• facebook
  • twitter
Monday, 6 January, 2025

গণেশের সাহস

আলোটা ক্রমশ টানছে ওকে নিজের দিকে। নিজের কৌতহল আর আটকে রাখতে পারলো না ও। পা বাড়ালো ওই আলোর রেখা লক্ষ্য করে। জঙ্গলে ঢুকে কিছুটা পথ এগোতেই গণেশ দেখলো একটা কুঁড়েঘর।

অঙ্কিত চিত্র

জয়দীপ রায়

এমনিতেই বেশ ভীতু গোছের লোক গণেশ। তার উপর রাত বারোটায় একা একা বাড়ি ফেরা, এ যেন গোদের উপর বিষফোঁড়া। মধ্যমগ্রামে সে গিয়েছিলো একটা নেমন্তন্ন খেতে। ভেবেছিলো সন্ধ্যার মধ্যে নেমন্তন্নের পাট চুকিয়ে বাড়ি ফিরে আসবে। তবে বাধ সাজলো আকাশ। সন্ধ্যার পর থেকে উঠলো ঝোড়ো হাওয়া, দেখতে সেই ঝোড়ো হাওয়া কালবৈশাখীতে পরিণত হলো। অগত্যা, ঝড় যখন থামলো তখন নেমন্তন্ন বাড়ির একটা পেটা ঘড়িতে ঢং ঢং করে বারোটার ঘন্টা বাজছিলো। তারপর আর কী, ‘রাম রাম’ নাম নিয়ে পথে নামলো গণেশ। তার বাড়ি দেবলগ্রামে। এখানে থেকে ৭ কিলোমিটার মেঠো পথ। গণেশের সাইকেল নেই। এতটা রাস্তা এই অন্ধকারে হেঁটেই যেতে হবে তাকে।

‘রাম রাম’ নাম জপ করতে করতে বেশ গতিতে পা চালালো সে। গণেশের আবার ভূতে বেশ ভয়। বেশি রাতে একা একা কোথাও যায় না সে। তবে আজ বেশ ফ্যাসাদে পড়েছে। জনমানবহীন শূন্য মেঠো পথ। একটা লোকেরও দেখা নেই। টুপ্ টাপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বেশ গা ছমছমে ব্যাপার। গণেশ হাঁটার গতি আরো অনেকটা বাড়িয়ে দিলো।

কিছুক্ষণ পর সে এসে পৌঁছলো রক্তকালীর মাঠে। এই মাঠ পেরোলে ডাবগ্রাম, আর তারপরেই দেবলগ্রাম। মাঠটা বেশ চওড়া। মাঠের একপাশে ঘন জঙ্গল, শেষ প্রান্তে একটা কালীমন্দির আছে। বহুকাল আগে এখানে নাকি নরবলি হতো। তাই মাঠটার নাম রক্তকালীর মাঠ। টুপ্ টাপ বৃষ্টিটা থেমে গেছে। আকাশের মেঘও বেশ কিছুটা সরে গিয়েছে। ঝিঁঝিঁ ডাকছে চারপাশে। মাঠে প্রবেশ করেই গণেশের শরীরটা কেমন একটু বেশ ছমছম করে উঠলো। আশপাশ একটু তাকিয়ে নিলো গণেশ। হঠাৎ তার চোখ আটকে গেলো জঙ্গলের ভেতর একটা জায়গায়। ঘন কালো অন্ধকারের ভেতর থেকে যেন হালকা আলোর শিখা দেখা যাচ্ছে না! হ্যাঁ তাই তো। খুব ক্ষীণ। গণেশের চোখ খুব ভালো। অন্ধকারেও যে কোনো কিছু খুব ভালো করে ঠাহর করতে পারে। তবে জঙ্গলের গাছপালার ভেতর ঠিক কোথা থেকে আলোটা আসছে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তবে একটা আলোর রেখা রয়েছে। সে অনেকটা রাস্তা ওদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে হাঁটলো। গণেশ খুব ভীতু হলেও ওর খুব কৌতূহল হতে লাগলো। জঙ্গলে কী রয়েছে। কেউ কি থাকে জঙ্গলের ভেতর। গণেশ দাঁড়িয়ে পড়লো।

আলোটা ক্রমশ টানছে ওকে নিজের দিকে। নিজের কৌতহল আর আটকে রাখতে পারলো না ও। পা বাড়ালো ওই আলোর রেখা লক্ষ্য করে। জঙ্গলে ঢুকে কিছুটা পথ এগোতেই গণেশ দেখলো একটা কুঁড়েঘর। এই জঙ্গলে কে থাকতে পারে? অতি সন্তর্পণে পা টিপে টিপে গণেশ কুঁড়েঘরটার কাছে পৌঁছলো। দরজা বন্ধ। জানালাও। ঘরের বেতের বেড়ার একটা জায়গা অল্প ভেঙে গিয়েছে। সেদিক দিয়েই উঁকি দিলো গণেশ। আর উঁকি দিতেই সারা শরীর দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেলো ওর। ঘরের ভেতর টিমটিমে একটা হ্যারিকেন জ্বলছে। তার ক্ষীণ আলোয় গণেশ দেখতে পেল, মেঝেতে গোল হয়ে বসে গল্প করছে তিন-তিনটে কঙ্কাল। খুব আস্তে নিজেদের মধ্যে কিছু বলাবলি করছে ওরা। এই দেখে ভয়ে গণেশের প্রাণ যেন বেরিয়ে যায়-যায় অবস্থা। কোনোদিকে না তাকিয়ে সে প্রাণপণে এক ছুট লাগলো। সব গুলিয়ে গেলো তার কোন দিক থেকে কোন দিকে ছুটছে সে নিজেও জানে না। দুবার তিনবার গাছে ধাক্কা খেয়ে মাটিতে পড়ে গেলো ও। চটিজোড়া কোথায় হারালো কোনো খেয়াল নেই। শুধু ছুটছেই আর দরদর করে ঘামছে। দিকবিদিকশূন্য হয়ে ও যে কোথায় ছুটে চলছে ও নিজেও জানে না। খালি ওর মনে হচ্ছে কঙ্কালগুলোও যেন ওর পেছন পেছন আসছে। মাথা ঘুরিয়ে দেখা অবকাশ নেই। হঠাৎ কার সঙ্গে যেন জোর ধাক্কা খেলো গণেশ। মাটিতে লুটিয়ে পড়তেই কে যেন তার উপর ঝুঁকে পড়লো। কে যেন বলছে, ক্যা হুয়া? ক্যা হুয়া! গণেশ ‘ভূত ভূত, জঙ্গলের ওই ঘরে ভুত আছে, কঙ্কাল কঙ্কাল’, বলতে বলতেই অজ্ঞান হয়ে গেলো।

গণেশের যখন জ্ঞান ফিরলো, দেখলো সে পুলিশ স্টেশনে একটা বেঞ্চিতে শুয়ে আছে। তাকে জাগতে দেখেই দারোগা এসে তার সামনে দাঁড়ালো। তারপর উচ্চ স্বরে বলে উঠলো, আরে সাবাস ভাই, সাবাস। কী করেছো তুমি। তোমার জন্যই আমি এবার প্রমোশন পাবো। চোখ খুলেই এমন কিছুর জন্য উপস্থিত ছিল না গণেশ। কিছু বুঝতে না পেরে ও শুধু হাঁ করে চেয়ে রইলো। হলোটা কী?

দারোগা আবার বললো, তোমার জন্যই রঘু ডাকাত ধরা পড়েছে। সাবাস!
কী হচ্ছে, দারোগা কী বলছে কিছুই বুঝতে পারছিলো না গণেশ। ও তো কাল রাতে ওই ঘরের ভেতর কঙ্কাল দেখে ভয়ে দৌড়োলো। তারপর কার সঙ্গে যেন জোর ধাক্কা খেলে। উফফ মাথাটা এখনো ফুলে আছে। আর কিছুই মনে নেই।

দারোগা তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে পুলিশ স্টেশনের কারাগারে তিনজনকে দেখালো। গণেশ দেখলো তিনজন গোল হয়ে মাথা নিচু করে বসে আছে। তারপর দারোগা পাশের টেবিলে রাখা সাদা-কালো ডোরাকাটা কঙ্কালের মতো জামা দেখিয়ে বললো, এটা দেখেই কাল রাত্রে তুমি ভয় পেয়েছিলে। এরা আসলে কঙ্কাল নয়। এরা কুখ্যাত ডাকাত। কঙ্কালের জামা পরে মানুষকে ভয় দেখিয়ে ডাকাতি করতো। আর ডাকাতি করে জঙ্গলের ভেতর ঢুকে যেত। গ্রামের শেষ সীমানায় জঙ্গলের ভেতর থাকতো বলে কেউ ওদের হদিস জানতো না। রাতে ও পথ দিয়ে কেউ যাতায়াত খুব একটা করে না। করলেও জঙ্গলের ভেতর থাকতো বলে ভয়ে কেউ ওদিকে যেত না। আসলে ওখানে এরাই ভূতের ভয় ছড়িয়ে রেখেছিলো। ভাগ্যিস তুমি সাহস দেখিয়ে জঙ্গলের ভেতর এদের আস্তানার কাছে গিয়েছিলে। তোমায় দৌড়ে আসতে দেখেছিলো আমাদের ওই এক সেপাই। সে তখন গ্রামের আসে-পাশে পাহারা দিচ্ছিলো। অজ্ঞান হবার আগে তুমি যা বলছিলে, সেসব সেপাইয়ের মুখে আমি শুনি। শুনেই আমার সন্দেহ হয়। জঙ্গলের ভেতর কঙ্কাল ঘরের ভেতর বসে থাকতে যাবে কেন?

রাতেই আমরা গিয়ে এদের পাকড়াও করি। এদের কাছ থেকে ৩০ ভরি সোনার গয়না আর অনেক কাঁসা-পেতলের বাসন উদ্ধার হয়েছে। অনেকদিন ধরে এদের খুঁজছিলাম আমরা। কিন্তু হদিস পাচ্ছিলাম না। তোমার জন্যই ধরতে পেরেছি ওদের। সাবাস!

এই বলে গণেশের পিঠ চাপড়ে দিলো দারোগা। এবার গণেশের কাছে সব পরিষ্কার হলো। নিজের অজান্তেই অনেক বড়ো সাহসীর কাজ করে ফেলেছে সে। দারোগা আবার বললো, তোমাকে সরকারের কাছ থেকে মেডেল পাইয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবো আমি।
গণেশের মুখে একটা চওড়া হাসি খেলে গেলো।