রসিক রবীন্দ্রনাথ

হাননান আহসান

ভাণ্ডারের আধুলি
শান্তিনিকেতনে নতুন একজন ছাত্রের আগমন ঘটেছে৷ এসেছে আশ্রমিক পরিবেশে শিক্ষালাভের উদ্দেশ্য নিয়ে৷ কবিগুরুর সঙ্গে তার তখনো পরিচয় হয়নি৷ অন্যান্য পড়ুয়া ছেলেদের সঙ্গে সে থাকে৷ নতুন হলেও তার দৌরাত্ম্য শুরু হতে বেশিদিন লাগেনি৷ চনমনে ছটফটে আর সহপাঠীদের পেছনে লাগায় তার জুড়ি ছিল না৷
আল্লখাল্লা পরিহিত, মাথায় টুপি লাগিয়ে কবিগুরু একদিন শান্তিনিকেতনের রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন৷ ভাণ্ডারে তাঁকে দেখে একছুটে তাঁর হাতে একটা আধুলি মানে আট আনা দিয়ে এলো৷ অন্য ছেলেরা ভাণ্ডারেকে ঘিরে ধরে জানতে চাইলো যে, সে কী দিয়ে এলো কবিগুরুকে৷ ভাণ্ডারে জানালো সে ফকিরকে পয়সা দিয়ে এসেছে৷ আরো জানালো মায়ের কাছে সে শুনেছে যে, ফকিরকে দান করলে প্যণ্যিলাভ হয়৷ আর সহপাঠীদেরকে ধমকে বলে দিল, উনি কবিগুরু হতে যাবেন কেন৷ সহপাঠীরা তার কথা শুনে বিষ্ময়ে হতবাক হয়ে গেল৷
এদিকে দিনদিন ভাণ্ডারের দৌরাত্ম্য বাড়তে থাকায় রবীন্দ্রনাথের কাছে নালিশ পৌঁছলো৷ ডাক পড়লো ভাণ্ডারের৷ কবিগুরু তাকে বললেন, ‘তুই কতো ভালো ছেলে বাবা৷ আমাকে একবার একটা আধুলি দিয়েছিলিস৷ কেউ তো আমাকে কখনো টাকা-পয়সা দেয় না৷ তুই ভালো ছেলে বলেই দিয়েছিস৷ আর ভালো ছেলেরা কখনো দুষ্টুমি করেনা৷ এরপর ভাণ্ডারের বদমায়েশি কিছুটা কমেছিল৷

নেপাল রায়ের দণ্ড
নেপাল রায় শান্তিনিকেতনে পড়াতেন৷ কৃতী অধ্যাপক ছিলেন৷ কবিগুরিও তাঁকে খুব পছন্দ করতেন৷ নেপালবাবুও কখনো কখনো কবিগুরুর বাসায় গিয়ে গল্পগুজব করে আসতেন৷ অকস্মাৎ একটা ছন্দপতন ঘটলো, রবীন্দ্রনাথ তাঁকে পত্রে জানালেন,’আপনি আজকাল কাজে অত্যন্ত ভুল করছেন৷ এটা খুবই গর্হিত অপরাধ৷ এজন্য কাল বিকালে আমার বাড়িতে এসে আপনার দণ্ড নিতে হবে৷’
চিঠি পেয়ে নেপালবাবুর মনের অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে উঠলো৷ কিছুতেই বুঝে উঠতে পারলেন না, কী এমন কাজ করেছেন যে দণ্ড নিতে হবে৷ সারারাত ঘুমোতে পারলেন না৷ সক্কালবেলায় দৌড়লেন গুরুদেবের বাসায়৷ চোখে-মুখে উদ্বেগ৷ তটস্থ হয়ে বসার ঘরে ঢুকলেন৷
একটু পরে মোটা একটা লাঠি হাতে গুরুদেব প্রবেশ করলেন৷ নেপালবাবু আরো সিঁটিয়ে গেলেন এই ভেবে যে হয়তো লাঠির ঘা খেতে হবে এবার৷ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে আশ্বস্ত করে বললেন, ‘এই নিন আপনার দণ্ড সেদিন যে আমার বাড়িতে এসে ফেলে গেছেন, তা একদম ভুলে বসে আছেন৷’


গান্ধীজির বিষ
রবীন্দ্রনাথ ও গান্ধীজি একে অপরকে পছন্দ করতেন৷ নানা জায়গায় তাঁদের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে৷ একবার সকালে কবিগুরু প্রাতঃরাশ খাবেন৷ সঙ্গে রয়েছেন গান্ধীজি৷ দুজনের জন্য পছন্দের খাবারের ব্যবস্থা হলো৷ রবীন্দ্রনাথ নিলেন গরম গরম লুচি৷ তাঁর পছন্দের পদ এটি৷ কিন্ত্ত গান্ধীজি এসব লুচিটুচি একেবারে পছন্দ করতেন না৷ তিনি নিলেন ওটসের পরিজ৷ দুজনই তৃপ্তির সঙ্গে খাচ্ছেন আর গল্প করছেন৷

গান্ধীজি বললেন, ‘গুরুদেব, তুমি জানো না যে তুমি বিষ খাচ্ছ৷’ রবীন্দ্রনাথ হাসলেন তারপর স্বভাবসুলভ রসিকতায় জানালেন, ‘মহাত্মাজি, ঠিকই বলেছেন৷ বিষই খাচ্ছি৷ তবে এই বিষ খুব ধীরে ধীরে কাজ করে৷ এই দেখুন না, গত ৬০ বছর ধরেই আপনার এই বিষ খেয়েই বেঁচে রয়েছি’৷ দুজন এরপর হো হো করে হেসে উঠলেন৷