অসিত কর্মকার
১
নোনা হিমেল হাওয়ায় একটাই ঘোষণা আর কিছু চটুল গান পাক খেতে খেতে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। গঞ্জের গন্ডি ছাড়িয়ে আশপাশের যত গ্রাম তাতে তোলপাড়। বাসন্তীগঞ্জে এক আশ্চর্য কান্ড ঘটতে চলেছে! গঞ্জের নেতাজি ক্লাব থেকে মাইকে ক’দিন ধরে তারই ঘোষণা। শুনতে শুনতে মুখস্থ হয়ে গেছে লবঙ্গর। সেইসঙ্গে গানের দু-চারটে করে লাইন তার মনে থেকে থেকে গুনগুনিয়ে ওঠে। পাঁচগ্রামের মানুষের কৌতূহল, কী এমন কেরামতি দেখাবে ওই মিস্টার স্বপন। লবঙ্গও ওই ঘোরে ডুবে মানুষটার ক্ষমতা কল্পনা করে। তার দু-চোখের উপর দুটো চাকা বনবন করে ঘোরে শুধু। আর কিচ্ছু না। আসলে লবঙ্গ সাইকেল চালানোয় কতরকম যে কেরামতি থাকতে পারে তা জানে না। গাঁঘরের মানুষজন সাইকেল চড়ে কাজের প্রয়োজনে। ওটুকুই শুধু দেখা তার। ফলে তার কল্পনাও শুধু দুটো চাকার চক্করে বাঁধা পড়ে আছে। দিন গোনে লবঙ্গ, কবে ওই মিস্টার স্বপন মানুষটার ক্ষমতা দেখবে। কী এমন ক্ষমতা দেখাবে ওই সামান্য এক সাইকেল নিয়ে! লোকে বলছে, ক্ষমতা মানে ওই নানারকম কেরামতি দেখানো। অনেক মাথা খাটিয়েও সেসব কেরামতি কল্পনায় আনতে পারে না লবঙ্গ। কৌতূহল দিনে দিনে তীব্র হচ্ছে শুধু।
নদীর ভেড়ির কোল ঘেঁষে চুপটি করে দাঁড়িয়ে দু’জনার কুঁড়েঘর। সরকারি খাস জমিতে ভিটিজমি হারানো আরও কিছু মানুষের বসবাস। এখান থেকে ক্লাবঘরটা পরিষ্কার দেখা যায়। মাটির দেয়াল, চার চালায় খড়ের ছাউনি। এ কদিন ধরে সকালবিকাল ক্লাবঘরে ছেলেদের ভিড়। বার বার ঘোষণায় নানা রকম কন্ঠস্বর। যে যখন মাউথস্পিকার হাতে পায় নিজের মত করে বড় গলায় মি. স্বপনের কৃতিত্বের কথা ফলাও করে বলে। নিজেদের মধ্যে হইহুল্লোড় করে। গানবাজনায় মাতে। তাস খেলায় ভুল পাত্তি ফেলায় চিৎকার ওঠে। সব মিলিয়ে সেই আশ্চর্য মানুষটাকে নিয়ে বাজার গরম হয়ে উঠছে। ক্লাবঘরের পাশে কালীর থান আর জগন্নাথদেবের মন্দির। মন্দিরের সামনে রথ মাথা উঁচিয়ে দাঁড়িয়ে। তার শিরে লাল ধ্বজা পতপত ওড়ে। রথের চাকার গা ধরে নদীর ঘাট। নদী পারাপারের সঙ্গে মালপত্র বওয়ার নৌকোর ভিড়। ভোর থেকে মানুষের কোলাহল, হাঁকডাক। লবঙ্গর স্বামী নন্দ ওই ঘাটে কাজে যায়। নৌকো থেকে মালপত্র বয়ে নিয়ে দোকানে দোকানে পৌঁছে দেয়। ওই রোজগার আর লবঙ্গর কটা তোলা কাজে দু’জনের সংসার কোনও রকমে চলে।
আজ সকাল থেকে লবঙ্গর মনটা উড়ু উড়ু। পাঁচ বাড়ির কাজ সেরে ফিরে এসেছে কখন। সংসারের কাজকর্ম ভুলে দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসেই আছে। নন্দ বাজার করে ফিরলে রান্না বসাবে। দুটো প্রাণীর রান্নাবান্না করতে কতটুকু আর সময় লাগে। লবঙ্গ ভাবে, এখান থেকে মানুষটার সব কেরামতি দেখতে পাবে তো সে! নাকি জায়গাটা ঘিরে দেওয়া হবে? টিকিট কেটে দেখতে হলে কি আর তারা দেখতে পাবে! সে ট্যাঁকের জোর তাদের নেই। যাদের আছে তারা চোখ মন ভরে দেখবে! দীর্ঘশ্বাস ফেলে লবঙ্গ।
ঘেমো শরীর নন্দর। বুক জুড়ে শ্রমের হাঁপ। গা-ভর পেশিতে টনটনে ব্যথা। শরীরের এ অবস্থা জুড়োতে খানিক সময় লাগে। হাতে বাজারের থলে।
কী রে, বসি আচিস ঝে বড়, ঘরদোর ঝাড়পোঁচ করিসনি একনও? বেলা কত হল দেকিচিস!
নন্দর কথায় সম্বিত ফেরে লবঙ্গর, বসা থেকে উঠে থলেটা হাতে নেয়। দাওয়াতে রেখে নন্দকে গ্লাসে জল গড়িয়ে দেয়। কোমরের গামছা খুলে গায়ের ঘাম মোছে নন্দ। দাওয়ার খুঁটিতে হেলান দিয়ে বসে এক নিশ্বাসে জলটা খায়। বাজারের থলেটা দাওয়ায় উপুড় করে লবঙ্গ। একটা বেগুন, চারটে আলু, দুটো ঝিঙে, দুটো ল্যাটা মাছ। তেল, নুন, মশলাপাতি খানিকটা করে। সব্জিগুলো চুবড়িতে তুলে রাখে। দাওয়ার কোল থেকে ঝাঁটাটা নিয়ে উঠোন ঝাড় দেয়। ডোবা থেকে ঝাঁটাটা ধুয়ে আনে। কুস্তে দিয়ে দাওয়া ঝাড় দিতে দিতে নন্দকে জিজ্ঞেস করে, সাইকিলি চড়ি কী এমন মজার খেলা দেকাবে গো? বলতিচে তো কদিন ধরি খুব!
শুনচি তো। ভগমানই ঝানে। বলে নন্দ গামছাটা বুকের সামনে ঘুরিয়ে হাওয়া খায়।এতক্ষণে শরীরটা খানিক জুড়োয়। ওই একই ঘোষণা আর গান শুনতে শুনতে নন্দ বিরক্ত। যেন তার কানের মধ্যে অষ্টপ্রহর ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। অসহ্য লাগে তার। নিত্যদিনের বাঁচার লড়াইয়ের মধ্যে এ যেন এক রসিকতা!
সেসব কেমন গো? বড় কৌতূহলী হয় লবঙ্গ।
হলিই দেকতি পাবি। নানা জনি নানা অকমটা বলচে। কারটা ঝে ঠিক কারটা বানানো বুঝিনে। বলার মধ্যে তাপ-উত্তাপহীন নন্দ, তাচ্ছিল্য ভাব। কাজ আর সংসার জীবনের বাইরের আর কিছুই তাকে ছোঁয় না। দিনগুলো এভাবে পাত করে দিতে পারলেই হল নন্দর।
টিকিট কাটতি হবে নে? ফের কৌতূহল দেখায় লবঙ্গ।
ধুর বাপু, খেলা দেকি খুশি হয়ি ঝে ঝা দেয়! এমনটাই তো শুনচি। বলে নন্দ দাওয়া থেকে নেমে গামছাটা কোমরে বাঁধে। ফের কাজে বেরোবে ।ফিরতে ফিরতে সেই দুপুর। তারপর স্নান, খাওয়াদাওয়া সেরে লম্বা ঘুম দেয়।
নন্দর কথা শুনে লবঙ্গর মন মিইয়ে যায়। ভাবে, টিকিট কেটে না দেখতে হলে ওই আশ্চর্য মানুষটার ক্ষমতা যতটা মাইকে বলছে ততটা নিশ্চয়ই নয়। বিমর্ষ হয়ে বলে, তাইলি বলো, মানুষটা তেমন দরোর কেউ নয়, না? সে কল্পনায় যে অসীম ক্ষমতাধর এক মানুষের ছবি এঁকেছিল তা নন্দর কথায় মুহূর্তে ভেঙ্গেচুরে যেতে চায়। কষ্ট হয় লবঙ্গর।
নন্দ বলে, তা কেন। ওভাবি মানষির ক্ষ্যামতার বিচার হয় নে। ক্ষ্যামতা আচে বলিই না মানুষটার এত নামডাক। মাইকি তার কত গুণির কতা শুনচিস নে!
লবঙ্গ হেসে বলে, টিকিট না কাটতি হলি তো আমাদিরই ভাল, কী বল?
দুঃখকষ্ট, সংসারের অভাব অনটন, খিদে তেষ্টা সব ভুলে কেমন এক মন কেমন করা ঘোরের মধ্যে দিন কাটে লবঙ্গর। সেই আশ্চর্য ক্ষমতাধর মানুষটার কেরামতি দেখতে তাদের ঘরের সামনে পাঁচ গাঁয়ের মানুষের ঢল নামবে। হয়ত এক মেলাই লেগে যেতে পারে। এই ঢিমেতাল গতানুগতিক জীবনে সে এক চমৎকার ব্যাপার হবে। লবঙ্গর বুকের ভেতরে সুখের আলোড়ন ওঠে। মনে তাড়া লাগে, দিন গোনা যেন তার আর ফুরোতেই চায় না!
নন্দ বলে, ও দুদিনির আমোদফুর্তি। আমাদির ওই নিয়ি পড়ি থাকলি চলে! কাজপাগল মানুষ নন্দ। কাজে মেতে থেকে ছেলেপুলে না থাকার কষ্ট ভুলে থাকার চেষ্টা করে।
২
আজ দুপুরে খেয়াঘাটে সে এক দৃশ্য! এমনটা কোনওদিন দেখেনি লবঙ্গ। সেই আশ্চর্য ক্ষমতাধর মানুষটাকে ক্লাবের ছেলেরা গাঁদা ফুলের মালা পরাল। একটা যুবতী মেয়ে তার কপালে চন্দন আর সিঁদুরের টিপ পরিয়ে দিল। সেইসঙ্গে কয়েকটা মেয়ে শাঁখ বাজাল। সবার পরনে লালপেড়ে সাদা শাড়ি, বাহারি সাজ। মানুষটাকে ঘিরে উল্লাস, হইহট্টগোল। ওদিকে মাইকে তারস্বরে ঘোষণা হচ্ছে, বন্ধুগণ, বন্ধুগণ, আনন্দ সংবাদ, আনন্দ সংবাদ, বাংলার গৌরব, আমার আপনার চিরকাঙ্ক্ষিত সেই আশ্চর্য ক্ষমতাধর সাইকেল চালক মিঃ স্বপন এইমাত্র আমাদের গঞ্জে এসে পৌঁছলেন। তাঁকে আমরা সুস্বাগতম এবং আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। বন্ধুগণ, বন্ধুগণ, সাইকেল যার কথা শোনে, সাইকেল চালানোর জাদুকর সেই মিঃ স্বপন এইমাত্র আমাদের মধ্যে…
কী এক কৌতূহলের ঘোরে ভিড় কেটে সামনে এসে দাঁড়ায় লবঙ্গ। মানুষটাকে দেখে তার শরীর মনে অদ্ভুত এক শিহরণ। অসীম ক্ষমতাধর মানুষটাকে এত কাছ থেকে দেখতে পাচ্ছে বলেই হয়ত এই শিহরণ। পরক্ষণেই অন্যরকম ভাবে, এই মানষির এত ক্ষ্যামতা! বিশ্বাস হতে চায় না। পরনে চটকদার প্যান্ট শার্ট, পায়ে চোখামাথার খুরওলা জুতো, চোখে রঙিন চশমা, হাতে সিগারেট, মুখে পান। তামাটে গায়ের রঙ, মাঝারি গড়ন চেহারা, হনুজাগা লম্বাটে মুখমণ্ডল। লম্বা লালচে চুল হাওয়ায় দুলছে। হাতজোড় করে মিটিমিটি হেসে ক্লাবঘরের দিকে এগিয়ে চলেছে মানুষটা। লবঙ্গও কখন বেখেয়ালে তার দুহাত জোড় করে ফেলে মানুষটার উদ্দেশ্যে। সেইসঙ্গে তার চোখেমুখে খুশির আভা ফুটে ওঠে। আশ্চর্য, মানুষটাও তার উদ্দেশে স্মিত হাসল যেন! ক্লাবের একটা ছেলে তার সাইকেলটাকে পিছনে পিছনে হাঁটিয়ে নিয়ে চলে। কী তার বাহারি সাজ। একটা সাইকেলের কত যত্ন!তার উপর গাঁদা ফুলের মালা জড়াল ক্লাবের কটা ছেলে। বিস্মিত চোখে পুরো চলমান দৃশ্যটার দিকে তাকিয়ে থাকে লবঙ্গ। কখন পায়ে পায়ে সেও ভিড়টার পিছু নেয়। যেন এক অমোঘ টান। কিছুতেই লঙ্ঘন করতে পারে না।
৩
আজ বৃহস্পতিবার। বাসন্তী গঞ্জের হাট। পাঁচ গ্রামের যত হাটুতে আর পসারিদের কোলাহলে গঞ্জ গমগম। তার উপর আবার অবিরাম ওই ঘোষণা আর চটুল গান। হাট একেবারে মাতোয়ারা। সকাল থেকে ক্লাবের সামনে উপচে পড়া ভিড়। দড়ি দিয়ে ঘেরা ছোট এক চৌকো জায়গা। তার ঠিক মাঝখানে হাত পাঁচেক লম্বা একটা বাঁশের টুকরো পোঁতা। ঘেরের দড়িতে জড়ানো গাঁদা আর কল্কে ফুলের মালা। মাইকে বার বার ঘোষণা, বন্ধুগন, বন্ধুগন, আর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হতে চলেছে আমার আপনার কাঙ্ক্ষিত, বাংলার গর্ব, মিঃ স্বপনের আশ্চর্য সব সাইকেলের খেলা। আয়োজনে, বাসন্তী নেতাজি ক্লাব। স্থান, ক্লাবপ্রাঙ্গণ।
কাল সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি লবঙ্গ। কখন ভোর হবে। নন্দর দুবাহুর মধ্যে খালি উসখুস করেছে সে। আর থেকে থেকে নন্দকে ওই মানুষটা সম্পর্কে নানা প্রশ্ন করে গেছে। নন্দর উত্তরে মন ভরেনি লবঙ্গর। ঘুমের ঘোরে কী সব উল্টোপাল্টা, অসংলগ্ন কথা বলে গেছে নন্দ। একসময় নন্দ গভীর ঘুমে ডুবে গেলে কী আশায় বিছানা ছাড়ে লবঙ্গ। ছিটে বেড়ার ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে তাকায়। শ্বেত জ্যোৎস্নায় ভেসে যাচ্ছে চরাচর। ক্লাবঘরটা কেমন রহস্যময় হয়ে দাঁড়িয়ে। ওই ঘরেই মানুষটার থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। এলাহি যত্নআত্তি তার। চালার খড় চুঁইয়ে কুয়াশা থিতানো জল টুপটুপ করে ঝরে পড়ে। দূরে কোথায় কুকুর ডেকে ওঠে লম্বা গলায়। মাথার ওপর নিশাচর ডানা ঝাপ্টায়। রাতের পৃথিবী জুড়ে কেমন এক অসহায়তার প্রলেপ।নিজেকেও বড় নিঃসঙ্গ, অসহায় লাগে লবঙ্গর। ওই মানুষটা, মিঃ স্বপন কি এখন ঘুমোচ্ছে? ঘুমোবেই তো। নইলে শরীর টিকবে কেন। রাত ফুরোলেই সাইকেল নিয়ে কত কসরৎ দেখাতে হবে না!শুধু জেগে থাকে লবঙ্গ আর ওই নদী। নদী কখনও ঘুমোয় না। ভাটায় ক্ষান্তি দিয়ে জোয়ার লাগছে তার বুকে। ঢেউ ভাঙ্গার শব্দ ভেসে আসছে।লবঙ্গরও মনের দেয়াল যেন টাল খেতে লাগে। এই ভেঙ্গে চূর্ণ হল বুঝি!তারপর কোথায় ভেসে যাবে সে!রাত গড়ায়। ভোর হয়। পুবাকাশের মেঘের কোলে নরম সূর্য কাঁচা হলুদরঙা আলো ছড়ায়। এখন থেকেই ক্লাব প্রাঙ্গণে মানুষের আনাগোনা। কৌতূহলী উঁকিঝুঁকি। কখন থেকে মিস্টার স্বপন তার আশ্চর্য ক্ষমতা দেখাবে!
মানুষটার পরনে নীল হাফ প্যান্ট, লাল স্যান্ডো গেঞ্জি।গলায় গেঁদা ফুলের মালা। কপালে চন্দন আর রক্ততিলক। অসংখ্য মানুষের হাততালির মধ্যে দিয়ে মানুষটা সাইকেলটা নিয়ে গর্বিত ভঙ্গিমায় ঘেরা জায়গাটার দিকে এগিয়ে চলেছে।বিরাট উল্লাস আর হাততালিতে ভিড়টা ফেটে পড়ছে। লবঙ্গ বড় অবাক হয়, একটা মানুষকে নিয়ে কত কী হচ্ছে গো! তা সে ক্ষ্যামতা আছে বলেই তো না! মনটা কেমন করে ওঠে লবঙ্গর। দুচোখের কোলে চিকচিক করে ওঠে জল। এমন ক্ষমতাধর মানুষ সে আগে কোনওদিন দেখেনি বলেই হয়ত এই আনন্দাশ্রু!
বাজার নিয়ে ফেরে নন্দ।লবঙ্গ বলে, ওই দেক, মানুষটাকি নিয়ি কী সব হচ্চে! এক্কুনি খেলা শুরু হয় এ্যাই। এট্টু দেকি ঝাও!
তুই দেক!আমার কাঝের মেলা দেরি হয়ি যাচ্চে।বাজারটা দাওয়ায় রেখেই ব্যস্তসমস্ত নন্দ বড় বড় পা ফেলে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে গেলে লবঙ্গ বলে, তোমার কি সগ আল্লাদ বলতি কিচ্চু থাকতিনি? ওকানটায় একবার ঘুরোন দিয়ি ঝেতে…! যেন আব্দারই করছে লবঙ্গ।
একান থিকিই তো খানটা দেকা যাচ্চে। দুকুরি ফিরি এসি না হয় ভাল করি দেকব। চলে গেল নন্দ।
হাই মা, মানুষটার কত কেরামতি গো! অবাক হয়ে দেখে লবঙ্গ। সাইকেলটা নিয়ে মিঃ স্বপন যা খুশি তাই করে। ভিড়টা ঘনঘন হাততালি আর চিৎকারে ফেটে পড়ে। খুশি হয়ে পয়সা ছোড়ে। ট্যাঁকের জোরওলারা পাঁচ দশ টাকার নোট পোষাকে আটকে দেয়। হাওয়া পেয়ে সে টাকা কেমন সুন্দর ওড়ে। যেন ছোট ছোট রঙিন পাখির উল্লাস মানুষটার বুক জুড়ে!পিছনের চাকায় ভর করে সামনের চাকা শূণ্যে তুলে দেয় মানুষটা। সামনের চাকার উপর শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে দিয়ে পিছনের চাকাটাকে ঝুমঝুম শব্দে নাচায়। সিটের উপর দাঁড়িয়ে দিব্যি বনবন করে পাক খায়। বসার সিট আর হ্যান্ডেল বরাবর লম্বা হয়ে উল্টো শুয়ে দিব্যি বনবন পাক খায়। এমনকী দুচোখ কালো কাপড়ে বেঁধে পর্যন্ত, কী অবাক কান্ড! সিটের উপর দাঁড়িয়ে পাক খায়, শরীরটা এতটুকুও টাল খায় না। ও বাবা, এত আস্তেও কেউ সাইকেল চালাতি পারে! আরও কতরকম কায়দা, কেরামতিই না দেখায় মিস্টার স্বপন। তার শ্রমের ঘামে আলো পড়ে আলোময় হয়ে ওঠে মানুষটা।কী যে এক মোহময় রূপ ফোটে! দেখে মুগ্ধ লবঙ্গর মনে হয়, এইই তো তার স্বপ্নের পুরষ!তার দৃঢ় বিশ্বাস, এ মানুষ তার সব আশা আকাঙ্ক্ষা পূরণ করার ক্ষমতা রাখে।
দুপুরের দিকে ভিড়টা পাতলা হয়ে আসে। কিছু কুচোকাঁচা ন্যাংটোপোদো ছেলেপুলে আর গঞ্জের কিছু ভবঘুরে সেখানে ইতস্তত ঘুরে বেড়ায়। মানুষটাও এসময় একটু বিশ্রাম পায়। ঢিমেতালে সাইকেল চালায়, মন করলে খুঁটিটাকে ধরে খানিক জিরিয়ে নেয়। শুধু মাইকটা তারস্বরে চিৎকার করে ঘোষণা করেই যায়, গান গেয়েই চলে। বিকেল হতে না হতে একরকম মেলা বসে যায়। তেলেভাজা, ঘুগনি পাঁপড়ভাজার দোকান লাগে। ঘেঁয়ো কুকুরগুলো পায়ে পায়ে ঘুরঘুর করে। ধুলোমাটিতে গন্ধ শুঁকে শুঁকে খাদ্য খোঁজে।
শীতকালের সন্ধ্যা তাড়াতাড়ি নেমে এল। হ্যাজাকের আলোয় পোকারা উড়াউড়ি করে। রাত বাড়তে কুয়াশা নামে। ফলে যত আলো ম্লান হতে থাকে। শেষ দর্শকটি ঘরে না ফেরা পর্যন্ত মিঃ স্বপনের মুক্তি নেই। তারপরও লবঙ্গ থাকে, দূরে। তার শরীর মনের উন্মাদনায় ভাটা পড়ে না। আগল ভাঙ্গা মন তার এখন। মরণ ধরেছে তাকে। মিঃ স্বপন কি তা জানে! ওই নদী, এই সংসার, ঘরে অক্ষম নন্দ সবই তুচ্ছ এখন তার কাছে। ঘুম আসে না। ঘুম আসুক, তাও চায় না। ঘুমোলেই তো মানুষ একরকম মরা। তখন এই ঘোর, এই ভাললাগা, মধুর অনুভূতি, সব যে সে হারাবে। এসবের মধ্যেই ডুবে যেতে যেতে কখন কোন এক অজানা দেশে পাড়ি দেয় সে। দুচোখের সামনে অদ্ভুত এক আলো ফোটে তার। সে আলোর বলয়ে এক চলমান দৃশ্য জেগে ওঠে। তার ঘরের দাওয়ার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে কিনা মিঃ স্বপন! তার একটা পা দাওয়ায় আরেকটা পা সাইকেলের প্যাডেলে। নারীর মনকাড়া টানটান দীপ্ত দেহভঙ্গিমা।
মিঃ স্বপন, তুমি একানি! বিস্মিত লবঙ্গ, জিজ্ঞেস করতে গিয়ে গলা কেঁপে ওঠে তার।
তোমাকে নিয়ে যেতে এলাম।
তুমি আমাকে চেন?
চিনি। তুমি আমার খেলা মুগ্ধ হয়ে দেখ। তোমার চোখের পাতা আর পড়ে না তখন। তোমার মুগ্ধতায় আমি বিস্মিত। ভালোবেসে ফেলেছি তোমাকে।আমার ওই খেলার পাকের সঙ্গে তোমাকেও এই হৃদয়ে বেঁধেছি। তুমি কী চাও তাও আমি জানি।
কী চাই আমি? বলো তুমি…! যেন ধরা পড়ে যাওয়ায় লবঙ্গ লজ্জাবনত, বিমূঢ় এখন।
উঠে এসো, তারপর বলছি! যেন অধিকার ফলাতে আদেশের গলায় বলে মানুষটা।
না, আমি অলুক্কুনে, অপয়া…, তোমার জীমন ক্ষ্যায় হবে।
ওসব মিথ্যা। আমি মানি না। তোমায় আমি নিয়ে যাবই।
কোতায়?
যেখানে তোমার আমার সুখ হবে।
আমার খুব কষ্ট ঝানো!
থাকবে না। তোমার ওই উনো কোল আমি ভরাব। উঠে এসো।
এ অন্যায়, অনাচার। ঘরের মানুষটা ঝানতি পারলি যে খুব কষ্ট পাবে। ও যে আমায় খুব ভালোবাসে, ঝানো!
জীবন একটাই জেনো। ভালোবাসার ফসলও এই জীবনেই পেতে যদি চাও তো সব পিছুটান ভুলে তাড়াতাড়ি উঠে এসো।
চুপ থেকে কত কী ভাবে লবঙ্গ। কত পুরুষই তো তাকে কামনা করে। কোলভরা সন্তান দেওয়ার লোভ দেখায়। বড় বিদ্যের ভাব নিয়ে বলে, মা হওয়ায় কোনও পাপ নেই রে লবঙ্গ। ও হওয়া মেয়িছিলির জীমনির সবচেয়ি বড় পবিত্র সাত্থকতা। তোর আর আমার মধ্যি ব্যাপারটা চিরকালির জন্যি গোপন থাকলি ও সন্তানও পবিত্র। কোনও কলঙ্কির ছামা পড়বে নে তার জীমনি। নন্দকে ছেড়ে অনেক দূরে নতুন করে ঘর বাঁধার লোভ দেখায় ওরা। টাকাপয়সা, গয়নাগাটি, সুখে রাখার হাতছানি দেয়। বলে, নন্দ অক্ষম। ও তোর জীমনটাই ক্ষ্যায় করি দিচ্চে। এই তো সুখভোগ করার বয়স তোর। গতরির এই বাঁধনে ভাঙন ধরলি কেউ আর ফিরিও তাকাবে নে ঝানবি। কিন্তু লবঙ্গ জানে, ওদের মনে প্রেম ভালোবাসা নেই। আছে শুধু কামনার আগুন। ওই আগুন নেভানোর উদগ্র বাসনা শুধু।মিটিয়ে নিলে তাকে দূর ছাইই করে দেবে। আর যে মিলনে প্রেম ভালোবাসা নেই সেই মিলনের ফসল কখনও আনন্দের হতে পারে না। কিন্তু এই আশ্চর্য ক্ষমতাধর মানুষটাকে অন্যধারার মনে করে লবঙ্গ। কী সুন্দর করে ভালোবাসার কথা বলে। তাতে কোনও খাদ নেই। এই মানুষটাই পারে তাকে সুখ দিতে। কোলভরা সন্তান দিতে। অস্ফুট কন্ঠে জানতে চায় লবঙ্গ, কোতায় বসব?
সামনে। আমার দুহাতের মধ্যে।
আমরা তাহলি পেইলে ঝাচ্চি!
সে তুমি যা খুশি ভেবে নিতে পার। দেরি কোরো না, ভোর হয়ে এল।
এট্টু দাঁড়াও। মানুষটাকি শেষবারির মতো একবার দেকি ঝাই।
তাহলে আমাকে তুমি পাবে না! জোর গলায় বলে, যেন অধিকার ফলাতে চায় মানুষটা।
না না, ঝেওনি! হাহাকার করে ওঠে লবঙ্গ। এই আমি তোমার সাইকিলি উটি বসচি। কিন্তুক খেয়াঘাট দিয়ি ঝাওয়া ঝাবেনি। সমাই ঝে আমায় চিনি ফেলবে। তোমারিও সমাই একন চেনে। কত নামডাক তোমার।সমাই মিলি তোমায় আমায় অসম্মানির চূড়ান্ত করি ছাড়বে। তোমাকি মারধরও করতি পারে। তাপ্পর এ গঞ্জ থিকি তেইড়ে দেবে তোমায়। একানি এসি এত মান পাওয়ার পরি সে কি ভাল দেকায়? পরপুরুষি মজি ঘরছাড়া হতি গিয়ি ধরা পড়ার কলঙ্ক নিয়ি কী করি বাঁচব গো! তাতে করি ঘরের মানুষটারও ঝে মুখ পুড়বে।
আশ্চর্য ক্ষমতাধর মানুষটার দুবাহুর বন্ধনে নিজেকে বেঁধে নেয় লবঙ্গ। সামনে যে দিকেই তাকায় শুধু পথ আর পথ। মেঠো বড় পথ, সরু পথ, ভাঙাচোরা পথ। কিন্তু মিঃ স্বপন লবঙ্গেকে নিয়ে যে পথেই যায় সে পথেরই শেষে সামনে নদী, জল আর জল।জলের ওপারে ফের ডাঙা। সেখানে আবার নতুন পথের শুরু। যে পথ ধরে লবঙ্গ এই আশ্চর্য মানুষটার সঙ্গে অনেক অনেক দূরে চলে যাবে। দুজনের নতুন সংসার হবে। মানুষটা তাকে সন্তান দেবে। কোল ভরবে তার। সুখ উপচে উঠবে সংসারে।আর এগোনো হয় না দেখে হতাশ হয় মিস্টার স্বপন। জিজ্ঞেস করে, তোমরা কি দ্বীপে বাস কর?
তা তো ঝানি নে। এ তো আমাদের বাসন্তী গাঁ, নদীপাড়ে তার গঞ্জ।
তাহলে বাসন্তী একটা দ্বীপ।
দ্বীপ কী গো?
যে মাটির চারিদিক নদী বা সমুদ্রে ঘেরা।
আমি এই পেথম ঝানলুম, আমরা জলে ঘেরা দ্বীপমাটিতি বাস করি। কিন্তুক আমরা এই ঝল পেরোব কী করি! সূয্যি এই উটি গেলি কিন্তুক…! পরপুরুষির হাত ধরি বেইরিচি, আমার ঝে ঘরি ফেরার আর উপায় নি গো! এ ঝল আমাদির পেরোতিই হবে। তোমার এত ক্ষ্যামতা, তা তুমি আমারি নিয়ি উড়াল দিতি পার নে! ডুকরে কেঁদে ওঠে লবঙ্গ। কাতর গলায় আকুতি জানায়, দাও, উড়াল দাও , দাও না গো, তুমি পারবে! এই আমি তোমার পায়ে পড়ি, উড়াল দাও, উড়াল দাও…!
এই নবং, নবং, কী উড়াল দাও, উড়াল দাও কচ্চিস? সপন দেকচিলিস! ঠেলা দিয়ে লবঙ্গকে জাগিয়ে দেয় নন্দ। বিজবিজিয়ে ঘেমে ওঠা শরীর লবঙ্গর। বুকের ভেতরে কেমন হাপরের ওঠানামা। ঘনঘন শ্বাস পড়ে। গলাটা কেমন শুকনো শুকনো লাগে। শোয়া থেকে উঠে বসে। কোথায় মিস্টার স্বপন, কোথায় জল, কোথায় জলের ওপারে ফের ডাঙা, সংসারছুট হওয়ার পথ! হ্যারিকেনটা উস্কে নিয়ে জলের কলসিটার দিকে এগিয়ে যায়। অনেকটা জল খায়। বুকের ভেতরটা খানিকটা জুড়োয়। ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে তাকায়। কুয়াশা পড়েছে খুব। ক্লাবঘরটা দেখতে পায় না আর। সাইকেল খেলা দেখানোর আজ শেষ দিন। শেষ দিন! বুকের ভেতরটা বড় শূন্য লাগে। তাতে পেয়ে হারানোর হাহাকার বাজে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে নন্দর উদ্দেশ্যে কী মনে করে অস্ফুটে বলে, চোকির সুমুখ থিকি ওই হট্টমেলা বন্ধ হলিই বাঁচি, বুঝলে!
নন্দ তার কথা শুনল কিনা বুঝতে পারে না লবঙ্গ। ক্ষোভ দুঃখ যন্ত্রণা নিয়ে আবার বিছানায় ফেরে। এক কাঁথায় দুজনে। নিজের দিকে একটু টান দিতে নন্দর গা থেকে কাঁথা সরে যায়। ওই পথে ঠান্ডার কামড় ঢুকে পড়তে ঘুম ভেঙ্গে যায় নন্দর। নড়েচড়ে ওঠে সে। হাত বাড়িয়ে লবঙ্গকে বুকের কাছে টানে। অস্ফুটে বলে, নে ঘুমো। মেলা আত হয়িচে।
এত ঘনিষ্ঠতার ওমেও ঘুম আসে না লবঙ্গর। নন্দর দুবাহুর মধ্যে আরেক নদী হয়ে জেগে থাকে সে। সে নদীর উপর দিয়ে টুকরো টুকরো সাদা মেঘ ভেসে যায়। মেঘের ফাঁকে দুটো চাকা জেগে ওঠে। চাকাদুটো বনবন করে ঘোরে। চাকা জল পেরোয়। অনন্ত অথৈ জল। বাকি সব মেঘে ঢাকা পড়ে যায়। মেঘের আড়ালে পাশ ফিরে শোয় লবঙ্গ। দীর্ঘশ্বাস পড়ে! এক বুক হাহাকার নিয়ে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। অভিমান ক্ষুব্ধ কন্ঠে অস্ফুট বলে, আপদটা বিদেয় হলিই বাঁচি!
লবঙ্গর এই গভীর গোপন উচ্চারণের সাক্ষি না থাকল ঘুমে কাতর নন্দ, না ওই আশ্চর্য ক্ষমতাধর মানুষটা। উদাসীন পৃথিবী তো নয়ই!