ফাঁকা মাঠের গোল

কল্পিত চিত্র

শাড়ি সরিয়ে পেটটা একটু বের করে দু’বার ঢ্যাক ঢ্যাক করে বাজিয়ে সুন্দরী বলে উঠল, ‘বুঝলি কালি, পেটে হেবি গ্যাস হয়ে গেছে, কেমন আওয়াজ উঠছে বল তো।’
—চা গিলবে তো নাকি?
—ভাবছি।
—ঘরে শুয়ে শুয়ে ভেবো। এখন এমনিই বাজার ভালো নয়।
—তোর কি অসুবিধা বলতো, এখন না খেলে পরে খাবো।
—না সুন্দরীদি ওসব চলবে না, দেখছো না, কেমন পুলিশ এসে দোকান বন্ধ করাচ্ছে। কালকেও দশ বারো কাপ চা ফেলেছি। তোমাদের মত আমার এত পয়সা নাই, আগের থেকে বলে দিলাম।
শেষের কথাগুলো শুনেই সুন্দরী নামের মেয়েটি কোমরে গুঁজে রাখা পোঁটলা খুলে একটা পাঁচ টাকার কয়েন দোকানে রাখা একটা কাচের বয়ামের ওপর রাখে, ‘এবার মেলা ফ্যাচ ফ্যাচ করিস না।’
—আহা চটছ কেন, বাজার খারাপ, তাই একথা বলছিলাম।
—বাজার তুর একার খারাপ? বৌদিরা ফোনে বলে দিল, ‘এখন আর কাজে আসবি না।’ কিন্তু টাকা কোথায় পাবো? গেলে তবে টাকা দেবে। হয়ত কেউ মাইনে কাটবে না। যা ছিল, সব বাজার করে নিয়েছি। আজ বুলবুলি এসে, টাকাটা দিয়ে গেলে একটু শান্তি, না হলে এক্কেবারে শেষ হয়ে যাবো, ও শালি আবার আজ সকাল থেকে ফোন ধরছে না, আগের হপ্তার কিছু টাকা এখনো বাকি আছে। অবস্থা খুব খারাপ।
—তুমার তো ব্যাঙ্কে টাকা রাখা আছে, সেখান থেকেই চালাও।
—কুথাকে পাবি, সেই মাসে শরীর খারাপ হল, সব টাকা গেল। ঠিক আছে তুই বোস আমি একটু হেগে আসি, এখন সন্ধে হতে একটু দেরিই আছে। মা কালীর নামে সব যদি একটু ঠিক হয় তো ভালো, না হলে মারিয়ে গাছ হয়ে যাবো।
সুন্দরী কালীর দোকানের দাওয়া থেকে নেমে গলির পথে পা বাড়াতেই পিছন থেকে বাপ্পা ডাকে, ‘এই সুন্দরী, কাজ করবে? একটা পার্টি আছে।’
এই বস্তিতে বাপ্পা খুব পরিচিত মুখ। যদিও ওকে সবাই ‘বেদো বাপ্পা’ বলেই ডাকে। দুপুর শেষ হবার পর থেকেই বস্তির অলি গলিতে ঘোরাঘুরি করে। ওর হাত ধরে অনেকেই সন্ধের সময় বেরিয়ে রাতের অন্ধকারে বা ভোরে পাশে ঝোলানো ব্যাগে টাকা নিয়ে বস্তিতে ফেরে। কারা কারা যায় সুন্দরী তাদের সবাইকে চেনে। বাপ্পা সুন্দরীকে প্রায়ই বলে, ‘আরে তোমাকে এই রকম টাকা কেউ দেবে না। কয়েক ঘন্টার তো ব্যাপার, কেউ জানতেও পারবে না।’ সুন্দরীর ভালো লাগেনা। তাও বাপ্পার কথাতে প্রতিবারেই সাড়া দেয়, মজা করে, ইয়ার্কি মারে। সেদিনও জিজ্ঞেস করে, ‘কোথায় ?’
—সামনেই ওই উত্তরের দিকে।
—শালা ঢেমনা ওটা সামনে?
—এখন আর বাইরে বেরোতে পারবে না, কাজেও যেতে পারছো না। কাঁচা টাকা আছে, একটু ভাববে। আজ মরলে কাল ছাই। তাছাড়া ভগবান যা যা দিয়েছে সব তো ব্যবহার করতে হবে। তোমার তো সব কিছু ধোয়া মোছা করে রাখা। বাইরের লোককে একটু দেখতে দাও, প্রণামী পাবে।
—মারবো টেনে এক চড়। বের এখান থেকে।
বাপ্পা মুচকি হেসে বস্তির ভিতরের গলিতে ঢোকবার সময় বলে, ‘তোমার ভগবানকে তে’মাথার মোড়ে দেখলাম। ঠ্যাং উল্টে পড়ে আছে, আজ রাতে ফিরবে না।’
সুন্দরী কোনও উত্তর না দিলেও একটা লম্বা শ্বাস ফেলে। এই লোকটার সঙ্গে ভাব করে বাড়ি ছেড়ে ছিল?
দেখতে দেখতে বস্তিতে দশবছর হয়ে গেল। কী কুক্ষণে লোকটাকে ভালো লেগে ছিল কে জানে! তখন অবশ্য  সুন্দরীর কম বয়স খোলতাই চেহারা, স্কুলেও পড়ত। একটা কাজের বাড়িতে ভগবানের সঙ্গে আলাপ হয়। ভগবান তখন শহরের একটা দোকানে কাজ করে। পালিয়ে বিয়ে করে নেয়, সে থেকেই এই বস্তিতে বাস। প্রথম প্রথম বেশ ভালোই চলছিল। বিয়ের কয়েকমাসের মাথায় সুন্দরীর একটা ছেলেও জন্মালো, সেটা তিনদিনের বেশি না বাঁচলেও পরেরটা বাঁচে। তারপর ভগবানের কি যে মতিভ্রম হল দোকানের কাজ ছাড়ল, একটু আধটু মদ খেত, তার পরিমাণটাও বেড়ে গেল। তারপর মদই খেতে আরম্ভ করল সুন্দরী আর ভগবানের সংসার। কাজ নেই, ঘরে চাল নেই, এক অদ্ভুত অবস্থার সৃষ্টি হতেই সুন্দরীর হাতে আর কোন উপায় থাকল না। চেয়ে চেয়ে কত দিন আর লোকের কাছ থেকে নেওয়া যায়। তখনই বাপ্পার কথা শোনে। এই বস্তির অনেকেই বাপ্পার সাথে যোগাযোগ রাখে, তার মাধ্যমে বাইরে যায়। খারাপ লাগে সুন্দরীর, এতো তাড়াতাড়ি হেরে যাবে, শরীরটাকে বিকিয়ে দেবে? সেই সময়েই একজন বাড়ির কাজের সন্ধান দেয়। বস্তির থেকেই ভোর বেলা আস্তে আস্তে ট্রেনে চেপে কাজে যায়। ফেরে সন্ধের দিকে। সুন্দরী আর চিন্তা করতে পারে না। আস্তে আস্তে চারটে বাড়িতে কাজ পায়। শহরের সব ফ্ল্যাট বাড়ি, অল্প কয়েকজন করে লোক, কাজের সেরকম কোন ঝামেলা নেই।
‘কিন্তু বুলবুলের কী খবর?’ একটু আগেই শুনল ট্রেন বাস সব বন্ধ, বুলবুলের অবশ্য এই বস্তিতে হেঁটে হেঁটেও আসতে পারে। আগের মাসেই ছেলেটাকে এখানে নিয়ে এসে বলেছিল, ‘হেঁটে হেঁটেই এলাম, পায়ে ব্যথা ধরে গেল।’
—হেঁটে এলে কেন?
—আর বলবে না, তোমাদের আগের মোড়টাতে নামলাম। আবার বাসে চাপবো? হেঁটে দিলাম। মিনিট কুড়ি লাগল।
‘আজ এলে একটু টাকা পয়সাগুলো পাবে। সব থেকে বড় কথা তুমি যখন অন্যের মাল ভাড়া নিয়ে আছো  ভাড়া তো মেটাতে হবে।’
—ভাড়া!
ভাড়াই বটে।
প্রথম কথাটা শুনে একটু অবাক হয়ে গেলেও ব্যাপারটা খারাপ নয়। ঝুমুকাকিই প্রথম কথাগুলো বলে। সুন্দরীর বাচ্চাটার তখন মাত্র একমাস বয়স। ঝুমুকাকি দেখতে এসে কয়েকটা কথার মাঝে বলে, ‘কাজে তো যাচ্ছিস না,  দু’মাস কেউ কেউ মাইনেটা পাঠাবে, তারপর কি করবি? বাচ্চা তোর দুধ খাবে, তুই কী খাবি? এই তো বরের ছিরি।’
কয়েকমাস আগেও একটা অপারেশন হয়েছে। সরকারি হাসপাতালে তারিখ না পেয়ে বাইরে করাতে হয়েছে। জমানো টাকা সব শেষ। শুধু দুচোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পড়তেই ঝুমুকাকি বলে ওঠে, ‘শোনো এক কাজ কর, বাচ্চাটাকে ভাড়া দিয়ে দে।’
—ভাড়া!
অবাক হয়ে যায় সুন্দরী। আমার ছেলেকে কে ভাড়া নেবে ? ছেলে আবার ভাড়া হয় নাকি? কী বকছ তুমি?’
—বকব কেন? তুই জানিস তোর মত কত মা তাদের বাচ্চাদের ভাড়া দিয়েছে? তোর কাছেই পাঁচ নম্বরের রুমা, আগের মাসেই ভাড়া দিয়েছে।
—কিন্তু ভাড়া নিয়ে কী করবে?
—ভিক্ষা করবে।
সুন্দরী তখন ব্যাপারটা সেরকম ভাবে বুঝতে না পারলেও কয়েকদিন পরে পরিষ্কার বুঝতে পারে। সেদিন বাসে চেপে বাড়ি ফিরছিল। একটা সিগনালে বাসটা দাঁড়াতেই জানলা দিয়ে দেখতে পায় বাইরে তার বয়সি একটা মেয়ে সিগনালে ভিক্ষা করছে। তার কোলে একটা বাচ্চা ছেলে।
মেয়েটা কয়েকদিন পরে বস্তিতে আসতেই সুন্দরী তাকে চিনতে পারে। ‘কয়েকটা ঘর পরেই থাকে আনোয়ারা, ও আবার হিন্দু সেজে শহরে বাবুদের বাড়িতে কাজ করতে যায়। কোলের ছেলেটাকে ভাড়া দিয়ে দিয়েছে। ওই মেয়েটা প্রতি সপ্তাহে এসে টাকা দিয়ে যায়।’
ঝুমুকাকি কয়েকদিন পরেই বুলবুলের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দিতেই সুন্দরীর কাছে সব জলের মত পরিষ্কার হয়ে যায়। নিজের ছেলে, কোন ঝামেলা নেই, শুধু প্রতি সপ্তাহে এসে টাকা দিয়ে যাবে।
—কত দেবে ?
—হপ্তায় এক হাজার। সদ্য আলাপ হওয়া বুলবুল বলে ওঠে।
তারপরেই বুলবুল গড়গড় করে বস্তির কোনও কোনও মেয়ে তাদের বাচ্চাকে ভাড়াতে দিয়ে দিয়েছে সব কিছু জানাতেই অবাক হয়ে যায় সুন্দরী। এত্তজনের বাচ্চা বাইরে ভাড়াতে খাটছে। কানে শুনলেও কথাগুলো যেন বিশ্বাস হয় না। আসলে দিনের বেশির ভাগটাই বাইরে থাকবার এটাই সুবিধা। সব খবর সব সময় কানে পৌঁছায় না। বরের কথাও ভাবে। ভাগ্যিস সেদিন মদের ঘোরেও রাতের অন্ধকারে ঘরে ঢুকেছিল, প্রতি সপ্তাহে হাজার টাকা পাবারও তো একটা ব্যবস্থা হল। প্রথম প্রথম ব্যাপারটা ভাবতেই কেমন যেন লাগত। শরীর বিক্রি করতে হচ্ছে না ঠিকই কিন্তু শরীরের অংশ তো। কথাগুলো বাপ্পার কানেও গেছিল। একদিন বস্তির মুখে সুন্দরীকে দেখতে পেয়েই বলল, ‘তাহলে বেচতে তোমাকে হচ্ছেই।’
কথাগুলো সূচের মত বুকে লাগলেও সুন্দরীকে সেদিন হাসতে হয়েছিল। তারপর থেকে অবশ্য বাপ্পা দেখতে পেলেই বিভিন্ন কথা বলত।
বস্তির ভেতর থেকে বাইরে আসার রাস্তায় সুন্দরীকে দেখতে পেয়েই বাপ্পা আবার বলে, ‘এখনো ভেবে বল, ভালো  টাকা পাবে, গাড়ি করে নিয়ে যাবো।’
সুন্দরী কথাগুলো ঘুরিয়ে উত্তর দেয়, ‘মোড় মাথায় ওষুধের দোকান খোলা? আমার জন্য একটা ওষুধ এনে দাও তো,  পেটটা ঢ্যাক ঢ্যাক করছে।’
—তুমি যাও, আমার অত সময় নেই। এখনো দুটো জায়গা থেকে মাল তুলতে হবে।
বাপ্পা চলে যেতেই কালী বলে, ‘তোমারই বা ওকে বলবার কী দরকার? ওষুধের দোকান খোলা আছে, নিজে নিয়ে এসো।’
—নিজেকেই যেতে হবে।
—বুলবুলি এলে এখানেই বসতে বলবি।
এখানে সন্ধে নামলেই খুব ভালো করে বোঝা যায়। সেটা অবশ্য এমনি সময় আরো বেশি। সকাল শুরু হলেই যে যার মত কাজে বেরিয়ে যায়। সুন্দরীকে তো সেই ভোর সাড়ে চারটের সময় বেরোতে হয়। এমনি আরো অনেকেই আছে।
বাজারটা করতেই দেরি হয়ে গেল। ওষুধের দোকানে ভিড় না হলেও মুদিখানার দোকানে খুব ভিড়। সন্ধে বেলায়  এ পাড়াতে একটা মাত্র দোকান কয়েক ঘন্টার জন্য খুলছে, সেখানেই ভিড়। সুন্দরীর কয়েকটা জিনিস কিনতেই এক ঘন্টার উপর পেরিয়ে গেল। বাইরের রাস্তাঘাট এক্কেবার শুনশান। পুলিশও বাইরে ঘুরতে দেখলেই বাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছে।
বস্তিতে ফিরতেই দেখল কালী দোকান গোটাচ্ছে। ‘এত তাড়াতাড়ি!’ জিজ্ঞেস করতেই ও বলে,‘একটু আগেই পুলিশ এসে দোকান বন্ধ করতে বলল।’
—সে না হয় হল কিন্তু বুলবুলি আসে নি তো? তুই কিছু জানিস?
—না রে কিছুই জানি না। তুই একবার পাঁচ নম্বরের রমার কাছে যা। ওর বাচ্চাও তো বুলবুলির কাছে …।
—এই সুন্দরী….।
কালীর কথার মাঝে নিজের নাম ধরে ডাক শুনেই সুন্দরী একটু চমকে উঠল। ঘাড় ঘোরাতেই দেখে রুমা এক্কেবারে হাঁপাতে হাঁপাতে ওরদিকেই আসছে। সুন্দরীকে দেখতে পেয়েই থমকে দাঁড়িয়ে বলে উঠল, ‘আমি তোমার ঘরেও গেছিলাম, বুলবুলির কোন খবর  জানো?’
—না রে, আমি এই কালীকে জিজ্ঞেস করছিলাম। তুই কিছু জানিস?
—বুলবুলির কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। একটু আগে আমাকে একজন ফোন করেছিল। পাশের বস্তিটাতে থাকে, ওর মেয়েরও কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না।
সুন্দরীর হাত পা অবশ হতে আরম্ভ করে। এবার এই বস্তিতে কিভাবে মুখ দেখাবে? অনেকেই তার কথা শুনে তাকে মানাও করেছিল, বুলবুলি নাকি বাচ্চা বিক্রি করে দেয়। সুন্দরী শোনেনি। তার মানে কি আর কোনও দিন ছেলেটাকে দেখতে পাবে না? সুন্দরী  তাও রুমার পিঠে হাত দেয়। ‘তুই একটু শান্ত হ, কাল বুলবুলির বাড়িতে গিয়ে দেখে আসবো।’
—কোথায় পাবে সুন্দরীদি, বুলবুলি তো রাতারাতি পালিয়েছে। আমাদের সব বাচ্চাগুলোকে বাইরে বিক্রি করে দিয়েছে।
হাত পা কাঁপতে লাগল সুন্দরীর। চোখের সামনে বস্তিটা কেমন যেন ধোঁয়া হয়ে গেল। কিছু সময় একটু নিজেকে ঠিক করে নিয়ে বলে উঠল, ‘তাহলে চল আমরা সবাই মিলে পুলিশের কাছে যাই।
—গেছিলাম। মোড়ের মাথায় উকিলবাবু থাকেন তার কাছে যেতেই উনি বললেন, ‘ছেলে ভাড়া দেওয়াটা এদেশে বেআইনি, বেশি কিছু করলে পুলিশ তোমাদেরকেই জেলে ঢুকিয়ে দিতে পারে।’
সুন্দরী আর কোনও কথা বলতে পারে না। ভগবান মোড়ের মাথায় উল্টে পড়ে আছে, বাচ্চাটাও…।
গলির একটা কোণে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে খোঁজার চেষ্টা করে আলো ফুটতে আর ঠিক কতটা দেরি?