আলোর মেয়ে মেরি কুরি

অজানা রশ্মির খোঁজে মেরি

মেরি ঠিক করলেন, ইউরেনিয়াম থেকে বেরিয়ে আসা ‘বেকরেল-রশ্মি’ ঠিক কী, তা জানার জন্যে গবেষণা করবেন। জানতেন, কাজটি খুবই কঠিন হবে। একদম নতুন একটি বিষয়। এই বিষয়ে কোনও বই নেই। বিষয়টি নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা আছে, সেরকম কোনও বিজ্ঞানী গবেষকও নেই। তাছাড়া, ওই অজানা রশ্মির তীব্রতা মাপার মতন কোনও যন্ত্রপাতিও নেই। সব ‘নেই’ এর মধ্যে মেরির যা ছিল, তা অন্য অনেকের মধ্যে থাকে না। কী ছিল মেরির? ছিল অসম্ভব মনের জোর আর অজানা বিষয় জানবার গভীর আগ্রহ। আর, তা ছিল বলেই ওরকম একটি জটিল বিষয় গবেষণার জন্যে বেছে নিতে পেরেছিলেন।

গবেষণা করার জন্যে আগে দরকার একটা উপযুক্ত জায়গা। কোথায় কাজের জায়গা পাবেন মেরি? পিয়ের কুরি তাঁর কর্মকর্তাদের অনুরোধ করে মেরির গবেষণা করার জন্যে একটু জায়গার ব্যবস্থা করলেন। জায়গাটি একতলায় বহুদিন ব্যবহার না হওয়া ছোট্ট এক ফালি স্যাঁতস্যাঁতে গুদামঘরের মতন। গরমকালে দারুণ গরম আর শীতে তেমনি জমে যাওয়ার মতন ঠান্ডা সেই ঘরটি। আগে ওই জায়গায় ডাক্তারি ছাত্রদের ‘মৃতদেহ-ব্যবচ্ছেদ’ শেখানো হত। মেরামত করে, ওই জায়গায় শুরু হল মেরি কুরির গবেষণা। জোগাড় হল যন্ত্রপাতি আর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র। গবেষণা-ঘরে ছিল, পাইন কাঠের কয়েকটি পুরনো টেবিল। ছিল ফারনেস আর গ্যাস বার্নার। কিন্তু কোনো চিমনির ব্যবস্থা ছিল না ওই ঘরে। মেরির যে ধরনের কাজ তাতে তৈরি হওয়া বিষাক্ত ধোঁয়া ও গ্যাস চিমনি না-থাকায় বেরিয়ে যেতে পারত না। দিনের পর দিন,মাসের পর মাস ওইরকম একটা জায়গার মধ্যে কাজ চলতে লাগল।


পরীক্ষা শুরু করলেন মেরি

‘ইউরেনিয়াম’ ছাড়া আর অন্য কোনও পদার্থ থেকে ওই রকম ‘রশ্মি’ বের হয় কি না, তার জন্যে বিভিন্ন পদার্থ সংগ্রহ করে নিয়ে এসে সেগুলি পরীক্ষা করে দেখবেন মেরি, সেগুলি থেকে কোনো রশ্মি বের হয় কি না। সহজ ছিল না সে কাজ।

লোহা (আয়রন) ধাতু যেমন খনি থেকে পাওয়া যায়। সেরকমই ‘পিচব্লেন্ড’ও খনি থেকে পাওয়া যায়। পিচব্লেন্ডের মধ্যে বেশিরভাগটাই ‘ইউরেনিয়াম’ থাকে। আরও বিভিন্ন ধরনের পদার্থও মিশে থাকে। পিচব্লেন্ড থেকে ‘ইউরেনিয়াম’ আবিষ্কার হয়েছিল, ওই সময় থেকে প্রায় একশো বছর আগে। তারও কয়েক বছর আগে ‘ইউরেনাস’ গ্রহ আবিষ্কার হয়েছিল। সেখান থেকেই নতুন খোঁজ-পাওয়া ধাতুটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘ইউরেনিয়াম’।

মেরি ভাবলেন, পিচব্লেন্ডের মধ্যে ‘ইউরেনিয়াম’ ছাড়া অন্য কোনও তেজস্ক্রিয় মৌল থাকতে পারে
কাজ শুরু করার জন্যে প্রথমে বেশ কয়েক টন ‘পিচব্লেন্ড’ আনা হয়। পিচব্লেন্ডের মধ্যে থাকা সব কিছুকে আলাদা আলাদা করে পরীক্ষা করে দেখলে তবেই জানা যাবে, তাতে কোনও অজানা মৌল রয়েছে কি না। তারপর, খোঁজ চালাতে হবে, তাতে অজানা কোনো ‘রেডিয়ো-অ্যাক্টিভ’ মৌল পাওয়া যায় কি না। খরের গাদায় সূচ খোঁজার চেয়েও বহুগুণ কঠিন এই কাজ! কাজ শুরুর পরে বছর পার হয়ে গেল।

খনিজ পদার্থ থেকে বিশুদ্ধ মৌল আলাদা করার কাজ

পিয়ের কুরি নিজের গবেষণার কাজের জন্যে এর আগে ‘ইলেকট্রোমিটার’ নামে একটি যন্ত্র তৈরি করেছিলেন। কিছু অদলবদল করে সেই যন্ত্রটিই এখন ‘তেজষ্ক্রিয়তা’ মাপার জন্যে খুব ভালো কাজে লাগছে। একটার পর একটা খনিজ পদার্থ পরীক্ষা করে মেরি খোঁজ করছেন কোনও ‘বিকিরণ’ দেখা যায় কি না। বিশুদ্ধ ইউরেনিয়ামের বিকিরণ ক্ষমতা পরীক্ষা করে অবশেষে খোঁজ পেলেন, ‘থোরিয়াম’ নামের মৌলিক পদার্থ থেকে অদৃশ্য রশ্মির বিকিরণ। এই বিকিরণ যে তেজস্ক্রিয় রশ্মি, বুঝতে পারলেন মেরি। এই বিশেষ ধরনের বিকিরণের নাম দিলেন ‘রেডিয়ো-অ্যাকটিভিটি’ (Radioactivity)। কয়েক মাস পরে তাঁর নিজের গবেষণার কাজ শেষ করে পিয়ের যোগ দিলেন মেরির সঙ্গে।

পিচব্লেন্ড থেকে ‘ইউরেনিয়াম’ ও অন্য বেশ কয়েকটি মৌলকে আলাদা করলেন পিয়ের ও মেরি। আলাদা করার পরে যে অবশিষ্ট অংশ পরীক্ষা করে আশ্চর্য হয়ে মেরি ও পিয়ের দেখলেন, তার মধ্যে রয়েছে ইউরেনিয়ামের থেকেও অনেক বেশি তেজস্ক্রিয়তা। আরও পরীক্ষা করে তাঁরা নিশ্চিত হন— ওর মধ্যে আছে দুটি নতুন তেজস্ক্রিয় মৌল।

আবার চলল একের পর এক পরীক্ষা, জানতে হবে—
কী ওই মৌল?

খনিজ পদার্থের মধ্যে থাকা বিভিন্ন মৌলিক পদার্থ আলাদা করার কাজে অনেকগুলি ধাপ। প্রথমে জিনিসগুলি ভেঙে গুঁড়ো করতে হবে। তারপর তাতে কোনও তরল পদার্থ ঢেলে সেটি গুলে যাওয়ার পরে। তা একটি বিশাল কড়াইয়ের মতন পাত্রে নিয়ে ফারনেসের ওপর বসিয়ে ফোটাতে হবে। ফারনেসে যখন টগবগ করে ফোটে, ওই সময় লম্বা লোহার একটি রড দিয়ে সেই ফুটন্ত দ্রবণটি সমানে নাড়িয়ে যেতে হয়। ফুটন্ত দ্রবণ নাড়ানোর জন্যে যে লোহার রডটি ব্যবহার করতেন মেরি, লম্বায় তা তাঁর কাছাকাছি ছিল। ফুটে গেলে সেটি ঠান্ডা করে ‘ফিলটার’ করতে হবে এবং তাতে অ্যাসিড ঢেলে আসিডে গুলে-যাওয়া অংশটি আলাদা করে নিতে হবে। প্রায় সাত টন পিচব্লেন্ডের স্ল্যাগ দিয়ে শুরু হয়েছিল কাজ। সেখান থেকে একটার পর একটা ধাপ পার হয়ে তবেই মিলবে বিশুদ্ধ মৌলের খোঁজ। প্রচন্ড খাটনির এই কাজ। দিন রাত এক করে কাজ চলতে থাকল।

পোলোনিয়াম ও রেডিয়াম আবিষ্কার

পিচব্লেন্ড থেকে পৃথক করতে করতে একটা সময় দুটি বিশেষ তেজস্ক্রিয় অংশকে আলাদা করতে পেরেছেন তাঁরা। সম্পূর্ণ নতুন দু’টি তেজস্ক্রিয় মৌলের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত হন। প্রথম আবিষ্কৃত মৌলটির নাম দেওয়ার কথায়, মেরির চোখের সামনে ভেসে উঠল মাতৃভূমি পোল্যান্ডের কথা। সেই কথা মনে রেখে, মেরি নতুন মৌলটির নাম দিলেন ‘পোলোনিয়াম’। নতুন তেজস্ক্রিয় মৌলের খোঁজ পাওয়ার (জুলাই ১৯৯৮) খবর বিজ্ঞানের গবেষণাপত্রে প্রকাশ করলেন মেরি ও পিয়ের।
প্রথম মৌল আবিষ্কারের মাস ছয়েকের মধ্যে দ্বিতীয় নতুন মৌলটি সম্পর্কেও নিশ্চিত হয়ে যান তাঁরা। বুঝতে পারেন, দ্বিতীয় মৌলটির তেজস্ক্রিয় ক্ষমতা ইউরেনিয়ামের চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বেশি। নতুন মৌলটির নাম রাখলেন— রেডিয়াম। ল্যাটিন ‘রেডিয়াস’ যার অর্থ হল ‘রশ্মি’ —সেখান থেকে নামকরণ করা হল ‘রেডিয়াম’। এরপর শুরু হল আবিষ্কৃত নতুন দুটি মৌলের চরিত্র ও ধর্ম জানার কাজ। পাশাপাশি দিন রাত এক করে চলতে থাকল নতুন মৌল ‘রেডিয়াম’কে পরিশুদ্ধ করার কাজ। নতুন জিনিস খোঁজার উত্তেজনায় কোনও কিছুরই খেয়াল ছিল না সেসময়। এমনকি নিজেদের শরীরের দিকেও খেয়াল ছিল না। অতো পরিশ্রম আর ধকল তাঁদের শরীর আর নিতে পারছিল না। মাঝে মাঝেই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন তখন মেরি। তবু শরীরের দিকে
না-তাকিয়ে অসমাপ্ত গবেষণার কাজ চালিয়ে গেছেন এক টানা।

অবশেষে এল মনে রাখার মতন সেই দিনটি। ১৯০২-এর ২০ এপ্রিল। সন্ধে পর্যন্ত ল্যাবরেটরিতে কাজ করে মেরি আর পিয়ের দু’জনেই ঘরে ফিরে এসেছেন। ঘরে ফেরার কয়েক ঘন্টা পরেই পিয়েরকে নিয়ে মেরি আবার ল্যাবরেটরিতে ফিরে এলেন। ল্যাবরেটরিতে এসে দেখতে পান, অন্ধকার ঘরে অদ্ভুত এক নীলাভ উজ্জ্বল আলো ছড়ানো! মেরির বুঝতে অসুবিধা হল না, এই আলো আসলে বিশুদ্ধ রেডিয়ামের থেকে বেরিয়ে আসছে। পিয়ের ঘরের আলো জ্বালাতে যাচ্ছিলেন। মেরি বারণ করলেন ‘প্লিজ আলো জ্বেলো না’। চার বছর ধরে কঠিন পরিশ্রম করার পরে এই সাফল্য এসেছে। মেরি তা প্রাণ ভরে দেখছেন। ঝুঁকে পড়ে রেডিয়ামের নীলাভ আলোর দিকে চেয়ে আছেন মেরি। যেমন করে সদ্য জন্মানো সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেন মা, ঠিক সেই ভাবে মেরি তাকিয়ে থাকলেন সেই অদ্ভুত আলোর দিকে।
‘রেডিয়াম’ আবিষ্কার বিজ্ঞানের অনেক নতুন দিক খুলে দিল। তাঁরা পরীক্ষা করে দেখেছেন, রেডিয়াম থেকে বেরোনো ‘তেজস্ক্রিয় রশ্মি’ জীবন্ত কোশকে নষ্ট করে দিতে পারে। মেরি বুঝতে পারলেন, ‘ক্যানসার’ রোগের চিকিৎসায় ‘রেডিয়াম’-এর কাজ করার বিপুল সম্ভাবনা। রেডিয়াম আবিষ্কারের কোনো পেটেন্ট নেননি তাঁরা। পেটেন্ট নিলে কম সময়েই কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে উঠতে পারতেন। কিন্তু, এই আবিষ্কার থেকে টাকা উপার্জন করতে চাননি তাঁরা। ইউরেনিয়াম, রেডিয়াম, পোলোনিয়াম সব কিছু তো প্রকৃতি তৈরি করেছে। তাঁরা শুধু তা খুঁজে বের করেছেন। রেডিয়াম আবিষ্কারের সুফল যাতে মানুষের কাজে লাগে, মানুষ ব্যবহার করতে পারে, সেটাই চেয়েছিলেন মেরি আর পিয়ের।

এইভাবে নিয়মিত পাঁচ বছর গবেষণার কাজ করে চলেছেন মেরি। থিসিস লিখে জমা দেওয়ার জন্যে তৈরি হলেন মেরি। তেজস্ক্রিয় মৌল নিয়ে গবেষণার কাজগুলি লিখে জমা দিলেন তাঁর পিএইচ ডি থিসিস। পিএইচডি গবেষণার কাজ নিয়ে সেমিনার দিতে হয়। মেরির পরীক্ষকরা এবং অন্য অধ্যাপক ছাড়াও অনেক ছাত্রছাত্রী মেরির সেই সেমিনার শুনতে এসেছিলেন। ১৯০৩ সালের মাঝামাঝি ‘ডক্টরেট’ ডিগ্রি পেলেন মেরি। তেজস্ক্রিয়তা নিয়ে মেরির থিসিসটি সেরা থিসিস হিসেবে স্বীকৃতি পেল।

(পরের সংখায় সমাপ্য)