• facebook
  • twitter
Thursday, 19 September, 2024

আলোর মেয়ে মেরি কুরি

বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় নারী বিজ্ঞানী হিসেবে মেরি কুরি বিজ্ঞান জগতের আদর্শ ও সম্মানিত ব্যক্তিত্ব। তিনিই প্রথম নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত নারী বিজ্ঞানী। তিনি নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন দু’বার। একবার যৌথভাবে পদার্থ বিজ্ঞোনে এবং অন্যবার রসায়নে। এই বিজ্ঞানীর শৈশব থেকে বড় হয়ে ওঠার গল্প ধারাবাহিকভাবে লিখছেন সিদ্ধার্থ মজুমদার।

মেয়েটির নাম ‘মারিয়া’। পুরো নাম, মারিয়া সালোমিয়ে স্কলদোভস্কা (Maria Salomea Skłodowska)। বাড়িতে আর বন্ধুরা সবাই ‘মানিয়া’ বলেই ডাকে। আমরাও এখানে তাকে মানিয়া-ই বলব। এই লেখায় আমরা ‘মানিয়া’র জীবনের গল্প শুনব। তখন তোমাদেরই মতন ছোটো ছিল মানিয়া। সে অনেক বছর আগের কথা। আজ থেকে একশো ছাপান্ন বছর আগে মানিয়ার জন্ম হয়েছিল। পোল্যান্ড নামের ছোট্ট একটি দেশে ‘ওয়ারশ’ (Warsaw) নামের একটি জায়গায় জন্মেছিল মানিয়া। ‘ওয়ারশ’ জায়গাটা পোল্যান্ডের রাজধানীও বটে। মানিয়ার কথা জানতে গেলে আমাদের পিছিয়ে যেতে হবে ওই সময়ে। মানে প্রায় দেড়শ বছর আগে। চলো দেখি, কেমন ছিল মানিয়ার ছোটবেলা।

মা,বাবা আর দিদি দাদার সঙ্গে মানিয়ার ছোটোবেলা
পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে মানিয়া ছিল সবার ছোটো। তার ওপরে ছিল তিন দিদি আর এক দাদা। সকলের বড়ো যে দিদি তার নাম ‘সোফিয়া’। তারপরে দাদা ‘যোসেফ’। পরের দিদি ‘ব্রনিস্লাভা’। ওদের মায়ের নামও ছিল ‘ব্রনিস্লাভা’। মায়ের নামেই এই দিদির নাম। মানিয়ার ঠিক ওপরের যে দিদি, তার নাম ‘হেলেনা’। বাবা ওয়ারশ-তে একটি রাশিয়ান স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সেখানে বিজ্ঞান আর অঙ্ক পড়াতেন। তবে বিজ্ঞান ও অঙ্ক ছাড়াও নানান বিষয়েই বাবার দারুণ জ্ঞান ছিল। তাই বাবাকে ওরা সবাই ‘চলন্ত এনসাইক্লোপিডিয়া’ বলত। আর মা ছিলেন নামকরা একটি বেসরকারি মেয়েদের স্কুলের হেড-মিস্ট্রেস। একদিকে ছোটো ছোটো পাঁচজন ছেলে মেয়ে, অন্যদিকে স্কুলের অতগুলি বাচ্চা। এসবের পরে তো ছিল বাড়ির সব কাজ সামলানো। এমনকি বাচ্চাদের জুতোও তৈরি করতে পারতেন মা। তাই সকাল থেকে রাত্রি পর্যন্ত মায়ের কাজ আর শেষ হত না।

সেসময় পোল্যান্ড ছিল পরাধীন দেশ। সেখানে তখন রাশিয়ান শাসন। পরাধীন পোল্যান্ডের মানুষদের যে কত দুঃখ,কষ্ট আর যন্ত্রণা ভোগ করত হয়েছিল। কত অসহায়ভাবে দিন কাটত ওখানকার মানুষদের। সে সময়কার ইতিহাস পড়লে জানা যায় সেসব কথা। শাসক রাশিয়ানদের বিরুদ্ধে কোনো ‘টুঁ’ শব্দ করলেই, পেতে হত কঠিন শাস্তি। নিজেদের দেশকে স্বাধীন করার জন্যে পোলিশ মানুষরা অনেক যুদ্ধ করেছে। যুদ্ধে রাশিয়ান সৈন্যদের হাতে অসংখ্য পোলিশ মানুষ মারা গেছে। বহু মানুষ আহত হয়েছে। কত মানুষ যে বন্দি হয়েছিল তার কোনো হিসেব নেই! অনেকের মতন মানিয়ার দাদু, কাকা ও মামারাও দেশকে স্বাধীন করার যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন।

মানিয়ার বাবারও গোপনে যোগাযোগ ছিল দেশপ্রেমিক বিপ্লবীদের সঙ্গে। কীকরে যেন সে কথা রাশিয়ান গুপ্তচরদের কানে পৌঁছে যায়। তার জন্যে মানিয়ার বাবা আর মাকে অনেক অত্যাচার আর কষ্ট সহ্য করতে হয়েছিল। দুজনেই উচ্চশিক্ষিত ছিলেন, তবু বাবা-মা কেউই উপযুক্ত চাকরি পাননি। শুধু তাই নয়। প্রতিবাদ করতে গিয়ে চাকরির জায়গা থেকে বাবাকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। মাইনে কমিয়ে দিয়েছিল। পোল্যান্ডের মানুষদের নিজেদের ভাষা ‘পোলিশ’। কিন্তু সে ভাষায় পড়তে পারত না কেউ। স্কুলে প্রত্যেককে রুশ ভাষাতে পড়াশোনা করতে হত। শুধু স্কুলেই নয়, বাইরেও সবাইকে রুশ ভাষাতে কথা বলতে হত। প্রত্যেক স্কুলে ছিল কড়া নজরদারি— কেউ যদি ভুলেও ‘পোলিশ’ ভাষায় কথা বলত, শাস্তি পেতে হত তাকে। বাড়ির লোকজনকেও রেহাই দেওয়া হত না। বুঝতেই পারছো, সেসময় কী ভয়ংকর অবস্থার মধ্যে দিন কাটত ওখানকার মানুষদের।

সব চেয়ে দুঃখ কষ্টের দিনগুলি
মানিয়া আর ওর সব দিদি ও দাদা প্রত্যেকেই পড়াশোনাতে খুব ভালো ছিল। শুধু পড়ার বই-ই নয়। রহস্য ও রোমাঞ্চের গল্প, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান— সব ধরনের বইয়েই ছিল ওদের আগ্রহ। বাবা-মা দু’জনেই ছেলেমেয়েদের পড়ার সময় পাশে থাকতেন। কোনো অসুবিধা হলে বুঝিয়ে দিতেন।

এভাবেই চলছিল। হঠাৎ বাড়িতে দারুণ দুঃখের একটা ঘটনা ঘটল। কেউই চিন্তা করতে পারেনি এরকম হতে পারে। ‘টাইফাস’ রোগে ভুগছিল সবার বড়ো দিদি সোফিয়া। সেই দিদি মারা গেল। কারোর মুখে কোনও কথা নেই। কে কার কান্না থামাবে? এ কী হল! মানিয়ার বয়স তখন ন-বছর।

বেশ কয়েকমাস ধরে মা স্কুলে যেতে পারছিলেন না। ভীষণ শরীর খারাপ তাঁর। সব সময় বিছানায় শুয়ে থাকেন। থেকে থেকেই মায়ের কাশির শব্দ শুনতে পেত মানিয়া। বুঝতে পারত, মুখে কাপড় চাপা দিয়ে কাশছেন মা। কিছুতেই কাছে ঘেঁসতে দিতেন না। মায়ের ঘরে ঢোকাও বারণ ছিল। ছোট্ট মানিয়া তখন বুঝতে পারত না, মায়ের কী হয়েছে। পরে জেনেছিল, যক্ষা (টিবি) হয়েছিল মায়ের। ‘টিবি’ রোগের তখন কোনো চিকিৎসা ছিল না। বিছানায় দিন রাত শুয়ে থাকতেন মা। মাকে দেখে খুব কষ্ট হত মানিয়ার। মা যাতে ভালো হয়ে ওঠেন, তার জন্যে কতবার সে ভগবানকে ডেকেছে।

ভগবানকে ডেকেও কিছু হল না। দিদির মতন মাও সবাইকে ছেড়ে একদিন চলে গেলেন। ভাবো তো একবার, মানিয়ার ওইটুকু বয়সে মা মারা গেল! কত কষ্ট পেয়েছে সে! সে সব ভাবতেই আমাদের কান্না পেয়ে যায়। তাই না? দিদি আর মাকে হারিয়ে এগারো বছরের মানিয়া শোকে দুঃখে সব সময় মনমরা হয়ে থাকে। মা চিরকালের মত চলে গেছে, বিশ্বাস হত না। মানিয়া ঠিক করে, ‘সে আর কখনও ভগবানকে বিশ্বাস করবে না। ভগবান নেই। যে ভগবান আমাদের মাকে ভালো করে দিল না, তাকে কেনই বা বিশ্বাস করব?’ বাড়িতে বাবা, দাদা আর দুই দিদিরও একই অবস্থা। বাড়ির সবখানে, সব জিনিসপত্রে যে মায়ের ছোঁয়া লেগে আছে। শোকে দুঃখে সবাই কেমন যেন পালটে গেছে।

কিশোরী মানিয়ার পড়াশোনা
আগে কখনও বাড়ির কোনো কাজ করতে হয়নি। এখন দিদিদের সঙ্গে মানিয়াকেও বাড়ির অনেক কাজে হাত লাগাতে হয়। পরে টাকা পয়সা লাগতে পারে, সে কথা ভেবে বাবা কোনোদিন টাকা জমিয়ে রাখেননি। আসলে ওসব নিয়ে কোনও চিন্তা ভাবনাই ছিল না বাবার। মায়ের মৃত্যুর পরে,বাবা তাই খুব মুশকিলে পড়ে গেলেন। সব কিছুর জন্যে তো টাকা দরকার। সম্বল বলতে বাবার মাইনের সামান্য ক’টা টাকা। বাবাই বা এত টাকা পাবেন কীকরে? এতদিন মায়ের চিকিৎসার জন্যে অনেক টাকা লেগেছে। শেষের দিকে মা স্কুল যেতে পারতেন না বলে মাইনে পেতেন না। সব খরচাপাতি বাবার মাইনে থেকেই হয়েছে। কতই বা মাইনে ছিল বাবার? অত কম টাকায় সংসার চালানো মুশকিলই বটে। বাবা তাই বাড়িতে ছাত্র ছাত্রী পড়ানো শুরু করলেন। এত অভাব দুঃখ কষ্ট, তবু তার মধ্যেই সকলে মানিয়ে নিয়েছিল। আসলে মা আর দিদির চলে যাওয়ায় যে দুঃখ কষ্ট আর যন্ত্রণা, সেখানে এই কষ্ট কী আর এমন?

বাবার একটাই লক্ষ্য, ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়া যেন বন্ধ না-হয়ে যায়। স্কুলের বই ছাড়াও পোলিশ ভাষায় ইতিহাস,সংস্কৃতি আর বিজ্ঞানের নানান বই কিংবা বিজ্ঞান-শেখার নানান খেলনা কিনে আনতেন বাবা। তবে ওই সব বই লুকিয়ে রাখতে হত। কেন না বাড়িতে পোলিশ ভাষায় লেখা বই আছে জানতে পারলে, খুব মুশকিলে পড়তে হত। আগেই বলেছি, মারিয়ার দাদা আর সব দিদি পড়াশোনাতে সকলেই খুব ভালো ছিল। অত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও চার ভাই বোনকে মানুষ করলেন বাবা। হাইস্কুলের শেষ পরীক্ষায় মানিয়া ফার্স্ট হয়। সোনার মেডেল পেল। এর আগে মানিয়ার মেজদিদি ব্রোনিয়া আর দাদা জোসেফও হাইস্কুলের ফাইন্যাল পরীক্ষায় সোনার মেডেল পেয়েছে।

ছেলে বলে জোসেফের ভর্তি হওয়ার কোনো অসুবিধা হল না। ওয়ারশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ায় জোসেফকে ভর্তি করে দিলেন বাবা। কিন্তু ব্রোনিয়া ও মানিয়ার সে সুযোগ নেই। কেননা, পরাধীন পোল্যান্ডে মেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার নিয়ম ছিল না। পড়তে হলে, দেশ ছেড়ে অন্য কোনো দেশে গিয়ে পড়তে হত। ব্রোনিয়া আর মানিয়ার সব সময় একটাই চিন্তা, ‘তাহলে কি আমাদের আর পড়াশোনা হবে না?’ কীকরেই বা হবে? বিদেশে পড়তে যাওয়ার জন্যে তো টাকা লাগবে। কে দেবে সে টাকা? দাদার ডাক্তারি পড়ার খরচ চালিয়ে, বাবার পক্ষে আর ওদের পড়ার খরচ দেওয়া সম্ভব নয়। ব্রোনিয়া ও মানিয়া দুজনেই ঠিক করল, ‘পড়া থামাব না। যেমন করেই হোক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ব’। ব্রনিয়া একদিন বাবাকে তাঁর পরিকল্পনার কথা বলল, ‘এখানে কিছুদিন ছাত্রছাত্রী পড়িয়ে, হাতে কিছু টাকা জমলে আমি প্যারিস চলে যাব, সেখানকার বিশ্ববিদ্যালয়ে ডাক্তারি পড়ব’।

পাশ করার পরে, দেখতে না-দেখতে একটা বছর কেটে গেল মানিয়ার। কোনো কিছু না করেই। ঘরে বসেই ফিজিক্স আর গণিতের বই পড়ে সে। বাবা সাহায্য করেন মানিয়ার পড়ায়। সব সময় মন পড়ে থাকে তাঁর— কীকরে কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে পারবে? (ক্রমশ)