জয়তী চট্টোপাধ্যায়
‘অপু, অপু, গোল বাঁচা।’ না। পারল না। বলটা হেসে-খেলে গোলপোস্টে ঢুকে পড়ল। কী করবে অপু! মাথায় খালি ঘুরপাক খাচ্ছে কাকিয়ার একরত্তি ছেলের মুখেভাতে পাওয়া গয়নাগুলোর হঠাৎ উধাও হয়ে যাওয়া।
‘স্টেডি অপু, স্টেডি’।
না। খেলায় মন দিল অপু। দুটো গোল বাঁচিয়ে এক গোলে জিতল ওরা।
টুর্নামেন্টের কাপ নিয়ে ক্লাবে রাখল। পুজো এসে গেল। বসে আঁকো প্রতিযোগিতার দিন ফাইনাল করতে হবে। ওদের রং-তুলি কিনে দিতে হবে। এ সব দায়িত্ব বারো বছরের অপুর ওপরে।
অপুদের দোতলা বাড়ি। নিচে বৈঠকখানা,
গেস্ট-রুম আর দাদু-ঠামের ঘর। পায়ে ব্যথা। ওপরে উঠতে পারেন না।
দোতলায় কাকু-কাকিয়া এক ঘরে। আর একটা ঘর অপুদের। অন্যটা খাবার ঘর। লাগোয়া ছোট রান্নাঘর। দাদু-ঠামার খাবার নিচে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। সামনে টানা বারান্দা। ওখানেই থাকে খাঁচায় একটা ময়না। আর আছে টবে প্রচুর ফুলের গাছ। পরিচর্যায় কাকাই।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধে।
সকলের মুখ গম্ভীর। খুব স্বাভাবিক। মুসকানের অন্নপ্রাশনে পাওয়া গয়নাগুলো কাকিয়া আলমারিতে একটা বাক্সে রেখেছিলেন। হঠাৎ খুলে দেখেন বাক্স ফাঁকা। মাথায় হাত।
কাকু সমানে গজগজ করছেন, ‘কতবার বললাম লকারে রেখে এসো। শুনল না।’
বাড়িতে সদস্য আটজন। অপু, ওর বাবা মা,
কাকু-কাকিয়া, দাদু-ঠাম আর সর্বক্ষণের হরিদা। ওকে কোলেপিঠে বড় করেছে।
সবাই সন্দেহের বাইরে।
বাবা চুপিচুপি বললেন, ‘তুই তো বেশ কিছু রহস্যের সমাধান করেছিস, অপু। এটাও করে দে। বাইরে যেন কথা না বেরোয়।’
‘চেষ্টা করছি। কিন্তু না পারলে একদম বকাবকি করবে না, ডিটেকটিভ বই পড়ে মাথাটা গেল বলে!’
বাবা হেসে মাথার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলেন।
রাতটা কেটে গেল নানা চিন্তায়।
কাকুর ঘরের ঠিক সামনে খাঁচার ময়নাটা ডেকে তুলল, ‘অপু ভোর হল, দোর খোলো…’
সব শেখানো কথা। দাদু আর ঠামকে দেখলেই বলে, ‘হরেকৃষ্ণ। অফিস যাবে না! দেরি হয়ে গেল যে।’ মায়ের গলায় বলে বাবাকে। সবাইকে ভালোবাসে। শুধু কাকুকে দেখলেই খালি গোমড়া মুখে বসে থাকে।
ভোরে উঠে অপু হাঁটতে বেরল। পুজো এসে গেল। ওদের বাগানে শিউলি গাছের তলায় কেউ যেন কমলা আর সাদায় ছাপা চাদর বিছিয়ে রেখেছে। অপু একটাও ফুল না মাড়িয়ে হেঁটে এসে গেট খুলল।
হুম। দুপাশে হম্বিতম্বি। দুটো ডগি। বিস্কুট খায় রোজ। ওদের আদর করে খাইয়ে এক পাক পাড়া ঘুরে এল।
বাড়ি ফিরতেই ময়নাটা বলে উঠল, ‘অপু এলি বাবা!’ হুবহু ঠামার মত।
রবিবার। কে বলবে! সবাই গম্ভীর মুখে চা খাচ্ছে।
‘দীপ, দীপ’… কে ডাকছে! স্কুলের কেউ হবে।
অভিনব অঙ্কখাতা নিয়ে গেল। ও কিছুদিন স্কুলে আসতে পারেনি তাই।
হঠাৎ শুনল ময়নাটা কা-কা করছে।
‘কী রে! কাক বন্ধু হল নাকি নিজের কাক হওয়ার সাধ জাগল!’
অদ্ভুত। তবুও কা-কা করেই চলেছে। কোনোদিকে ভ্রূক্ষেপ নেই।
অপু কাকিয়াকে ঘরে ঢুকে জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি কী এর আগে বাক্সটা খোলোইনি!’
‘না রে, মস্ত ভুল হয়ে গিয়েছে। তোর কাকু পইপই করে বলেছিল লকারে রেখে আসতে। আমারই দোষ।’
সারা বাড়ি ঘুরে এসে অপু দাঁড়াল ময়নার কাছে। ছোলা খাচ্ছে আর চোখ পাকিয়ে বলছে কা-কা। অপুকে দেখে কা-কা ডাকটা বেড়ে গেল।
অপু দেখল ময়নার খাঁচা থেকে কাকুর ঘরটা স্পষ্ট দেখা যায়।
সোমবার দুপুরে একটা ফোন এল। ল্যান্ড লাইনে। সবাই অফিসে। বাকিরা দিবানিদ্রায় ব্যস্ত।
অপু ধরল ফোনটা।
‘এটা কি কুমার সেনের বাড়ি! উনি মনে হয় অফিসে। আমার একটা কথা বলার ছিল।’
‘বলুন। আমি ওঁর ভাইপো বলছি।’
‘আসলে উনি কিছুদিন আগে লকারে এসেছিলেন। সই করতে গিয়ে দামী পার্কার পেনটা ফেলে গিয়েছেন। হয়তো খুঁজে বেড়াচ্ছেন। তুমি একটু বলে দিয়ো ভাই।’
অপুর হাত থেকে রিসিভার পড়ে যায় আর কী!
এই কারবার। আসুক কাকু।
প্রায় সাতটা তখন। কাকু ফিরতেই চেপে ধরল অপু।
‘তোমার পার্কার পেনটা কোথায় গো!’
‘খুঁজে পাচ্ছি না রে! বড় শখের কলম।’
‘এর মধ্যে ব্যাঙ্কে গিয়েছিলে! লকারে গয়না রাখতে!’
‘ইস পেনটা ওখানেই ফেলে এসেছি না! ধরে ফেললি অপু! ফোন এসেছিল না! আমি একটু শিক্ষা দিতে চেয়েছিলাম তোর কাকিয়াকে। সময়ের কাজ সময়ে করতে হয়।’
‘বুঝলাম। এবার ওগুলো তুলে এনে আমাকে দেবে কাল। আমি সুযোগ বুঝে রেখে দেব।’
কাকু অফিসের কাজের মাঝেই অপুকে গয়নাগুলো দিয়ে গেলেন।
পরদিন। কাজ শেষ।
অপু সন্ধের সময় কাকিয়াকে বলল, ‘চাবিটা দাও তো। দেখি একটু বাক্সটা।’
বাক্স খুলতেই ঝলমল করে উঠল।
‘দেখো দেখো আসমানের গয়নাগুলো উড়ে উড়ে ফিরে এসেছে!’
কাকিয়া তো দেখে হাঁ! এও কী সম্ভব! ততক্ষণে বাড়ির সবাই হাজির।
‘কোথায় গিয়েছিল কী করে ফিরল কোনও জিজ্ঞাসা নয়। বাড়ির জিনিস বাড়িতেই রইল।’ বললেন অপুর বাবা।
শুধু অপু বুঝল, ময়না কাকুকে গয়না নিতে দেখেছিল। না শেখালে তো কথা বলতে পারে না, তাই কেবল কা-কা করছিল। ইস, এটা অপুর বোঝা উচিত ছিল। তবে অপুর লাভই হল।
পরদিনই বাবা এনে দিলেন রাজ্যের ডিটেকটিভ বই। আর কানে কানে বললেন, ‘সাবাস বেটা।’