অসুখ

শুদ্ধেন্দু চক্রবর্তী

কফিশপে কফিতে চুমুক দিতে দিতে হঠাৎ অন্যমনস্ক হয়ে তাকিয়ে রইল অনিকেত। অনিকেতকে আজকাল এরকম প্রায়ই অন্যমনস্ক হতে দেখছে বিদিশা। লেখার চাপে কী! তবে তেমন চাপ তো নেই এখন। নেই বলেই হয়তো অন্যমনস্ক। যখন তার সমসাময়িক বন্ধুরা পূজাবার্ষিকীর উপন্যাস লিখতে ব্যস্ত, তখন অনিকেতের ঝুলিতে কোনও উপন্যাসের বায়না নেই এইবছর। সেই জন্যই কী অনিকেত অন্যমনস্ক? ভাবতে ভাবতেই অনিকেত হঠাৎ বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলল, জানো। আমার মনে হয় অসুখটা বাড়ছে। এই কফিটা খাওয়া আর উচিত হবে না।
—কী আবার হলো বলো তো।
—মনে হচ্ছে পেটের ইনফেকশনটা বেড়ে গেছে। আজ রাতে কিছু খাবো না।
—কিছু হয়নি তোমার অনিকেত। ডাঃ মুখার্জি এণ্ডোস্কোপি আল্ট্রাসোনোগ্রাফি রক্তপরীক্ষায় কিছুই পাননি।
—এসব রোগ ল্যাবরেটরিতে ধরা যায় না, বিদিশা। তবে তা বলে দয়া করে আমাকে সায়কায়াট্রিস্টের কাছে পাঠিও না প্লিজ। আমি পাগল নই।

আর কথা বাড়ালো না বিদিশা। এর আগেও এমন হয়েছে অনিকেতের। কিন্তু আজকাল যেন একটু ঘনঘনই ঘটছে এগুলো। এ নিয়ে বেশি কথা বললে রাতে অনিকেত খুব চেঁচামেচি অশান্তি করে। বিদিশা আর অনিকেতের এই লিভ-ইনের বয়স এক বছর হতে চলল। বিদিশা এই ক’দিনে বুঝেছে একমাত্র লেখালেখির ভিতর থাকলে অনিকেত মনের দিক থেকে শান্ত থাকে। নাহলে আজকাল কী যেন এক অদ্ভুত অস্বস্তি তাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মনে মনে খানিকটা নিজেকেই দোষ দিচ্ছিল বিদিশা। এসব কিছুর বাড়াবাড়ি হওয়ার শুরু যবে থেকে সে অনিকেতকে ফ্রানৎস কাফকার ওই গল্পসংকলন উপহার দিয়েছে। এই বই পেয়ে অনিকেত মাসখানেক তার ভিতর ডুবে থাকার পর হঠাৎ কেমন বেশিরকমের উৎকণ্ঠার শিকার হয়ে গেছে যেন। তার দৃঢ় ধারণা হয়েছে তার শরীরে এক জটিল অসুখ দানা বেঁধেছে। প্রথম প্রথম অনেক টেস্ট করিয়েছে বিদিশা। লাভ হয়নি। তেমন কিছুই ধরা পড়েনি।


তাদের দুজনের এই একসঙ্গে থাকার বৈষয়িক রসদের জোগান দেয় বিদিশাই। বিদিশার ব্যাঙ্কের চাকরি। সল্টলেকে যেতে হয় রোজ। অনিকেতের সঙ্গে যখন প্রথম তার পরিচয় হয়েছিল, তখন ও একটা বড় নিউজ চ্যানেলে কাজ করত। কিন্তু আলাপের দুই মাসের মাথায় চাকরিটা ছেড়ে দিল সে। তার হঠাৎ মনে হলো তার লেখালিখির ভাবনার পথে এই চাকরি নানান সমস্যা সৃষ্টি করছে। সেই থেকে তার আর তেমন কোনও বাঁধাধরা উপার্জন নেই। দু-একটা বায়না লেখা পেলে লেখে। কিছু পয়সা আসে তাতে। তাও অনিয়মিত। জিজ্ঞেস করলেই তারাশংকরের ‘আমার সাহিত্যজীবন’-এর উদাহরণ তুলে বলে জীবনে এই অনিশ্চয়তা না থাকলে ভালো সাহিত্য কখনো হতে পারে না।

ডাক্তার মনোরোগ দেখাতে একবারও বলেননি, এমন নয়, কিন্তু সেকথা শোনামাত্র অনিকেত ভয়ানক রিঅ্যাক্ট করেছে। বিদিশা তাই আর ওই প্রসঙ্গ তুলতে চায়না আজকাল। কফি খেতে আর জোর করল না বিদিশা। উঠে পড়ল দু’জনে। তাদের ফ্ল্যাটটা এই কফিশপের কাছেই। বিদিশাই লোন নিয়ে ফ্ল্যাটটা কিনেছে। এই মলটা থেকে হাঁটা পথে তিন মিনিট। চলার পথে অনিকেত শুধু বলল, তুমি সৌপর্ণ রায়চৌধুরীর ‘বর্নিতা’ উপন্যাসের কথা খুব বলেছিলে। তাই না? ওটা পড়লাম গতকাল। ওইরকম জঘন্য লেখা খুব কম পড়েছি সারা জীবনে।

বিদিশা চুপ করে রইল। সে জানে অনিকেত নিজের লেখা ছাড়া আর কারো লেখাই সহ্য করতে পারে না। ‘বর্নিতা’ কিন্তু তার নিজের পড়ে বেশ লেগেছে। একজন নিঃসঙ্গ মেয়ের জীবনের খোঁজ। কখন যেন কথার ফাঁকে অসচেতনভাবে অনিকেতের বেরিয়ে পড়েছিল সেই অনুভূতির কথা।

বিদিশা চুপ করে রইল। পাড়ার মোড়ে একটা ইস্ত্রিদোকান আছে। বিদিশা ঘরে ঢোকার আগে সেখান থেকে তার আর অনিকেতের শার্টগুলো নিয়ে নিল। কাল ব্যাঙ্কে একটা মিটিং আছে। তালা খুলে ঘরে ঢুকতেই অনিকেত বসে পড়ল সোফার পর। বিদিশা আড়চোখে দেখল অনিকেত নিজের মনে বিড়বিড় করছে।

মাঝেমাঝে নিজেকে একটা কাঁচের বয়াম বন্দি মাছ মনে হয় বিদিশার। যেন এক আঁজলা জল জুড়েই তার পৃথিবী। এই ছোট্ট টু-বিএইচকে ফ্ল্যাট আর অনিকেত। বয়ামের জল পাল্টাতে হয় মাঝে মাঝে। নাহলে জলে অক্সিজেনের অভাবে মাছেরা ছটফট করে। বিদিশাও ভিতরভিতর ছটফট করছিল। স্নানঘরে গিয়ে কুর্তি খুলে এক মুঠো জল ছিটিয়ে দিল নিজের মুখে। তারপর শাওয়ার খুলে দিল। খানিকটা তরতাজা জল না হলে সে বাঁচবে কী করে? চুল মুছে পোশাক বদলে বসার ঘরে এসে বিদিশা দেখল অনিকেত আবার কাফকার সেই গল্পসংকলনে ডুবে আছে। সেই বই থেকে চোখ না সরিয়েই অনিকেত বিদিশাকে বলল, আমার মনে হয় ফেলিৎজে বাওয়া কাফকার সঙ্গে যা করেছে, ঠিক করেনি।
বিদিশা সহজ হবার চেষ্টা করে বলল, কেন? কী করেছে?

অনিকেত অদ্ভুত তাচ্ছিল্যর সঙ্গে তার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জানো না বুঝি? ও। কাফকার লেখা চিঠিগুলো প্রকাশকের কাছে এসে অতোগুলো বছর পর বিক্রি করে দিল। ভাবো তো। এতো বাণিজ্যিক। কাফকার প্রথম প্রেম! কাফকার মতো একজন মানুষ! আচ্ছা বিদিশা, আমি তোমাকে এক বছর আগে যে মেসেজগুলো করেছিলাম, সেগুলো কোনওদিন তুমি এইভাবে মিডিয়াকে বেচে দেবে?

বিদিশা উত্তর দিল না। কেমন যেন তার দুটি কান অপমানে গরম হয়ে উঠেছে। অনিকেত আর তার সম্পর্কের কমন এরিয়া সাহিত্য। ফেলিৎজে বাওয়ার কথা সে জানে। তাঁকে যে সাহিত্যসমাজের একাংশ একজন ধান্দাবাজ মহিলা মনে করে, একথাও সে জানে। কিন্তু তার নিজের তেমন মনে হয় না।
—কী গো? বললে না?
—কী বলব?
—মিডিয়াতে দেবে?
—তোমার কেন মনে হলো হঠাৎ এরকম কথা?

অনিকেত চুপ করে গেল। ঘরের কোনার দিকে চেয়ে আপনমনে বিড়বিড় করতে থাকে।
নিজের ঘরে চলে এল বিদিশা। সামান্য বিছানায় গা এলিয়ে দিতেই রুমেলার কথা মনে পড়ে গেল তার। রুমেলা তার স্কুলের বন্ধু। সাইকোলজি নিয়ে পড়াশোনা করেছে। এখন উত্তর কলকাতায় প্র্যাকটিস করে। মাঝে মাঝে মেসেঞ্জারে কথাবার্তা হয় দু’জনের। ওকে একবার অনিকেতের ব্যাপারটা বললে কেমন হয়। ও ফ্রি থাকলে এ সপ্তাহেই যাবে সে। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিল বিদিশা। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। ঘরে তখন মৃদু নাইটল্যাম্প জ্বলছে। চোখ খুলতেই ভয়ে সিঁটিয়ে গেল সে। আধো নীল অন্ধকারে অনিকেত দাঁড়িয়ে আছে। নগ্ন! তার দিকেই একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছে। কী বলতে চাইছে অনিকেত? কিছূ কি বলতে চাইছে?ধড়মড় করে উঠে বিদিশা অনিকেতের কাছে গিয়ে বলল, কী হয়েছে তোমার অনিকেত? কষ্ট হচ্ছে?

অনিকেতের চোখে জল। সে অসহায়ভাবে বিদিশার দিকে তাকিয়ে বলে, আমি একটা পোকা হয়ে গেছি বিদিশা। একটা ছোট্ট পোকা। চারপাশে মানুষ, পৃথিবী এতো বড়! আমার ভয় করছে।
—তোমার কিচ্ছু হবে না অনিকেত। আমি আছি তো।
—আমাকে ছেড়ে যাবে না তো বিদিশা? ফেলিৎজের মতো?
—অনিকেত ধীরে ধীরে প্যান্ট গলিয়ে এবার বিছানায় শুয়ে পড়ে।শুতে শুতে আপন মনে বিড়বিড় করে বলে, আমি একটা পোকা হয়ে গেছি। তোমার বাবা মা জ্যেঠা, ওরা সবাই জানতে পারলে আমাদের মেরে ফেলবে।

অনিকেতের বাবা মা নেই। মামার কাছে মানুষ। সেই ছোট্ট বয়স থেকে। অন্যদিকে বিদিশার যৌথ পরিবার। বাবারা কাকা জ্যাঠা মিলিয়ে মোট ছয় জন। কাকাতুতো জ্যাঠাতুতো ভাই বোন মিলিয়ে পরিবারের সদস্যসংখ্যা কুড়ির কাছাকাছি। তবু অনিকেতের জন্য সব ছেড়ে সে চলে এসেছে। প্রথম যেদিন তার বাড়িতে অনিকেতকে নিয়ে গিয়েছিল সে, সেইদিন অনিকেত সামান্য ঘাবড়ে গিয়েছিল। আসলে এতোটা সম্মান, মানুষের প্রশ্রয়সান্নিধ্য সে আগে কখনও পায়নি। আজ এতোগুলো দিন বাদে অনিকেত আবার সেকথা কেন বলছে? কী চলছে তার মনে? অনিকেত অঘোরে ঘুমোচ্ছে। সকালে টোস্টারে পাঁউরুটি সেঁকে অনিকেত আর নিজের জন্য কফি বানিয়ে বিদিশা প্রাতঃরাশ সেরে নিল। অনিকেতের কফিটা ফ্লাস্কে ঢেলে একবার তার পড়ার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। টেবিল ভর্তি অনিকেতের অসম্পূর্ণ পাণ্ডুলিপি ছড়িয়ে রয়েছে। এভাবে পড়ে থাকলে হারিয়ে যাবে। বিদিশা পাতার নম্বর মিলিয়ে একে একে তাদের গুছিয়ে রাখল। গোছানোর ফাঁকে কখনও চোখ চলে গেল সেই পাতায় লেখা শব্দর উপর। লেখাটি একটি উপন্যাস। কিন্তু এর আগেও বিদিশার পড়ে মনে হয়েছিল, লেখাটা খুবই অগোছালো। বিচ্ছিন্নভাবে লেখা। চরিত্রগুলো, ঘটনাগুলো যেন জমাট বাঁধবার আগেই কেমন ছেতরে যাচ্ছে। এই উপন্যাস নিয়ে অনিকেত খুব উৎসাহী ছিল প্রথম প্রথম। এক একটা অধ্যায় লিখে তাকে পড়তে বাধ্য করত সে। তারপর অবধারিতভাবেই জিজ্ঞেস করত বারবার তাকে। কেমন হয়েছে? কী বলবে বিদিশা? সে তো মিথ্যে বলতে পারে না। লেখাটা তার ভালো লাগেনি তেমন। সংক্ষেপে বলত শুধু, শেষ হোক। তারপর বলব। লেখা শেষ হয়নি আজও। আজকাল তেমন লিখতে পারে না অনিকেত। বিদিশা বেরিয়ে পড়ল। অনিকেতকে ডাকল না ঘুম থেকে। ঘুমোচ্ছে। ঘুমাক।

অফিসের একেবারে সামনে এসে বাস থেকে নামতে নামতে বিদিশা দেখল তার ফোনটা ভাইব্রেট করছে। রুমেলা ফোন করেছে।
—কী রে? খবর কী?
—একটা দরকার ছিল। দেখা করা যায়?
—আজ?
—হতেই পারে। সমস্যাটা গুরুতর। জরুরি। তবে আমার একটা মিটিং আছে আজ। বিকেল পাঁচটার পর হবে। দেখা করবি?
—বেশ। ফুলবাগানে একটা নতুন ক্যাফে হয়েছে। আমার চেম্বারটা কাছেই। ওখানেই দেখা করি চল। ছটা। ডান?
—একদম।
মিটিং কথোপকথন, সবকিছু যেন ঝড়ের মতো কেটে গেল। বিদিশা ভিতর ভিতর অস্থির হয়ে উঠছিল। অনিকেত সারাদিন ফোন করেনি। মেসেজও নয়। এমনটা এক মাস আগেও ছিল না। অসুখটা ক্রমশ চেপে বসছে। অফিস শেষ হতেই বিদিশা বেরিয়ে পড়ল। ফুলবাগানে পৌঁছোতে মিনিট কুড়ি লাগবে। ক্যাব নিয়ে নিল একটা। যেতে যেতে অনিকেতকে ফোন লাগালো দুইবার। কিন্তু ফোন বেজে গেল! তবে কি অনিকেত ঘুম থেকে ওঠেনি এখনও!
রুমেলা আগেই পৌঁছে গিয়েছিল। বিদিশা রুমেলার টেবিলের দিকে এগিয়ে গেল। সামান্য হেসে বসতেই রুমেলা বলল, ব্যাপার কী বল তো?

বিদিশা আর রুমেলা সেই স্কুলজীবন থেকেই পাশাপাশি বসত। এতোদিন পর বিদিশার মনে হল যেন সেই পুরনো স্কুলের দিনগুলো ফিরে এসেছে এক মুঠো অক্সিজেনের মতো। অনিকেতকে নিয়ে সব দুশ্চিন্তা ভাবনা এক এক করে বিদিশা রুমেলাকে বলল। রুমেলা মন দিয়ে শুনল সব। তারপর বলল।
—দেখ। একবার অন্তত ওর সঙ্গে সামনাসামনি কথা বললে ভালো হতো যদিও। কখনও আলাপ তো করাসনি। তবে তোর কথা শুনে যা মনে হচ্ছে তাতে ওর ভিতর মনের অসুখ ধরেছে, এতে সন্দেহ নেই।
—একটু বল তো কী মনে হচ্ছে তোর?
—তরুণ লেখকদের মধ্যে এইসব প্রায়সই হয়। বিশেষত যারা প্রচারের আলো পেয়েও পায়নি।
—অনিকেত তো আজকাল কিছু লিখতেই পারছে না। খালি বলছে একটা দুর্গের ভিতর আটকে গেছে সে। জিজ্ঞেস করলে কাফকার ‘দ্য কাস্ল’ থেকে অনর্গল উদ্ধৃতি দিয়ে চলেছে।
—তোদের সম্পর্কে কোনও প্রভাব পড়েনি?
—পড়েছে তো! আজকাল আমাকে ও তেমন কাছে আসতে দেয় না। অযথা যখন তখন চেঁচিয়ে ওঠে। দূর থেকে অদ্ভুত আচরণ করে। আমি আর পারছি না রে। সব কথা মেপে বলতে হয়। কী করি বল তো?
—চিল। এটা একটা সিন্ড্রোম। ওর ভিতর একটা ক্রাইসিস চলছে। অস্তিত্ব সংকট। ওর মনে হচ্ছে ওর আকৃতি ছোট হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
—ঠিক ঠিক। ও বলছিল ও পোকা হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ।
—‘মেটামরফোসিস’ পড়েছিস?
—পড়েছি তো।
—অনিকেত তোর দেওয়া কাফকার ওই বইয়ের ভিতর ঢুকে পড়েছে। ও এখন নিজেকে রিলেট করতে পারছে। এমন দু-একজন কেস আমি পেয়েছি। প্রতিটি কেসেই অসুস্থ মানুষটি অত্যন্ত মেধাবী। কিন্তু মেধার পথে ভয়ানক প্রভাব তাদের সেই সৃষ্টির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে।

—এই অসুখের নাম কী রে! আমার যে খুব ভয় করছে। আমি কি তবে ওই বইটা সরিয়ে নেব?
—ভয় পেয়ে কী হবে? মন শক্ত কর। ওকে একদিন নিয়ে আয় আমার কাছে। বা আমিই যাবো তোর বাড়ি। অবশ্য যদি তুই অ্যালাউ করিস। তারপর চিকিৎসা শুরু হবে। বইটা সরাতে পারিস। তবে তাতে লাভ হবে না। ও আরও অশান্ত হয়ে উঠবে। আসলে কিছুকিছু বইয়ের ভিতর এমন মাদক শক্তি থাকে, যার সামনে বড় বড় মাদকাসক্তিও ফিকে হয়ে পড়ে। অনিকেতের যে অসুখটা হয়েছে, আমি তার নাম দিয়েছি ‘কাফকা সিন্ড্রোম’। কাফকার কথা ভাবতে ভাবতে অনিকেতের মনে হচ্ছে ওর সঙ্গে ঠিক সেই সেই জিনিসগুলো হচ্ছে যা কাফকার সঙ্গে ঘটেছিল। ওর মনকে গ্রাস করে নিয়েছে কাফকার অস্তিত্বসংকট।

ঘরে তড়িঘড়ি ফিরতে গিয়ে পা কেটে গেল বিদিশার। রাস্তায় ধারালো কিছু একটা ছিল। দূর থেকে বোঝা যায়নি। সামান্য রক্তপাত হলেও সেদিকে নজর দিল না সে। ফ্ল্যাটে এসে কলিং বেল টিপতে গিয়েই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ল সে। ফ্ল্যাটের দরজা আধাভেজানো। ঠেলা দিতেই খুলে গেল। ভিতরে আলো জ্বালাতেই বিদিশা দেখল ঘরে কেউ নেই। অনিকেত, অনিকেত বলে ডাক দিলেও কোনও সাড়া পেল না সে। তারপর হঠাৎ তার চোখ গেল টেবিলের উপর। সেখানে ফুলদানি চাপা দেওয়া একটা সাদা চিরকুট। ‘প্রিয় বিদিশা, অনেক ভেবে দেখলাম। আমার এই না-লিখতে পারার কারণ হল তোমার সান্নিধ্য। তুমি থাকলে আমার আর কোনও সংশয় জটিলতা সংগ্রাম কিছুই থাকে না। তুমি আমার উপন্যাস নিয়ে কিছুই বললে না। এর অর্থ বুঝতে পারি। এর অর্থ ওই লেখাটি ঠিক মতো হয়নি। সেই কারণেই আমি পাণ্ডুলিপিটা নষ্ট করে ঘরের ডাস্টবিনে ফেলে যাচ্ছি। পৃথিবীর সব মানুষগুলোর সামনে দাঁড়িয়ে পড়লে আমার নিজেকে ‘পোকা’র মতো মনে হয়। কিন্তু সেই মানুষের সারিতে তুমি নেই। তুমি আমাকে ছোট্ট পোকা হতে দাও না। আমার এই ছোট্ট হয়ে যাওয়ার ভিতরেই সম্ভাবনা লুকিয়ে রয়েছে। আমার সমস্ত শরীরে যে বিষ ছড়িয়ে পড়েছে তার থেকে নিষ্কৃতি পাবার একমাত্র পথ ওই ‘পোকা’ বনে যাওয়া। সেই কারণেই আমি চলে যাচ্ছি। আমাকে ভুল বুঝো না। একদিন হয়তো আবার ফিরে আসব। সব কিছুই রেখে গেলাম। শুধু তোমার দেওয়া কাফকার বইটা নিয়ে গেলাম। কোনও দিন ফিরে এলে অন্য লেখা পড়াব। ইতি, অনিকেত।’

চিঠি পড়া শেষ করে ধপ করে সোফার ওপর বসে পড়ল বিদিশা। সিলিঙে মাকড়শার জালে একটা ছোট মাছি প্রাণপণে ওড়বার চেষ্টা করছে। বিদিশা দেখল, চুম্বনের মতো মাকড়শাটা তাকে ঘিরে তার শরীরের ওপর ক্রমশ ওত পেতে বসছে। নাহ। আর পালানো যাবে না। অনেকটা দেরি হয়ে গেছে!