আলোর দিশারী

তাপস চট্টোপাধ্যায়

‘হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস অথবা অ্যাকুয়ার্ড ইমিউনো ডেফিসিয়েন্সি সিনড্রোম৷ সহজ কথায় আমরা বলি এইচ আই ভি বা এইডস্৷’
ডাঃ রায়চৌধুরীর ঠিক মুখোমুখি মহাশ্বেতা৷ এই মারণরোগটা ওর খুবই চেনা৷ সিনেমা টিভিতে একাধিকবার শুনেছে, দেখেছে৷ কিন্ত্ত এই রোগ সুদর্শনের—? মহাশ্বেতার সবকিছু কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে যায়৷
—‘দেখুন, এই অ্যাকসিডেন্টে ওঁর ইউরেনারি সিস্টেমে একটা আঘাত লাগে৷ রুটিন কিছু টেস্টের সময় এইচ আই ভি টেস্ট এখন ম্যানডেটরি৷’

ডাঃ রায়চৌধুরী মহাশ্বেতাকে নানাভাবে বোঝাতে চেষ্টা করেন৷ কিন্ত্ত কোনও কিছুই তার কানে পৌঁছয় না৷ তারস্বরে কিছু ড্রামের আওয়াজ আর মুঠো মুঠো কুয়াশায় সবকিছু অস্পষ্ট মনে হয়৷
—‘মিসেস সেন, ডোন্ট বি আপসেট, এখনও সবকিছু শেষ হয়ে যায় নি৷’


ডাঃ রায়চৌধুরী চেয়ার ছেড়ে উঠে মহাশ্বেতার পাশে দাঁড়ান৷ আশ্বস্ত করার চেষ্টা করেন, ‘দিস ইজ টু আর্লি স্টেজ৷ সি ডি ফোরটি সেলসের এখনও খুব বেশি ক্ষতি হয়নি৷ আপনি নিশ্চিন্তে বাড়ি যান৷ রজত বিদেশ থেকে ফিরলে ডিসিশন নেওয়া যাবে৷’
কিছুটা ঘোরের মধ্যেই মহাশ্বেতা লিফ্টের দিকে এগিয়ে চলে৷ ওপরের ফ্লোরেই সুদর্শনের কেবিন৷ মহাশ্বেতা আজই রিলিজ হয়েছে৷ ওর আঘাতটা অত গুরুতর ছিল না৷

অঞ্জলি বেশিরভাগ সময়টাই সুদর্শনের কেবিনে থাকে৷ এ বছরই ডাক্তারিতে ফাইনাল ইয়ার পাশ করেছে৷ এই কলেজেরই হাউস স্টাফ৷ ফর্সা ছিপছিপে চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখ৷ মুখজুড়ে সবসময় একটা মিষ্টি হাসি৷
—‘আমরা একই কলেজে পড়ি, তুমি আবার ওকে বৌমা ভেবে বসো না৷’ প্রথম দিন রজত কিছুটা ঠাট্টার ছলেই অঞ্জলির সঙ্গে মহাশ্বেতার পরিচয় করিয়ে বলেছিল৷
—‘সেটা তোকে বলে দিতে হবে না, ওটা আমার চয়েস৷’
অঞ্জলি লজ্জা পাচ্ছিল, মহাশ্বেতা ওকে নিয়ে কিচেনে চলে যায়৷

কলেজে রজত অঞ্জলির থেকে সিনিয়র ছিল৷ ডাক্তারি পড়ার সময়ই ওদের পরিচয়, তারপর প্রেম৷ উত্তর কলকাতার অভিজাত বংশের মেয়ে৷ অঞ্জলির মা খুব সাদামাটা স্বভাবের হলেও বাবা খুব রাশভারি প্রকৃতির৷ ন্যাশনাল মিউজিয়ামের সর্বময় কর্তৃত্ব থেকে অবসর নেওয়ার পর এখন কলকাতা মিউজিয়ামের পার্ট টাইম গবেষক৷

মহাশ্বেতার মুখ থেকে ছেলের প্রেমোপাখ্যান শুনে সুদর্শন একটু বেশিই উল্লসিত হয়ে ওঠে৷ সেনাবাহিনীতে চাকরির সুবাদে ওর স্বভাবের একটা বিশেষ দিক হল সামান্য কিছুতেই চেঁচিয়ে পাড়া মাথায় করা, ‘তোমার রোমিও ছেলেকে বলে দিও বিদেশে গিয়ে আবার কোন শ্বেতাম্বরী জুলিয়েটের পাল্লায় না পড়ে৷ স্টেটস থেকে ফিরলেই সোজা ছাঁদনাতলা৷ নো কম্প্রোমাইজ৷’

অবশ্য দুই পরিবারের সহমতেই রজত রেজিস্ট্রি ম্যারেজটা সেরেই বিদেশে পাড়ি দেয়৷
সুদর্শনের কেবিনের কাছে এসেই মহাশ্বেতার মাথাটা একটু ঘুরে যায়৷ হাসপাতালের লবিতে ভিজিটার্সদের জন্য রাখা একটা চেয়ারে বসে পড়ে৷ দুর থেকে কেবিনের পর্দার ফাঁক দিয়ে সুদর্শনকে বেডে আধশোয়া অবস্থায় দেখা যাচ্ছিল৷ পাশে দাঁড়িয়ে অঞ্জলি বাঁহাতে ধরা কাচের বাটি থেকে সুদর্শনকে কিছু একটা খাইয়ে দিচ্ছে৷ গতকালই সুদর্শন অঞ্জলিকে দিয়ে মহাশ্বেতাকে নিজের কেবিনে ডেকে পাঠিয়েছিল৷ মাথাটা খুব ধরেছিল৷ মহাশ্বেতা সুদর্শনের কপালে অনেকক্ষণ বাম মালিশ করে দেয়৷ এটা ওর পুরোনো অভ্যেস৷ মাথা ধরার অজুহাতে যখন-তখন একটু কাছে পাওয়া, একটু উষ্ণ স্পর্শ৷

এই মূহূর্তে মহাশ্বেতা অন্য কিছু চিন্তা করতে পারছে না৷ ডাঃ রায়চৌধুরীর মুখের কয়েকটা শব্দ তার তেত্রিশ বছরের দাম্পত্য জীবনকে একটা কঠিন প্রশ্ন চিহ্নের মুখে দাঁড় করিয়েছে৷ একটা সাংঘাতিক বিশ্বাসভঙ্গতা, নিষ্পাপ সারল্যের বিপক্ষে এক ঘৃণ্য ষড়যন্ত্র তার নারীসত্তাকে ক্ষতবিক্ষত করে তুলেছে৷ এই তো মাত্র ক’টা দিন আগের ঘটনা৷ বিয়ের নিমন্ত্রণ করতে সুদর্শনের সঙ্গে গাড়িতে চেপে খড়গপুরে ন’মাসির বাড়ি যাচ্ছিল৷ রজত ফোনে জানিয়েছিল যে, সে সামনের মাসেই কলকাতা আসছে, এক মাসের ছুটি৷ বিয়েটা সেরে ফিরে যেতে চায়৷ হাতে সময় মাত্র দেড়টা মাস৷ এ বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে৷ পাড়াপড়শি, আত্মীয়-স্বজন নিমন্ত্রণ, ডেকরেটর কেটারিং বিয়ের যোগাড়যন্ত্র, মহাশ্বেতার মাথায় পাহাড় প্রমাণ বোঝা৷ তখনই হঠাৎ মৃন্ময়ীর কথাটা মাথায় এসেছিল, ন’মাসির ছোট মেয়ে৷ ডিভোর্সি, ইংরেজি স্কুলে পড়ায়৷ বাপের বাড়িতেই পাকাপাকি থাকে৷ সমবয়সী হলেও স্বভাবের দিক থেকে মহাশ্বেতার একদম বিপরীত৷ ডানপিটে আর স্পষ্টবাদী৷ তবুও ছোটবেলা থেকেই ওদের একটা বন্ধুত্বের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল৷ সুদর্শনও ওর ওই চপল স্বভাবের শ্যালিকাটিকে একটু বেশিই পছন্দ করত৷

সামনে হাইরোডটা এঁকেবেঁকে চলে গেছে অনেকটা দুর৷ যেন মস্ত কালো একটা ময়াল সাপ বিকেলের পড়ন্ত বেলায় শুয়ে বিশ্রাম নিচ্ছে৷ স্পিডোমিটারের কাঁটা প্রায় নব্বই ছুঁইছুঁই৷ ড্রাইভিং সীটে সুদর্শনের হাতে স্টিয়ারিং৷ স্টিরিওতে একটা জনপ্রিয় রবীন্দ্রসঙ্গীতের হালকা সুর মহাশ্বেতাকে কিছুটা অন্যমনস্ক করে তুলেছিল৷ দগদগে লাল রঙের অস্তমিত সূর্যটা গাছপালার আড়াল থেকে লাল আভা ছড়িয়ে দিয়েছে৷ দিনান্তের একটা ক্লান্ত অনুভূতির রেশ সর্বত্রই বেশ স্পষ্ট৷

—‘একি তুমি এখানে বসে আছো, চলো, বাবা ওয়েট করছে৷ দেখা করে ফিরতে হবে তো!’ কেবিন থেকে বেরিয়ে মহাশ্বেতাকে দেখে অঞ্জলি কিছুটা বিস্মিত৷
সুদর্শনকে বেশ রোগা লাগছিল৷ মুখটাও ফ্যাকাশে৷ মাথায় ব্যান্ডেজ, মুখে গলায় বেশ কয়েকটা ক্ষত এখনও শুকোয়নি৷ ডান হাতে প্লাস্টার৷

অন্য সময় হলে মহাশ্বেতা হয়তো অনেক বেশি ব্যস্ত হয়ে পড়ত৷ সামান্য দাড়ি কাটার সময় গালে একটু রক্ত দেখলেই যে হৈচৈ বাধিয়ে দেয়, সেই মহাশ্বেতার কাছে আজ সব গুরুত্বহীন মনে হয়৷ উল্টো দিক থেকে দুরন্ত গতিতে ছুটে আসা একটা জোরালো আলো, তারপর বিকট শব্দ৷ কাচভাঙার আওয়াজ৷ একসঙ্গে অনেক মানুষের চিৎকার চেঁচামেচি৷ ডান হাতে আর বুকের ওপর একটা প্রচণ্ড চাপ আর যন্ত্রণা৷ সেদিনের অ্যাকসিডেন্টের পর হসপিটালের বেডে শুয়ে মহাশ্বেতা সবচেয়ে আগে যাকে খুঁজেছিল আজ তাকে অনেকটা পর বলে মনে হয়৷ ‘হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস’ খুব চেনা বিকৃত কদাকার ছায়াশরীরটা তখন ওর আশপাশে নানান অঙ্গ-ভঙ্গি করে মহাশ্বেতার সহজ সরল বিশ্বাস আর ভালবাসাকে ক্রমাগত বিদ্রুপ করছিল৷
আর্মি থেকে রিটায়ার করে সুদর্শন কলকাতার একটা মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে সিকিউরিটি ইনচার্জের চাকরি নেয়৷

বাড়িটার নাম ‘আলোর ঠিকানা’৷ অনেক খোঁজাখুঁজির পর দক্ষিণ কলকাতার এই বাড়িটাই ওদের দু’জনের পছন্দ হয়৷ রজতের স্কুলও খুব কাছাকাছি, পাড়াটাও বেশ অভিজাত৷ অতএব বাড়িটা কেনার সিদ্ধান্ত নিতে ওদের একমুহূর্ত দেরি হয়নি৷ মহাশ্বেতাও আর্মির বদলির জীবন থেকে মুক্তি পেয়ে থিতু হতে চেয়েছিল৷
বাড়ি ফেরার কিছুক্ষণের মধ্যেই ল্যান্ড লাইনে রজতের ফোন আসে৷ আই এস ডি কলের রিং টোনটাই আলাদা৷ বাইরের বারান্দায় ইজিচেয়ারে মহাশ্বেতা মাথাটা এলিয়ে চোখ বুজেছিল৷ ভিতরের ঘরে অঞ্জলি ফোনে কথা বলছিল৷ একটু পরেই কর্ডলেসটা এনে মহাশ্বেতাকে বলে, ‘এই নাও, তোমার ছেলের ফোন৷’
মহাশ্বেতা ক্লান্ত হাতে রিসিভারটা কানে লাগায়৷ ও প্রান্ত থেকে রজতের গলা শুনতে পাওয়া যায়, ‘হ্যালো মাম, কেমন আছো? অঞ্জু বলছিল, তুমি খুব টায়ার্ড ফিল করছ৷ এখন একটু শুয়ে রেস্ট নাও, পরে কথা বলব, গুড ডে!’ রজত একতরফাই বলে যায়, মহাশ্বেতা হাঁ হুঁ ছাড়া আর কিছু বলার শক্তি খুঁজে পায় না৷
বেলা প্রায় দেড়টা৷ অঞ্জলি মাঝে এসে খাবার জন্য পীড়াপীড়ি করে৷ কাজের মেয়েটাও অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ফিরে যায়৷ মহাশ্বেতা চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান করে৷

এই সময়টায় সাধারণত মহাশ্বেতার রান্নাবান্না, ঘরের কাজ সব শেষ হয়ে যায়৷ সুদর্শন লাঞ্চে আসে প্রায় তিনটের কাছাকাছি৷ তাই মহাশ্বেতার হাতে অঢেল সময় থাকে৷ বারান্দায় টবে সে অনেকগুলো গাছ বসিয়েছে৷ অবশ্য সবই দেশি ফুলের— গরমে জবা টগর, হাসনুহানা, শীতকালে গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, গোলাপ, আরো কত কী৷ এই সময়টা পাইপ দিয়ে জল দেয়, তারপর বারান্দাটা ভালো করে ধুয়ে স্নানে যায়৷ স্নান সেরে ঠিক এই জায়গায় দাঁড়িয়ে চুল শুকোবার সময়েই বারান্দার জাফরি দিয়ে নিচে মেন গেটের দিকে নজর রাখে৷ গাড়িটা গেট দিয়ে ঢোকার সময় সুদর্শনের সঙ্গে চোখাচোখি হয় তারপর মহাশ্বেতা দ্রুত পায়ে দরজা খুলতে নিচে নামে৷ প্রতিদিনের রোজনামচায় এমনই টুকরো টুকরো স্মৃতিগুলো এই মুহুর্তে মহাশ্বেতাকে ভারাক্রান্ত করে তোলে৷

অঞ্জলি একটু আগেই মহাশ্বেতার দুপুরের খাবারটা টেবিলে রেখে গেছে৷ বোধহয় সুদর্শনের কাছে যাবে৷ মেয়েটারও ক’দিন খুব ধকল যাচ্ছে৷ সারাটা দিন হাসপাতাল ঘর করতে করতে বেচারা কাহিল, রাতের আগে বাড়ি ফিরতে পারে না৷ কাজের মেয়েটা ভেতরেই আছে, টিভি দেখছে বোধহয়৷ মহাশ্বেতা বারান্দায় ঠিক যেখানটায় বসে আছে তার পাশেই একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ উঠেছে৷ মিষ্টি গন্ধে চারপাশটা
ম’-ম’ করছে৷ বেশ কয়েকটা টিয়া, বুলবুলি, টুনটুনি বোধহয় বাসা করেছে৷ রোজ ওরা দলবেঁধে পাতার ছায়ায় গাছের ডালে এসে বসে, খেলা করে৷ ওদের দেখতে দেখতে মহাশ্বেতার দিন কাটে৷ আজ রোদটাও একটু কড়া উঠেছে, সামনের রাস্তায় লোকজন কম৷ দু-একটা ফেরিওয়ালা তাদের চেনা সুরে হেঁকে চলে যাচ্ছে৷

মহাশ্বেতার কানে কিছুই ঢুকছে না৷ একটা কথা ‘হিউম্যান ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ভাইরাস’ কেবলই কানে বেজে চলেছে৷ চোখের সামনে তিল তিল করে গড়ে ওঠা সবুজ স্বপ্নের পাহাড়টা যেন একটা বিধ্বংসী ধ্বংসের অপেক্ষায় দিন গুনছে৷

এরই মধ্যে ফোনটা আবার বেজে ওঠে৷ রজতের ফোন আসার পর কর্ডলেসটা পাশেই রাখা ছিল, মহাশ্বেতা আনমনে তুলে নেয়৷
—‘কিরে, কেমন আছিস তোরা?’ অপর প্রান্তে মৃণ্ময়ীর আওয়াজ ভেসে আসে, ‘কী কাণ্ডটাই বাধালি বলতো! এখানে সবাই খুব চিন্তায় ছিল৷ সামনে এতবড় কাজ, আর তো মাত্র কটা দিন বাকি! হ্যাঁরে, আমাদের হ্যান্ডসাম ভালো আছে তো?’
মৃণ্ময়ী এভাবেই কথা বলে৷ একটা প্রসঙ্গের মধ্যে আর একটা প্রসঙ্গ মিলেমিশে যায়৷ মহাশ্বেতা কোন জবাব দেয় না৷
—‘তুই একটু তাড়াতাড়ি চলে আসতে পারিস? খুব দরকার তোকে৷’ মহাশ্বেতার গলায় স্পষ্ট একটা উদ্বেগের ছাপ৷
—‘আমি তো দু একদিনের মধ্যে আসছি৷’ মৃণ্ময়ী বলে৷
—‘না না, তুই বরং কালই চলে আয়’, মহাশ্বেতার স্বরে অনুনয়ের সুর৷
‘আচ্ছা বাবা কালই আসছি৷’
বিয়ের আর মাত্র এক সপ্তাহ বাকি৷ আগামী পরশু রজত কলকাতায় পা রাখছে৷ অন্য সময় হলে মহাশ্বেতার মনটা আনন্দে নেচে উঠত হয়ত৷ ঘরদোর গুছোতে লেগে পড়ত কিংবা নতুন কোন রেসিপির খোঁজে পত্র-পত্রিকা ঘাঁটাঘাঁটি করত৷ কিন্ত্ত এই মুহুর্তে কিছুই ভালো লাগছিল না৷
মহাশ্বেতার ব্যবহারের এই পরিবর্তন অঞ্জলির নজর এড়ায় না৷
—‘মা, তোমার শরীরে কোনও কষ্ট হচ্ছে?’ অঞ্জলি শারীরিক অসুস্থতাই আন্দাজ করে৷
মহাশ্বেতা জবাবটা এড়িয়ে গিয়ে বলে, ‘নাঃ, ভালোই আছি, একটু দুর্বল লাগছে৷’

ইতিমধ্যে মৃণ্ময়ী চলে এসেছে৷ একটু বেশি ছুটি নিয়ে পাকাপাকিভাবেই৷ পরের দিনই রজতের প্লেন ল্যান্ড করছে কলকাতায়৷ আগের দিন সন্ধ্যেবেলায় মহাশ্বেতাকে একটু বেশিই অস্বাভাবিক লাগে৷ সুদর্শনও বাড়ি ফিরেছে৷ মোটামুটি সুস্থই আছে, তবে একটু খুঁড়িয়ে হাঁটতে হয়৷ বেশি সময় নিজের বেডরুমেই থাকে৷ কাজের মেয়েটাকে নিয়ে মৃণ্ময়ী ঘরের কাজকর্মে লেগে পড়েছে৷ কদিন ধরেই বিকেলের দিকে অঞ্জলিকে নিয়ে বিয়ের বাজারও করেছে৷ মহাশ্বেতাকে যাওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি কম করেনি৷ একদিনই গিয়েছিল, রজতের বিয়ের পাঞ্জাবি আর অঞ্জলির বেনারসিটা পছন্দ করেছে৷ সোনার দোকানের লোক বাড়ি এসে অঞ্জলির পছন্দমত গয়নার ডিজাইন জেনে গেছে৷ সবকিছুর মধ্যেও মহাশ্বেতার চলনে, ব্যবহারে একটা পরিবর্তন মৃণ্ময়ীর নজর এড়িয়ে যায় না৷ একটু বেশি রাতে মহাশ্বেতাকে একপ্রকার জোর করেই ছাদের ঘরে নিয়ে যায়৷

—‘কী হয়েছে, আমাকে খুলে বল তো৷’ মৃন্ময়ী নাছোড়বান্দা৷
মহাশ্বেতা অনেকক্ষণ চুপ করে থাকে৷ মৃণ্ময়ী বুঝতে পারে, মহাশ্বেতা একটা অব্যক্ত যন্ত্রণা লুকিয়ে রাখার চেষ্টা করছে৷ সেটা যে দৈহিক নয় সেটা বুঝতেও অসুবিধা হয় না৷ এগিয়ে এসে সস্নহে মহাশ্বেতার পিঠে হাত রাখে৷ তখনই মহাশ্বেতা মৃণ্ময়ীকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়ে— ‘আমার সর্বনাশ হয়ে গেছে রে মিনু৷’ এরপর একটু সময় নিয়ে বাকিটাও সবিস্তারে বলে ফেলে৷

দু’জনেই চুপচাপ হয়ে যায় অনেকক্ষণ৷ খোলা আকাশের নিচে অন্ধকার ছাদে দুই বান্ধবী একে অপরের মনের গভীরে ডুব দিয়ে কিছু যেন খুঁজতে চেষ্টা করে৷ যা পায়, তা শুধুই হতাশা৷ একটা অযাচিত পরিণামের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ৷

আজ রজত আসছে৷ সকাল থেকেই মৃণ্ময়ী মহাশ্বেতাকে মানসিকভাবে শক্ত হতে বলে৷ এরই মধ্যে মহাশ্বেতাও মৃণ্ময়ীকে পেয়ে অনেকটা জোর ফিরে পেয়েছে৷ সকালেই স্নান সেরে সামান্য কিছু প্রসাধনে নিজেকে একটু স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে৷

রজত বাড়ি ফিরেই ব্যাগটা রেখে মহাশ্বেতাকে জড়িয়ে ধরে৷ এটা ওর পুরোনো অভ্যাস৷ ছোট থেকেই মায়ের সঙ্গে তার বেশি মাখামাখি৷ স্কুল থেকে ফিরে মায়ের আদর না খেলে জামাকাপড় খুলতে চাইত না৷ রজতের স্পর্শটা আজ মহাশ্বেতাকে আগের মতো উচ্ছল করল না৷ একটা চাপা কষ্ট বুকটা ঠেলে উঠে গলায় আটকে গেল৷

আর দুটো দিন পরেই গায়ে হলুদ৷ নিমন্ত্রণের পাঠ কিছুটা মহাশ্বেতা আগেই সেরে রেখেছিল৷ বাকিটা সুদর্শন করেছে৷ গত দু’দিন সুদর্শনকে বেশ সুস্থ মনে হয়েছে৷ রিকশা আর টোটোতেই বাইরের কাজগুলো সেরেছে৷ পরশু থেকেই আত্মীয়-স্বজনেরা আসতে থাকবে৷ সুদর্শন পাড়াতেই একটা গেস্ট হাউস ক’দিনের জন্য ভাড়ায় নিয়েছে৷ ইতিমধ্যে রান্নার লোক ছাদের প্যান্ডেলে রান্নাবান্না শুরু করে দিয়েছে৷ ডেকরেটরের লোক বাড়ির সামনে নহবতখানা তৈরি শুরু করেছে৷ সবকিছুর তদারকি সুদর্শন নিজেই করছে৷ মাঝে মধ্যে মহাশ্বেতাকে কিছু বললেও ওর দিক থেকে জবাব পায় না৷

এরই মধ্যে মহাশ্বেতার অস্বাভাবিক আচরণটা রজতের চোখ এড়ায় না৷ অনেকভাবে সে জানতেও চেষ্টা করে৷ মহাশ্বেতা শরীরের বাহানায় সবকিছু এড়িয়ে যায়৷ কিন্ত্ত নিজেকে আর বোধহয় আটকে রাখতে পারে না৷ গায়ে হলুদের সকালেই রজতের গায়ে হলুদ লাগিয়ে অঝোরে কাঁদতে থাকে৷ মহাশ্বেতার এমন আচরণে একবাড়ি লোক অবাক হয়ে যায়৷ মৃণ্ময়ী কাছেই ছিল, চট করে মহাশ্বেতাকে ধরে ওপরের ঘরে নিয়ে যায়৷
গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হতেই রজত পোশাক ছেড়ে মায়ের কাছে চলে আসে৷ মহাশ্বেতা বিছানায় শুয়ে আছে৷ রজত চট করে প্রেশারটা চেক করে একটা ট্যাবলেট খাইয়ে চোখ বুঝতে বলে৷

মহাশ্বেতা কতক্ষণ ঘুমিয়ে পড়েছিল খেয়াল নেই৷ ঘুমটা ভেঙে যেতেই বুঝতে পারে বিকেল গড়িয়ে গেছে৷ ঘরে রজত আর অঞ্জলিকে দেখতে পায়৷ মৃণ্ময়ীও ঢোকে৷ রজত অঞ্জলিকে দরজাটা বন্ধ করতে বলে৷
মহাশ্বেতা খাটের ওপর উঠে বসে৷ একটা অজানা আশঙ্কার মুখোমুখি সে৷ বুঝতে অসুবিধা হয় না, যে নির্মম সত্যটাকে এতদিন সে গোপন কারাগারে বন্দি করে রেখেছিল, সে এবার মুক্তি চাইছে৷

রজত কোনোরকম ভনিতা না করেই বলতে শুরু করে, ‘মা, মণিমাসির কাছে আমরা সবটাই শুনেছি৷ তুমি হয়তো অবাক হবে, আমি আর অঞ্জলি ব্যাপারটা অনেক আগেই জেনেছিলাম৷ বাবার আর তোমার রুটিন ব্লাড টেস্টের সময় আমরা অনেকগুলো সেগমেন্টের সঙ্গে এইচ আই ভি টেস্টটাও করিয়ে নিয়েছিলাম৷ ইন ফ্যাক্ট আমার আর অঞ্জলিরও৷ আসলে আমাদের প্রফেশনে এটাই আমাদের ঠিকুজিকুষ্টি৷ সেটাও প্রায় বছর খানেক আগে৷ তখনই আমরা প্রথম জানতে পারি তোমার আর বাবার ভাইরাস এফেকশনটা পজেটিভ৷’
রজত অনেকটা প্রত্যয়ের সঙ্গে নাটকীয়ভাবে বলে চলে৷ মহাশ্বেতার সবকিছু অবিশ্বাস্য লাগে৷ সেই ছোট্ট রজত, মনে পড়ে ওর মাছের কাঁটা বেছে দেওয়ার সময় মহাশ্বেতা চশমা পরে নিত, পাছে একটা ছোট্ট কাঁটাও ওর গলায় চলে না যায়৷ একবার তো খেতে বসে জিভ কামড়ে রক্তারক্তি, মহাশ্বেতা জ্ঞান হারিয়েছিল৷ সেই ছোট্ট রজত আজ জীবনের এতবড় ঘৃণ্য, অভিশপ্ত, একটা কঠিন সমস্যাকে কত সহজভাবে বলে চলেছে৷ ওর ব্যক্তিত্বের এই দৃঢ়তা মহাশ্বেতার ক্ষীণ সত্তাকে আলোকিত করে৷ এবার রজত মহাশ্বেতার খুব কাছে সরে আসে৷ একেবারে কাছে, মায়ের দুর্বল হাতটা নিজের সবল হাতের বেষ্টনীতে নিয়ে অভয় দিয়ে বলে, —তুমি কোনোরকম নার্ভাস হয়ো না৷ এটা অত্যন্ত প্রাইমারি স্টেজ৷ তাছাড়া অলরেডি তোমাকে আর বাবাকে একজন এইচ আই ভি স্পেসালিস্ট ট্রিটমেন্ট করছেন৷ তুমি বা বাবা চেনো তাকে, ডাঃ ভেঙ্কটেশ৷ ওঁকে তোমাদের সিম্পলি একজন ডক্টর অফ মেডিসিন বলেই জানানো হয়েছে৷ ইনফ্যাক্ট এ সমস্ত কৃতিত্ব অঞ্জলির৷ সি হ্যাজ মেড এভরি গেমপ্ল্যান৷’

মহাশ্বেতা রজতের হাত দুটো ধরে ফেলে৷ নির্বাক ঠোঁট দুটো অনেক কিছু বলতে গিয়েও পারে না৷ দুটো চোখে নেমে আসা জলের ধারা দৃষ্টিকে ঝাপসা করে তোলে৷ রজত মহাশ্বেতার চোখের জল মুছিয়ে কাছে টেনে নেয়৷

—‘মা প্লিজ কেঁদো না৷ বাবা জানলে কষ্ট পাবে৷ হি ইজ ওনলি আওয়ার পেশেন্ট, দ্যাটস্ অল৷ তাছাড়া এই ভাইরাসে যে কেউ অ্যাফেক্টেড হতেই পারে৷ পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ, ইচ্ছায় হোক বা অনিচ্ছায়, আজ এই ভাইরাসে আক্রান্ত৷ তাছাড়া অনেক সময় কনট্যামিনেটেড ব্লাড ট্রান্সফিউশন, হাইফোডারমিক নিডলস্-এর ব্যবহারেও এই ভাইরাস অন্য কারো রক্তে মিশে যেতে পারে৷ তুমি তো জানো মা, নাইনটিন সিক্সটিটুর ওয়ারে বাবাকে লাইন অফ্ কন্ট্রোলে থাকতে হয়েছিল, বোমার আঘাতে ইনজিওর হয়ে প্রায় চল্লিশ ঘণ্টা বাঙ্কারে কাটাতে হয়েছিল৷ তখন কতবার ইঞ্জেকশন, ব্লাড ট্রান্সফিউশন হয়েছে৷ ওই এমারজেন্সিতে অনেক সময় অন্য কোনও সোলজারের সঙ্গে ডাইরেক্ট ব্লাড ট্রান্সফিউশনও করতে হয়৷ ইন দ্যাট ইভেন্ট এনিথিং মে হ্যাপেন৷’

মহাশ্বেতার এতক্ষণ সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছিল৷ একটা গভীর খাদের কিনারা থেকে রজতের কথাগুলো যেন ওকে টেনে তোলার চেষ্টা করছিল৷

কথা বলতে বলতে রজত কিছুটা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে৷ উঠে গিয়ে পর্দাগুলো সরিয়ে জানলাগুলো এক এক করে খুলে দেয়৷ অঞ্জলি এগিয়ে এসে মহাশ্বেতার পাশে বসে ওর পিঠে হাত রাখে৷

খোলা জানলা দিয়ে অনেকটা পড়ন্ত রোদ মহাশ্বেতার সারা শরীরে ছড়িয়ে যায়৷ ঘরভর্তি গুমোট অন্ধকারটাও অনেকটাই কম৷ ওর চারপাশেই এখন শুধু আলোর দিশারীরা৷