বোবা নক্ষত্রের দ্বীপভূমিতে পায়ের ছাপ, মরা কচ্ছপ

সৈয়দ হাসমত জালাল

কবি ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না প্রায় তিন দশক ধরে কবিতা লিখছেন। ইন্দ্রাণীর কবিতার পাঠক বুঝতে পারেন, খুব সচেতনভাবে অথচ অনায়াস নৈপুণ্যে তার পাশের চেনা জীবন ও জগৎকে বেশ খানিকটা অন্যভাবে, স্বনির্মিত চিত্রকল্পে, তুলে ধরেন তিনি। এ বছর জানুয়ারিতে কলকাতা বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে তাঁর একটি শীর্ণ কবিতাগ্রন্থ ‘নির্জনতার লিথোগ্রাফ’। মাত্র দু’ফর্মার বইটিতে রয়েছে আঠাশটি মাত্র কবিতা। কিন্তু সব মিলিয়ে একটি অসামান্য ব্যাপ্তি তৈরি করেছেন ইন্দ্রাণী তাঁর অত্যন্ত সংবেদনশীল, সচেতন নির্মাণের মধ্যে।

তাঁর কবিতায় যেমন রয়েছে সময়ের ক্ষতচিহ্ন, তেমনি জড়িয়ে আছে একজন নারীর, একজন কবির, একজন মানুষের অস্তিত্ব, বেদনা, নির্জনতা এবং চিৎকারও। এই ঘাতক সময়কে চিহ্নিত করেন ইন্দ্রাণী— ‘দশ আঙুলে হত্যার নিশপিশ নিয়ে / সারারাত বসে থাকি নিরীহ মানুষ।’ আর ‘নিভন্ত আগুনে শুকনো পাতা দিতে দিতে / কবিতার ভাষা বদলে যাচ্ছে, বদলে যাচ্ছে সমস্ত সংকেত / ধুলোবালি কাঁকরের মতো গুঁড়িয়ে যাচ্ছি…’। (ঘাতকের জন্ম)


ইন্দ্রাণীর এই গ্রন্থের প্রতিটি কবিতাতেই কোনো-না-কোনোভাবে ফুটে আাছে এক ধরনের বিপন্নতা, যাকে আমরা আমাদের দিন, রাত্রি এবং জীবনযাপনে অনুভব করতে থাকি। কিন্তু তাকে খানিকটা সচেতনভাবেই হয়তো এড়িয়ে চলতে চাই। কিন্তু এড়িয়ে যাননি ইন্দ্রাণী। তাই ‘যক’ কবিতায় তিনি লেখেন— ‘তাড়াতাড়ি করে তুলে আনছি শুকনো জামা / লণ্ঠনের কাচ থেকে তুলে ফেলছি জড়ুল চিহ্ন / কলসিতে ভরে রাখছি কাঠফাটা তেষ্টা…।’ ‘মাংসাশী’ কবিতায় তিনি লেখেন— ‘চারটে কলসপত্রী দেয়াল ঘিরে ধরেছে / তারা গিলে নিচ্ছে ধীরে আর পড়ে থাকছে খোলসখানা।’ আমাদের অমনস্ক দৈনন্দিনতার মধ্যে যে ঘাতক সময় লুকিয়ে পড়ে, তাকেও ভিন্নভাবে তুলে এনেছেন তিনি, ওই একই কবিতায়— ‘ভোরবেলায় ধূমকেতু কয়েক হাজার বছর / পার করে এসে নতুন পৃথিবী চিনতে পারল না / আমরাই কি চিনতে পেরেছিলাম হাসিখুশি পড়শিকে? / মেঘের ছায়া ধরে রাখা জল আর ততটা সরল নয়, / কখন বসার ঘর সাজিয়ে নিয়েছি বিষাক্ত টবের গাছে!’

‘হাতঘড়িরা কতটা বিশ্বাসী’ কবিতায় গোপন বেদনা জড়িত অতীত-স্মৃতিকে ভিন্ন এক ফর্মে এবং কিছুটা কথা বলে যাওয়ার মতো সাবলীলতায় ফুটিয়ে তুলেছেন কবি— ‘কাল যখন শেষ রাত (যা কখনো ঘড়ি নয়, শরীরই বলে) / একটা স্বপ্নের মধ্যে দেখলাম মা-র জার্মান মেক একরত্তি ঘড়িটা। / দশটা দশ নয় তাতে আটটা কুড়ি দেখাচ্ছিল।’ কিংবা ‘আমার প্রথম প্রেমিকের ফেরৎ চেয়ে নেওয়া ঘড়ি— / আমি সময়কে যা বলার তা বলে ফেলার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি।’

ইন্দ্রাণীর নিজের একটা বিশ্বাসের জগৎ আছে, যা শিল্পময় এবং সংবেদনশীল। কিন্তু বাস্তব জগৎ তো সবসময় তার সঙ্গে মেলে না। আর তাই এরকম অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়— ‘ছুটে চলেছি আমার বিভিন্ন জন্ম থেকে চুল্লির কমলা সন্ত্রাস থেকে / পালাতে চাইছি ভোট মাফিয়ার থাবা থেকে আর রাষ্ট্রীয় ধান্দাবাজি থেকে / উপত্যকার পাহাড়ি পথে ওঁৎ পেতে থাকা শাঁখের করাত থেকে / ভালোবাসাহীন লম্বা রাত থেকে ছিটকে এসে বসে থাকি একলা চাঁদের পাশে’। এই ‘আমি’ শেষ পর্যন্ত হয়ে ওঠে আরও অনেক ‘আমি’র কথা। তবুও শেষে জেগে থাকে এক গভীর সংশয়। এই ‘সময়ের বিতংসসমূহ’ থেকে সরে যেতে চাওয়া মানুষ কি সত্যিই বাস্তবে এসব করে, নাকি এ তার বিপন্ন আকাঙ্ক্ষার ভেতর থেকে উঠে আসা স্বপ্নের ছবি! (এইসব বিভাবতী)। কোথাও কি টাল খায় বিশ্বাস! কবি মনে করেন, ‘গানের একটা ধর্ম আছে না!’ কিন্তু পরক্ষণেই তাঁর মনে হয়— ‘ধর্মের নাম সংগীত হলে অথবা কাব্য হলেও নষ্টামি চলতো? / মানুষকে বিশ্বাস কী!’ (একদিন শৈব দুপুরে)।

ইন্দ্রাণীর কবিতায় একটি পরাবাস্তব জগৎ আছে। আছে প্রকৃতিকে ছুঁয়ে ছড়িয়ে পড়া একান্ত নিজস্ব সংবেদনও। ‘কোথায় যেতে পারে’ কবিতায় তাই দেখি— ‘এখন মাছের ঘাই-এর সাথে ভেসে ওঠে চাঁদের আঘাত চিহ্ন, / ভালো মন্দ শব্দেরা বুড়বুড়ি তোলে আর দৈববাণীর জন্ম হয়।’ আর এসবের মধ্যে থেকে উঠে আসে এক চিরন্তন, নির্জন বেদনাসংগীত— ‘জল থেকে জলে, আকাশ থেকে আকাশে আর ঘাস থেকে ঘাসে, / পাঁজর থেকে পাঁজরে জ্যোৎস্না গলে গলে মিশে যাচ্ছে। / একটা ‘ভুলে বিসরে গীত’ বাজছে বহুদূরের নির্জন দুপুরে।’

ইন্দ্রাণীর কবিতা পড়তে পড়তে কখন অজান্তেই তাঁর কবিতার ‘আমি’ একসময় ‘আমরা’ হয়ে ওঠে। আসলে এ শুধুই কবির ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা হয়ে থাকে না, একসময় কখন তা হয়ে ওঠে পাঠকেরও অভিজ্ঞতা। ‘চিৎকার ১’ কবিতায় তিনি বলেন, ‘খুব চিৎকার করি কিন্তু শব্দ পৌঁছয় না কোথাও।’ কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘আমার শীর্ণ অস্তিত্ব ধনুকের মতো বেঁকে যায় / আমার চিৎকার তির হয়ে ছুটতে থাকে—’। এখানেই নিঃশব্দ চিৎকার হয়ে ওঠে সুতীব্র প্রতিবাদ। ইন্দ্রাণীর কবিতায় বিভিন্নভাবে উঠে এসেছে সমাজ, রাষ্ট্র— কিন্তু তা বাহ্যত প্রকট নয়, বরং একজন মানুষের জীবনে সেসবের ঘাত, প্রতিঘাত এবং প্রতিক্রিয়াই উঠে এসেছে কবিতা হয়ে। তাঁর নির্মিত কিছু কিছু চিত্রকল্প পাঠককে একই সঙ্গে আক্রমণ করে, আবার মুগ্ধও করে। কোথাও কোথাও নিঃশব্দে ঢুকে পড়ে জাদুবাস্তবতাও। ‘বিকেলে বেড়াতে গিয়ে’ কবিতাটির শুরু হয় এভাবে— ‘গর্ভ ছিঁড়ে বের করে আনা শিশুদের নিয়ে / এক বিশাল রূপকথা পার্কে বেড়াতে আসি নরম বিকেলে / স্তব্ধ মেঘ ফেটে গর্ভজলের হড়পা বান এলে শিশুরা বিষাদ ধ্বনি করে।’ তাঁর প্রতিটি কবিতা থেকেই এরকম সব পঙক্তি উদ্ধৃত করা হয়। ‘লিথোগ্রাফ’ কবিতায় তিনি এরকম ছবি আঁকেন— ‘একটি জমাট পাথুরে সন্ধেরাত / আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত প্রহর / আর বোবা নক্ষত্রের দ্বীপভূমিতে পায়ের ছাপ, মরা কচ্ছপ।’ ইন্দ্রাণীর কবিতার এই জগৎ পাঠককে আক্রান্ত করে, আবিষ্ট করে।
নির্জনতার লিথোগ্রাফ। ইন্দ্রাণী দত্ত পান্না। লুব্ধক প্রকাশন। প্রচ্ছদ: শমীক দত্ত। মূল্য: ৭০ টাকা