সংঘমিত্রা রায়
স্কুল বাসে বসে সায়ন দেখল বুড়ো লোকটি ফুটপাতে বসে আছে। সবার কাছে হাত পেতে ভিক্ষে চাইছে। কেউ দিচ্ছে, কেউ গালাগাল করছে । এমনকি ওর মা লোকটাকে একটা টাকা দিল না। কিন্তু সায়ন জানে মায়ের ব্যাগে বেশ টাকা আছে ব্যাগে টাকা রাখতে সায়ন দেখেছে।
সায়ন বাসে জানলার পাশে বসে আছে। ট্রাফিক জ্যাম। দেখল একটা ছোট্ট ছেলে এসে বৃদ্ধ লোকটির কাছে বসল। ছেলেটিকে সে চেনে তাদের বাড়ির কাজের মাসি রত্নার ছেলে বিনু। বস্তিতে থাকে একটা সরকারি স্কুলে ক্লাস থ্রিতে পড়ে।
ছেলেটি তার ব্যাগ থেকে কয়েকটা ভাঙা বিস্কুট, বিস্কুটের গুঁড়ো আর মুড়ি বের করে বৃদ্ধ লোকটাকে দিল। বৃদ্ধ লোকটি খুব খুশি হয়ে খেল। তাঁর গালে মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করল। তারপর বিনুও খুশি হয়ে স্কুলে চলে গেল।
সল্ট লেকের একটা ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে সায়ন ক্লাস ফাইভে পড়ে। লেখাপড়ায় ভালো, বাবা-মা দু’জনেই সরকারী চাকরি করেন সায়ন খুব ভালো ছবিও আঁকে।
বিনুর ভিখারিকে বিস্কুট আর মুড়ি দেওয়া দেখে সায়নের মনটা কেমন করে উঠল। বিনুর বাড়িতে খুব অভাব পেট ভরে খেতে পায় না তারা। ওর বাবা নেই, ওরা তিন ভাইবোন। রত্নামাসি লোকের বাড়ি কাজ করে। অনেক কষ্টে ওদের চলে। তিন ভাইবোন সরকারি স্কুলে পড়ে। কিন্তু তারপরও বিনু হয়তো নিজে না খেয়ে বৃদ্ধ লোকটাকে খেতে দিল। কিন্তু সায়নের বাড়িতে কত খাবার নষ্ট হয় প্রতিদিন কত খাবার ডাস্টবিনে ফেলে রত্নামাসি। সায়নের মা সুতপাদেবীর কড়া হুকুম বাসি খাবার যেন ঘরে না থাকে। তিনি বাড়তি খাবার থাকলে পরের বেলা সেটা খান না, ফেলে দেন। সুতপার মেজাজ সবসময় গরম থাকে, রত্না খুব ভয়ে ভয়ে থাকে খাবার ফেলে দেয় কিন্তু নিজে নেওয়ার কথা মুখ ফুটে বলে না।
ওদের বাড়িতে খাবার ফেলে দেওয়া হয়, সায়ন সেটা দেখেছে। এত খাবার নষ্ট হয় সায়ন তো কিছু খেতে দিতে পারত ভিখারিকে। নিজেকে বিনুর কাছে ছোট মনে হল সায়নের।
পরদিন সায়ন স্কুলে যাওয়ার সময় ওর টিফিনটা নিয়ে দিয়ে দিল বৃদ্ধ লোকটাকে। টিফিনে ফল ছিল। লোকটি খুব খুশি হল আদর করল সায়নকে।
কিন্তু এই খবর সায়নের মায়ের কানে পৌছে যায়। সায়নের সহপাঠীর মা বলেছেন। তিনি খুব রেগে যান।
সায়ন স্কুল থেকে ফিরে এলে সুতপাদেবী অফিস থেকে এসে সায়নকে বললেন, ‘তুমি কেন তোমার টিফিন ওই লোকটাকে খেতে দিয়েছ?’
‘কাল বিনু লোকটাকে খাবার এনে দিয়েছিল। ওদের কত কষ্ট, ওরা পেট ভরে খেতে পায় না । রত্নামাসি লোকের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালায়। তারপরও বিনু গরীব লোকটাকে খেতে দিয়েছে। আর আমাদের বাড়িতে কত খাবার নষ্ট হয়, আমি তো পেট ভরে খেয়ে বের হলাম। কিন্তু ওই দাদুর কেউ নেই। পেট ভরে খেতে পায় না। তাই আমি ওকে খেতে দিলাম।’
‘ও মাগো, তুমি বিনুর মতো একটা ছেলের কাছ থেকে শিক্ষা নিচ্ছ! ছিঃ ছিঃ। তোমাকে লেখাপড়ার জন্য এতো ভালো স্কুলে ভর্তি করলাম, কত ভালো ভালো বই কিনে দিই। ভালো টিচার রেখে দিয়েছি আর তুমি বিনুকে দেখে শিখছ। ভাবা যায়!’
সায়নের দাদু পাশে বসে ছিলেন। তিনি সবকিছু শুনছিলেন। তিনি বললেন, ‘শুধু বই থেকেই শিক্ষা নেওয়া যায় না বৌমা। আমাদের শেখার জন্য পুরো জগৎটা রয়েছে। আমাদের চলার পথে যা ভালো কিছু চোখে পড়ে তাই শেখা উচিত। সবার কাছেই শেখার মতো কিছু না কিছু আছে। মানুষকে হতে হয় হাঁসের মতো পাঁকের মধ্য থেকে যেভাবে নিজের খাবার আহরণ করে তেমনি আমাদের চলার পথে খারাপ জিনিসটা বর্জন করে ভালো যা চোখে পড়ে তা শিখতে হয়। শুধু কোনটা ভালো আর কোনটা খারাপ সেটা বুঝতে হবে। আজ আমার দাদুভাই বিনুর কাছ থেকে যা শিখেছে তা খুব ভালো । সে শুধু আজ নিজের কথা না ভেবে অন্যের দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে শিখেছে। এটা কম বড় কথা নয়। ওকে শুধু বইয়ের পড়ার মধ্যে আবদ্ধ না রেখে জগৎ থেকে শিক্ষা নিতে দাও। কারণ এই জগৎও একটা বড় পাঠশালা। এতে দাদুভাই একজন ভালো মানুষ হবে।’
সায়নের মা বুঝতে পারলেন শ্বশুরের কথাগুলো। বললেন, ‘ঠিক আছে বাবা বুঝেছি আপনার কথা। ওকে নিজের মতো চলতে, শিখতে আমি আর বাধা দেব না। শুধু মন দিয়ে পড়াশোনা করলেই আমি খুশি।’
‘আরেকটা কথা বলি বৌমা, এত খাবার নষ্ট না করে রত্না বা যাদের দরকার তাদের দিয়ে দিও।’
‘তাই করব বাবা আমার চোখ খুলেছে।’
সায়ন মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, ‘ধন্যবাদ মা আমার সঙ্গে সঙ্গে তুমিও কিছু শিখলে তাই না।’
—‘একদম বাবা।’