• facebook
  • twitter
Wednesday, 27 November, 2024

ভূতের মা

জঙ্গলে ঢুকে পালান অবাক। দেখল গাছে থোকায় থোকায় আম। পেকে লাল হয়ে আছে। সে একটা গাছের অনেকটা উপরে উঠে আমের থোকায় হাত বাড়াতে যাবে, এমন সময় পা পিছলে গেল।

দুপুরে বাড়ির সকলে ঘুমে। পালানের চোখে ঘুম নেই। তার মাথায় একটা চিন্তা ঢুকে আছে। উঠোন থেকেই দেখতে পাওয়া যায় যে বুক ধুকপুক জঙ্গলটা, শুনেছে ওই জঙ্গলে অনেক আম গাছ আছে। আমগুলি মিষ্টি হলেও সেখানে ভয়ে যায় না কেউ। পালান আজ যাবে।

বহুদিন আগে পুলক নামে একটি ছেলে আম পাড়তে গিয়ে পড়ে মারা যায়। ছেলেটির মা সেদিন আছাড়ি পিছাড়ি কেঁদেছিল।
তাই নিয়ে এলাকায় কিছুদিন শোক ছিল। তারপর থেকে ওই বাগানে কেউ গেলে সে যখন ফিরে আসে, তখন সমস্ত শরীরে নোখের আঁচড়ের দাগ। আর সুস্থ হয় না। বিছানায় শুয়ে থাকে। দারোয়ান কবেই পালিয়েছে। বাগানের মালিকও যেতে ভয় পায়। ভয়ে কেউ আর ওই বাগানের ধারে কাছে যায়নি।

একজন খুব সাহস করে গিয়েছিল। তার নাকে একটা পাকা আম এসে এমন করে ফাটল যে নাকটা চ্যাপ্টা হয়ে গেল। এই শুনে কেউ আর বাগানমুখো হয়নি।

বাবা মাকে হারিয়ে পালান যখন অসহায়, কাকা, জেঠা কেউ খেতে পর্যন্ত দেয় না, তখন মামা নিয়ে এসেছিল। সেখানে কয়েকমাস মামীর হাতে মার খেয়ে এখন এসেছে মামার এক বন্ধুর বাড়ি। সেই বাড়িতে কাজকর্ম করছে। মামা মাসে একবার এসে মাইনে নিয়ে যায়। বলে, ‘ভালো করে কাজ কর অনেক মাইনে দেবে। উন্নতি করবি।’

মাইনের টাকা মামা নিলে তার উন্নতিটা কেমন করে হবে? তা বুঝতে পারে না। পালানের মনে হয় বাবা, মা না থাকাটা খুব দুঃখের। সেও যদি না থাকে তবে তাকে আর দুঃখ পেতে হবে না।

তাই পালান ঠিক করেছে আজ সে বুক ধুকপুক জঙ্গলে যাবেই। এখানে সে যেভাবে ভূতের খাটনি খাটে, তাতে যদি তাকে জঙ্গলের ভূত মেরেই ফেলে, তবে সে মরে গিয়ে বেঁচে যাবে। ভূত কিছু করার আগে যদি কয়েকটা আম খেতে পারে তাতেই জীবন সার্থক। বাবা, মা চলে যাওয়ার পর সে আর আস্ত আম খায়নি।

জঙ্গলে ঢুকে পালান অবাক। দেখল গাছে থোকায় থোকায় আম। পেকে লাল হয়ে আছে। সে একটা গাছের অনেকটা উপরে উঠে আমের থোকায় হাত বাড়াতে যাবে, এমন সময় পা পিছলে গেল। নিচের দিকে পড়তে পড়তে তার মনে হল কেউ যেন তাকে আবার উপরের দিকে ঠেলে তুলছে। তুলে একটা গাছের ডালে আরাম করে বসিয়ে দিল।

খুব অবাক হল পালান। এতক্ষণে তার হাত বা পা ভেঙ্গে নিচে পড়ে থাকার কথা! বেশি কিছু ভাববার আগেই পালান দেখল তার মতো বারো তেরো বছরের একটি ছেলে মুখোমুখি বসে আছে।

পালান ভয়ে ভয়ে বলল, ‘তুমি কে?’
‘আমি পুলক। এখানে আম পাড়তে এসে ডাল ভেঙে অক্কা পেয়েছিলাম।’
পালান ভয়ে চমকে গাছ থেকে আবার পড়ে যাচ্ছিল।

পুলক বলল, ‘আমাকে ভয় পেও না। আজ থেকে আমরা বন্ধু।’
পালান বলল, ‘বন্ধু হবে কী করে? আমিও কি তোমার মতো মরে ভূত হলাম?’ একটু মনখারাপ করে বলল, ‘অবশ্য মরে গেলেও আমার কোনো দুঃখ নেই।’

‘আমি তোমাকে মরতে দিইনি, আমার মায়ের কথা ভেবে। মা কত কষ্টে দিন কাটায়। খুব ভাবে আমার কথা।’
‘তোমার মা এখন কী করে?’

‘মাকে আমি আম পাঠাই। মা তাতে ভয় পায়। তবু কিছু খেয়ে বাঁচতে হবে, তাই সেগুলি নিয়ে বাজারে বিক্রি করে। বাজারে লোকজন জানতে চায় এত ভালো আম পেল কোথায়। এটা খুব সমস্যা। মা কিছু বলতে পারে না।’

পুলক একটা আম দিল পালানকে। বলল, ‘এটা খাও। আরও দিতে পারতাম কিন্তু দেব না। যে বাড়িতে তুমি কাজ কর তুমি এই জঙ্গলে এসেছ জানতে পারলে তোমাকে মামার বাড়িতে পাঠিয়ে দেবে। সেখানে আগে তোমাকে মামী মারত এখন মামাও মারবে।’

‘মোটেই না। মামা আমাকে খুব ভালোবাসে।’

‘তবে নিজের কাছে না রেখে বন্ধুর বাড়িতে কাজে পাঠাল কেন? তোমার পরিশ্রমের টাকা তোমাকে না দিয়ে কেন মামা নিয়ে যায়? তোমাকে ভালো করে কাজ করতে বলে কেন? এভাবে তোমার কি উন্নতি হবে?’
পালান আম খাচ্ছে আর পুলকের কথা শুনছে। বলল, ‘তুমি এত কথা জানলে কী করে?’

‘আগে জানতাম না। আমি এখন ভূত, তাই সব জানতে পারি। আমি তোমাকে আমার বাড়িতে নিয়ে যাব। তোমার আর আমার মায়ের দু’জনেরই আপন কেউ নেই। তুমি মায়ের সঙ্গে থাকবে তার ছেলে হয়ে। আমার খেলনা, ছবির বই এখন থেকে সব তোমার। এবার আমার মা যেমন একজন ছেলে পাবে তেমন তুমিও মা পাবে।

আমি আর কোনোদিন মায়ের কাছে ছেলে হয়ে ফিরতে পারব না। তুমি আমার মায়ের কাছে থাকবে। আমি প্রচুর আম পাঠাব। তুমি তাই দিয়ে বড় ব্যবসা করবে। লেখাপড়া করে বড় হবে। আমার মাকে দু’বেলা খেতে দেবে।’

পালানের হাত ধরে প্রায় হাওয়ায় ভেসে যাবার মতো হাঁটতে হাঁটতে পুলক বলল, ‘একজন ভুতের মাকে, নিজের মা ভাবতে পারবে না তুমি?’