• facebook
  • twitter
Wednesday, 2 April, 2025

মায়ের কাছে যাব

মাথায় ফেট্টি বাঁধা গামছাটা খুলে নিয়ে মিস্তিরি তার ঘামে ভেজা মুখখানি ভালো করে সময় নিয়ে মুছল। সেইসঙ্গে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলও।

কাল্পনিক চিত্র

মুক্তি দাশ

তাতাইদের বাড়ির পেছন দিকের যে মেঠোপথটা বিশ্বাসকাকুর বাড়ির কাছে বাঁক নিয়ে সটান গিয়ে বড় রাস্তায় মিশে গেছে, সেই রাস্তায় এখন মেরামতির কাজ চলছে। এবড়ো-খেবড়ো মাটির রাস্তাকে দুরমুশ পিটিয়ে সমান করে ইট পর্যন্ত বেছানো হয়ে গেছে। এর ওপর আবার নাকি সিমেন্টের ঢালাইও হবে।

তাতাই তার বাড়ির জানলার গ্রিলে গাল ঠেকিয়ে খুব মনযোগ দিয়ে রাস্তা সারানো দেখে। রোজ দেখে। বিভোর হয়ে দেখে। মাথায় ফেট্টি বাঁধা কালো-কালো ঘেমো শরীরের চার-পাঁচজন মিস্তিরি অনবরত কাজ করে চলেছে।

একদিন বেজায় কৌতূহলী হয়ে একজন মিস্তিরি কাজের ফাঁকে জানলার কাছে এসে বলল, ‘কী গো খোকাবাবু, ক’দিন ধরে দেখছি খুব মন দিয়ে তুমি আমাদের কাজ দেখেই যাচ্ছ, দেখেই যাচ্ছ… তোমার নাম কী গো?’

আরে বাবা, তাতাইয়েরও তো ইচ্ছে হয়, ওদের সঙ্গে একটু আলাপ-সালাপ করতে, গল্প-টল্প করতে। আজ প্রশ্রয় পেয়ে তাতাই বলল, ‘আমার নাম তো তাতাই… তোমরা রাস্তা বানাও বুঝি?’

‘হুমম! বানাই তো! দেখছ না, তোমাদের এই মাটির রাস্তায় কত সুন্দর করে ইট পেতে দিয়েছি। এরপর সিমেন্ট দিয়ে পাকা করে দেব। একদম ঝক্কাস! তখন আরাম করে এই রাস্তায় তোমরা বিন্দাস হাঁটাচলা করতে পারবে, ছুটোছুটি করতে পারবে। হোঁচট খেয়ে পড়তে হবে না। সাইকেলও চালাতে পারবে… তুমি সাইকেল চালাতে পারো?’

কথাগুলো যেন তাতাইয়ের কানেই ঢুকলো না। সে ততক্ষণে জানলা দিয়ে দূরের আকাশ দেখছে। আনমনা উদাস গলায় আকুতিমাখা সুরে সে বলল, ‘আমার জন্যে একটা রাস্তা বানিয়ে দেবে গো?’

মিস্তিরি অবাক। কথাটার মাথামুন্ডু কিছুই বুঝতে না পেরে সে বলল, ‘তুমি কোন রাস্তার কথা বলছ বল দিকিনি?’
পৃথিবীর চরমতম দুঃখী মানুষের গলায় তাতাই বলল, ‘আমার মায়ের কাছে যাবার রাস্তা। আমি মায়ের কাছে যাব। কিন্তু আমার মা যে এখানে থাকে না…’

‘আহা রে! কোথায় থাকেন তোমার মা?’
‘সে অনেক অ-নে-ক দূরে! আমি যখন খুব ছোটো, এই এত্তোটুকু পুচকি ছিলাম… কোথায় যে হারিয়ে গেল আমার মা! বাপি বলে, সেই থেকে মা নাকি আকাশের তারা হয়ে গেছে…’

মিস্তিরির চোখ নিজের অজান্তেই চলে গেল রোদ ঝলমলে আকাশের দিকে। দেখতে পেয়ে হেসে ফেলল তাতাই, ‘দূর বোকা! এখন তো বেজায় রোদ্দুর। দিনেরবেলা তারা দেখা যায় বুঝি? একদিন সন্ধেরাতের দিকে এসো না, মাকে দেখিয়ে দেব! কত্তোবার বাপিকে বলেছি, আমাকে মায়ের কাছে একবারটি নিয়ে চলো… আমি ঠিক মাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসব!

বাপি শোনেই না! খালি বলে…’
মিস্তিরি প্রায় বাকরুদ্ধ। কোনোরকমে বলল, ‘কী বলে?’
‘বলে, মায়ের কাছে যাবার কোনো উপায় নেই। কোনো রাস্তাই নাকি আর খোলা নেই! ও কাকু, একদিন রাত্তিরে এসো না গো! আকাশের কোণে ওই তারাটা দেখিয়ে দেব, তুমি ভালো করে দেখে নিয়ে সেই অব্দি একটা রাস্তা বানিয়ে দেবে… দেবে তো? বলো না!’

মাথায় ফেট্টি বাঁধা গামছাটা খুলে নিয়ে মিস্তিরি তার ঘামে ভেজা মুখখানি ভালো করে সময় নিয়ে মুছল। সেইসঙ্গে চোখের কোণ বেয়ে গড়িয়ে পড়া জলও। তারপর ধরা গলায় বলল, ‘দেব বাবা। নিশ্চয়ই দেব!’