তপনকুমার দাস
মাকে কিন্ত্ত নাচ দেখাতে হবে মাসি৷
নাচ? আমি?
হঁ্যা গো হঁ্যা, তুমি৷
তারপর কোমর আর হাঁটু ভাঙলে নিস্তার রাখবে তোমার দিদুন? চোখ পাকিয়ে বলবে, গীতা, এই বয়সে ধেই ধেই নাচ করে কোমর ভাঙলে সারাজীবন কি ভাঙা কোমর জোড়া লাগবে? বউমা সময় পায় না৷ আমার হাঁটু ব্যথা৷ এতগুলি লোকের রান্না কে করবে শুনি? বলতে বলতে একেবারে লুটোপুটি খায় গীতামাসি৷ হাসির একেবারে ঝড় তুলে৷
গীতা মাসি সেই কবে থেকে এ বাড়িতে রান্নাঘরের দায়িত্বে আছে জানে না সৃজা৷ জানবে কেমন করে৷ দিদুন বলে এই তো সেদিনের সেই বেড়াল বাচ্চার মতো পুচকিটা কত বড় হয়ে গেল৷ পুচকি কি আর সব পুরোনো কথা জানতে পারে?
ভাঙুক কোমর৷ তোমাকে নাচতেই হবে৷ কেন, ছোটবেলায় নাচ শেখোনি? ভুলে গেছো, তাই তো? আমি শিখিয়ে দেবো৷
না গো দিদি, শিখিনি৷ শিখতে পারিনি৷ গীতামাসির হাসি ভরা মুখটা কালো হয়ে যায়৷ থেমে যায় হাতের খুন্তি৷
কেন? কেন?
রিক্সা টেনে সংসার চালাতে হতো বাবাকে৷ স্কুলে মাইনে লাগতো না তাই ক্লাশ ফাইভ পর্যন্ত পড়াশোনা করতে পেরেছি৷ নাচগান শিখবো কোত্থেকে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে গীতামাসি৷
তাহলে তুমি একটা আবৃত্তি, মানে কবিতা বলো— গীতামাসির জন্য মনটা খারাপ হয়ে যায় সৃজার৷
সেটা বলতে পারি৷ কবিতাটা জানি, স্কুলে পড়েছি৷ একটু মুখস্থ করতে হবে৷ তবে লজ্জা লাগে৷ রান্নার মাসি কবিতা বললে লোকে কী বলবে— ভাতের হাড়িতে খুন্তি নাড়ায় গীতামাসি৷
কেউ কিছু বলবে না৷ কবিতা কি কারও কেনা? দেখবে সবাই হাততালি দেবে— গীতামাসির লজ্জা ভাঙানোর চেষ্টা করে সৃজা৷ জিজ্ঞাসা করে, কী কবিতা বলবে?
‘হাট’৷ ‘কুমোর পাড়ার গোরুর গাড়ি’—
বাহ! বাহ! খুব সুন্দর! — তালি বাজিয়ে নেচে ওঠে সৃজা৷
কি রে, রান্নাঘরে বসে কী করছিস? মেজকাকার ছেলে অয়ন কোত্থেকে এসে মনিটরে মতো প্রশ্ন করে সৃজাকে৷ জানতে চায়, গীতামাসি রাজি৷ চল নামটা লিখে রাখবি৷
পড়ার ঘরে ফিরে খাতা খুলে গীতা মাসির নাম লিখে নেয় অয়ন৷ বাব্বা চারজন হয়ে গেল৷ চোখ রাখে ছোটবোন সৃজার চোখে— আচ্ছা ভোলাদাদা ভোগাবে না তো?
বলতে না বলতেই বাঁশি বেজে ওঠে, ফুরুর৷ কাঁচড়ার গাড়ি ঠেলে দুয়ারে এসে দাঁড়ায় ভোলা৷ পৌরসভায় চাকরি করে৷ সাফাইওয়ালা৷ হলে কী হবে, রুচি আছে ছেলেটার৷ অনুষ্ঠানের কথা বলতেই এক পায়ে খাঁড়া— আমি কিন্ত্ত দুটো কবিতা বলব৷
নাম করতে না করতেই হাজির৷ চল, আর একবার জিজ্ঞেস করে নিই— বেণী দোলায় সৃজা৷
দরকার নেই৷ আর ঝুমাদি, ঝুমাদি শেষ পর্যন্ত ডোবাবে না তো?
না না, কাল বিকেলেও বলেছে, অয়নের কথা শেষ হতে না হতেই ছোটকাকার ছেলে অভিরূপ এসে দাঁড়ায় পড়ার ঘরে, পিছনে এক বালতি জল আর ঘর মোছার ন্যাতা হাতে ঝুমাদি৷
কি গো ঝুমাদি, রেওয়াজ করছো তো— জানতে চায় সৃজা৷
সবার বড় অভিরূপ৷ ক্লাস সিক্সে পড়ে৷ তারপর অয়জন৷ ক্লাস ফোর৷ আর সৃজা তো ক্লাস থ্রি৷ হলে কী হবে, এতবড় যে অনুষ্ঠান হবে তার ক্যাপ্টেন তো সৃজা৷ তার মাথা থেকেই তো এসেছিল বুদ্ধিটা৷
দেখবে? তুমি গানটা চালাও, কাপড়ের অাঁচল শক্ত করে কোমরে গুঁজে নেয় ঝুমাদি৷ জলের বালতি সরিয়ে রাখে ঘরের কোণে৷
‘আজ ধানের ক্ষেতে রৌদ্রছায়ায়…’ গান শুরু করে সৃজা নিজেই৷ দু’হাত মেলে নাচ শুরু করে ঝুমাদি৷ সৃজা যেমন শিখিয়েছিল, ঠিক তেমনটি৷
বাহ! ঝুমা তো ভালোই নাচতে পারিস দেখছি— হঠাৎ ঘরে ঢোকেন অক্ষয়বাবু৷ সৃজা অয়নদের দাদুভাই৷ সৃজার সঙ্গে পরামর্শ করে অনুষ্ঠানটার ব্যবস্থা করেছেন৷ একটু অন্যরকম অনুষ্ঠান৷ ছোটরা তো থাকবেই নাচ, গান, আবৃত্তির সম্ভার নিয়ে৷ সঙ্গে থাকবে গীতা মাসি, ভোলাদা, ভোম্বল কাকা, ঝুমাদিরা৷ যারা সারা বছর নানান কাজ করে পেট চালায়৷ তাদের নিয়েই হবে জয়ন্তী৷
দাদুভাই ঘরে ঢুকতেই জিভ কামড়ে এক দৌড়ে পড়ার ঘরের বাইরে
পালিয়ে যায় ঝুমা৷ লজ্জায়৷
বিদু্যৎকে বলেছিস? জানতে চান অক্ষয়বাবু৷
বিদু্যৎ কে? একসঙ্গে প্রশ্ন করে সৃজা, অভিরূপ আর অয়ন৷
বাহ্ বাহ্ বাহ্! এই ভুলো মন নিয়ে তোমরা লেখাপড়া, নাচ-গান, ছবি অাঁকা শিখবে কেমন করে?
জানি জানি৷ বিদু্যৎকাকু৷ সৃজাকে টোটো চালিয়ে নাচের স্কুলে নিয়ে যায়, জানিয়ে দেয় অভিরূপ৷
এখন এই সাতসকলে বিদু্যৎকে ডাকবে কেন? কোথাও যাবে? আলোচনার আসরে এসে হাজির হন বন্দনা৷ সকলের দিদুন৷ বসে পড়েন চেয়ারে৷
বেড়াতে যাবো৷ চিড়িয়াখানায়৷ তুমি যাবে? দিদুনের কোল ঘেষে দাঁড়ায় সৃজা৷ অক্ষয়বাবুর চোখে রাখে দুষ্টুমির চোখ— দিদুন কিন্ত্ত ডুবিয়ে ছাড়বে৷
কেন? আমি আবার কী করলাম? অবাক হল বন্দনা৷
একদিনও তো রেওয়াজ করতে শুনলাম না৷ আর তো মোটে দু’দিন বাকি৷ গান যদি ভুল হয়, স্টেজের মাইক বন্ধ করে দেব, দিদুনের কোল ছেড়ে ঘুরে দাঁড়ায় সৃজা৷
আমি বিনা মাইকেই গাইবো৷ শোন, ‘ভেঙে মোর ঘরের চাবি নিয়ে যাবি কে আমারে৷’
কাট! কাট! দু’হাত তুলে দিদুনকে থামিয়ে দেয় অয়ন, এই গানটা তো বাউলদাদু গাইবেন৷ আমার সঙ্গে কথা হয়েছে৷
রতন বাউল আসবে? আনন্দে উচ্ছ্বসিত হন দিদুন৷ বলেন, কতদিন রতনদার গান শুনিনি৷
তাই তো বাউলদাদুর নামটাই তো লেখা হয়নি—খাতা খোলে অয়ন৷
বিদু্যতের নামটাও লিখে নাও— পরামর্শ দেন দাদুভাই, ছোটবেলায় আবৃত্তি করে আমার হাত থেকেই প্রথম পুরস্কার নিয়েছিল৷ পড়াশুনায়ও ভালো ছিল৷ কী করবে বেচারা, জুট মিল বন্ধ হতেই টোটোটা কিনেছিল৷
ঠিক ঠিক, সে আবৃত্তি আমিও শুনেছি৷ ‘বীরপুরুষ’ কবিতা— দাদুভাইকে সমর্থন করেন দিদুন৷ তারপর টোকা দেব অভিরূপের গায়ে, জিজ্ঞাসা করেন, কমলকে বলেছিস?
কে কমল? অবাক হয় অভিরূপ৷
কমল দাদু৷ আমাদের বাগানে গাছের সেবা করে সুন্দর ফুল ফোটায়৷
বুঝেছি৷ কিন্ত্ত কমলদাদু কি পারবে? দিদুনের কথায় সন্দেহ প্রকাশ করে সৃজা৷
পারবে না মানে, খুউব পারবে৷ আমি বলে দেবো৷ নিড়ানী দিয়ে মাটি খুঁড়তে খুঁড়তে নিজের মনে গান গায় কমল৷ গাছপালাদের গান শোনায়৷ এবার আমাদের অনুষ্ঠানে গাইবে৷ নে কমলের নামটা লিখে রাখ৷
দিদুনের কথায় নেচে ওঠে সৃজা৷ শনিবারটা যে কবে আসবে?
আচ্ছা দাদুভাই, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি সবার? গীতামাসি, ভোলা, ঝুমাদি৷
হঁ্যা, রবীন্দ্রনাথ সকলের৷ সারা পৃথিবীর রবীন্দ্রনাথ৷ যে যেখানে যে কাজই করুক না কেন, রবীন্দ্রনাথ আছেন সবার মাঝে— অয়নের প্রশ্নের উত্তর বোঝানোর চেষ্টা করেন অক্ষয়বাবু, তোমরা যে কাজে নেমেছো, দেখবে ঠিক সফল হবে আর মানুষগুলোও সম্মানিত হয়ে শান্তি পাবে৷
অনুষ্ঠানের নাম হবে ‘সবার রবীন্দ্রনাথ’ চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান দিদুন৷
ইয়া! দু’হাত আকাশের দিকে ছুড়ে দেয় তিন ভাইবোন, সঙ্গে দাদুভাই৷
আমাদের জয়ন্তীর জয় হোক— স্লোগান দেন দিদুন৷
কিন্ত্ত শনিবারটা আসবে কবে— দুমদাম পা দাপায় সৃজা৷