• facebook
  • twitter
Monday, 16 September, 2024

অন্তর্দৃষ্টি

পরমা অয়নকে বলেছিল পলাশকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। অয়ন রাজি হয়নি। বলল— আরও ভিজতে বলো, ভালো হয়ে যাবে। ওর পেছনে টাকা ঢালতে আমি নারাজ।

শিশির দাশগুপ্ত

শীতের সন্ধ্যায় হিম পড়লে প্রায় সকলেরই মন উদাস হয়ে ওঠে। জবুথবু ঠাণ্ডায় সারা শরীরে চাদর মুড়ি দিয়ে যত মানুষের মধ্যেই বসে থাকুক কেউ; তবু কোথায় যেন সে আনমনা হয়ে পড়ে। ঝিঁঝি পোকার অন্তহীন শব্দ তাকে আরো বেশি বেশি করে প্রকৃতিমনা করে তোলে। সে হারিয়ে যেতে থাকে ঝিমুনি পৃথিবীতে।

পলাশও ঠিক তেমনি। একান্তে বসে চোখ বন্ধ রেখে সে শুনছিল ঝিঁঝির একটানা সুরেলা আওয়াজ। সেই আওয়াজের মধ্যেই সে আস্বাদ করছিল পৃথিবীর গান, যা কখনো স্তব্ধ হয় না। পলাশ ডুবে যাচ্ছিল এক অদ্ভূত সমুদ্রে। তার চোখের সামনে ভেসে উঠছিল রঙ্-বেরঙের ফুলের সমারোহ। সুন্দর হিমালয়ের বরফ শহর। সাদা আর সাদা বরফ। আবার ঝটিতেই ভেসে উঠছিল চোখের সামনে কাশফুল। কাশের শাদা রঙ আর বরফের সাদা রঙের মধ্যে কোথায় মিল, কোথায় ভিন্নতা খুঁজে বেড়াতে চায় পলাশ।

পলাশ তার মনের সাদা পাতায় কত কী ছবি এঁকে ফেলে, সুন্দর পেঁজা পেঁজা সাদা তুলোর মত মেঘ। তাদের সঙ্গে পলাশের কত আত্মীয়তা। পলাশ যেন কথা বলে মেঘের সঙ্গে। সেই সাদা মেঘের ছবি সে সাদা পাতায় আঁকবে কীভাবে? কীভাবে আঁকবে সাদা কাশের ছবি? ভাবতে ভাবতেই ঢাকের শব্দ তার কানে আসে। ঢাকের পেছনে সাদা পালক দেখেই তার মন আনন্দে উদ্বেল হয়ে ওঠে। সাদা পাতায় ঢাকীকে সে সহজেই জায়গা দিতে পারবে কিন্তু, সাদা পালক, সে কীভাবে আঁকবে?

আঁকার খুব শখ পলাশের। শুনেছে তার মা ভাল ছবি আঁকতো। পলাশ কখনো দেখেনি। তার মনে আছে তখন তার বয়স বছর চারেক। বাড়িতে একটা বিশাল ছবি টাঙানো হয়েছিল। বাবা এনেছিল। মা বলেছিল— মোনালিসা; বলেছিল— বড় হও, তখন বুঝবে। এই ছবির চোখদুটিই আসল।

মনে পড়তেই বিষণ্ণ হয়ে পড়ে পলাশ। তার বুকের মধ্যে একটা নাচার ক্রোধ তৈরি হয়। সেই ছবিটা পরে আর পলাশ দেখতে পায়নি। ছবির চোখদুটো এখনো স্পষ্ট মনে আছে। এমনকী গোটা ছবিটাও। পলাশ ছবিটার চোখে আলো খোঁজে, ভাষা খোঁজে, নিজেকে খোঁজে।
কতদিন পলাশ মাকে বলেছে কাগজ এনে দিতে, রঙ এনে দিতে। মায়ের কাছে বায়না ধরলেই মা কথা দিত, আশ্বস্ত করতো। বলতো— এনে দেবো। পলাশকে একটা কাঠপেন্সিল, কিছু কাগজ দেওয়া হতো। পলাশ তাতেই আঁকিবুঁকি কাটতো।

কখনো ঝলমলে পৃথিবী, কখনো শুকনো নদী, কখনো ডানাভাঙা পাখি, কখনো ডানাকাটা প্রজাপতি, কখনো শুধু মানুষের মুখ। মা বলতো— এসব কী এঁকেছো? মানুষের মুখ তো হয়নি। সব পশুর মুখ হয়ে গেছে।
—কোন পশুর মা?
—সেরকম বিশেষ নয়। তবে ওগুলো মানুষের মুখ হয়নি।
—বাবা যে বলে, মানুষও পশু।
পলাশকে এখন আর আগের মতো তার মা বুকে টেনে নেয় না। ছেলের বয়স হচ্ছে। এখন চোদ্দ। ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠছে পলাশ। যত বড় হচ্ছে, ততই বায়নাক্কা বাড়ছে, তার সঙ্গে রাগ।

অথচ এই পলাশই বছর ছয়েক আগেও ছিল ভীষণ শান্ত,সুস্থির। কোথাও বেড়াতে নিয়ে গেলে তার কী আনন্দ। আট বছরের পলাশ ছূটে ছুটে বেড়াতো সবুজ লনে। গাছের সান্নিধ্য তার সবচেয়ে ভাল লাগতো। একটা কচি সবুজপাতা পেলে তাকে উল্টেপাল্টে কত রকমভাবে দেখতো। বলতো— মা, দেখো পাতাটার একদিকে কত গাঢ় রঙ ঢেলেছে, উল্টোদিকে রঙ ফুরিয়ে এসেছিল। পলাশের মা হাসতো। বলতো— বোকা, ওটাই নিয়ম। একদিকে সবসময় বেশি রঙ থাকলে অন্যদিক তো ফ্যাকাশে হবেই।

পাখিদের দেখলেই আনন্দ তার ধরতো না। পাখিদের রঙিন পাখনা নিয়ে ছোট্ট পলাশ কত কথা বলতো। বলতো— মা, টিয়াপাখির রঙ দেখেছো? আর ঠোঁটের রঙ? মা বলতো— এটাই প্রকৃতি। আবার ওর ঠোঁটটা দেখো, কেমন বাঁকানো অথচ সুন্দর, মানানসই। পলাশ বলতো— টুকটুকে লাল।

পলাশের ছবি আঁকার রোখ এত বেশি ছিল যে, তার মা বাধ্য হয়েছিল রঙ কিনে দিতে। পাশে বসে বলতো— এটা সবুজ, ঘাস রঙ। তুমি সবুজ লন আঁকতে পারো। বলতো— এটা হলুদ, সর্ষে খেতের ছবি আঁকো।

পলাশ লাল বলের মতো সূর্য আঁকছিল। পাশেই ঘন কালো মেঘ। মা বলেছিল— এটা কেমন হলো? লাল সূর্য মানেই ভোর অথবা পড়ন্ত বিকেল, সন্ধ্যা ছুঁইছুঁই। তুমি তার পাশে কালোমেঘ আঁকলে সূর্য তো ঢাকা পড়ে যাবে। তখন নিচে পৃথিবীর ছবিটা কেমন হবে? সেখানে তো অন্ধকার নেমে আসবে।

পলাশ মায়ের কথা শোনেনি। বলেছিল— তুমি মন দিয়ে ছবির দিকে তাকিয়ে থাকো। দেখতে পাবে বস্তির ঘরে উনুনের আলো। কাঁথামোড়া বুড়ি খাটিয়ায় বসে টানছে হুক্কা। হুক্কার চিড়বিড় আগুন। কতগুলি বাচ্চা শুকনোপাতা জ্বালিয়েছে। সেখানে ওদের মুখে আলো সাঁতার কেঁটে যাচ্ছে। তার মধ্যে একটা বুড়ো, তার মোটা মোটা আঙুলগুলো হাতশুদ্ধো সেঁকে নিচ্ছে। মুখে তার বিড়ি। বিড়িটা টানলেই তার মুখে একটা বাজ পড়া আলো। বাচ্চাদের বাবাকে দেখো, ফিরছে কারখানা থেকে। উঠোনেই খুলে ফেলেছে ইউনিফর্ম। ওই দ্যাখো, তার বুকে এখনো ফার্নেসের আগুন, আলো।

পরমা কেঁদে ফেলে। তার ছেলের মধ্যে এ কী শিল্পীসত্তা! তবে কি পলাশ সত্যিই ছবি আঁকতে পারবে? সেই ছবিটা যা কিনা একসময় পরমাকে তাড়িয়ে বেড়াতো। কিন্তু কীভাবে? মুখে শাড়ির আঁচল গুঁজে পরমা সরে যায় পলাশের সামনে থেকে। তার বুকের মধ্যে তখন পলাশের আঁকা ছবিটাই প্রবল হয়ে ওঠে। ঘনকালো মেঘের মধ্যে থেকে নেমে আসে ভয়ঙ্কর বাজ। কানে তালা লেগে যায় পরমার। বৃষ্টি নামে বুকে, চোখে।

সেই থেকে পলাশকে আঁকায় সাহায্য করে পরমা। সবসময় আঁকার ব্যাপারে সে উৎসাহ দেয় ছেলেকে। যদিও সে জানে, তার পলাশের পক্ষে কখনোই ছবি আঁকা পূর্ণতা পাবে না। তবু, তবুও পলাশের স্বপ্নিল চোখকে সে পড়তে পারে। সেখানে রয়েছে ভরাট নদী, আকাশ, পাহাড়, ঘাস, বন, লতাপাতা ও নানা রঙ্, বেরঙের সুখ, অসুখ।

নিখিল ভারত অঙ্কন প্রতিযোগিতার পনের বছরের বিভাগে পরমা ওর আঁকা একটা ছবি এবছর পাঠিয়েই দিল। পলাশ বায়না ধরেছিল বাবার কাছে। অয়ন বিষয়টাকে গুরুত্বই দেয়নি। উল্টে বলেছিল— থাম্, কুঁজোর আবার চিত হয়ে শোবার ইচ্ছা। গায়ে লেগেছিল পরমার। রাগে, ক্ষোভে, যন্ত্রণায় সে ছবিটা পাঠালো।

গতকাল সন্ধ্যায় আঁকা ছবি। পলাশ এঁকেছে একজন বৃদ্ধ মানুষ ইজিচেয়ারে হেলান দিয়ে রয়েছেন। পাশেই ফায়ারপ্লেস। বাইরে তুলোর মত বরফ পড়ছে। ছবিটা জল রঙের। রঙের ব্যবহারে পরমাই সাহায্য করেছে। ভাবনা পলাশের। এমন ছবি আঁকলে কেন? পলাশ বলেছিল— বুড়োটা ঠাণ্ডায় ঝিমোচ্ছে। সারা শরীরে কম্বল জড়ানো। ঘরটা নিস্তব্ধ। ফায়ারপ্লেসের পাশে দেখো আমি কয়েকটা ঝিঁঝিপোকা এঁকেছি। ওদের গুনগুনানিতে মানুষটি স্বপ্নে গ্রীষ্ম উপভোগ করছে। বাইরে বরফের কুচি। ওখানে দেখো, দুটো বালক-বালিকা। বুড়োটার নাতি-নাতনি। ওরা কিন্তু আনন্দ করছে। বুড়োটা জানে ওরা গ্রীষ্ম।

পরমা বলে, এমনভাবে ছবির কথা ভাবো কেন? সহজ ছবি আঁকো, যে ছবি খুশির কথা বলে, আনন্দের কথা বলে, দুঃখের কথা বলে; তুমি যে ভাবনায় ছবির কথা ভাবো তা সঠিক ভাবনা কি না; সেই ছবি মানুষ কীভাবে নেবে সেটা আমিও ভালভাবে বুঝে উঠতে পারি না—

উত্তরে পলাশ বলে— মা, ছবিটা শুধু চোখে দেখলে তা আর ছবি হল কোথায়? ছবিতে যা থাকে তা তো তুমি স্বাভাবিক পৃথিবীতেই দেখতে পাও। সে তো ক্যামেরা দিয়ে ছবি তুললেই হয়। কিন্তু সাদা কাগজকে আমি কথা বলাতে চাই; আমি চাই সাদা কাগজে শব্দ ফুটে উঠুক। সেইজন্যই আমি ছবিটা মাথায় রাখি। সেখানে আগে নানান বিবাদ চলে। তারপর আমি ছবি আঁকি। তুমিও ছবিটা দেখার পর মাথায় পাঠিয়ে দাও। সেখানে ঝগড়া চলুক। তারপর মনে হবে এটা ছবি হল কি না? তুলি-রঙ কলম হয়ে উঠল কি না?

পরমা বলে— বুঝেছি, তুমি নিজেও ছুটতে চাইছো সময়ের তালে তালে; নিজের মধ্যেই চালিয়ে যাচ্ছ এক লড়াই। আমিও বিশ্বাস করি, মানুষের লড়াই আসলে নিজের সঙ্গেই। বাইরের চেয়ে ভেতরের লড়াইটাই আসল।

পলাশ বাধা দিয়ে বলে— না, মা, একটু অন্যরকম। আমার লড়াই; আমার সঙ্গে এটা ঠিক কিন্তু আমার তো কিছু কমজোরি আছে। সেটাকে অগ্রাহ্য করতে হয়। সময়ের সঙ্গে কি না বুঝি না তবে আমি লড়াই চালাই মস্তিষ্কে। মুহুর্মুহু সেই লড়াই। আমি শুধু বলি; চুপচাপ একই কথা বলি— আমার সমস্ত শরীরটাই আমার চোখ, আমার সমস্ত শরীরটাই আমার মাথা। আমি সেই গোটা মাথাটা নিয়ে দুমদাম লড়াইতে থাকতে চাই।

পরমা ছেলের তুলিগুলো জলে ধুতে ধুতে আড়ালে নিজের চোখদুটোকেও ধুয়ে নেয়।
আরও একটা ছবি এঁকেছিল পলাশ। বোলপুরের রূপপুর। সেখানকার আদিবাসী জীবন, বাউলের কুঠুরি, বিকেলের প্যাঁক প্যাঁক হাস, নিরিবিলি গ্রাম, খড়ের ছাউনি ঘর আর পলাশ, শিমুলের ছড়াছড়ি। ছবিতে কৃষ্ণচূড়া, রাধাচূড়া গাছও আছে। আছে সরকার থেকে লাগানো ইউক্যালিপটাস।

পরমা বলেছিল— সব ভালো, তবে একটা গরুর গাড়ি দিলেই পারতিস। পলাশ বলেছিল— আমি সেই ছোট্টবেলায় দেখেছিলাম গরুর গাড়ি। এখন আমার সঙ্গে সঙ্গে গ্রামটাও বড় হয়েছে। সেখানে কাদামাটি এখন কমে গিয়েছে। সেখানে গিয়ে দেখো এখন অটো চলে, টোটো চলে। দেখছো না, ছবিতে আমি পাখি দিইনি।

—ওমা, তাই তো এটা মস্ত ভুল। এমন গ্রাম্য পরিবেশে পাখি ছাড়া ছবি অসম্পূর্ণ।
—না, মা। এখন ডিজেলের গন্ধ রূপপুরেও। পাখিরা এ’সব সইতে পারে না। আমিও ওদের কষ্ট দিতে চাইনি। আমি তো ওদেরই দলে।
এবারের শীতে অকাল বর্ষণ হল। পরমা খেয়াল করেনি, এই বৃষ্টিতে ছাদে উঠে গিয়েছিল পলাশ। খুব বকেছিল পরমা। বিকেল শেষ হতেই জ্বর এলো। বেশ জ্বর। সারারাত মাথার সামনে ঠায় বসে ছিল পরমা। মাঝেমাঝেই হাতপাখার হাওয়া আর কপালে জলপট্টি। ভোরের দিকে ঘাম দিয়ে জ্বরটা ছাড়ল।

পরমা অয়নকে বলেছিল পলাশকে একবার ডাক্তারের কাছে নিয়ে যেতে। অয়ন রাজি হয়নি। বলল— আরও ভিজতে বলো, ভালো হয়ে যাবে। ওর পেছনে টাকা ঢালতে আমি নারাজ।
মুখ বন্ধ রাখে পরমা। দুপুরে রান্না, স্নান সেরে পলাশকে নিয়ে সে ডাক্তার দেখাতে যেই বেরতে যাবে, সেইসময়েই পিয়ন এলো। এলো সুসংবাদ।

অয়ন এবার নিজেই উদ্যোগ নিয়ে ওদের দু’জনের জন্য টিকিটের ব্যবস্থা করলো। পলাশের জন্য হাতে করে মৌসাম্বীও নিয়ে এল কয়েকটা। পরমাকে জিজ্ঞেস করলো, পলাশের পোশাকের দরকার আছে কি না।
পরমা অবাক। অবাক অয়নের হঠাৎ পরিবর্তনে। কিন্তু এই পরিবর্তনটা পরমাকে খুশি করতে পারলো না। বরং অয়নের প্রতি তার একটা বিরক্তি জন্মালো।

ওষুধ খাবার পরপরই জ্বরটা কমে গিয়েছিল। সেদিন ডাক্তারই ছিলেন প্রথম বাইরের কেউ যে সুসংবাদটা শুনে খুশি হয়েছিলেন। পলাশকে অনেক, অনেক উৎসাহ দিয়েছিলেন।

সুস্থ হয়েই এঁকে ফেলেছিলো একটা ট্রেনের ছবি। ছবিটিতে প্রচণ্ড জোরে সবুজের বুক চিরে বেরিয়ে যাচ্ছে একটা ট্রেন। চারদিকের সবুজ বনানী ভেদ করে ছুটে চলেছে যন্ত্রদানব। ট্রেনটি ফাঁকা। কোনও যাত্রী নেই। পরমা বললো— এবার মানুষ আঁকো, জানালার পাশে যাত্রী দেখাও। তুমি বাইরে দেখিয়েছ, কিছু অল্পবয়সী ছেলে লাইনের পাশ দিয়ে দৌড়চ্ছে; মাঠের উপর দিয়ে। এবার যাত্রীদেরকে দেখাও ছবিতে।

পলাশ তুলি রেখে উঠে পড়ে। —না মা, আমি যাত্রী দেখাবো না। আমার ট্রেনটা এখানে আসলে সময়। ওই দেখছো না, পাশেই মানুষ ছুটছে, সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। এখানে প্যাসেঞ্জার দেখালেই এটা ট্রেন হয়ে যাবে। আমি তো ওকে সময় বলছি।

এখন পলাশকে নিয়ে পরমা দিল্লিতে। সন্ধ্যাবেলা পুরস্কারমঞ্চে উঠে এলো পলাশ। তার ডান হাত মাকে ধরে রেখেছে। পলাশের বুকে এখন এক কুয়াশাময় শহর; যে শহরের ঘরবাড়ি, ইট-কাঠ, পাথুরে জীবনে এক ক্ষয়িষ্ণু কিশোর অন্ধকার কানাগলি থেকে সূর্যের খোঁজে বেরিয়েছে। বুকের মধ্যে তার টলমল করতে লাগল সেইখানকার পথঘাট, আশেপাশের নাগরিক শহর। কিশোরটি অন্ধকারেই হাতড়ে চলেছে তার স্বপ্নছবিটাকে। সে পাচ্ছে না। একটা স্রোত তার বুক থেকে উঠে আসতে চাইছে কণ্ঠনালির দিকে। সেই কিশোরটি বড় আন্তরিকতার সঙ্গে তার নরম হাতদুটিকে এগিয়ে দিতেই ছুঁয়ে ফেলে এক ঠিকানা, এক নিরাপদ আশ্রয়।

পলাশ মায়ের শরীর ছুঁয়ে, ধীরে ধীরে মায়ের হাতদুটি ছুঁয়ে, মায়ের শীর্ণ অথচ কঠিন আবার নরমও আঙুলগুলি ছুঁয়ে অনুভব করতে থাকে জয় বা সাফল্যের স্পর্শ পলাশের চুলে এখন মায়ের হাতের স্পর্শ; এক অমোঘ শান্তি, এক অনির্বচনীয় সুখ, এক জাগতিক আহ্লাদ, তিতিক্ষা।

পরমা অনুভব করে পুত্রের আকুতি। পলাশকে দু’হাতে বুকের মধ্যে টেনে নেয় পরমা। পলাশের ডানহাতটাকে নিয়ে আসে জেতা পদকের শরীরে। পলাশ আঙুল দিয়ে ছুঁয়ে অনুভব করে তার প্রাপ্য সম্মান।

মুহূর্তের মধ্যেই সে হাত সরিয়ে নেয়। পলাশ আবার মায়ের গাল স্পর্শ করে। স্পর্শ করে মায়ের অশ্রু। পরমা পলাশকে আরও আঁকড়ে ধরে। পরমা বলে— তুমি আমাদের গর্ব। এবার দেখো, ফিরে গেলে বাবা তোমাকে কত্তো ভালবাসবে।
—তা কী করে হবে মা? কীভাবে…
পরমা পলাশের মুখটা হাত দিয়ে চেপে দেয়। চাপা গলায় পরমা বলে— এমন কথা কক্ষনো বলো না, বলতে নেই। তুমি তো শিল্পী, তুমি না অনুভবী!

অনুষ্ঠানের পরের দিন দিল্লির কাগজে পলাশের ছবি, পাশে পরমা। পুরস্কার নেবার পর প্রেস ধরেছিল পরমাকে। পরমা তখন বলে চলেছিল— ওর সব ছবিতেই আমি সাহায্য করি। মনের আলো দিয়েই ও সব ছবি আঁকে। আট বছর বয়স যখন, তখন টাইফয়েডে ওর চোখ দুটো নষ্ট হয়। ধীরে ধীরে ও সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীন হয়ে পড়ে। তারপর থেকে ওর ছবি আঁকা। পলাশ সব ছবিই আঁকে স্মৃতির রঙ দিয়ে। বুঝি, ওর অন্তর্দৃষ্টি আছে।