আবেশকুমার দাস
বেরোনোর মুখেই একটা ফাঁকা টোটোকে রোজ স্টেশনের দিকে চলে যেতে দেখে নন্দ৷ যার রংটা কোনও দিন থাকে লাল৷ কোনও দিন ছাই ছাই৷ সময়ের অল্প হেরফেরে ঘটে রোজ ঘটনাটা৷ কোনও দিন বাড়ি থেকে বেরিয়েই৷ কোনও দিন জুতোয় পা গলাতে গলাতে৷ বিল্লুদের বাড়ি পেরোতে পেরোতেও এক-আধদিন চোখে পড়েছে বেরিয়ে যেতে টোটোটাকে৷ ভারতী ভবনের গা ঘেঁষে নাকবরাবর আদহাটা রোডের ডাইনে দিনভর ঝিমিয়ে পড়ে থাকা তাদের গলিটাকে সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে৷
গলি থেকে চেঁচিয়ে লাভ হতো না৷
রাস্তার হট্টগোলে চাপা পড়ে যেত তার গলা৷
তারপর যখন ভারতী ভবনের সামনে গিয়ে দাঁড়ায় নন্দ, দেরি হয়ে যায় ততক্ষণে৷
খানিক প্রতীক্ষার পর হয়তো আসে পেছনের চারটে সিটই ভরে যাওয়া পরের টোটোখানা৷ মোটাসোটা ড্রাইভারের লাগোয়া ফালিতে চেপেচুপে নিজেকে ঠেসানোর চেষ্টা করতে করতেই ফুরিয়ে যায় এক কিলোমিটার রাস্তা৷ কপালগুণেই পেছনের লোকগুলোও যেন স্টেশনের আগে নামার নামটিও করে না এসব দিনে৷
এক-একদিন হাঁটাও লাগায় রণে ভঙ্গ দিয়ে৷ এবং কমজোরি কোমর নিয়ে যত জোরে পারে হেঁটে কোনও দিন মিলি ভবন, কোনও দিন বিধান সঙ্ঘ অবধি চলে যাওয়ার পরই ভোজবাজির মতো পেছন থেকে আবার এসে পড়ে বিলকুল ফাঁকা আর-একখানা টোটো৷ জোর হলে একটা প্যাসেঞ্জার থাকে ক্বচিৎ৷ প্রায়দিনই পাওয়ার হাউস মোড়ের মধ্যেই নেমে যায় সে লোকটাও৷
সময়ের এই হিসেবটাকেই ছ’মাস ধরে কিছুতে মেলাতে পারছে না নন্দলাল৷
কখন বেরোলে ফাঁকা টোটোটাকে পাবে ঠিক গলির মুখেই৷
এমনিতে খাসা লোকেশনেই বাড়ি তার৷ দু’পা বেরোলেই বাজার-দোকান৷ আবার রোডের উপরও নয়৷ পাড়াঘরের মধ্যে বেশ নিরিবিলিতেই৷ অথচ বারান্দায় বসে থাকলে দিনভরই চোখে পড়বে আদহাটা রোডের ব্যস্ততা৷ সেই সুবাদেই বেরোনোর মুখে রোজই দেখতে পায় ফাঁকা টোটোগুলোর নাকবরাবর পশ্চিমে চলে যাওয়া৷
এক-একদিন রাতে বলে শর্মিষ্ঠা, দু’মিনিট হাতে নিয়ে বেরোও না কেন বাপু? আজই তো দেখলাম, চলে গেল ফাঁকা টোটোটা…
শর্মিষ্ঠা আর নতুন কী দেখেছে?
রোজই দেখছে নন্দ৷
কিন্ত্ত এক মিনিট আগে কাগজ থেকে চোখ নামিয়ে, হাত চালিয়ে দেড় মিনিট আগেই চানখাওয়া সেরে ফেলে, ঘড়ি ধরে পাক্কা আড়াই মিনিট আগে বেরিয়েও দেখেছে৷ টোটোওয়ালাও বোধহয় সেদিন আড়াই মিনিট আগেই বেরিয়ে পড়েছিল বাড়ি থেকে৷ অথবা এতটাই দেরি করেছিল যে নন্দ যখন গিয়ে দাঁড়িয়েছে গলির মাথায়, তখনও সে বেচারা এসে পৌঁছতেই পারেনি অকুস্থলে৷ তারপর যতক্ষণে এসে হাজির হয়েছিল, তার মধ্যে ভরে গেছে পেছনের চারখানা সিটই৷ সাহেব কলোনি থেকে ভারতী ভবন রাস্তাটা তো কম নয়৷ অফিসযাত্রী অঢেল থাকে৷ বরং তাদের পাড়াতেই যত বয়স্ক লোকজনের বাস৷ তবে আশ্চর্যের কথা হল, বিল্লুদের বাড়ি যখন পেরোচ্ছে নন্দ, বড় রাস্তা দিয়ে ফাঁকা টোটো নিয়ে রোজের মতোই চলে গিয়েছিল পূর্ববর্তী কোনও টোটোওয়ালা৷
সেই সুবাদেই বলা যায়, সময়ের হিসেবটাকে বিগত ছ’মাসের চেষ্টাতেও মেলাতে পারেনি নন্দলাল৷
মানে যবে থেকে মোটর সাইকেল প্রায় ছাড়তে হয়েছে ডাক্তারের নির্দেশে৷
চালানো তাও একরকম, মুশকিল হয় সিঁড়ি দিয়ে ওই হন্দরকে বারান্দায় রোজ তোলাপাড়া৷
কোমরের সেই যন্ত্রণা ভোলার নয়৷
আর-একটা কথাও বলে নেওয়া দরকার এখানে৷
এক্সরে প্লেটটা কিন্ত্ত রুজু হয়নি কোনও নন্দলালের নামে৷
হওয়ার কথাও ছিল না৷ যেহেতু কোনও সরকারি নথিতে নেই নামটা৷ নন্দলাল নামে কেউ থাকে না আদহাটা রোড সংলগ্ন বিজয়নগরের এই এলাকায়৷ উনিশশো চুরাশি সালের জুলাই মাসের অনেক আগেই কলকাতার লাগোয়া শহরতলির বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোয় সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুর নন্দলাল নামকরণের রেওয়াজ তামাদি হয়ে গিয়েছিল৷ বেড়ে ওঠার বয়সে নিজের সেকেলে নামটাকে নিয়ে সন্তানকে যাতে কোনও বিড়ম্বনায় না পড়তে হয়— সেটুকু সচেতন হয়েই উঠেছিলেন রক্ষণশীল মা-বাপেও৷ সন্দীপ পালকে ব্যঙ্গ করেও তাই নন্দলাল নামে সম্বোধন করেনি কেউ কখনও৷ এমনকি ক্লাসের ছেলেদের চেহারা, গায়ের রং বা আচার আচরণের ধাত বুঝে নিত্যনতুন অপ্রীতিকর এক-একটা নামকরণের দৌলতে কুখ্যাত সেই নরেন্দ্র বিদ্যানিকেতনের ইংরেজির মাস্টার আশিস মুখুজ্জেও না৷ এটুকু বলাই যাবে, আর যা-ই পারুন বা না-ই পারুন, সন্তানের ভবিষ্যৎকে ঘিরে ওটুকু বিচক্ষণতার পরিচয় ঠিকই দিয়েছিলেন সত্যজিৎ ও জয়ন্তী পাল৷
নন্দলাল নামটা আসলে সন্দীপ পালের নিজেকে নিজেই দেওয়া৷
যার এক পূর্ব পটভূমিও অবশ্যই আছে৷
ঘটনা হল, ডাক বিভাগের প্রাক্তন কর্মচারী সত্যজিৎ পালের একমাত্র পুত্রটির সন্দীপ নামকরণ থেকেই যথেষ্ট ইঙ্গিত মেলে পরিবারটির তৎকালীন সংস্কৃতিমনস্কতার, যা সেই আমলের বাঙালি মধ্যবিত্ত পরিবারগুলির অন্যতম চরিত্রলক্ষণই ছিল৷ সে যতই অধুনা সূর্যাস্তের পরপরই পেনশনভোগী সত্যজিৎ পাল ও তাঁর রোগজর্জর গৃহিণী জয়ন্তী পাল নিয়মমাফিক বোকাবাক্সের বাংলা ধারাবাহিকে নিবিষ্ট হন না কেন৷ উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী বা সুকুমার রায়ের রচনাবলী সেকালের বাঙালি শিশুদের হাতে হাতেই ঘুরত৷ গোলযোগটা ওখান থেকেই বাধে৷ অতি অল্প বয়সেই সুকুমার-সাহিত্যের সেই মন্দকপাল কিশোর নন্দলালের সঙ্গে পরিচয় ঘটে যায় সন্দীপ পালের৷ সেই যে চরিত্রটি একবার ছুটিতে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েও ঠকেছিল, আবার পরের বারে না গিয়েও৷ সংস্কৃতে মেডেলের লোভে নিজের জোরের জায়গা ইতিহাসে আলগা দিয়ে পরীক্ষার পর জানতে পেরেছিল যে সেবারের মেডেলটা ইতিহাসেই ছিল৷
সুকুমার রায়ের লেখনীর প্রসাদগুণে এই কিশোর চরিত্রটির দুর্গতি শিশু থেকে বৃদ্ধ সকলকেই হাসায়৷ সেই বয়সে সন্দীপ পালও হেসেছিল বিস্তর৷ আট-দশবার পড়েওছিল গল্পখানা৷ পরিণামে না চাইতেও দাঁড়ি, কমা, সেমিকোলন-সমেত মুখস্থ হয়ে যায় গোটা কাহিনিটা৷ যদিও আর পাঁচটা শিশুর ক্ষেত্রে যা ঘটে, তার বেলায় মোটেও সে পথে হাঁটেনি এ কাহিনির পরবর্তী প্রতিক্রিয়া৷ যেহেতু মোটামুটি ক্লাস সিক্স-সেভেন থেকেই আচমকা মনে হতে শুরু করে সন্দীপ পালের, তার জীবনের ঘটনাপ্রবাহ যেন কতকটা নন্দলালের পথেই চলেছে৷ এক-একটা বছর কাটছিল৷ এক-একটা নতুন ক্লাসে উঠছিল সন্দীপ পাল৷ আর বিশ্বাসটাও পাকাপোক্তই হয়ে উঠছিল৷
সেবার ক্লাস এইটের অ্যানুয়াল৷
ভৌত বিজ্ঞান পরীক্ষার দিন ঘরপাহারায় ছিলেন বাংলার শিক্ষক চঞ্চলবাবু৷
বলা শক্ত কেন যেন এই মানুষটির সঙ্গে কোনও কালেই সেভাবে বনেনি সন্দীপ পালের৷
তাঁর ক্লাসেও যে কারণে বাড়তি সতর্কতাই অবলম্বন করতে হতো তাকে৷
আড়াই ঘণ্টার পরীক্ষার দু’ঘণ্টা তখন অতিক্রান্ত৷
প্রশ্ন খুব সহজ না হলেও খুব কঠিনও নয়৷ সারা বছর পাঠ্যবইটাকে মোটামুটি নাড়াচাড়ার অভ্যাস থাকলেই পুরো উত্তর করা যায়৷ তেতলার সিঁড়ির লাগোয়া সেই ঘরটাতেও মোটামুটি প্রথম পনেরোর মধ্যে থাকা ছেলেপিলেদেরই সিট পড়েছিল৷ এমন আদর্শ পরিস্থিতিতে যা ঘটে৷ পরীক্ষা ভাল হলে শেষের দিকটায় মন ফুরফুরে হয়ে ওঠে সকলেরই৷ সেদিনও কোনও কারণ ছাড়াই একে একে প্রত্যেককেই কেন যেন ‘ছোট-বাইরে’ যেতে হতে লাগল৷ অভীক, অনিন্দ্য, সুপ্রতীক সক্কলেই বেরোয়৷ আবার অল্পক্ষণেই ফিরেও আসে৷ অবিলম্বেই যেন একটা মজায় গিয়ে দাঁড়াল ব্যাপারটা৷ স্যারও অল্প ভুরু কুঁচকেও শেষ অবধি ঠোঁটের কোনায় হালকা প্রশ্রয়ের হাসি টেনে ছেড়ে দিচ্ছিলেন সবাইকেই৷ রকমসকম দেখে হাত তোলার ইচ্ছে হল সন্দীপ পালেরও, স্যার, ছোট-বাইরে যাব?
নিমেষেই মুখের ভাব বদলে যায় চঞ্চলবাবুর, পরীক্ষা দে৷ খাতা জমা দিয়ে একেবারে যাবি৷
যদিও এরপরই বিতনুকে আবার ছেড়ে দিলেন একইভাবে৷
আবার হাত তোলে সন্দীপ পাল৷
এবং আবারও নামঞ্জুর হয়৷
ব্যাপারস্যাপার দেখে তখন হাসতে শুরু করেছে গোটা ঘর৷
এরপর রামাঙ্কুরকেও যখন বিনা বাক্যব্যয়ে ছেড়ে দিলেন চঞ্চলবাবু, আর বসে থাকতে পারেনি সন্দীপ পাল৷ শেষ প্রশ্নটার জবাব তখনও লেখা বাকি৷ জানা উত্তর৷ ফার্স্ট, সেকেন্ড, থার্ডের মধ্যে না হলেও বরাবর প্রথম দশেই থাকত সে৷ কিন্ত্ত ঘরের মধ্যে চলতে থাকা অশ্লীল তামাশাটা চুপচাপ হজম করে নেওয়া আর সম্ভব হয়নি৷
কী রে, হয়ে গেল, পনেরো মিনিট আগেই খাতা দিয়ে দিতে দেখে চোখ বড় বড় হয়ে উঠেছে চঞ্চলবাবুর, পুরো লিখেছিস তো?
হ্যাঁ স্যার৷ শেষ৷
স্থির চোখে একবার তার মুখের দিকে তাকালেন মানুষটা৷ জবাবটা বিশ্বাস করতে যে কষ্ট হচ্ছে তাঁর, বুঝতে পারছিল সন্দীপ পালও৷ পরক্ষণেই জীবনে প্রথমবারের জন্য তার দিকে তাকিয়ে হা হা করে হেসে উঠলেন চঞ্চলবাবু, দেখলি তো, তখন ছাড়িনি বলেই কেমন সবার আগেই বেরিয়ে যেতে পারছিস…
সেদিনই গোপনে নিজের নামটা নন্দলাল রাখে সন্দীপ পাল৷
যদিও বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে আর কেউ জানে না কথাটা৷
বলা দরকার, নন্দলাল কিন্ত্ত ঘোরতর ঈশ্বরবিশ্বাসী৷
কিন্ত্ত সর্বশক্তিমান ঈশ্বরও আজ অবধি জানতে পারেননি তার এই গোপন নামটা৷
সেবার রেজাল্ট বেরোতে দেখা গিয়েছিল মাত্র তিন নম্বরের জন্য ফোর্থ হয়েছে নন্দলাল৷
তা দশ নম্বরের জানা উত্তর তো ছেড়েই দিয়ে এসেছিল সে৷
তারপর কাঁটায় কাঁটায় এই পঁচিশ বছর পেরিয়ে আসতে আসতে বারবার টের পেয়েছে নন্দলাল৷ নিজেকে দেওয়া নামখানা কত অভ্রান্ত তার৷ দুটো বেজে যাওয়ার পরও কাচের এপাশে অপেক্ষমান ভিড়টার দিকে তাকিয়ে আরও কয়েক মিনিট লেনদেনের কাজ চালিয়ে গিয়েছে ব্যাংকের স্টাফ৷ ঠিক নন্দলালের পালা আসতেই ঝাঁপ নামিয়ে উঠে পড়েছে লোকটা, আর নয়৷ আবার ব্রেকের পর…
আমারটাও যদি করে দিতেন স্যার৷ বেশি অ্যামাউন্ট নয়…
টাইম হয়ে গেছে৷ আপনাদের জন্যই বসেছি এতক্ষণ৷ খাওয়াদাওয়া আছে আমারও৷
আমিও স্যার বাড়ি ফিরে চানখাওয়া সারতাম আসলে৷ অনেকক্ষণ এসেছি তো৷ বাড়িও সেই রেলের ওপারে৷
খেয়েদেয়ে আসবেন এরপর থেকে৷ দেরি হতেই পারে৷
শুধু আর একজনেরটা…
কথাটা শেষ হয়নি৷ শেষ করার দরকারই পড়েনি আসলে৷ আর বাড়তি শব্দ খরচ অপ্রয়োজনীয় বিবেচনা করে কাউন্টার ছেড়ে চলে গিয়েছে লোকটা৷
লাইনের পেছন থেকে উড়ে এসেছে টুকরোটাকরা মন্তব্য, কেউ না কেউ আটকে পড়তই…
সেই৷ সত্যিই তো৷ ব্রেক দরকার ওঁদেরও৷
যেখানেই থামতেন ভদ্রলোক, পরের জন বলত তারটা করে দিতে…
যুক্তিগুলো ঠিকঠাকই৷ বুঝতে পারছিল নন্দলালও৷ কিন্ত্ত প্রতিবার তার সঙ্গেই এমনটা হলে কেমন লাগে!
নাওয়া খাওয়া সারতে তিনটে পেরিয়ে যাবে আজ৷ যতই সাইকেল থাক রেলের ওপারে, জর্জ রোড থেকে কম রাস্তা নয় তার বাড়ি৷ আবার চলে গেলেও দিনটাই মাটি…
সেদিনই শেষ নয়৷
আবার, আবারও টের পেয়েছে, সত্যিই সে নন্দলাল৷
এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে যাচ্ছিল ঢিমেতালে৷ রবিবার গিয়েছে এক তারিখ৷ সোমবার রাজ্যের ভিড় এটিএমগুলোর সামনে৷ দাঁড়ালেই যার নাম ঝাড়া কুড়ি মিনিট৷ গোয়ালাফটকের কাছে পৌঁছে চোখে পড়ল ফাঁকা এটিএম-টা৷ মোটর সাইকেল রেখে ঢুকতে যাবে৷ লাগোয়া স্টেশনারি দোকানের লোকটা গলা বাড়িয়ে বলল, দাদা, একটু ওদিক করে রাখবেন? মালের গাড়ি ঢুকবে এখুনি৷
আঙুল দেখানো জায়গায় গাড়ি রেখে এসে দেখে একটা ছেলে ইতিমধ্যে ঢুকে পড়েছে টাকা তুলতে৷
আরও একটা লোক দরজার সামনে৷
এই দ্বিতীয় লোকটার সঙ্গে ছিল দুটো কার্ড৷ মেশিনে ভরল দু’বার করে৷ তার মধ্যে দ্বিতীয় কার্ডটার পিন আবার ভুল দিয়েছিল৷ বাড়িতে ফোন করতে হল৷ এত রগড়ের পর স্বভাবতই হয়ে গেল একচোট৷
মজা হল, কাজ মিটিয়ে বেরিয়ে যখন স্টার্ট দিচ্ছে বাইকে, তখনও ঢুকতে পারেনি স্টেশনারি দোকানের মালের গাড়ি৷
কিন্ত্ত এই ছ’মাস ধরে যা ঘটে চলেছে রোজ, যেন ছাপিয়ে যাচ্ছে সব পূর্ব অভিজ্ঞতাকেও৷
ভাবতে ভাবতে আনমনেই ভারতী ভবনের সামনে এসে পড়েছিল নন্দলাল৷ নীচু করে হাঁটছিল মাথা৷ চোখ তুলে তাকাতেই যেন হোঁচট লাগে৷ মোটে একজন প্যাসেঞ্জার নিয়ে স্টেশনের দিকে যাওয়া টোটোটা মন্থর হয়েছে তাকে দেখে, যাবেন দাদা?
হ্যাঁ হ্যাঁ, দাঁড়াও…
এপাশ-ওপাশ দেখে রাস্তা পেরোতে পেরোতেই চোখে পড়ে৷
পিছু পিছু আরও দুটো ফাঁকা টোটো৷
সিটে বসেও যেন বিশ্বাস হচ্ছিল না এই উলটপুরাণকে৷ মনে হচ্ছিল চিমটি কেটে দেখে নিজেরই গায়ে৷ পাশের লোকটাও সিড়িঙ্গে চেহারার৷ আরাম করে হাত-পা ছড়িয়ে বসতে বসতেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়, ছ’মাসে প্রথম বাড়ি থেকে বেরিয়েই ফাঁকা টোটো পেলাম…
চালাতে চালাতেই হালকা ঘাড় ঘোরায় ছেলেটা, এতদিন পাননি? আশ্চর্য! রাস্তায় টোটো বেশি হয়ে গেছে মানুষের চাইতে…
নন্দলাল কিছু বলতে যাচ্ছিল৷
তার আগেই মুখ খোলে সিড়িঙ্গে লোকটা, যা বলেছ ভাই৷ আমাদের পাড়াতেই দু’জন টোটো চালাচ্ছে৷ কী করবে? পাশ করে বেরিয়ে কিছু পায়নি এখনও…
আমিও দাদা সায়েন্স গ্র্যাজুয়েট, কেমন ব্যঙ্গের সুর ছেলেটার হাসিতে, পরিচয় দিই না৷ কথাটা তুললেন বলে বললাম৷ কিছু তো করতে হবে, বলুন…
গোল আয়নাটার দিকে চোখ চলে যায় নন্দলালের৷
একগাল খোঁচা খোঁচা দাড়ির আড়ালেও বেশ ভদ্রসভ্যই মুখ ছেলেটার৷
পরক্ষণেই খেয়াল হয় সামনে পেছনে গোটা রাস্তাটা জুড়ে সত্যিই অগুনতি টোটো৷ দুবলা-পাতলা চেহারার একটা তিন চাকার বিলকুল ফাঁকা যান ঠিক তখনই ওভারটেক করছিল তাদের৷ নন্দলাল খেয়াল করে ড্রাইভারের সিটে বসে থাকা ওই ছেলেটাকেও শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাড়িরই লাগে৷ মুখ ফসকে বেরিয়ে পড়ে আচমকাই, তোমরাও দেখছি সব নন্দলাল হয়ে গেছ…
যা বলেছেন দাদা৷ শালা নন্দলালই বনে গেছি গোটা জেনারেশনটাই…
খ্যা-খ্যা করে হাসতে থাকে ছেলেটা৷
পাশের লোকটাও যোগ দেয় সেই হাসিতে৷
শুধু এতজন নন্দলালের একলপ্তে দেখা পেয়ে হাসা উচিত কিনা ঠিক করতে পারে না সন্দীপ পাল৷