অঞ্জনা চট্টোপাধ্যায়
১
রুটি দুটোকে আলু-পটলের ছেঁচকি দিয়ে কোনোরকমে গলাধঃকরণ করে খাওয়ার টেবিল থেকে উঠে পড়ল দীপাঞ্জন। শোওয়ার ঘরে ঢুকে আয়েস করে খাটের ওপর বসে হাতে তুলে নিল মাস খানেক আগে কেনা স্মার্টফোনটাকে। আগে সময় পেলেই অফিসের কম্পিউটার থেকে ফেসবুকের আপডেট চেক করত দীপাঞ্জন। কিন্তু এখন, নতুন ফোনটাতে ফেসবুক ইনস্টল করার পর থেকে ও যখন খুশি অনলাইনে সামাজিকতা করে। দীপাঞ্জন ফেসবুক খুলে দেখতে লাগলো সাজেস্টেড ফ্রেন্ডদের লিস্ট। বেছে বেছে ক্লিক করতে লাগলো দামী পোশাক পরা, সুন্দর করে সাজগোজ করা সুশ্রী নারী-পুরুষদের ছবির নীচে থাকা নীল রঙের ‘অ্যাড ফ্রেন্ড’ বাটনে। খুলে খুলে দেখতে লাগলো তাদের প্রোফাইল।
বছর পঞ্চাশের ছাপোষা, মধ্যবিত্ত দীপাঞ্জনের খুব ইচ্ছা করে ওদের মতো করে বাঁচতে। ওদের মতো দামী জামাকাপড় পরতে, নামী রেস্তোরায় খেতে, বিদেশে বেড়াতে যেতে।
পাপিয়াকে ঘরে ঢুকতে দেখে দীপাঞ্জন মোবাইল ফোন রেখে দিল ।
ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ার থেকে একটা বাক্স বের করে এনে পাপিয়া বলল, ‘এই দেখো, আজ এই বালা দুটো কিনলাম। সামনের মাসে বিয়েবাড়ি আছে না, তাই। কেমন হয়েছে?’
দায়সারা ভাবে মাথা নাড়ালো দীপাঞ্জন। এসব গিলটি করা গয়না দেখলে খুব বিরক্ত লাগে ওর। কমদামি জিনিসের ওপর রঙ চড়িয়ে দামি করার চেষ্টা। পাপিয়াকে অনেক বার বারণ করেছে, কিন্তু কোনো লাভ হয়নি। সোনার গয়নাগুলোকে মেয়ের বিয়ের জন্য তুলে রেখে, ইমিটেশনের গয়না পরে কাজ চালাচ্ছে পাপিয়া।
মেয়ে টুকটুকি এ বছর ঊচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছে। ও লেখাপড়ায় ভালো। কোনো রকমে যদি একবার টেনেটুনেও এমএ-টা পাশ করতে পারে, তাহলে ভালো পাত্র পেতে আর কোনো অসুবিধা হবে না। তাই এখন থেকেই মেয়ের বিয়ের জন্য টাকা জমাচ্ছে দীপাঞ্জন। আর পাপিয়া সযত্নে আগলে রাখছে নিজের বিয়ের গয়নাগুলোকে।
২
টুকটুকি ঊচ্চ-মাধ্যমিক পরীক্ষায় ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছে। দীপাঞ্জনের অনেক দিনের ইচ্ছা ছিল নামি রেস্তোরাঁয় খাওয়ার। আজ সুযোগ পেয়ে, মেয়ের সাফল্য উদযাপন করতে বালিগঞ্জ প্লেসের একটা অভিজাত বাঙালি রেস্তোরাঁয় সপরিবারে খেতে এসেছে দীপাঞ্জন।
থরে থরে সাজানো সুখাদ্যগুলোর প্রত্যেকটাকে একবার করে চেখে না দেখলে বুফে লাঞ্চের পয়সা উশুল হয় না। স্টার্টার ও মেনকোর্সের প্রায় সবকটা পদের অল্পবিস্তর স্বাদগ্রহণের পর, দীপাঞ্জন এগিয়ে গেল ডেসার্ট সেকশনের দিকে; পেটে আর বেশি জায়গা নেই তাই কয়েকটি পরিচিত মিষ্টান্ন প্লেটে তুলে নিয়ে ফিরে এল নিজের টেবিলে। আয়েশ করে বসে দুটো বেকড সন্দেশ, একটা ছানার মালপোয়া আর দু-চামচ রাবড়ি মাখানো মিহিদানা খেয়ে পরম তৃপ্তিতে ছোট্ট করে একটা ঢেকুর তুলল। রেস্তোরাঁর কোথাও ‘ঢেকুর তোলা নিষেধ’ কথাটি লেখা নেই, তবুও চল্লিশ পার হওয়া স্ত্রী ও অষ্টাদশী কন্যার মুখে অসন্তোষের ছাপ স্পষ্ট। অশান্তির ভয়ে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল দীপাঞ্জন, দেরি না করে এগিয়ে গেল ওয়াশ বেসিনের দিকে।
বিরিয়ানি, পোলাও বা ফ্রায়েড রাইস চামচ দিয়ে খেলেও চলে, কিন্তু ভাতের স্বাদ পেতে হলে হাত দিয়ে ভালো করে মেখে খাওয়া ছাড়া উপায় নেই; কারণ চামচ দিয়ে ভাত খেলে পেট ভরে ঠিকই কিন্তু মন ভরে না। তাছাড়া শুক্তো, মাছের কালিয়া, আমের চাটনি এসব কি আর চামচ দিয়ে খাওয়া যায়? ঝালে-ঝোলে-অম্বলে রসনাকে তৃপ্ত করতে গিয়ে দীপাঞ্জনের ডান হাতটা তেল-মশলায় একেবারে চটচটে হয়ে গিয়েছিল। মিষ্টি খাওয়ার আগে একবাটি লেবু মেশানো গরম জলে হাত ধুয়েছিল বটে কিন্তু মাংসের ঝোলের গন্ধটা এখনও যেন হাতে লেগে রয়েছে, তাই ওয়াশ বেসিনে কলের জলের তলায় সুগন্ধি লিকুইড সোপ মাখানো হাতদুটো রেখে ভালো করে ঘষে ঘষে ধুয়ে নিচ্ছিল দীপাঞ্জন।
‘অ্যাই, তুই রিন্টু না?’ অনেকদিন পর আবার ছোটবেলার সেই ডাকনামটা শুনে বেশ অবাক হয়ে ঘাড় ঘোরালো দীপাঞ্জন। ওকে এখন আর কেউ রিন্টু নামে ডাকে না, মায়ের সঙ্গেই মায়ের দেওয়া আদরের নামটাও গতাসু হয়ে গিয়েছে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই আবার নিজের মতামত ব্যক্ত করল পাশে দাঁড়ানো লম্বা-চওড়া দশাসই চেহারার লোকটা, ‘তুই তো একেবারে বুড়ো হয়ে গেছিস রে!’ এবার বেশ বিরক্তবোধ করল দীপাঞ্জন। সর্বজনীন তোয়ালেটাতে সদ্য ধোয়া হাতদুটো মুছতে একেবারেই ইচ্ছা করছিল না, তাই প্যান্টের পকেট থেকে নিজস্ব রুমাল বের করে হাত মুছতে মুছতে বিরক্তমুখে লোকটাকে জরিপ করতে লাগলো।
হালকা সবুজ ফুলশার্টে ঢাকা থলথলে ভুঁড়িটা বাদামি ট্রাউজারের ওপর বেঢপভাবে ঝুলে রয়েছে। মুখখানা একেবারে নধরকান্তি পাকা পেঁপের মতো। দক্ষ নাপিতের হাতের কারসাজিতে পাতলা হয়ে আসা চুলগুলোকে বেশ ঘন দেখাচ্ছে। দামি পারফিউমের হালকা সুগন্ধ জড়িয়ে রেখেছে লোকটার শরীরকে। না, একে আগে কখনও দেখেছে বলে তো মনে পড়ছে না দীপাঞ্জনের।
‘কী রে, আমাকে চিনতে পারছিস না? আমি দেবু, দেবব্রত। তোর সঙ্গে একই স্কুলে পড়তাম। আমাকে ভুলে গেলি?’ গলার স্বরে অভিমান ও মুখের অভিব্যক্তিতে কেমন একটা অবাক হওয়ার ভাব। লোকটার দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখল দীপাঞ্জন। আরে হ্যাঁ, এ তো দেবু, ওর স্কুলের বন্ধু, ক্লাস ফাইভ থেকে নাইন অবধি তো একসঙ্গেই পড়াশোনা করেছে দু’জনে। লেখাপড়ায় ভালো না হলেও দেবু খেলাধুলায় বেশ ভালো ছিল। খুব ভালো ক্রিকেট খেলতো। ব্যাটিং আর বোলিং-এ ছিল সমান দক্ষ। ক্লাস নাইন থেকে টেনে ওঠার পরীক্ষায় ফেল করেছিল দেবু। তারপর থেকেই আর কোনো যোগাযোগ নেই ওর সঙ্গে। কিন্তু এ কী চেহারা হয়েছে দেবুর! কোথায় সেই রোগা ছিপছিপে ঘেমো গন্ধওয়ালা ডানপিটে ছেলেটা আর কোথায় এই থপথপে গন্ধমাদন! একবার দেখে কি আর দুজনকে মেলানো যায় ?
‘এ কী চেহারা করেছিস রে?’ ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি নিয়ে জিজ্ঞেস করল দীপাঞ্জন।
‘যাক বাবা, চিনতে পেরেছিস তাহলে’ সন্তুষ্ট হয়ে জবাব দিল দেবু।
এভাবে ওয়াশ বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে বেশিক্ষণ কথা বলা চলে না। দেবুকে সঙ্গে নিয়ে দীপাঞ্জন নিজের টেবিলে এসে বসল। পুরানো বন্ধুর সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিল স্ত্রী ও কন্যার। ইতিমধ্যে ওয়েটর হাজির হল বিল নিয়ে। বিল মেটাবার পর আর টেবিল আঁকড়ে বসে থাকা যায় না। মুখশুদ্ধির মৌরি চিবোতে চিবোতে দেবুর ফোন নাম্বার নিজের মোবাইলে সেভ করে, পাতলা কাগজে মোড়া দু’চারটে টুথপিক নিয়ে উঠে পড়ল দীপাঞ্জন। দেবু ওর নতুন বিজনেস পার্টনারের সঙ্গে এখানে এসেছে। তার সঙ্গে পুরোনো বন্ধুর আলাপ করানোর কোনো প্রশ্নই ওঠে না। নিজের টেবিলের দিকে এগিয়ে যাওয়ার আগে একগাল হেসে দেবু বলল, ‘এতদিন পরে দেখা হল, কিন্তু ভালো করে কথাবার্তা বলা হল না। বৌদি আর মামণিকে নিয়ে একদিন আয় না আমাদের ওখানে, জমিয়ে গল্প করা যাবে।’ ঘাড় কাত করে সন্মতি জানাল দীপাঞ্জন, তারপর দেবুর নাম্বারে মিসড কল দেওয়ার জন্য মোবাইলের বোতাম টিপতে টিপতে পা বাড়ালো ‘এক্সিট’ লেখা দরজার দিকে ।
৩
প্রত্যক্ষ যোগাযোগ না থাকলেও, কলেজে পড়ার সময় বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে দেবব্রতর সম্বন্ধে অনেক কানাঘুষো শুনেছিল দীপাঞ্জন। দেবুর না কি রাজ্যসমেত রাজকন্যা লাভ হয়েছে। ওর সুদর্শন চেহারা দেখে এক বড়লোকের মেয়ে ওর প্রেমে পাগল। ওই মেয়ের সঙ্গে যদি দেবুর বিয়ে হয় তাহলে ওকে আর কোনোদিনও ভবিষ্যতের চিন্তা করতে হবে না। মেয়ের বাবার বিশাল ব্যাবসা; পুত্রসন্তান নেই, তাই শ্বশুরের অবর্তমানে জামাই হবে সবকিছুর একচ্ছত্র অধিপতি। দীপাঞ্জন তখন নিজের ভবিষ্যতের চিন্তায় এতই ব্যস্ত ছিল যে, বন্ধুর সৌভাগ্য নিয়ে বেশি কিছু ভাবার সময় পায়নি। কিন্তু আজ, এতদিন পর দেবুকে দেখে আবার নতুন করে সবকিছু মনে পড়ে গেল।
হোয়াটসঅ্যাপের ডিসপ্লে পিকচারে দেবব্রতর হাসিমুখের ছবি ছাড়া আর কিছুই দেখা যাচ্ছে না। দীপাঞ্জন তাই ফেসবুক ঘেঁটে খুঁজে বার করল পুরোনো বন্ধুকে। ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে লাগল দেবুর প্রোফাইল পিকচারটাকে। হাফ-প্যান্ট, টি-শার্ট আর চোখে নীল সানগ্লাস পরা এক অতীব সুন্দরী মহিলার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে দাঁড়িয়ে রয়েছে দেবু; ওদের পিছনে ধবধবে সাদা মাছের দেহওয়ালা সিংহের মূর্তির মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে জলের ফোয়ারা। ঘনিষ্ঠতা দেখে স্মার্ট মহিলাটিকে দেবুর স্ত্রী আর মারলিওনের স্ট্যাচুটাকে দেখে ফটোটা যে সিঙ্গাপুরে তোলা তা বুঝতে এতটুকুও অসুবিধা হয় না। স্কুলজীবনে পিছনে পড়ে থাকা দেবু আজ সবাইকে পিছনে ফেলে অনেকদূর এগিয়ে গিয়েছে।
একটা লম্বা নিঃশ্বাস নিল দীপাঞ্জন। পড়াশোনায় ভালো হয়ে কী লাভ হল দীপাঞ্জনের? একটা সাধারণ চাকরি, মায়ের পছন্দ করা উজ্জ্বল শ্যামবর্ণের রবীন্দ্রসংগীত জানা গৃহকর্মনিপুণা, সাদামাটা ঘরোয়া স্ত্রী, মধ্যবিত্ত গৃহস্থের ছাপোষা জীবন। যাকে কোনোদিনও প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে দেখেনি আজ তার বিজয়কেতন দেখার পর দীপাঞ্জনের মনের কোণে ঈর্ষা আর হতাশার কাঁটা দুটো পাকাপাকিভাবে টিকটিক করে ঘুরতে শুরু করে দিল।
রেস্তোরায় দেখা হওয়ার দু-তিন দিন পর, একদিন সকালে দেবব্রতর ফোন এল দীপাঞ্জনের কাছে। কোনো এক ছুটির দিনে সপরিবারে ওর ওখানে যাওয়ার এবং দুপুরে খাওয়া-দাওয়া করার আমন্ত্রণ জানাল দেবু। মুখে নেতিবাচক উত্তর দিলেও বিত্তশালী বন্ধু ও বন্ধুর পরিবারকে কাছ থেকে দেখার এমন সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করল না দীপাঞ্জন। মনস্থ করল দেখা-সাক্ষাতের ব্যাপারটা পরের রবিবারেই সেরে ফেলবে। তবে সপরিবারে নয়, বিকালের দিকে একাই যাবে সৌভাগ্যবান বন্ধুকে কাছ থেকে দেখতে।
৪
ড্রয়িংরুমের বাতাস রুম ফ্রেশনারের হালকা মিষ্টি, বিদেশি সুগন্ধে ভরা। দুধের সরের মতো পেলব চামড়ায় মোড়া নরম গদিওয়ালা সোফাটাতে জড়সড় হয়ে বসেছিল দীপাঞ্জন। মেঝেতে পাতা কাশ্মীরি কার্পেট থেকে শুরু করে সিলিংয়ের ঝাড়লন্ঠন, এ ঘরের সবেতেই রয়েছে বিলাসিতার ছাপ। যদিও সবেতেই রুচিবোধের থেকে বৈভবের প্রাধান্যটাই বেশি।
দায়সারা পরিচয়পর্ব মিটে যাওয়ার পর, স্ত্রীর ডাকে সাড়া দিয়ে দেবু সেই যে শোওয়ার ঘরে ঢুকেছে তারপর থেকে আর তার টিকি দেখা যাচ্ছে না। কিছুক্ষণ আগে কাজের মেয়েটি সামনে রাখা কাচের টি-টেবিলটাতে দু’কাপ কফি, নুন মাখানো কাজুবাদাম আর দু-তিন রকমের বিস্কুট সাজিয়ে দিয়ে গেছে। অস্পৃশ্য আবস্থায় পড়ে থাকতে থাকতে ধীরে ধীরে স্বাদ হারাচ্ছে সেগুলো। দেওয়ালে টাঙানো ঊনপঞ্চাশ ইঞ্চির টিভিটাতে ক্রিকেটারেরা মন দিয়ে বল করছে, রান নিচ্ছে, আউট হচ্ছে। তাদের চিয়ার আপ করার জন্য সুন্দরী তন্বীরা মাঝে মাঝে বাজনার তালে তালে নাচছে। তবে সেই জগঝম্প আওয়াজ কোনোমতেই পাশের বেডরুম থেকে ভেসে আসা স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যের আওয়াজকে ঢাকা দিতে পারছে না। ঘরের পরিবেশ বাতানুকূল হলেও দীপাঞ্জনের কপালের দু’পাশে জমতে শুরু করেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম, আর তার সঙ্গে মাঝে মাঝেই স্পষ্ট হচ্ছে কপালের মাঝখানের যতিচিহ্ন।
৫
হাই-হিল জুতোয় খটখট শব্দ তুলে, বাঁ-হাতের ওপর আলগাভাবে ফেলে রাখা ফিনফিনে শাড়ির আঁচলটাকে ঠিক করতে করতে দীপাঞ্জনের দিকে একবারও না তাকিয়ে রাগত মুখে বেরিয়ে গেল দেবুর পরমা সুন্দরী, আধুনিকা স্ত্রী পৌলমী। দীপাঞ্জন আসার কিছুক্ষণ পরেই মোবাইল ফোনে কথা বলতে বলতে বেরিয়ে গিয়েছিল দেবুর এমবিএ পড়া সুপুত্র টিনটিন; বাবার ছেলেবেলার বন্ধুকে একটা প্রণাম করা তো দূরে থাক, দু-একটা কথা বলার সৌজন্যও দেখাতে পারেনি বছর কুড়ির সৌম্যদর্শন ছেলেটা। একা একা বসে থাকতে থাকতে দীপাঞ্জনের মনে হল, দেবুর এই তিন কামরার অত্যাধুনিক বিলাসবহুল ফ্ল্যাটটা দামি আসবাবপত্র দিয়ে পরিপাটি করে সাজানো গোছানো হলেও ফ্ল্যাটে বসবাসকারী তিনজন মানুষের সম্পর্কটা খুবই অগোছালো হয়ে গিয়েছে।
একটু পরেই একগাল হেসে শোওয়ার ঘর থেকে বেরিয়ে এল দেবু। টেবিল থেকে একটা কাপ তুলে নিয়ে ঠান্ডা কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, ‘আর বলিস না, ওই যে কথায় আছে না মেয়েদের মন মানুষ তো দূর, ভগবানেও বুঝতে পারে না। এইসব বড়লোকের মেয়েরা প্রেম করার সময় একরকম আর বউ হলে আর একরকম। বউয়ের মন যুগিয়ে চলা যে কী কঠিন, তা এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি।’
গুমোট পরিবেশটাকে হালকা করার জন্য অনিচ্ছাসত্বেও একটু হাসল দীপাঞ্জন।
‘আমার অবস্থা তো বুঝতেই পারছিস, এতো কাজের চাপ, বাড়ির দিকে একটুও নজর দিতে পারি না। তাই পৌলমী আর টিনটিন, ওদের লাইফস্টাইল ওদের মতো করেই সেট করে নিয়েছে। পৌলমীর তাও আমাকে মাঝে মাঝে দরকার পড়ে, এই যেমন আজ একটা ম্যারেজ অ্যানিভার্সারি অ্যাটেন্ড করতে যাবে তাই আমার দরকার পড়েছে। টিনটিনের অবশ্য সেসবের কোনো বালাই নেই, মাসের প্রথমে পকেটমানি-টা ঠিকঠাক পেয়ে গেলেইও খুশি।’ দেবু জবাবদিহি করেই চলেছে। কিন্তু আর কিছুই শুনতে ইচ্ছা করছে না দীপাঞ্জনের।
‘আজ আমি উঠি রে। অনেক দেরি হয়ে গেল, বাড়িতে সবাই অপেক্ষা করছে।’ দেবুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে, তাড়াতাড়ি বেরিয়ে পড়ল দীপাঞ্জন।
সেদিন রাত্রে পাপিয়া আর টুকটুকির সঙ্গে গল্প করতে করতে দীপাঞ্জন অনেকক্ষণ ধরে রুটি, তরকাটি খেল। আজ থেকে আর তাড়াতাড়ি খাওয়া শেষ করে শোওয়ার ঘরে ঢুকে ফেসবুক দেখার প্রয়োজন নেই দীপাঞ্জনের। দরকার নেই কাউকে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠাবার। কারণ, ওদের জীবনও হয়তো দেবুরই মতো গিলটি করা। ভালোবাসাহীন কমদামি সম্পর্কগুলোর ওপর বৈভবের রঙ চড়ানো। পাপিয়ার কেনা ইমিটেশনের গয়নাগুলোর মতো।