মজুর অর্থাৎ দরিদ্র শ্রমজীবী মানুষের পক্ষে এবং ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে সরব হলেন তিনি৷ তাঁর ‘সর্বহারা’ কিংবা ‘সাম্যবাদী’ কবিতার শব্দচয়নের মধ্যেই এই চিন্তাধারার প্রতিফলন স্পষ্ট৷

২০২০-২১ সালে মহামারীর সময়ে আমেরিকায় চার কোটি মানুষ কাজ হারিয়েছে, ভারতে সেই সংখ্যা প্রায় বারো কোটি৷ দেশে দেশে এ ঘটনা বিরল নয়৷ কয়েক মাসের বেতন পাননি বহু বেসরকারি সংস্থার কর্মচারী৷ এই প্রসঙ্গে মনে পডে় যায় নজরুলের ‘কুলি-মজুর’ কবিতার (‘সাম্যবাদী’) এই অমোঘ পঙ্ক্তিটি— ‘বেতন দিয়াছ?— চুপ রও যত মিথ্যাবাদীর দল৷’

এ দেশের টেলিভিশনে বা সংবাদপত্রে আমরা দেখেছি মহামারীর কারণে লকডাউন ঘোষিত হলে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক কাজ হারিয়ে, খাবার না পেয়ে, কয়েকশো কিলোমিটার হেঁটে ঘরে ফিরছিলেন সপরিবারে৷ তাঁদের জন্যে ছিল না কোনও পরিবহনের ব্যবস্থা৷ কতজন অনাহারে, ক্লান্তিতে মৃতু্যর মুখে ঢলে পডে়ছেন৷

রাত্রিবেলা রেললাইনে ঘুমিয়ে-পড়া ষোলোজন শ্রান্ত শ্রমিক কাটা পডে়ছেন মালগাডি়তে৷ মজুর-শ্রমিকদের এই দুরবস্থা বিভিন্ন রূপে বিভিন্ন ক্ষেত্রে দেখা যায় এই উপমহাদেশের জুডে়৷ পূর্বোক্ত ‘কুলি-মজুর’ কবিতার পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলি অনিবার্যভাবেই স্মরণে আসে— ‘রাজপথে তব চলেছে মোটর, সাগরে জাহাজ চলে,/ রেলপথে চলে বাষ্প-শকট, দেশ ছেয়ে গেল কলে,/ বল তো এসব কাহাদের দান! তোমার অট্টালিকা/ কার খুনে রাঙা? ঠুলি খুলে দেখ, প্রতি ইঁটে আছে লিখা৷’

আজ যেখানে অসংখ্য শ্রমজীবী মানুষের জীবন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে, মুক্ত বাজারের মাধ্যমে বড় পুঁজিকে সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে ছোট পুঁজিকে গ্রাস করে নেওয়ার, ওই বড় পুঁজিই রাষ্ট্রের সাহায্যে অধিকার করছে দেশের বিভিন্ন ধরনের সম্পদ— এর বিরুদ্ধে দাঁড়ানোর একমাত্র পথ হচ্ছে রাজনৈতিক লড়াই৷ এই লড়াই ও আন্দোলন সংগঠিত হলে তবেই পুঁজিবাদী ব্যবস্থার ধনিক শ্রেণী আর শ্রমজীবী মানুষের জীবিকা ও জীবনের স্বার্থকে পদদলিত করতে পারবে না৷

এই পরিপ্রেক্ষিতে মনে পডে় যায় নজরুলের ‘সর্বহারা’র শ্রমিকের গান, কৃষাণের গান ইত্যাদি কবিতার কথা৷ যেখানে ‘ধনিক বণিক শোষণকারী জাত’ জোঁকের মতো রক্ত শুষে নেয় কিংবা যেখানে রাজা-উজির নিংডে় নেয় শ্রমিকের শ্রম, সেই শ্রমিককেই এই রাজা-উজিরদের বোঝা বইতে হয়, তখন তাদের বিরুদ্ধে শ্রমজীবী মানুষকে লড়াইয়ের ডাক দেন নজরুল— ‘এবার জুজুর দল ঐ হুজুর দলে/ দলবি রে আয় মজুর দল৷/ ধর হাতুডি় তোল কাঁধে শাবল৷’

নারী-পুরুষের অসাম্য নিয়েও কলম ধরেছিলেন নজরুল৷ নারীবাদের অন্যতম প্রবক্তা সিমোন দ্য বোভোয়া বলেছিলেন, ‘নারী হয়ে কেউ জন্মায় না৷’ অর্থাৎ জৈবিকভাবে একজন শিশু স্ত্রী-অঙ্গ নিয়ে জন্মায়, এটুকুই প্রাকৃতিক সত্য৷ জন্মলগ্নে সে জানে না— সে নারী না পুরুষ৷ বিভিন্ন সামাজিক বিধিনিষেধের বেড়া তৈরি করে দিয়ে তার উপর লিঙ্গের কৃত্রিম ধারণা ও বিভাজন আরোপ করে সমাজ৷ এই বিভাজন নারীর জন্য অসাম্য ও বঞ্চনার আপাত-অদৃশ্য চোরাবালি তৈরি করে দেয়৷ মেয়েদের বঞ্চনার অন্যতম মূল উৎস ‘অর্থনীতি’৷ পুঁজিবাদী যুগেই এই অর্থনৈতিক বঞ্চনা চরমে ওঠে৷

পরিবারই আসলে নারীদের ‘পুরুষের জন্যে নিবেদিতপ্রাণ যন্ত্রে পরিণত করে আর সেই নারীদের বলি দিয়েই পুরুষের কীর্তিসৌধ তৈরি হয়’— বলেছিলেন এঙ্গেলস৷ এ কথা আজও সমান সত্য৷

‘সাম্যবাদী’ কবিতাগুচ্ছে নজরুল মানুষের সাম্যের কথা বলে গেছেন৷ নারীর প্রতি সমাজের বৈষম্যবোধ নজরুলের সৃষ্টির গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছিল৷ ‘নারী’ কবিতাটি তার সার্থক উদাহরণ৷ তিনি বলতে পেরেছিলেন, ‘সাম্যের গান গাই–/ আমার চক্ষে পুরুষ-রমণী কোনো ভেদাভেদ নাই!/ বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর/ অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর৷’ নারীকে মানুষ হিসেবে দেখার, মর্যাদা দেওয়ার যে কথা নজরুল বলে গিয়েছেন, আজও নারীদের সেই সুদিন আসেনি৷ তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, নারী শুধু প্রেয়সীই নয়৷ জগতের বড় বড় জয় মহীয়ান হয়েছে মাতা, ভগ্নী ও বধূদের ত্যাগে৷ তিনি আশা প্রকাশ করেছিলেন, ‘সেদিন সুদূর নয়–/ যেদিন ধরণী পুরুষের সাথে গাহিবে নারীরও জয়৷’
সময়ের বিবর্তনেই নারীর অবস্থান আগের তুলনায় বদলেছে৷ পুরুষের পাশাপাশি নারীরও প্রবেশাধিকার ঘটেছে কর্মজগতে৷ কিন্ত্ত রবীন্দ্রনাথের ‘চিত্রাঙ্গদা’ যেমন বলেছিল— ‘পূজা করি মোরে রাখিবে ঊর্ধ্বে/ সে নহি নহি,/ হেলা করি মোরে রাখিবে পিছে/ সে নহি, নহি৷ যদি পার্শ্বে রাখো মোরে/ সংকটে সম্পদে,/ সম্মতি দাও যদি কঠিন ব্রতে/ সহায় হতে,/ পাবে তবে তুমি চিনিতে মোরে৷’ এইভাবে নারীকে চেনার এবং নজরুল-অভীপ্সিত পুরুষের সঙ্গে নারীরও জয়গান গাওয়ার সমাজ কি তৈরি হয়েছে! নারীর এই সমানাধিকারের জন্যে এখনও অনেক পথ পেরোতে হবে আমাদের৷

২০২০ সালে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মিনিয়াপোলিস শহরের একটি অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা পৃথিবীর সমস্ত মানুষকে নাডি়য়ে দিয়েছিল৷ জর্জ ফ্লয়েড নামের এক নিরস্ত্র মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গকে রাস্তায় ফেলে এক মার্কিন শ্বেতাঙ্গ পুলিশ হাঁটু দিয়ে তার গলা চেপে ধরে রাখে আট মিনিটের বেশি সময় ধরে৷ ফ্লয়েড বারবার বলতে থাকে, ‘আমি শ্বাস নিতে পারছি না’, কিন্ত্ত নির্বিকার পুলিশটি নিজের প্যান্টের পকেটে হাত পুরে রেখে উপভোগ করেছে ফ্লয়েডের ক্রমশ শ্বাসরোধ হয়ে যাওয়া৷ কৃষ্ণাঙ্গের প্রতি শ্বেতাঙ্গদের এত ঘৃণা, এত বর্ণবৈষম্য! তথাকথিত জাতীয়তাবাদের নামে এই বিদ্বেষ আজ যেন নতুন করে মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সারা বিশ্বেই৷ কোথাও ধর্মের, কোথাও জাতের, কোথাও গাত্রবর্ণের দোহাই দিয়ে চলেছে এই হত্যালীলা৷

‘ফরিয়াদ’ কবিতায় নজরুল লিখেছিলেন— ‘শ্বেত, পীত, কালো করিয়া সৃজিলে মানবে, সে তব সাধ৷/ আমরা যে কালো, তুমি ভালো জানো, নহে তাহা অপরাধ৷/ তুমি বলো নাই, শুধু শ্বেত-দ্বীপে/ জোগাইবে আলো রবি-শশী-দীপে,/ সাদা রবে সবাকার টুঁটি টিপে, এ নহে তব বিধান!/ সন্তান তব করিতেছে আজ তোমার অসম্মান!/ ভগবান! ভগবান!’ নজরুল যেন প্রত্যক্ষ করেছিলেন এখনকার এই ঘটনাটি৷ চমকে উঠতে হয় ‘সাদা রবে সবাকার টুঁটি টিপে’ পঙ্ক্তিটি পডে়৷ স্মরণে আসে, ১১৪ বছর আগে রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন ‘অপমানিত’ কবিতায়— ‘মানুষের অধিকারে বঞ্চিত করেছ যারে,/ সম্মুখে দাঁড়ায়ে রেখে তবু কোলে দাও নাই স্থান,/ অপমানে হতে হবে তাহাদের সবার সমান৷’

সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশ সরকার তাদের শাসনের স্বার্থেই সাম্প্রদায়িকতার যে বিষবৃক্ষটি রোপণ করেছিল এই উপমহাদেশের মাটিতে, তাদের ভারত ছাড়ার পর এত বছর পর তা শুকিয়ে যাবার কথা ছিল৷ কিন্ত্ত তা হয়নি৷ দ্বিজাতি-তত্ত্বের ভিত্তিতে ভাগ হলো দেশ, কিন্ত্ত সাম্প্রদায়িকতার আগুন ধিকিধিকি জ্বলতেই থাকল৷ আসলে ধর্মব্যবসায়ীরা যেমন এর জন্যে দায়ী, তেমনই কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের গোপন কর্মসূচি এই আগুন নিবতে দেয় না৷

সব দেশে, সব কালেই মহান কবি-লেখকরা ধর্ম ও জাত-পাতের ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন মানবতাকে৷ আমরা যদি আমাদের দেশের দুই কবি রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলকে দেখি, তাহলে দেখব তাঁরা মানবতার আদর্শের কথা বলেছেন, মানুষের জয়গান গেয়েছেন৷ তাঁরা দু’জনেই আধ্যাত্মিকতায় বিশ্বাসী ছিলেন, কোনও ধর্মকেই অসম্মান করেননি৷ বরং এক-একটি ধর্মের দর্শনকে তাঁরা মানুষের চিন্তা-চেতনার উন্নতির পক্ষে সহায়ক বলে মনে করেছেন৷ কিন্ত্ত কোনও একটি বিশেষ ধর্মের গণ্ডির মধ্যে তাঁরা নিজেদের পরিচয় বা কার্যকলাপকে সীমাবদ্ধ রাখেননি৷

নজরুল তাঁর ‘বিংশ শতাব্দী’ কবিতায় লিখেছেন— ‘কাটায়ে উঠেছি ধর্ম-আফিম নেশা/ ধ্বংস করেছি ধর্ম-যাজকী পেশা৷’ তিনি বুঝেছিলেন, মোল্লাতন্ত্র আর পুরুততন্ত্র উভয়ই ধর্মের নামে মানুষের পরিচয়কে খণ্ডিত করে, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ উসকে দেয়৷ মানুষকে সামগ্রিকভাবে মানুষ পরিচয়ে না দেখলে এই পারস্পরিক দূরত্ব বা হানাহানি কোনোদিন ঘুচবে না৷ সেজন্যেই তিনি ‘সাম্যবাদী’ কবিতায় এত স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন— ‘গাহি সাম্যের গান–/ যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা ব্যবধান৷/ যেখানে মিশেছে হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলিম-ক্রীশ্চান!’

আজ আমাদের এই উপমহাদেশেই শুধু নয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বেডে় গেছে ধর্মীয় সন্ত্রাসবাদ৷ বেডে়ছে ধর্মীয় সংকীর্ণতা৷ নিজের নিজের ধর্মরক্ষার অজুহাতে অন্য ধর্মের মানুষের প্রতি বাড়ছে আক্রমণ৷ এ সময় নজরুলের এই পঙ্ক্তিগুলি তীব্রভাবে প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে— ‘হায় রে ভজনালয়,/ তোমার মিনারে চডি়য়া ভণ্ড গাহে স্বার্থের জয়!/ মানুষেরে ঘৃণা করি/ ও কারা কোরান বেদ বাইবেল চুম্বিছে মরি মরি!/ ও মুখ হইতে কেতাব গ্রন্থ নাও জোর করে কেডে়,/ যাহারা আনিল গ্রন্থ-কেতাব সেই মানুষেরে মেরে/ পূজিছে গ্রন্থ ভণ্ডের দল!— মূর্খেরা সব শোনো,/ মানুষ এনেছে গ্রন্থ, —গ্রন্থ আনেনি মানুষ কোনো!’ ব্রিটিশ শাসনকালের তুলনায় এখন ধর্মীয় সন্ত্রাস অনেক বেশি বেডে়ছে৷ জানি না, এ সময় নজরুলের মতো আর কোনও কবির পক্ষে এরকম পঙ্ক্তিমালা লেখা সম্ভব কি না৷ কেউ লিখলেও ধর্মান্ধরা কি তা মেনে নেবে!

১৯২৬ সালে কলকাতায় পরপর হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা হয়েছিল৷ তারপরই কৃষ্ণনগরে অনুষ্ঠিত ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক সম্মেলন’-এ ‘কাণ্ডারী হুঁশিয়ার’ গানটি গেয়ে নজরুল সবাইকে চমকে দিয়েছিলেন৷ ‘হিন্দু না ওরা মুসলিম? ঐ জিজ্ঞাসে কোন্ জন?/ কাণ্ডারী! বলো ডুবিছে মানুষ, সন্তান মোর মার৷’ এই কথাগুলি আজও যেন মন্ত্রের মতো উচ্চারিত হয়, হওয়া দরকার৷ জাত-পাত-ধর্ম-বর্ণ নয়, মানুষ নজরুলের মতো ভাবতে শিখুক, বলতে শিখুক— ‘মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান!’ বহু ব্যক্তিগত আক্রমণ ও সমালোচনা সহ্য করেও নজরুল অবিচল ছিলেন তাঁর অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় দেশের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করতে৷ সে প্রয়োজন আজও রয়ে গেছে৷ আর সেজন্যেই নজরুলের রচনা পুনঃ পুনঃ পাঠেরও প্রয়োজন৷ তাঁর সাম্য ও মানবতার আদর্শকে আমাদের সমাজ-জীবনে, আমাদের দেশে, এই উপমহাদেশে রূপায়িত করা দরকার মানুষের স্বার্থে, মানুষেরই কল্যাণে৷