শতবর্ষে নারায়ণ সান্যাল

বিপুল জনপ্রিয় হলেও তেমন আলোচিত হননি তিনি

লেখক হিসেবে নারায়ণ সান্যাল ছিলেন বিচিত্র-বিষয়মুখী এবং বিপুল জনপ্রিয়৷ গবেষণা-নির্ভর বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তিনি সাহিত্য রচনা করেছেন৷ ফরাসি ভাস্কর্য থেকে দেবদেউল, বাস্ত্তবিদ্যা থেকে বিজ্ঞানের রহস্যময় আলোছায়া সবই এসেছে তাঁর রচনায়৷ উপন্যাস থেকে ভ্রমণসাহিত্য, কিশোরসাহিত্য থেকে গোয়েন্দা কাহিনী, এমনকী নেতাজি সুভাষ-রহস্যও তাঁর লেখার বিষয়৷ তাঁকে নিয়ে লিখেছেন দেবপ্রিয় বাগচী

তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘ষাট একষট্টি’-তে নারায়ণ সান্যাল একটি কৌতুকপ্রদ ঘটনার কথা উল্লেখ করেছেন৷ তাঁর নিজের উক্তিতেই সেটা দেখে নেওয়া যাক— ‘লস এঞ্জেলসের দুর্গাপূজা মণ্ডপে ঠাকুর দেখতে গেছি৷ পূজামণ্ডপে নাচ-গান-ভ্যারাইটি প্রোগ্রাম৷ বাচ্চারা ‘আলিবাবা’ অভিনয় করবে৷ উদ্যোক্তারা বললেন, এসেই যখন পড়েছেন তখন মঞ্চে উঠে দু-চার কথা বলুন৷ …কর্মকর্তাদের কেউ হবেন— আমাকে দর্শকদলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার দায়িত্ব নিলেন৷ মঞ্চে অবতীর্ণ হওয়ার আগে ভদ্রলোক জনান্তিকে আত্মীয় সম্বোধন করে বললেন, মেসোমশাই, আমি ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার, বাংলা বই-টই, মানে বিশেষ পড়ি-টড়িনি— ইয়ে হয়েছে, আপনি যদি আপনার লেখা খানকতক বইয়ের নাম বলে দেন৷ আমি বলি, কী দরকার? তুমি শুধু বলো, ইনি বই-টই লেখেন৷ —না মানে, অন্তত আপনার একাডেমি পুরস্কার পাওয়া বইটার নাম যদি…৷ —আবার বাধা দিয়ে বলি, তুমি ভুল করছ ভাই৷ একাডেমি পুরস্কার আমি আদৌ পাইনি৷ তুমি আমার ওপর যা-ইচ্ছে গুণের আরোপ করতে পারো; শুধু বোলো না— ‘আমি ভালো গান গাই বা ভালো রাঁধতে জানি৷ কারণ এ পূজামণ্ডপে তা যাচাই হয়ে যাবার আশঙ্কা আছে৷’


এই উদ্ধৃতি থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বড়ো পুরস্কার না পেলে বাঙালিরা বড়ো কোনও লেখক সম্পর্কে অজ্ঞ থেকে যায়৷ এবং তাঁকে বিশেষ গুরুত্বও দিতে চায় না৷ রবীন্দ্রনাথ এর সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ৷ নোবেল পুরস্কার পাওয়ার আগে রবীন্দ্রনাথকে একশ্রেণির বাঙালি কম ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেনি!

এছাড়া এই উদ্ধৃতি থেকে নারায়ণ সান্যালের কৌতুকবোধেরও পরিচয় পাওয়া যায়৷ নিজেকে নিয়ে কৌতুক করতে পারা খুব সহজ নয়৷ নারায়ণ সান্যালের বিভিন্ন লেখার মধ্যেও এই কৌতুকবোধের পরিচয় পাওয়া যায়৷ প্রবাসী ওই ‘ইলেকট্রনিক্স এঞ্জিনিয়ার’ অবলীলায় বলতে পারেন— বাংলা বই-টই বিশেষ পড়িনি৷ আর নারায়ণ সান্যাল নিজেও একজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার হয়ে বাংলা ভাষায় বৈচিত্র্যময় বিষয় নিয়ে সাহিত্য রচনা করে গেছেন৷ আর তা পাঠকদের কাছে বিপুল জনপ্রিয়ও হয়েছে৷

নারায়ণ সান্যালের জন্ম ১৯২৪ সালের ২৬ এপ্রিল৷ কৃষ্ণনগরে তাঁর জন্ম হলেও তাঁর শিক্ষাজীবন কলকাতায়৷ ১৯৪৮ সালে শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ থেকে বি ই পাশ করেন৷ তিনি ইনস্টিটিউট অফ ইঞ্জিনিয়ার্স (ইন্ডিয়া)-র ফেলো ছিলেন৷ পিডব্লিউডি-তে চাকরি করার সময় দণ্ডকারণ্য অঞ্চলে তাঁর পোস্টিং হয়৷ সেখানকার অরণ্য ও উদ্বাস্ত্ত জীবনের কথা তিনি দুটি উপন্যাস লেখেন, ‘বকুলতলা পি এল ক্যাম্প’ ও ‘দণ্ডকশবরী’৷ বই দুটি খুব জনপ্রিয় হয়েছিল৷ বহু বই লিখেছেন তিনি৷ তাঁর বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৪০৷ শিশুসাহিত্য থেকে সায়েন্স ফিকশন, স্থাপত্য বিষয়ক গ্রন্থ, শিল্প সমালোচনা, মনস্তত্ত্ব, প্রযুক্তি, উদ্বাস্ত্ত সমস্যা, ইতিহাস, পশুপাখি বিষয়ক বই থেকে সামাজিক উপন্যাস— এরকম ছিল তাঁর লেখার বিষয়বৈচিত্র্য৷
পৃথিবীর নানান গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার আলো-ছায়া নিয়ে লিখতে ভালোবাসতেন নারায়ণ সান্যাল৷ আদিম মানুষ থেকে সভ্য হয়ে ওঠার ঘটনা নিয়ে তাঁর কল্পবিজ্ঞানের কাহিনি ‘নক্ষত্রলোকের দেবতাত্মা’৷ বিভিন্ন বিদেশি গ্রন্থের সাহায্যে নিয়ে তিনি লিখেছেন অনেক উপন্যাস৷ শুক্রগ্রহ অভিযান নিয়ে আর্থার সি ক্লার্কের ‘২০০১— এ স্পেস ওডিসি’ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাঁর লেখা ‘হ্যালের
যন্ত্র-না’৷

তাঁর বিখ্যাত উপন্যাস ‘বিশ্বাসঘাতক’৷ আমেরিকার প্রথম পরমাণু বোমা তৈরির ম্যানহাটান প্রজেক্ট নিয়ে লেখা ওই উপন্যাস৷ ওই উপন্যাসের নির্মাণ খানিকটা ব্যতিক্রমী৷

সান্তা ফে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র৷ ১৯৪৫ সালের ১১ আগস্ট, সেদিনই সমাপ্তি ঘটেছে বিশ্বযুদ্ধের৷ শহরের এক পানশালায় বসে আছেন লস আলামস পরমাণু কেন্দ্রের এক বিজ্ঞানী৷ একটু পরেই টুপি ও কালো চশমা পরিহিত এক ব্যক্তি তাঁর টেবিলের সামনে এসে বলে, ‘আমি জুলিয়াসের কাছ থেকে আসছি৷’ শুনেই সেই বিজ্ঞানী একটি পলমল সিগারেটের প্যাকেট তুলে দিলেন তার হাতে৷ কত ডলার দিতে হবে, আগন্ত্তকের এই প্রশ্নের উত্তরে বিজ্ঞানী বলেন, এক সিলিংও নয়৷ প্যাকেটের ভেতর ছিল ছোট্ট একটা মাইক্রো ফিল্মের রোল৷ সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন কয়েক বিলিয়ন ডলার মূল্যের পরমাণু বোমা তৈরির ফর্মুলা পেয়ে গিয়েছিল একদম বিনামূল্যে৷ আর পশ্চিমি দুনিয়ার চোখে ওই বিজ্ঞানী হয়ে গেলেন বিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় বিশ্বাসঘাতক৷ তিনি ডক্টর ক্লাউস ফুকস৷ ব্রিটেনের এক আদালতের রায়ে তাঁকে কারাগারে কাটাতে হয়েছে দশ বছর৷

নারায়ণ সান্যালের আর একটি বিখ্যাত বই ‘তিমি তিমিঙ্গিল’৷ এই বইয়ে তিমিদের নিয়ে আছে অসাধারণ গল্প৷ তাদের জন্ম, বড়ো হওয়া, প্রেম বিবাহ এবং মানুষের মতো ভয়ঙ্কর জীবের জন্য আজ তারা লুপ্ত হতে বসেছে৷ খুব দক্ষতার সঙ্গে একটি বাস্তবচিত্র তুলে ধরেছেন লেখক৷

গোয়েন্দা কথাসাহিত্যের জগতে তাঁর লেখা ‘কাঁটা’ সিরিজ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য৷ এই সিরিজের বেশিরভাগ গল্পই স্ট্যানলি গার্ডনার এবং আগাথা ক্রিস্টির বিভিন্ন উপন্যাস দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে লেখা৷ আবার তাঁর ‘বিশুপালবধ উপসংহার’ মূলত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের অসমাপ্ত লেখা ব্যোমকেশ বক্সি সিরিজের শেষাংশ৷

এইসব বইয়ের পাশাপাশি তিনি শিশুদের জন্যে যুক্তাক্ষর বর্জিত ‘হাতি আর হাতি’-র মতো আশ্চর্য বইও লিখেছেন৷ এছাড়াও শিশু-কিশোর সাহিত্য হিসেবে ‘শার্লক হেবো’, ‘অরিগ্যামি’, ‘ডিজনিল্যান্ড’, ‘নাক উঁচু’ প্রভৃতি বইগুলির কথাও উল্লেখ করতে হয়৷ তাঁর ‘সত্যকাম’, ‘রূপমঞ্জরী’, ‘অজন্তা অপরূপা’ প্রভৃতি বইগুলিতে যেন ছবি এঁকেছেন তিনি৷ এমন আশ্চর্য তাঁর লিখনশৈলী৷ তাঁর ‘অজন্তা অপরূপা’ উপন্যাসটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছিলেন সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি বইয়ের কিছু অংশ নিজে সংশোধনও করে দিয়েছিলেন৷ এই উপন্যাসের জন্য নারায়ণ সান্যাল ১৯৬৯ সালে পেয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের রবীন্দ্র পুরস্কার৷

নারায়ণ সান্যাল সম্পর্কে এরকম কথা বারবারই শোনা গেছে যে, তাঁর কোনও উপন্যাস সেই অর্থে ‘মৌলিক’ লেখা নয়৷ যদিও তিনি কখনও তাঁর লেখার মূল উৎস গ্রন্থের নাম জানাতে দ্বিধা করেননি৷ তবে এই ধরনের অপবাদের বিরুদ্ধে তিনি নিজেই উত্তর দিয়েছিলেন, ‘মাকড়সার জাল তাঁর নিজস্ব কীর্তি৷ মৌমাছির মৌচাক তা নয়৷ যাঁরা সাহিত্যে মৌলিকতা ভিন্ন রস আস্বাদনে অক্ষম, তাঁরা মাকড়সার জাল চর্বন করতে থাকুন, আমার মধুকর বৃত্তিতে বাধা দেবেন না৷’

নিঃসন্দেহে একের পর এক মধুর ভাণ্ডার তিনি খুলে দিয়েছেন বাঙালি পাঠকের সামনে৷ দান্তে, লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি থেকে রোঁদ্যা, এরকম স্রষ্টাদের সৃষ্টিকর্মকে তিনি বাংলায় তুলে ধরেছেন তাঁর বইয়ের মধ্য দিয়ে৷ ওই একই লেখক আবার ‘আমি নেতাজীকে দেখেছি’, ‘আমি রাসবিহারীকে দেখেছি’ কিংবা ‘নেতাজীর রহস্য সন্ধানে’-র মতো বই লিখেছেন৷ এমনকী, ১৯৯৮ সালে তিনি লিখে গেছেন ‘অগ্নিকন্যা মমতা’৷
তাঁর বেশ কিছু উপন্যাস চলচ্চিত্রায়িত হয়েছে৷ ‘সত্যকাম’ উপন্যাস থেকে তৈরি হয়েছে একটি হিন্দি চলচ্চিত্র৷ এছাড়া তাঁর ‘নাগচম্পা’, ‘অশ্লীলতার দায়ে’, ‘নীলিমায় নীল’, ‘প্রশান্ত পণ্ডিত’ ইত্যাদি লেখা থেকেও তৈরি হয়েছে বাংলা সিনেমা৷

তিনি পুরস্কৃত হয়েছেন বার বার৷ ‘সত্যকাম’-এর জন্য বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন থেকে পুরস্কৃত হন৷ আবার ২০০২ সালে তাঁর ‘রূপমঞ্জরী’ উপন্যাসের জন্য পান পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বঙ্কিম স্মৃতি পুরস্কার৷

এসব সত্ত্বেও দেখা যায়, বাঙালি মননশীল পাঠকসমাজের একাংশ নারায়ণ সান্যালের সাহিত্যকৃতি নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত৷ যদিও তাঁকে অবহেলিত লেখক কোনোভাবেই বলা যাবে না৷ তাঁর জনপ্রিয়তাও রীতিমতো চোখে প.ডার মতো৷ তবু সেই অর্থে তিনি খুব একটা আলোচিত নন৷ তিনি যেমন নিন্দিতও নন, তেমনি বিশেষ প্রশংসাও তাঁকে নিয়ে দেখা যায় না৷

আজকাল গবেষণা নির্ভর বিষয়ে লেখা সাহিত্যের কদর বেড়েছে৷ অনাবাসী ভারতীয় সাহিত্যিকরাও এই ধরনের লেখা লিখে থাকেন৷ সাম্প্রতিক বাংলা সাহিত্যের ক্ষেত্রেও এই প্রবণতা ইদানীং লক্ষ্য করা যায়৷ বিভিন্ন তথ্য, পরিসংখ্যান বা প্রামাণ্যতার নিদর্শন সেইসব সাহিত্য রচনায় দেখা যায়৷ অথচ এ কাজ অনেক আগেই করে গেছেন নারায়ণ সান্যাল৷

তবে ভারত সরকারের পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, পরিবার পরিকল্পনা ইত্যাদি কল্যাণমূলক প্রকল্প নিয়ে লেখার জন্য তিনি কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা পুরস্কৃত হন৷ হয়ত-বা এসব কারণেও বাংলা সাহিত্যের মূল পঠনক্রিয়া ও মানসিকতার সঙ্গে তাঁর কিছুটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷

নারায়ণ সান্যাল প্রয়াত হয়েছেন ১৯ বছর আগে, ২০০৫ সলের ৭ ফেব্রুয়ারি৷ কিন্ত্ত খোঁজ নিলে দেখা যাবে, এখনও তাঁর বইয়ের পুনর্মুদ্রণ হয়ে চলেছে৷ সাহিত্যিক বনফুল তাঁকে চিঠিতে লিখেছিলেন, ‘আপনি অনেক খেটেছেন, অনেক পড়েছেন৷ সস্তা হাততালি নাইবা পেলেন৷ বাংলা সাহিত্যের যে উপকার আপনি করলেন তার মূল্য তাতে একতিলও কমবে না৷’

নারায়ণ সান্যাল আসলে বিচিত্র বিষয় নিয়ে পড়াশোনা করতে ভালোবাসতেন৷ যাঁরা যত বেশি পড়েন, তাঁদের অন্তরের তাগিদও হয় বেশি৷ আর এই অন্তরের তাগিদ থেকেই তিনি লিখে গেছেন এক বিষয় থেকে অন্য বিষয়কে নির্ভর করে৷ সেই অর্থে বাংলা সাহিত্যে নারায়ণ সান্যাল একজন বিরল ও অনন্য লেখক৷