• facebook
  • twitter
Sunday, 16 March, 2025

সংখ্যালঘুদের সঙ্গে নিয়ে চলাটা সংখ্যাগরিষ্ঠদেরই কর্তব্য

শুধু কর্তৃত্বই নয়, রীতিমতো অত্যাচার চলত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপর। কারণ ছিল একটাই, তাদের বাংলা ভাষা ছেড়ে উর্দু বা পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষায় কথা বলতে হবে।

প্রতিনিধিত্বমূলক চিত্র

আশিস সামন্ত

সালটা ১৯৪৭। দীর্ঘকাল শাসনের পর ব্রিটিশ কর্তৃত্ব সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, তারা এবার ভারতের জমি থেকে ব্রিটিশ উপনিবেশিকতা প্রত্যাহার করবে। তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ক্লিমেন্ট অ্যাটলি সেটা স্পষ্টই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সেই সময় ভারতবর্ষে দুটি প্রধান রাজনৈতিক দল, ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ এই পদক্ষেপকে স্বাগত জানায়। যাই হোক, এত বছর পর স্বাধীনতা পাওয়া যাচ্ছে, সেটা হাতছাড়া হতে দেওয়া যায় না। সব কিছুই ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু চাঁদ যত সুন্দরই হোক না কেন, যত দারুণ জ্যোৎস্নাই প্রদান করুক না কেন, চাঁদের কলঙ্ক তো আর মিথ্যে হয়ে যেতে পারে না। আর ১৯৪৭ সালের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ভারতবর্ষের স্বাধীনতার বিষয়টিতে সবথেকে বড় কলঙ্ক ছিল বৃহৎ ভারতবর্ষের বিভাজন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের দেশ বিভাজনের সিদ্ধান্তে কোনওপ্রকার মত ছিল না, কিন্তু মুসলীম লীগ, বিশেষ করে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহই সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে দেশ বিভাজনের প্রস্তাব দেন এবং তা কার্যক্রমও করা হয় যে তা আমরা সবাই জানি। দেশ বিভাজন বলতে একটি জাতির, বিশেষ করে মুসলিম জাতির সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে একটি আলাদা রাষ্ট্র, পাকিস্তান তৈরির প্রস্তাব দিয়েছিলেন মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। দেশ বিভাজন বলতে কী? পাঞ্জাব, সিন্ধু প্রদেশ এবং বঙ্গের কিছুটা অংশ ভারতের মূল ভূখণ্ড থেকে বাদ হয়ে যাওয়া। সেই অংশটিই ১৯৪৭ সালের ১৫ অগাস্টের পর মুসলিম গরিষ্ঠ দেশ পাকিস্তান নামে পরিচিত হয়। বঙ্গের কেটে যাওয়া অংশটুকু যেখানে বাঙালি মুসলিমের আধিক্য বেশি সেটি পূর্ব পাকিস্তান এবং পাঞ্জাব ও সিন্ধুপ্রদেশের কেটে যাওয়া অংশটুকু যেখানে অবাঙালি মুসলিমের আধিক্য বেশি সেটি পশ্চিম পাকিস্তান নামে অভিহিত হয়।সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। কিন্তু দেখা গেল আস্তে আস্তে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে একপ্রকারের দোলাচল শুরু হল। যেহেতু পশ্চিম পাকিস্তানের অবাঙালি মুসলিমরাই সমগ্র পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণ করত, সেহেতু বঙ্গের ওপারে বাঙালি মুসলিমদের উপরও তারাই কর্তৃত্ব স্থাপন করবে সেটাই স্বাভাবিক।

শুধু কর্তৃত্বই নয়, রীতিমতো অত্যাচার চলত পূর্ব পাকিস্তানের মানুষদের উপর। কারণ ছিল একটাই, তাদের বাংলা ভাষা ছেড়ে উর্দু বা পশ্চিম পাকিস্তানের ভাষায় কথা বলতে হবে। যেহেতু উর্দুভাষী মুসলিমরা সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ, তাই তাদের কথাই শুনতে হবে এবং মানতে হবে। না মানলেই ধর্ষণ, নিপীড়নমূলক অত্যাচার এমনকি প্রকাশ্যে খুনও পর্যন্ত করে দেওয়া হতো। আস্তে আস্তে এই অত্যাচার মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ে পৌঁছে যায়। তখনই পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতিতে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে এক নির্ভীক সাহসী বাঙালি যুবক, যাঁর নাম শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে, এই একনায়কতন্ত্রের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দেন এবং সকল বাঙালিকে আহ্বান জানান। তাঁর ডাকে এগিয়েও আসে হাজারে হাজারে, লাখে লাখে বাঙালি। শেষ পর্যন্ত ১৯৭১ সালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহায়তায় শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর লক্ষ্যে পৌঁছান। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের ওপর থেকে লিখিতভাবে সমস্ত কর্তৃত্ব উঠিয়ে নেয়, জন্ম নেয় নতুন বাংলাদেশ রাষ্ট্র। এতগুলো কথা বললাম কেন, কেনই বা ইতিহাসের এই ঝরাপাতাগুলোকে আবার মনে করালাম? আসলে একটি বই পড়তে পড়তে ইতিহাসের এই অধ্যায়গুলো মনে পড়ে যাচ্ছিল। এবং মনে একটাই প্রশ্ন বারবার জেগে উঠছিল, এই কারণেই কি সংখ্যাগরিষ্ঠ পৃথক রাষ্ট্র চাওয়া হয়েছিল? বইটির নাম আগে বলে নিই। বইটি হল পারুল বই প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত বিশিষ্ট সাংবাদিক এবং রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুমন ভট্টাচার্য এবং বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের প্রধান সৈয়দ তানভীর নাসরীনের লেখা “কেন আমরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলছি?”

এই বইটিতে লেখক-লেখিকার আটটি নিবন্ধ রাখা হয়েছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার প্রায় ৫৩ বছর পর ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে আমূল পালাবদল ঘটল এবং তারপরে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি অবনতির যে গভীর গহ্বরে প্রবেশ করল তার সাক্ষ্য বহন করে এই বই। প্রতিটি নিবন্ধ লিখতে গিয়ে লেখকদ্বয়ের কলম গর্জে উঠেছে বিগত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের উপর যে অকথ্য অত্যাচার, যে নিপীড়ন চলছে তা নিয়ে। বইটিতে আলাদা করে বাংলাদেশের উল্লেখ থাকলেও তাঁদের লেখা পড়ে এটুকু বুঝতে পারলাম যে, লেখক-লেখিকা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতবর্ষ, গাজা এবং বিশ্বের যেখানে যেখানে সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচার চলেছে এবং বর্তমানে চলছে, সেইসব নিয়েও সমানভাবে চিন্তিত ও সেইসব বিষয় নিয়েও তাঁদের কলম গর্জে উঠেছে। বইটির মধ্যে লেখক এবং লেখিকা একদিকে যেমন সংখ্যালঘুদের উপর অত্যাচারের এক বীভৎস দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছেন, তেমনই দুজনেই সম্প্রীতির কথাও বলেছেন, একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে সংখ্যালঘুদের সঙ্গে নিয়ে চলাটা যে সংখ্যাগরিষ্ঠদেরই কর্তব্য তা তাঁরা স্পষ্টভাবে বুঝিয়েছেন। বাংলাদেশ ধীরে ধীরে নিজের সমস্ত সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছে। জামাতের এবং পাকিস্তানের সহযোগিতায় কীভাবে ইউনূস সরকার নৈরাজ্যের, অরাজকতার সৃষ্টি করে চলেছে প্রতিনিয়ত এবং এপারের বাম ও অতি বামরাও তাতে যেভাবে প্রচ্ছন্ন সমর্থন জোগাচ্ছে, তা নিয়েও লেখক এবং লেখিকা নিজেদের মতামত প্রকাশ করেছেন। সত্যি কথা বলতে গেলে এই বই, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির লিখিত কোলাজ, যা সবারই পড়া উচিত।

কেন আমরা বাংলাদেশের সংখ্যালঘুদের পক্ষে কথা বলছি?

সৈয়দ তানভীর নাসরীন
সুমন ভট্টাচার্য
পারুল বই প্রকাশনী
মূল্য : ১৫০ টাকা

News Hub