দার্জিলিঙের পথে যেসব সবুজ চা বাগানকে পেছনে রেখে টু্যরিস্টরা ছবি তোলে সেই চা বাগানের ভেতর থেকে মেয়েরা উধাও হয়ে যেত৷ আজও যায়৷ কোথায় যায় তারা! উত্তর ছিল না বাড়ির লোকের কাছে৷ জানা ছিল না পুলিশেরও৷ খোঁজ চালিয়েছিলেন দার্জিলিঙের সাহসী মেয়েটি— রঙ্গু সউরিয়া৷ আশপাশের ছেলেদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন কাঞ্চনজঙ্ঘা উদ্ধার কেন্দ্র৷ ফিরিয়ে এনেছেন নকশালবাড়ি, কালিম্পং, বিজনবাড়ি, মিরিকের হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের৷ হয়তো-বা পারেননি কখনও পাচার হওয়া মেয়েটাকে ফিরিয়ে আনতে৷ কিন্ত্ত কীভাবে ফিরিয়ে এনেছেন এ নিয়েই ধারাবাহিক ‘পাহাড় থেকে মেয়ে পাচার’৷ লিখছেন মঞ্জীরা সাহা
প্রথম পর্ব
সকালের রোদ একটু একটু উঁকি মারছে মেঘ কুয়াশার আড়াল থেকে৷ পা দুটো বারবার হোঁচট খাচ্ছে৷ না, দেখতে পাচ্ছি না তা নয়৷ দেখা যাচ্ছে ভালোই৷ হোঁচট খাওয়ার কারণটা অন্য৷ অভ্যেসের অভাব এরকম রাস্তায় চলা৷ যে মাটিতে পা ফেলতে ফেলতে চলেছি সেটা কাঁকুরে৷ মাঝে মাঝেই এবড়োখেবড়ো৷ উঁচুনিচু৷ বালি কাঁকরের মধ্যে মাথা উঁচিয়ে আছে কালো কালো পাথর৷ কোথাও একটু ছোট পাথর কোথাও একটু বড়৷ মানুষে মানুষে ধাক্কা লেগে যাচ্ছে৷ ভিড় বাড়ছে৷ মাল নামাচ্ছে কেউ পিঠ থেকে৷ এদিক ওদিক ত্রিপল প্লাস্টিক চৌকি পাতছে, গুছোচ্ছে৷ ঢালছে৷ দুটো মালভর্তি বস্তা পিছন থেকে ধাক্কা লাগিয়ে সামনের দিকে চলে গেল এক্ষুনি৷ বড় বড় তামাক পাতা সাজানো চলছে লাইনকে লাইন৷ বস্তা থেকে ঢালছে একগাদা লেডিজ ব্যাগ৷ ইমিটেশনের চুড়ি কানের দুল নেপালিদের বিয়ের সবুজ পুঁতির মালা৷ চৌকির উপর ডাল চাল মশলা সাজাচ্ছে মেয়েগুলো৷ চেরা চেরা চোখ৷ চ্যাপ্টা নাক৷ ফর্সায় তামাটে পরত পরা চামড়া৷ গায়ের চুড়িদার সোয়েটার জিন্সগুলো ময়লা ধরনের৷ চোখে পড়ছে ঠোঁটের চড়া লাল গোলাপি লিপস্টিকগুলো৷ ঝুড়ি ঝুড়ি ঢুকছে সবুজ সবুজ টাটকা টাটকা ক্যাপ্সিকাম ফুলকপি কাঁচালঙ্কা স্কোয়াশ৷ ডাইনে বাঁয়ে হাটে ঢোকার রাস্তায় বেসনে লঙ্কার গুঁড়ো মিশিয়ে ফ্যাটানো চলেছে৷ আঢাকা কাটা পেঁয়াজ আলু লঙ্কা তেলের শিশি৷ স্টোভে পাম্প দিয়ে চলেছে জোরসে৷ গরম তেল থেকে ধোঁয়া বেরচ্ছে কোথাও৷ বড়া ভাজা শুরু হবে একটু পরে৷ ঢুকে ডান দিকে চলে যাচ্ছে সবজির ঝুড়িগুলো৷ পুরুষ মহিলা সবজি ঢালতে গুছোতে খুব ব্যস্ত ওখানে৷ সবজির ওই লাইনগুলো ছাড়িয়ে আরও কিছুটা হাঁটলেই আরও বেশি বেশি পাথর৷ উঁচু পাহাড়টা শুরু৷ পাথরের মাঝে মাঝে বড় বড় গাছে ঘন সবুজ ওই পাহাড়৷ নীচু থেকে চোখটা উঁচুর দিকে গেলে আরও বড় বড় পাইন ওক গাছ পাহাড় বেয়ে উঠে গেছে৷ আরও উঁচুতে পাহাড়ের মাথায় গাড়ির লাইন৷ পাহাড়ের ওপর রাস্তা বানানো হয়েছে৷ গাড়িগুলো নামছে ওই পিচের রাস্তা দিয়ে৷ বাঁক নিয়ে ওই উঁচু পাহাড় থেকে হাটের পাশের রাস্তাটায় এসে দাঁড়াচ্ছে৷ রাস্তার পাশের দোকান থেকে জলের বোতল পাউরুটি কোল্ডড্রিঙ্কস চিপস্ কিনছে৷ কোনওটা দাঁড়াচ্ছে না৷ সাঁ সাঁ স্পিড তুলে চলে যাচ্ছে৷ কানে এল গান বাজছে একটা গাড়িতে৷ …এ দিল দিওয়ানা৷ দিওয়ানা৷ এ দিল…৷
জিপ গাড়িগুলির সামনে লেখা মিরিক৷ এ জায়গাটার নাম দুধিয়া৷ শিলিগুড়ি থেকে দেড় ঘণ্টা লাগে গাড়িতে আসতে৷ এটা দুধিয়া হাট৷ আজ রবিবার৷ শুধু রবিবার হাট বসে৷ বিকেলের আলো চলে যাওয়ার আগে হাট উঠে যাবে৷ এই হাট বহু পুরনো৷ লোকাল মানুষ দূর দূর থেকে আসে এ হাটে৷ হাটের আশেপাশে নতুন নতুন রিসোর্ট৷ টু্যরিস্টের আসা এক রাত বা দু রাতের জন্য৷ নতুন একখানা অফবিট টু্যরিস্ট স্পট৷
হাট থেকে বেরিয়ে গিয়ে চওড়া পিচের রাস্তাটায় উঠলাম৷ মাথার পেছনে একদিকে কার্শিয়াং পাহাড়৷ আর অন্যপাশে একটা পাহাড় ডিঙিয়ে গেলে মিরিক পাহাড়৷ আমি চলেছি মিরিকের উল্টোদিকে৷ কিছুদূর এগিয়ে দুধিয়া বাজার পার করে যে রাস্তাটা ডান পাশে নদীর দিকে চলে গেলো আমার গাড়ি চলল সেই দিকে৷ বালাসোন নদী৷ বালাসোন ক্রস করছে গাড়ি ব্রিজের উপর দিয়ে৷ নীচে অনেকটা দূর অবধি বালি আর বড় ছোট পাথর৷ এখনও কুয়াশার নীচে ঢেকে আছে বালাসোনের স্রোত৷ নদীর পারের কুয়াশার ভেতর থেকে চার পাঁচ রকমের হিন্দি গান ডিজে মিউজিক আসছে ভেসে৷ ড্রাইভার বলল, গাড়িগুলি পিকনিকপার্টির৷ রাস্তাটা এবার বাঁক নিয়ে বালাসোনের পাশ দিয়ে উপর দিকে উঠছে৷ বাঁ হাতে আমার সঙ্গে চলেছে বালাসোন৷ আর ডান দিকে উঁচুতে ঘন জঙ্গল৷
দু-কিলোমিটার মতো ছাড়িয়ে এসে জঙ্গলের ভেতরে হঠাৎ একটা বড় বাড়ি অনেকখানি জায়গা জুড়ে৷ ওটা পানিঘাটা থানা৷ পানিঘাটা থানা পার করে আরও একটু এগিয়ে গিয়ে বাঁ হাতের রাস্তাটায় আমার গন্তব্য৷ বিচ লাইন৷ কাছেই ফরেস্ট অফিস৷ ডান পাশে দেখা যাচ্ছে উঁচু পাহাড়৷ তারই নীচে রাস্তার ডাইনে বাঁয়ে ছোট্ট পাড়াটা৷ গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল ছোট্ট একখানা বাড়ির সামনে৷ সারি সারি ফুল ফুটে আছে বাড়ির উঠোনে৷ রাস্তার উল্টোপিঠ থেকে চিলতে রোদটা ছেড়ে এক ভদ্রমহিলা হাসতে হাসতে এগিয়ে এলেন সামনে৷ ওঁর সঙ্গেই দেখা করতে এখানে আসা৷ জানুয়ারি মাসের কনকনে ঠাণ্ডায় ওই একফালি রোদ পাহাড়ি পাড়াটায় ঢুকতে পেরেছে৷ মুখে একগাল হাসি৷ অনেকখানি লম্বা চওড়া চেটোর ডান হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দিলেন৷ হাতের পাতাটা যে শক্ত চাপে বুঝতে পারলাম৷ সেই শক্ত হাত দিয়ে কসরত করে সার জল পাথুরে মাটিতে ওই বাগানভর্তি ফুলগুলো ফুটে উঠেছে৷ অ্যাঞ্জেলিয়া, ক্যামেলিয়া, শিনোরিয়া, পিকোনিয়া পিঞ্জি৷ লাল হলুদ বেগুনি৷ কড়া ঠাণ্ডায় বাগানভর্তি শাক পাতা পুষ্ট হয়ে গা জড়াজড়ি করে সবুজ করে রেখেছে৷ রাই শাক, মুলি শাক, বোটে ধনিয়া৷ নামগুলো একগাল হেসে বলে চলছিলেন ভদ্রমহিলা৷
ওই পাড়ার নীচেই পাহাড়ের ঢালে পানিঘাটা টি এস্টেট৷ দু-চার মিনিট ওই পাহাড়ের ঢাল বেয়ে নেমে এলে যে বড় সবুজ বাগান দেখা যাচ্ছে ওগুলো লম্বা লম্বা চা গাছ৷ নিউ জলপাইগুড়ি থেকে পাহাড়ে যেতে যে সবুজ সুন্দর কার্পেটের মতো চা বাগান চোখ দেখে অভ্যস্ত, এ চা বাগান তেমন নয়৷ হাইট মেয়েদের কোমর ছাড়িয়ে আরও অনেক দূর বেড়ে উঠেছে৷ ঝোপ জংলায় ভরা৷ পানিঘাটা টি এস্টেট বন্ধ হয়ে গেছে অনেক বছর হল৷ ম্যানেজারের বসার জায়গাটা ভেঙে পড়েছে৷ মাপার দাঁড়িপাল্লা সরিয়ে নিয়ে গেছে ওখান থেকে৷ যে মাটিতে জল পড়লেই চা পাতায় সবুজ হয়ে উঠত এখন সব ঝোপ হয়ে বড় হয়ে জঙ্গল হয়ে গেছে৷ টি এস্টেট বন্ধ হয়ে গেছে সাত আট বছর হল৷ টি এস্টেট এর গায়ে লেগে আছে একদিকে জঙ্গল আরেকপাশে গ্রাম৷ মাঝে কোনও ব্যারিকেড নেই৷
—জঙ্গল থেকে এখন লায়ন ঢুকে পড়ে৷ গাঁও থেকে বকরি গোট শূয়ার কুকুর তুলে নিয়ে যায়৷ চা গাছগুলোতো এখন বড় হয়ে জঙ্গল হয়ে গেছে না! তো মানুষ বোঝে না ওই জঙ্গলের ভিতরে লায়ন নাকি গোট নাকি বকরি হাঁটছে৷
ওই ভদ্রমহিলা বলছিলেন হিন্দি মেশানো বাংলা টানে৷ গায়ে জ্যাকেট ট্রাউজার৷ লম্বা শক্তিশালী একটা চেহারা৷
গলির পাশের ওই বাড়িটিতে ছোট মেয়েটি তখন বড় হচ্ছে৷ বাগানের ওই চা গাছগুলো মেয়েদের বুকের নীচ অবধি বাড়লেই থামিয়ে দেওয়া হত৷ নভেম্বর অবধি বাড়তে দেওয়া হত৷ ডিসেম্বর জানুয়ারিতে আবার কাটছাঁট চলত চা গাছের ডালপালা৷ নতুন পাতা গজাতে শুরু হতো ডিসেম্বর জানুয়ারিতে৷ জুলাই অগাস্টের পাহাড়ের ঘন বৃষ্টিতে পাতায় পাতায় এক্কেবারে সবুজ ওই বাগান৷ সারা বছর ভোর অন্ধকার থাকতেই এ পাড়ায় আসেপাশের পাড়াগুলোতে চুলায় আগুন জ্বলে উঠত৷ ঘন কুয়াশায় ঢাকা ডিসেম্বর জানুয়ারি হোক বা কালো মেঘে ঢেকে যাওয়া জুলাই অগাস্ট রান্না চাপত ভোর অন্ধকারে৷ রান্না করা গরু শুয়োর ছাগলের যত্নআত্তি করা সংসার সামলানো৷ এসব কাজ সেরে সাতটা বাজলে দলে দলে মেয়েরা ঢুকত চা বাগানে৷ চুড়িদারের উপর ত্রিপল গায়ে বেঁধে ঢুকে যেত চা পাতার মধ্যিখানে৷ পিঠে ফাঁকা ঝোলা৷ মাথায় রুমাল৷ তিন পাতা ভেঙে ভঙে ভরত পেছনের ঝোলায়৷ ঝোলা ফুলে উঠছে চা পাতায়৷ বিকেল পাঁচটা বাজলে লাইন দিত গিয়ে বাইদরের কাছে৷ চা মাপা চলত৷ যখন বাগানে চা পাতা কম তখন দিনে কম করে চৌদ্দ কেজি তুলতে হত৷ জুলাই অগাস্ট বেশি বেশি বৃষ্টিতে বেশি পাতায় ভরে যেত বাগান৷ দিনে ১০০ কেজি বা তারও বেশি দিনে তুলতে হবে৷ কেজি প্রতি দুই টাকা ছিল পারিশ্রমিক৷ সন্ধ্যা হয়ে যেত চা পাতা তুলতে তুলতে৷ ভেজা জামাকাপড়ে ওই অতো চা তুলে মাপজোক সেরে বাড়ি ফেরা৷ পাহাড়ের গা ধরে অন্ধকার হয়ে নিঝুম হয়ে আসত গ্রাম৷ আবার চুলা জ্বলে উঠত ঘরে ঘরে৷ তারপর চিৎকার৷ মেয়েদের গলায়৷ ধরমর করে কেউ ঢুকে পড়ত ওই বাড়ির ওই কাঠের ঘরের পিছন দিকটায়৷ বাঁচতে৷ প্রচণ্ড চিৎকার করতে করতে৷ কখনও ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে৷ বেশিরভাগ শোনা যেত একটাই কথা৷ ভদ্রমহিলার ভালো করে মনে আছে সেই কথাটা৷
বুড়া মালাই কুরদাইসে…৷ বুড়া মালাই কুরদাইসে…৷ ভদ্র মহিলা থেমে থেমে মনে করে বাংলা করে বলছিলেন আমাকে৷
রোজ রোজ শুনতাম ওরা ছুটতে ছুটতে এসে বলছে আমার মায়ের কাছে৷ স্বামী বলেন না আপনারা৷ নেপালীতে বলে বুড়া৷ বুড়া মানে স্বামী৷ মানে স্বামী পেটাচ্ছে৷
রক্সা খেয়ে এ পাড়ার বৌ পেটানোর ঘটনা প্রায় রোজ ওঁর দেখা৷ রক্সা ওই এলাকায় নেশা করার লোকাল প্রোডাক্ট৷ দুধিয়া হাটে ঢোকার আগে রাস্তার পাশে একটা দেয়াল ছাড়া বারান্দায় চোখে পড়েছিল৷ এক বৃদ্ধা বানাচ্ছে৷ পচা ভাতগুলিকে প্লাস্টিকের উপর ছড়াচ্ছিল৷ প্রথমে গরম ভাত পচায়৷ সেই পচা ভাতে গাছ পাতা শেকড় মিশিয়ে বানানো বড়ি ভেঙে মেশায়৷
এখানে পাড়ায় পাড়ায় বানানো হয় রক্সা৷ মেয়েরাই বানায়৷ বেচে৷ ভালো নেশা হয় ওতে৷ সারাদিন চা বাগানে কাজ করত বেশিরভাগ মেয়েরা৷ কিছু কিছু পুরুষমানুষ৷ রাতের বেলা বৌ পেটানোর ঘটনাটা আর তারপর ওঁর মায়ের কাছে মেয়েদের ছুটে আসার দৃশ্যটা ওঁর ছোটবেলা থেকে একেবারে চেনা৷ বাবা ছিলেন টি এস্টেট-এর জল সরবরাহকারী৷ রাশভারী মানুষ৷ মামা-মামা করে ডাকত পাড়ার মেয়ে বৌরা৷ মা ওই চা বাগানেরই প্লাকার৷ নাম এইটি সউরিয়া৷ এইটি সউরিয়া ওদের ঘরের ভিতর বসতে দিত৷ বেঁচে যেত ওরা এক রাতের জন্য৷ তারপর হয় ফিরিয়ে দিয়ে আসত৷ নাহলে তিনি নিজে গিয়ে বোঝাতো ওদের স্বামীদের৷ নতুবা থেকে যেতো ওরা এই বাড়িতেই পুরো রাত৷ ভোর হলে মেয়েরা আবার বাড়ি ফিরে যেত৷ আবার চুলা ধরাতো৷ আবার খাবার বানাতো৷ শুরু হত প্রতিদিনের রুটিন৷ চা বাগানের দিকে আবার রওনা৷
পাহাড়ের কোলে ওই কাঠের ঘরে এইটি সউরিয়ার তিন মেয়ে এক ছেলে রুটি সবজি মশলার কৌটো খাট আলমারির সংসার কীভাবে যেন হয়ে উঠত ওই চা বাগানের মেয়েদের রাতের বেলার বাঁচার আশ্রয়স্থল৷ ওই মেয়েরা তাদের জীবনের নিত্যদিনের রুটিন আর বদলাতে পেরেছিল কিনা জানি না, তবে এভাবে রাতের পর রাত এই ঘটনা দেখতে দেখতে ছোট মেয়েটার মনে তৈরি হচ্ছিল অচেনা অজানা এক অন্যরকমের ভবিষ্যতের গল্প লেখার প্লট৷ যে গল্প হতে পারত কোনও স্কুল শিক্ষিকার, মাস গেলে বেতন পাওয়া কোনও সরকারি বেসরকারি কর্মচারীর, যে গল্প হতে পারত কোনও সুখী গৃহিণীর, সে সব গল্পগুলো সব বদলে হয়ে উঠল অচেনা অজানা সব গল্প৷
সামনের কাঠের ঘরটা এখন ইট সিমেন্টের৷ বারান্দায় দুপাশে ঝুলছে টব থেকে ফুল৷
জোরসে দুটো হর্নের আওয়াজ শোনা গেল কথার মাঝেই৷ পরপর দুটো বাইক এসে থেমে গেল গ্রিলের গেটের বাইরে৷ চারজন লোক৷ ভদ্রমহিলার নাম ধরে ডাকলেন ওরা৷ চ্যাপ্টা নাক চারজনেরই৷ ভ্রুগুলি ছড়ানো৷ হাইট বেশি নয়৷ হূষ্টপুষ্ট চেহারা৷ কথা শুরু হল ওদের মধ্যে৷ একজনের কথার মাঝে আরেকজন কথা বলে ফেলছে৷ মুখগুলি উদ্বিগ্ন৷ গলিটা জুড়ে দাঁড়িয়ে আছে ওরা৷ বলে চলেছেন অনবরত৷ ভদ্রমহিলা প্রশ্ন করে চলেছেন৷ বারেবারে৷ চারজনের মধ্যে বলছেন একজন বেশি৷ তার শেষ কথাগুলো বাকি তিনজন রিপিট করে চলেছে৷ কথাগুলো হচ্ছে একেবারে ট্র্যাডিশনাল নেপালি ভাষায়৷ মানে বোঝা যাচ্ছে না একটি কথারও৷ শুধু কথার ভেতর একটা টেনশন চলছে বোঝা যাচ্ছে৷ মোবাইলের স্ক্রিন মাঝখানে খোলা৷ একজনের হাত থেকে অন্যজনের হাতে ঘুরছে৷ এবার ভদ্রমহিলার মোবাইলে আলো জ্বলে উঠল৷ সবার চোখ এবার ওঁর মোবাইলের দিকে৷ ভদ্রমহিলা টাচ স্ক্রিন স্ক্রোল করে করে জিজ্ঞাসা করে চলেছেন কীসব৷ একজন দেখাচ্ছে৷ বাকি তিনজন ঝুঁকে পড়েছে মোবাইলের স্ক্রিনের দিকে৷ গলার আওয়াজগুলো চড়ে যাচ্ছে কখনো-সখনো৷ আবার নামছে৷
এই অবধি ব্যাপারটা ঠিক কী বোঝা যায়নি৷ বোঝা গেল তারপরে৷ ভদ্রমহিলা চারজনকে নিয়ে ঢুকে পড়লেন গেটের ভেতর৷ মোবাইলটা নিয়ে একেবারে আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন৷ স্ক্রিনটা আমার মুখের কাছে এনে বললেন, এই দেখেন এই মেয়েটা মিসিং হয়ে গেছে৷ একমাস হল৷ মেয়েটা এনার ওয়াইফটা আছে৷
কুয়াশা আরও কেটে গিয়ে ধোঁয়া ধোঁয়া ভাবটা কেটে গেছে ওদের কথোপকথনের মধ্যে৷ এই ঝলমলে পাহাড়ি গ্রামে সুন্দর একটি মেয়ের ছবি আমার হাতের উপর৷ ঠোঁটে লাল লিপস্টিক৷ রঙ ধবধবে ফর্সা৷ চেরা চোখে চুল বাঁধার ধরন ট্র্যাডিশনাল পার্বত্য এলাকার মেয়েদের মতো৷ একগাল হাসি৷ সে হারিয়ে গেছে৷ খবরটা অনেকটা একটু আগে ওই কালো পাথরে ঝট করে একটা হোঁচট খাওয়ার মতো৷
ভদ্রমহিলা বলে চলেছেন, ইনি ওঁর হাসব্যান্ডটা আছে৷ যাকে দেখিয়ে দিলেন তিনি এতক্ষণ সব থেকে বলছিলেন বেশি৷
ইনি বাইরে কাজ করেন৷ ওখানে বসেই শুনেছেন যে তার ওয়াইফটা আর ঘরে নাই৷ মিসিং হয়ে গেছে৷ ছুটি পাচ্ছিলেন না তো৷ তাই দেরী হল ঘরে ফিরতে৷
কথা শেষ না হতেই মোবাইলের মেয়েটির হাসি মুখের ছবিটা অদৃশ্য হয়ে গেল৷ দশ সংখ্যার মোবাইল নম্বর ভেসে উঠল৷ সঙ্গে রিংটোন৷ আমার হাত থেকে ভদ্রমহিলা ফোনটা চট করে নিয়ে নিলেন৷
হ্যালো… হ্যালো…৷ হাঁ বোলিয়ে৷ কিছুক্ষণ চুপ৷ কথার আওয়াজ আসছে মোবাইলের ওপাশ থেকে৷ ওপারের গলার আওয়াজটাও মেয়েদের এটুকু বোঝা যাচ্ছে৷ শুনছেন মন দিয়ে৷
—ঠিক করে নাম বলো৷ দাঁড়াও এক মিনিট৷ বলতে বলতে বারান্দায় ঢুকে পড়ে সোফায় বসে উপরে একখানা ডায়েরি খুলে নিল৷ বোঝা যাচ্ছে ওপাশ থেকে যা শুনছেন ডায়েরির পাতায় লিখছেন৷ ইংরাজিতে৷
হ্যাঁ বলো৷ ঠিক করে নাম বলো৷ অ্যাঁ অ্যাঁ৷ বুঝতে পারছি না৷ বুঝতে পারছি না৷ ঠিকসে বোলো!
সরু রাস্তাটার ওপারের বাঁশ টাঙানো বেড়া থেকে রোদটা কখন যেন এসে পৌঁছে গেছে বাগানের উপর৷ একখণ্ড মেঘ ওই চিলতে রোদের উৎসস্থলে পৌঁছে গিয়ে ঢাকা দিয়ে দিয়েছে ওই পাহাড়ের কোণের আকাশটাকে৷ অন্য জায়গাটা মেঘ সরে ফাঁকা এখন৷ ভদ্রমহিলার বারান্দার গ্রিলের বাইরের লাল ফুলগুলি নতুন রোদে আরও লাল হয়ে উঠেছে৷
ভদ্রমহিলার মুখটা আরও একটু গম্ভীর হয়ে এসেছে৷
—হাঁ বলো তোমার ভিলেজের নাম৷ হা থানা বলো৷ হাঁ তোমাদের তোমাদের থানার নাম৷ জানো? থানা… থানা…! জানো?
ওপার থেকে কোনও উত্তর এলো কিনা বোঝা গেল না৷ ডায়েরির পাতার দিকে চোখ পড়ে গেল৷ ভিলেজ ফাঁকা৷ পি এস ফাঁকা৷ শুধু ডিসট্রিক্টের পাশে একটা নাম বসল৷ বসার পরেও বারবার প্রশ্ন চলেছে৷
নাম, গ্রামের নাম লেখাগুলো কালো কালি দিয়ে দু’বার তিনবার কাটাকুটি হল৷
তুমি এইসব ভুলভাল বোললে ম্যায় ক্যায়সে ঢুন্ড নিকালুঙ্গা? বোলো ঠিকসে বোলো৷ এরকম কোনও জায়গা নাই আমি জানি৷ এই সব ঠিক নাম না৷
আবার কী যেন মন দিয়ে শুনছেন৷
দেখো ইয়ে সব ফেক নেম হ্যায়৷ তুম ফেক নেম নেহি বোলো৷ এরকম ফেক নাম বোলো না বুঝলে৷
যে লেখাটা থেকে গেল অনেক কাটাকুটির পর সেটা ডিস্ট্রিক্ট কোচবিহার৷
একটু আগে যে গল্পটা শুনতে শুনতে থেমে গেছিল এটা সেটার কোনও অংশ নয়৷ এটা অন্য আরেকটা গল্প৷ অন্য আরেকটা মেয়ের কথা৷ এ মেয়েটাও মিসিং৷ সে নিজেই ফোন করছে এই ভদ্রমহিলাকে বাড়ি ফিরে আসার জন্য৷ সেই সকালে আমার সামনে দাঁড়িয়েই ভদ্রমহিলার কাছে দু-দুটো মিসিং কেস চলে এলো বুঝতে পারলাম৷
এই সমস্ত গল্পগুলো শুরু হয় দার্জিলিঙ কোচবিহার জলপাইগুড়ির নেপাল সিকিমের কোনও চা বাগান কোনও হাইওয়ে কোনও বাসস্ট্যান্ড কোনও পাহাড়ি বা সমতল মাটির উপর দাঁড়িয়ে থাকা গ্রাম থেকে৷ বা ওই দুধিয়া হাট থেকে৷ ওই দুধিয়ার আশপাশের অনেক গ্রাম থেকে মেয়েরা শাকসবজি তামাক পাতা ইমিটেশনের গয়না বেচতে আসে বা কিনতে আসে৷ সারা সপ্তাহ শেষে ওই একখানাই পাহাড়ের কোল যেখানে এলে পাড়ার বেপাড়ার চেনা অচেনা বন্ধু-বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা হয়৷ প্রেমিকের সঙ্গে দেখা হয়৷ নতুন নতুন মানুষের সঙ্গে দেখা হয়৷ দুধিয়া হাট থেকে শেয়ারের জিপ গাড়িতে চাপাচাপি করে বসে বা পাহাড় বেয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেয়েগুলো চলে যায় মাঝেমাঝেই অন্য অজানা ঠিকানায়৷ আর গল্পগুলো বেশির ভাগ শুরু হয় কোনও অচেনা ফোন নম্বর থেকে৷ মেয়েদের কাছে রং নম্বরে আসা ফোনগুলিই সূচনা করে দেয় নতুন নতুন হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের গল্পের৷ গল্পের শেষটা লেখা হয় পাহাড়ের পাশের এই ভদ্রমহিলার বাড়িতে এসে৷ বা শেষটুকু ভদ্রমহিলারও অজানা থেকে যায়৷
যার কাছে সকালবেলাতেই এসব খবর এসে হাজির তার বয়স এখন পঁয়তাল্লিশ ছুঁয়েছে৷ সে যখন দার্জিলিং স্কুলের ছাত্রী তখনই খোঁজ করত কোন বন্ধু যেন ইস্কুল ছেড়ে পড়া ছেড়ে দিয়ে চলে গেল? কেন গেল? কোথায় গেল? তারপর দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজ৷ দার্জিলিং গভর্নমেন্ট কলেজের কাছাকাছি দুটো সদর হাসপাতাল৷ কে যেন ওই খাড়াই পথে হাঁটতে হাঁটতে আর হাসপাতালে পৌঁছতে পারল না! ওই যে খাড়া ঢাল বেয়ে বিছানার চাদরের খুঁট ধরে আনছিল রোগীকে, আর পারল না ওই হাসপাতাল অবধি এসে পৌঁছে যেতে! কে যেন ওই খাদের মাঝে হাসপাতালে আসতে হাঁপাতে হাঁপাতে মরে গেল খোলা আকাশের নীচে! কোনও রুগির খাবারটা ওই পাহাড়ের কোলের বাড়ির লোক এসে পৌঁছে দিতে পারল না কনকনে ঠাণ্ডায়! গরম জলটা কার যেন একটু দরকার! খোঁজ করত…খোঁজ করত…৷
তারপর শুরু হত কাজ৷ দল বানিয়েছিল বন্ধু বান্ধবের সঙ্গে৷ হাসপাতালের পাশেই কোনও বাড়ি কোনও চায়ের দোকান কোনও হোটেল থেকে জোগাড় করত সেই খাবার সেই একটু উষ্ণ গরম জল৷ এসব সেরে হস্টেলে ফিরতে ফিরতে সন্ধে৷ বি এড শেষ করতে করতেই খোঁজের ধরন গেল বদলে৷ চা বাগানের ভেতর থেকে কোন মেয়েটা যেন মিসিং হয়ে গেল? কোথায় গেল? কে নিয়ে চলে গেল মেয়েটাকে? ফিরিয়ে আনা যায় না!
এখন শক্তিশালী একটা চেহারা৷ চওড়া হাতের পাঞ্জা৷ ছোট ছোট চুল আর অনেক খানি সাহস৷
সেই কোন সব ক্লাসের ভুগোল বইতে পড়তাম নেপালীরা খুব সাহসী খুব পরিশ্রমী পাহাড়ে চড়তে খুব দক্ষ৷ ইনি পাথরে তৈরি পাহাড়ের চূড়ায় ট্রেক করে ওঠেননি কখনও৷ ওঁর ট্রেক অন্য পথে৷ ঘন কালো অন্ধকার জগতে চলা ওঁর৷ বারবার হোঁচট৷ বারবার ধাক্কা৷ ঝড় জল৷ ধাক্কাগুলো একেকবার একেকরকম৷
কতরকম খোঁজ করতে থাকে৷ খোঁজ… খোঁজ… খোঁজ…৷ মেয়ে হারানোর পরে খোঁজ৷ অন্য জেলায় খোঁজ৷ দূরের রাজ্যে রাজ্যে খোঁজ৷ কখনও সাঙ্গে শুধু একখানা মুখের ছবি৷ নাম-ধাম ঠিকানার খোঁজ৷ কোনও মাল্টি স্টোরিড বিল্ডিংয়ে কোনও ঘুপচি ঘরে খোঁজ৷ কোন অন্ধকার গলিতে গিয়ে খোঁজ৷ কখনও পুলিশের হেল্প পেয়েছেন৷ কখনও সঙ্গে পাননি৷ খোঁজার শেষে আবার নতুন খোঁজ৷ বাড়ি ফেরানোর পরে খোঁজ৷ বাড়িতে থাকতে পারল তো সেই মিসিং মেয়েটা ফিরে এসে!
হ্যালো… হ্যালো…
গলাটা চড়ছে
ঠিক করে বোলো হ্যাঁ…
ওই যে গলাটা চড়ছে… চোখটা লালচে হয়ে আসছে… এগিয়ে আসছিল তখন ওই চিলতে রোদটা ছেড়ে হাসি মুখে, উঁচু লম্বা পুরুষালি চেহারার ভদ্রমহিলা৷ উনি রঙ্গু সউরিয়া৷ দার্জিলিংয়ের এই সাহসী মেয়েটা কাদের খোঁজেন? দলে দলে মেয়েদের৷ দার্জিলিং জলপাইগুড়ি কালিম্পং থেকে হারিয়ে যাওয়া মেয়েদের৷ বিক্রি হয়ে যাওয়া মেয়েদের৷ পাচার হয়ে যাওয়া মেয়েদের৷
নকশাল বাড়ির চা বাগানের সেই বারো চোদ্দ বছরের মেয়েটিকে খুঁজে বার করা দিয়ে শুরু হয়েছিল তাঁর এই অভিযান৷ বয়স তখন অল্প৷ সবে পাশ করেছেন বিএড৷ নকশাল বাড়ির চা বাগানে ঘুরতে ঘুরতে খবর পেলেন একটি মেয়ে অনেক বছর ধরে আর ফেরে না দিল্লির কাজের বাড়ি থেকে…৷