ফেস্টুন

কাল্পনিক চিত্র

অয়ন চৌধুরী

ছেলেটা দৌড়াচ্ছে। পাটের ফেঁসোর মতো চুলটা হাওয়ায় দুলছে কিছুটা। গত চোদ্দ দিন ওর কাজ নেই। ঘরে বসে আছে। ঘরে অসুস্থ বউ। হাঁপানির টান ওঠে। প্রশান্তর দোকান থেকে দু’টাকা দামের ট্যাবলেটগুলো কিনে আনে কাজ থেকে ফেরার পথে। সন্ধের দিকে বিড়ি খেতে খেতে মোড়ের দিকে যায়। নানারকম খবর শোনে এর ওর মুখে। বাতাসে রোগ উড়ছে। পুলিশ ঠেঙিয়ে ঘরে ঢোকাচ্ছে লোককে। ঘরে থাকাই নাকি এর ওষুধ। অবাক লাগে মনোজের। মনে মনে ভাবে শিবানীর এরকম একটা রোগ হলেই পারত, তাহলে তো সারাদিন ঘরে থেকেই সুস্থ হয়ে যেত ও। শিবানীর জন্য কষ্ট হয় ওর।

এখন মনোজ ছুটছে গোলাপবাগান মাঠের দিকে ওখানে নাকি সকাল ন’টায় চাল-আলু দেবে। সরকারের লোক আসবে। কাল মোড়ের মাথায় শুনেছে ও। ওর ভয় হল ও লাইনের অনেক পিছনে পড়ে যাবে। ও মাঠে পৌঁছে দেখল লোকে লোকারণ্য। একটা মঞ্চ বেঁধে সেখান থেকে নেতামানুষরা সরকারের ছবি দেওয়া প্যাকেটে চাল আলু দিচ্ছে। চোখটা জ্বলজ্বল করে ওঠে মনোজের। গত দু’দিন আগেই ঘরে চাল ফুরিয়েছে। হাতে পয়সা নেই গত চোদ্দ দিন। চিড়ে-মুড়ি খেয়েছে শেষ দু’দিন। কিছুজনকে দেওয়া হয়েছে চাল-আলু। ও লক্ষ করল তার ছবিও উঠছে অনেক।


হঠাৎ মাইকে ঘোষণা করছে আজকের মতো চাল-আলু শেষ। আবার কাল দেওয়া হবে। মনোজের নিজের উপর রাগ হয়। আরও অনেক আগে এলে ও পেত হয়তো। অথচ ও দেখতে পাচ্ছে একটা লরিতে বোঝাই চাল-আলুর বস্তা। দুটো বছর তিরিশের ছেলে কী যেন বোঝাচ্ছে। মনে হল বলছে মালগুলো কোথাও একটা নিয়ে যেতে। কত লোক এই খাবারটুকুর আশায় এসেছিল। তারা নিচুমুখে ফিরে যাচ্ছে। বৃদ্ধ মানুষগুলোর জামা ঘামে ভিজে সপসপে হয়ে গেছে। একজন বৃদ্ধার দিকে তাকায় মনোজ। শরীরটা ঝুঁকে গেছে বয়সের ভারে। পরনে কতদিনের একটা কাপড়। হাতে লাঠি নিয়ে হাঁটছে। চোখে একটা চশমা। সম্ভবত স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার বিনাব্যয়ে চক্ষুপরীক্ষা শিবির থেকে পেয়েছে। মনোজের এরকম ধীর পায়ে শামুকের মতো চলা মানুষগুলোকে দেখে নিজের কষ্ট, শিবানীর কষ্ট ভুলে যেতে ইচ্ছে করে। মনোজ যেন দাঁড়িয়ে পড়ে কয়েক মুহূর্ত। ধমক লাগায় ওই ছেলে দুটো — ‘ওই এখানে কী আছে? বলা হল না যে আজ আর হবে না, মাল শেষ। টাইমে আসবি না, এখন এখানে দাঁড়িয়ে আছিস কেন?’ মনোজ সরে যায়।

রাস্তায় লোক নেই। দোকানগুলো সব বন্ধ। আজ কিছুটা চাল পেলে খুব ভাল হত। শিবানীর শরীর ভাল না। ও একটু গরম ভাত পেলে গায়ে লাগত। বাড়ি ফিরে আসে মনোজ। স্নান করে। শিবানীকে জানায় এত লোক যে ও যাওয়ার আগেই মাল শেষ হয়ে গেছে। কাল আবার আগাম যেতে হবে। মুড়ি জলে ভিজিয়ে খায় ওরা। শুকনো মুড়ি শিবানী গিলতে পারে না। পথঘাট শুনশান। মাইকে কী যেন প্রচার হচ্ছে আর দু’একবার পুলিশের গাড়ি যাওয়া আসা করছে। সেদিন সারারাত মনোজ ঘুমোতে পারল না। খুব সকালে ওকে যেতেই হবে। চাল-আলু পেলেই হবে। একটু গরম ভাত ফুটিয়ে খেতে পারবে লবণ আর কাঁচালঙ্কা দিয়ে। সারারাত ধরে মনোজ অপেক্ষা করতে থাকে ভোর হওয়ার।


আজ তিনদিন হয়ে গেল মনোজ রোজ গোলাপবাগান মাঠ থেকে ফিরে আসছে। রোজই ও পিছনে পড়ে যায়। আর মাল শেষ হয়ে গেলে লরি বোঝাই করে চাল আলুর বস্তা কোথায় যেন চলে যাচ্ছে। একটা সাদা গাড়িতে করে নেতামানুষও ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। পিছনে বাইকে যায় জনা দশেক ছেলে যারা আসলে সমস্তটা সামলায়। মনোজ কিছুতেই বুঝতে পারে না পুরো ব্যাপারটা। জট পাকিয়ে যায় ওর মাথায়। কেন রোজ ও পিছনে পড়ে যায়। কত মানুষ চাল না পেয়ে ফিরে যায়। ও বুঝতে পারে এই মানুষগুলোও ঠিক তারই মতো অসহায় হয়ে পড়েছে এই দুর্দিনে। কেউ কি ভেবেছিল এরকম একটা দিন আসতে পারে যখন মানুষের সঙ্গে মানুষের দেখা করাই সবচেয়ে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে? আকাশের দিকে তাকিয়ে কিছু একটা ভাবতে চেষ্টা করে মনোজ। কিছু ভেবে পায় না। একটা গভীর দীর্ঘশ্বাস ভিতর থেকে উঠে আসে। এর আগে রাস্তাঘাট এত শুনশান কোনোদিন দেখেনি ও। ভয়টা এবার শিকড়বাকড় নিয়ে মনের মধ্যে যেন আরও এঁটে বসছে। খেটে খাওয়া মানুষগুলোর জীবনে যেমন যেকোনো দুর্যোগই হঠাৎ আছড়ে পড়ে সেরকমই এই রোগও সবচেয়ে বেশি অসহায় করে দিয়েছে তাদেরই। সামান্য টাকাও অবশিষ্ট নেই মনোজের হাতে। শিবানীর কাল রাত থেকে হাঁপ উঠেছে আবার। প্রশান্তর দোকান থেকে ধার করে কয়েকটা ট্যাবলেট এনেছে।

ঘরে খাবার নেই। কিন্তু এরই মধ্যে আর একটা চিন্তা মাথার উপর ঝুলে আছে। যদি শিবানীকে হাসপাতালে দিতে হয়! ওর মুখের দিকে তাকায় মনোজ। শুকনো গাছের গুঁড়ির মতো জীর্ণ হয়ে আছে। ওর বুক ওঠা নামা করছে। মনোজ ঘরের বাইরে এসে খোলা জায়গাটায় বসে পড়ে। সামনে তাকিয়ে থাকে। ওর চোখে পড়ে ল্যাম্পপোস্টে লাগানো একটা ঢাউস ফেস্টুনের দিকে। তাতে ও পাড়ার মিজানের হাত জোড় করা ছবি। তাতে কয়েকটা কথা লেখা আছে। মনোজ পড়তে পারে না। ছবিখানা দেখে মনে হল যেন মানুষের কাছের লোক। সর্বদা মাথার উপর ঝুলে থেকে মানুষকে রক্ষা করবে। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কী যেন ভাবে মনোজ। ঘর থেকে জামাটা বের করে গায়ে গলিয়ে নেয়। শিবানীকে বলে ও কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে আসবে। শিবানী আধখোলা চোখে একবার তাকায় কিন্তু কথা বলতে পারে না। ওর হাঁপটা বাড়ছে বুঝতে পারে মনোজ।

মনোজ দরজাটা ঠেকিয়ে বেরিয়ে এল পথে। এতদিন ও লক্ষ করেনি, আজই প্রথম লক্ষ করল প্রতি পোস্টেই এরকম ঢাউস ফেস্টুন। একে অপরকে টেক্কা দিচ্ছে। মিজানের বাড়ির সামনে যখন পৌঁছাল মনোজ, সেখানেও লোক কম না। তাহলে কি এখানেও পিছনে পড়ে যাবে ও! একবার দেখা করে বলতে পারবে না একটু চালের ব্যবস্থা করে দিতে! মনোজের গলা শুকিয়ে আসে। এই রোদে অনেকটা হেঁটে এসেছে ও। পেটে খাবার নেই। রাস্তার পাশেই একটা কল থেকে জল খেল ও। চোখেমুখে জল দিয়ে ও আবার মিজানের বাড়ির গেটের কাছে আসতেই পথ আটকাল দু’জন। মিজান সাহেবের সঙ্গে একবার দেখা করতে চায় বলে জানায় মনোজ। একপ্রকার রাগের সুরেই বলল ছেলেদুটো, ‘দাদা এখন আর কারও সাথে দেখা করবে না। কাল আসতে হবে।’ মনোজ নিরুপায় হয়ে যেন শেষ চেষ্টার মতো ওদেরই বলল ‘বেশ ক’দিন হয়ে গেল ঘরে খাবার নেই। বউ অসুস্থ। কিছুটা চাল…’। এবার ধমক লাগাল ওরা— ‘দাদা কি চাল আলু নিয়ে বসে আছে নাকি! সরকার তো রেশন দিচ্ছে বিনা পয়সায়। সেখানে যা না। আর কত খাবি?’

মনোজ ফিরে আসে। কাল সকালেই ও গোলাপবাগান মাঠে আর রেশনের দোকানে যাবে। চেষ্টা করবে একটু খাবার জোগাড় করতে। এখন কেউ কাজ দেবে না, সকলেই মনোজের দিকে কেমন সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে। দৃষ্টিটা এমন যেন তারই শরীরে সমস্ত রোগের বীজ পোরা আছে। চেন্নাই থেকে প্রথমে পায়ে হেঁটে, তারপর সরকারী বাসে গ্রামে ফিরে এসেছে ও। এসে থেকেই দেখছে মানুষজনের এই অদ্ভুত দৃষ্টি। মনোজ এসব বুঝতে পারলেও তা নিয়ে মাথা ঘামাতে চায়নি। এসব নিয়ে কথা বাড়ালে আরও বিপদ হতে পারে। তার চেয়ে ভাল নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখতে চেষ্টা করা। এমন একটা ভাণ করা যেন কিছুই হয়নি।

বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খেতে থাকে শিবানীর হাঁ করে থাকা মুখটা। অভাবের জীর্ণতা লেগে সৌন্দর্য হারিয়ে ফেলা সেই বুকটা যেটা এখন খুব ওঠানামা করছে। এসব ভাবতে ভাবতে ও হাঁটছিল। ওর চোখে পড়ল আবার একটা বিরাট ফেস্টুন। যাওয়ার সময়ই এই জায়গাটা ফাঁকা ছিল। এখন সেখানে জ্বলজ্বল করছে এক হাসিমুখ। কী লেখা আছে! ও ভাবল কে উঠল ওখানে এত বড় ফেস্টুনটা টাঙাতে? তারা কি পয়সা পায়? তাহলে এ ক’দিন নাহয় মনোজ এই ফেস্টুন টাঙানোর কাজই করতে পারে! প্রতিদিন তো নিত্যনতুন ফেস্টুন লাগানো হচ্ছেই। আর একটু এগিয়ে ও দেখল কয়েকটি ছেলে দড়ি দিয়ে বেঁধে একটা প্রকাণ্ড ফেস্টুন তুলছে। তিনজন একটা লোহার ফ্রেমের উপর দাঁড়িয়ে আছে হাওয়াই চটি পরে। মনোজ একটু দেখতে চেষ্টা করে ওরা কীভাবে অত বড় ফেস্টুনটা তুলছে৷ এবারে একটু ওই ছেলেগুলোর সঙ্গে কথা বলবে ভাবছে। জিজ্ঞেস করবে ওরা কত টাকা পায়, কীভাবে এই কাজ জোটে ঠিক তখনই পিছন থেকে প্রথম লাঠিটা কোমরের উপর পড়ল। তারপর ক্রমাগত মার। মাটিতে পড়ে গেল মনোজ। ও কিছু একটা বলতে চেষ্টা করল। কিন্তু এক একটা লাঠির বাড়িতে আর্তনাদ ছাড়া আর কিছু বেরিয়ে এল না গলা থেকে। যে ছেলেগুলো ফেস্টুন তুলছিল তারাও যেন ভয়ে কুঁকড়ে গেল। হতভম্ভ হয়ে দেখল মনোজকে পুলিশ তুলে নিয়ে চলে যাচ্ছে…


শিবানীর হাঁপ বেড়েছিল খুব। দু’একবার চিৎকার করে ডাকতে চেষ্টা করেছিল মনোজকে। মনোজ তখন থানায় হাত জোড় করে কাকুতিমিনতি করছে। বলছে, ‘বউয়ের শরীর খুব খারাপ ছেড়ে দেন বাবু।’ রাত পেরিয়ে সকালবেলায় যখন ও ফিরেছে তখন গৌরী কাকিমা বলছে, ‘এরকম অসুস্থ বউকে ফেলে চলে গেলি মনোজ!’ কিন্তু লজ্জায় মনোজ বলতে পারল না যে ওকে পুলিশ ঠেঙিয়ে ধরে নিয়ে গেছিল। কোনও অন্যায় করে ওকে পুলিশে ধরেনি কোনোদিন অথচ কাল দু’মুঠো চাল খুঁজতে বেরিয়ে হাজতে রাত্রিবাস করতে হল ওকে।

শিবানীকে রমেন কাকারা তিনজন মিলে হাসপাতালে নিয়ে গেছিল। শিবানী অনেকখানি হাঁ করেও শ্বাস নিতে পারছিল না। ওর চোখ ঠিকরে বেরিয়ে আসছিল। হাসপাতাল ফিরিয়ে দিল। ওখানে কোনও চিকিৎসা হবে না এখন। এখন যে রোগ হচ্ছে সেই রোগের চিকিৎসা হবে ওখানে। বাইরের পেশেন্ট নেবে না আর। শিবানী একটু শ্বাস নিতে খামচে ধরছে নিজের বুকের কাপড়খানা। কী একটা যেন বলবে অথচ এতটুকু শব্দ ওর মুখ থেকে সরছে না। শুধু ওর ভেতরে গরগর করে বাজছে একটা বায়ুশূন্য ফুসফুস। যেন একটু বাতাস পেলেই ও দীর্ঘনিঃশ্বাস নিয়ে কিছু একটা বলতে চায়। এরকম অবস্থায় কোথায় যাবে বুঝতে না পেরে ওরা ডাক্তার আব্দুল কাফির বাড়িতে নিয়ে গেল৷ শিবানীর বুক তখন হাপরের মতো ওঠা নামা করছে। ওর কষ্ট দেখা যায় না।

কাফি সাহেবকে খুব অনুরোধ করতে উনি দেখলেন। কাকে একটা ফোন করে একটা বড় অক্সিজেন সিলিন্ডার আনিয়ে মুখে কী একটা পরিয়ে দিল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ পর একটু একটু করে ওর বুক শান্ত হল। একটা ইনজেকশন দিয়ে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে এল ওরা। ডাক্তার বলেছে এই সিলিন্ডারটা এখন চলবে। শেষ হলে ফিরিয়ে দিতে হবে। রমেনকাকা বলল, ‘আমরা কোনও টাকাপয়সা ডাক্তারবাবুর হাতে দিতে পারিনি। এই দুর্দিনে সকলের কী অবস্থা তা তো জানোই। ঘরে তোমার কাকিমা শুইয়ে দিয়েছে। ইনজেকশনের পর থেকেই ঘুমোচ্ছে ও।’
মনোজের মুখে কথা সরে না। ওর মনে পড়ে খুব ছোটতে এই কাফি ফুটবল খেলতে গিয়ে বারবার হেরে যেত। তা নিয়ে স্কুল যাওয়ার পথে কাফিকে খ্যাপাতো মনোজ আর তার বন্ধুরা। সেই কাফিই আজ দেবতার মতো শিবানীর প্রাণ বাঁচিয়েছে। ওর ইচ্ছে হল একবার আব্দুল কাফির হাত দুটো ধরে ছোটবেলায় করা সমস্ত অপমানের জন্য ক্ষমা চাইবে। মনোজ ঘরে ঢুকতে পারে না। কী যেন এক ভয় ওকে চেপে ধরছে৷ ওই ঘুমন্ত মুখ নয়, শিবানী জেগে উঠে একবার ওকে ডাকুক সেই অপেক্ষায় দাওয়ায় বসে পড়ল। ও ঘুমিয়ে পড়ল কি? কাল সারারাত জাগা। শিবানীর চিন্তা ওর মাথা থেকে এক মুহূর্ত সরেনি অথচ লড়াইটা শিবানী একা লড়েছে। জিতেছে। শুধু মনোজই হেরে গেল। গোহারা হেরে গেল গতকাল৷

শিবানী উঠে কি জিজ্ঞেস করবে কোথায় ও ছিল গতকাল? কী উত্তর দেবে মনোজ! আবার কি ফিরে আসবে পাশের পাড়ার গোবিন্দর বউ মালতির সঙ্গে রটে যাওয়া সেইসব অপবাদ? সে তো অনেক বছর হল। বছর দশ-এগারো তো হবেই। কোনো খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে মনোজ সেই বাড়িতে ঢোকেনি। রাজমিস্ত্রির কাজ করেছিল ওই বাড়িতে। গোবিন্দর কাছে বাকি টাকা চাইতে গেছিল। সেই সময় মালতি সবে স্নান করে কাপড়-জামা ছাড়ছিল ঘরে। মনোজ দেখে ফেলেছিল সেই নগ্ন শরীর। কিছুটা সময়ের জন্য কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। তারপর সেসব নিয়ে নানা অপবাদ রটে গিয়েছিল। এমনকি এই কথাও রটে গিয়েছিল যে মনোজের ওই বাড়িতে যাতায়াত আছে। তা নিয়ে গোবিন্দ বাড়ি বয়ে এসে শাসিয়েও গেছিল দু’বার। সেসবের কথা বাদ দিলেও হাজতবাস কি আর এমনি এমনি হয় কোনো দোষ না করলে— এরকমই ভাববে গাঁয়ের লোক। মাথা থেকে হাত নামিয়ে দেওয়ালে মাথাটা হেলিয়ে দেয় ও। গতকালের মারে এখনও সারা গায়ে ব্যথা।

মনোজের চোখে পড়ে ল্যাম্পপোস্টে লাগানো ফেস্টুনটা। একটা লোক এখনও একইভাবে হেসে যাচ্ছে ওই ফেস্টুন থেকে। রাগে গা গরগর করতে থাকে ওর। কিন্তু কথা খুঁজে পায় না। চুপ করে থাকে। কিন্তু ভিতরটা যেন তোলপাড় করতে থাকে ওই দাঁত বের করা ছবিখানা দেখে। সামান্য ভাতের জন্য সে কাল সারাদিন ঘুরে বেড়িয়েছে, রাত্রিভর হাজতবাস করেছে। ওর বউ শিবানী মৃত্যুর খাদে প্রায় পড়েই গিয়েছিল। শেষ মুহূর্তে কাফি ডাক্তার আর কয়েকজন মিলে টেনে তুলেছে। এসব ভাবতেই ওর মনে পড়ে কালকের ঘটনাপরম্পরা। ওই দাঁত বের করা ছবিটার দিকে আরেকবার তাকিয়ে মনে হল ওই বাঁকা হাসিটা মনোজের অসহায়তাকেই উপহাস করছে। অসহ্য লাগে মনোজের। ওই ছবির দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারে না। চোখ বুজে নেয় ও।