• facebook
  • twitter
Friday, 22 November, 2024

অভিশপ্ত আলমারি

পায়েল চট্টোপাধ্যায় ১ এটাই হবে শ্যামলী জানত৷ আলমারিটা সকলে ওর ফ্ল্যাটেই নিয়ে যেতে বলবে৷ পটলগুলো গোল করে কেটে বড় গামলাটায় জলে ভেজাতে ভেজাতে কথাগুলো কানে এলো শ্যামলীর৷ কয়েক মাসের মধ্যেই এই বাডি়টা ছেডে় ওদের তিনটে টুকরো পরিবার চলে যাবে তিনটে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে৷ এই শর্তেই প্রোমোটারকে বাডি়টা দেওয়া হচ্ছে৷ বেশ কিছু আসবাবপত্র এখনো আগের মত

পায়েল চট্টোপাধ্যায়


এটাই হবে শ্যামলী জানত৷ আলমারিটা সকলে ওর ফ্ল্যাটেই নিয়ে যেতে বলবে৷ পটলগুলো গোল করে কেটে বড় গামলাটায় জলে ভেজাতে ভেজাতে কথাগুলো কানে এলো শ্যামলীর৷ কয়েক মাসের মধ্যেই এই বাডি়টা ছেডে় ওদের তিনটে টুকরো পরিবার চলে যাবে তিনটে আলাদা আলাদা ফ্ল্যাটে৷ এই শর্তেই প্রোমোটারকে বাডি়টা দেওয়া হচ্ছে৷ বেশ কিছু আসবাবপত্র এখনো আগের মত রয়েছে, যেন তাদের কোনো বদল হওয়ার ইচ্ছেই নেই৷ আলমারিটাও তেমন৷ শাশুডি়র প্রিয় আলমারি, ঠিক যেন প্রাণের সখী৷ আর সেগুন গাছের পুরনো জিনিসটা এখনো বেশ মজবুত রয়েছে৷ মৃতু্যর আগের দিন পর্যন্ত শ্যামলীর শাশুডি় মানে সৌদামিনী দেবী যেমনটা ছিলেন৷ এই আলমারি গোছাতে গোছাতেই তো দুম করে চলে গেলেন৷ শ্যামলী তখন রান্নাঘরে পাটিসাপটা তৈরি করছিল৷ আলমারিটা শ্যামলী গুছিয়ে রাখত, আসলে চোখে স্পষ্ট দেখতে পাওয়ায় একটা অসুবিধা ছিল সৌদামিনী দেবীর৷ গ্লকোমা ধরা পডে়ছিল শেষ দিকে৷ প্রায় সাতবছর আগের সন্ধ্যেটা মায়ার মত শ্যামলের বুকে বেঁচে রয়েছে৷ শ্যামলী তখন রান্নাঘরে বড় চাটুটার মধ্যে পাটিসাপটাগুলো ওল্টাচ্ছে৷ পাটিসাপটা উল্টে মুড়তে তখনও বেশ ভয় পেত শ্যামলী, আজও ভয় পায়৷ ছেলে-বৌমা এই নিয়ে হাসাহাসি করে এখন৷ তখন চৈতি, মিলিরা যেমন হাসাহাসি করত৷ ওরা সেদিন তখনও অফিস থেকে ফেরেনি৷ চৈতি আর মিলি মানে শ্যামলীর দুই জা কখনোই রান্নাঘরে ঢুকতে ভালোবাসে না, তবে সকালের রান্নাটা দুজনে মিলে করে৷ এই নিয়ম শাশুডি়ই গডে় দিয়েছিল, এখনো তাই চলছে৷ দু’জনেই বাইরে যেত, তাড়াহুড়ো থাকত বাডি়র বাকিদেরও৷ শ্যামলীর সেসব পাট কোনকালেই ছিল না, শুধু ছেলের স্কুলটুকু থাকত৷ কাকিমারাই রেডি করে দিত পুচকুনকে৷ তারপর মোটামুটি আধ ঘন্টার তফাতে সকলেই বাডি় থেকে বেরিয়ে যেত৷
সেদিনও সকলে বাডি় থেকে বেরিয়ে যেতে, পাটিসাপটাগুলো নিয়ে রান্নাঘরে বসেছিল শ্যামলী, শাশুডি় আলমারি গোছাবে বলে নিজের ঘরে চলে গেল, তখন পাটিসাপটা তেলে পড়ার ছ্যাঁক শব্দ, শ্যামলীর বুকে এসে লাগল৷ একটু পরেই একটা ভারী কিছু মেঝেতে পডে় যাওয়ার শব্দ৷ শুনেছিল শ্যামলী৷ তারপর ফোন, হাসপাতাল, জলজ্যান্ত মানুষটা মৃতদেহ হতে খুব একটা সময় নেয়নি৷ নিজের ভেতর একটা ঠান্ডা স্রোত অনুভব করছিল শ্যামলী৷

তিনতলা বাডি় আর রান্নাঘরটুকু নিয়েই এতগুলো বছর কেটেছে শ্যামলীর, সঙ্গে সৌদামিনী দেবীরও৷ বাডি়তে এক টুকরো ময়লাও সহ্য করতে পারতেন না সৌদামিনী দেবী৷ স্বামী মারা যাওয়ার সময় পিঠোপিঠি তিন সন্তানের বয়স তখন কৈশোরবেলায় উঁকি দিচ্ছে৷ স্বামীর মৃতদেহের সামনে বসেও এক ফোঁটা চোখের জল ফেলেননি মধ্য-চল্লিশের সৌদামিনী৷ কঠোর হাতে সন্তানদের মানুষ করেছেন৷ শ্বশুর-শাশুডি়র খেয়াল রাখার পাশাপাশি পারিবারিক ব্যবসার দিকেও তীক্ষ্ণ নজর ছিল সৌদামিনীর৷ শ্বশুর-শাশুডি়ও একমাত্র বৌমার ওপর সবকিছু ছেডে় দিয়ে দিব্যি নিশ্চিন্ত জীবন কাটিয়েছিলেন৷ তেমনটাই শুনে এসেছে শ্যামলী৷ পুরুষকর্তৃত্বহীন বাডি় হওয়া সত্ত্বেও শৃঙ্খলার কোন অভাব ছিল না৷ বাডি়র পুরুষরাও এই ঘেরাটোপে থাকতেই পছন্দ করেছে আজীবন৷

বিয়ে হয়ে আসার পর প্রথম প্রথম এ বাডি়র লতানেগাছগুলো বড় প্রিয় ছিল শ্যামলীর৷ রোজ জল দিত আর ওদের সঙ্গে মনের কথা বলত৷ স্বামীর সঙ্গে আলাপ, কথাবার্তা বলতে রাতের বিছানা আর একটা ক্লান্ত মানুষের নাক ডাকার শব্দ শুনতে পাওয়ার মধ্যবর্তী সীমানা-সময়৷ ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ, ভিজে তোয়ালে, বিছানার চাদরের একটা অদ্ভুত গন্ধে শ্যামলীর চোখ জ্বালা করত৷ পুরনো রক্ষণশীল বাডি়টাতে একটা উনুন ছিল তখনো, কিছু রান্না-বান্না উনুনে হত, উনুনের ধোঁয়া বুক পর্যন্ত পৌঁছে যেত৷

শ্যামলীর বিয়ের প্রায় ছয়-সাত বছর পরে এই বাডি়র আরও দুই বউ আসে৷ দুজনেই স্কুল শিক্ষিকা৷ শাশুডি় নিজে পছন্দ করেই এনেছিলেন৷ ঠিক যেমন শ্যামলী এই বাডি়তে এসেছিল৷ বাকি দুই বউ একই পরিবারের মেয়ে৷ মাসতুতো বোন৷ সৌদামিনী দেবীর সইয়ের পরিবার৷ মজুমদার ভিলায় চাকরিজীবী মেয়ে বিয়ে হয়ে আসবে এ বড় সহজ ছিল না, তবুও সইয়ের কথায় শ্বাশুডি় মত দেয়৷ মজুমদারভিলা আলো করে দুই বউ তিনতলা বাডি়র আর দুটো তলা দখল করেছিল৷ ওদের ঘরের পাশ দিয়ে যেতে যেতে শ্যামলী কতবার দাঁডি়য়ে পডে়ছে, কী সুন্দর গন্ধ! ‘ওটা কি মাখো গো তোমরা! এমন সুন্দর গন্ধ বেরোয়?’ একদিন শ্যামলী জিজ্ঞেস করেছিল৷ একটা কাচের সুন্দর দেখতে শিশি বার করে দিয়েছিল চৈতি, মিলিও একটা নাম কাগজে লিখে দিয়েছিল৷ ‘এটা তো পারফিউম, সেন্টও বলে, তুমি যেমন পাউডার মাখো, আমরা এটা ব্যবহার করি, দাদাকে বলো না এনে দিতে!’ তারপর দুজনেই খিলখিল করে হেসে বেরিয়ে গিয়েছিল৷


—‘দেখো বড়দি, মা যে তোমায় সবচেয়ে বেশি ভালবাসত এই কথা কি অস্বীকার করতে পারো?’
চায়ের কাপে আয়েসী চুমুক দিতে দিতে বলল চৈতি৷ মজুমদার-ভিলার বড় বারান্দাটায় বসে কথা হচ্ছে৷ আগামীকাল থেকে বাডি়র জিনিসপত্র শিফটিং শুরু হবে৷ কিছু জিনিসপত্র বিক্রি করার ব্যবস্থা করেছে তিন ভাই মিলে৷ বাকিগুলো নিয়েই সিদ্ধান্তের পসরা সাজানো হচ্ছে৷

—‘দেখো দিদি আমরা তো আর কতটুকু সময়ই বা বাডি় থাকতাম, ওই আলমারিদের কাছে সারাক্ষণ তুমি ঘুরঘুর করতে, কারণ মায়ের শাডি়, সোয়েটার, ব্লাউজ থেকে শুরু করে উল-কাঁটা এমনকি মা নাকি কতগুলো পারফিউমের শিশিও রেখে দিয়েছিল ওই আলমারিতে, এইতো সেদিন সব জিনিসপত্র বার করতে গিয়ে দেখলাম, আর সেটা শুধু তুমিই জানতে, এরপরেও বলবে ওই আলমারি তুমি নিতে চাও না! মায়ের স্মৃতির ওপর তোমারই তো সব থেকে বেশি অধিকার!’

চৈতির কথায় শ্যামলী চমকে ওঠে৷ মজুমদার-ভিলায় নীচের তলায় দুটো বড় আয়না ছিল৷ ওগুলো আজ খুলে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে৷ অনেকগুলো লাল টিপ আটকানো ওতে৷ শ্যামলীর চোখ পডে় ওখানে, নিজের সাদা চুল, কুঁচকে যাওয়া চামড়া, মলিন হয়ে যাওয়া আয়নাটায় ধূসর দেখায়৷ আয়নাটার একটা কোণ দরজা লেগে ভেঙে গেল, শ্যামলী দৌডে় ওইদিকে গিয়ে কাচের টুকরোগুলো গুছিয়ে নিচ্ছে, নইলে কারোর পায়ে লেগে রক্ত পড়বে৷ কাজটা করতে করতেই বলে

—‘আমার ঘরে আসলে তেমন জায়গা নেই রে, একটা ঘর তোদের দাদার আর আমার, আরেকটা ঘর ছেলে-বউয়ের, আর একটা এক্সট্রা ঘর রেখেছি, বুঝেছিস আজ না হয় ওরা দুজন, কিন্ত্ত কখনো তো…’
শেষের কথাগুলো বলার সময় শ্যামলীর চোখ-মুখ চকচক করে ওঠে, ‘তবে এক ফুঁয়ে যেভাবে মোমবাতি নিভে যায়, তেমন করেই শ্যামলীর কথাগুলো থামিয়ে দিয়ে চৈতি বলে ওঠে, দিদি আমাদের পুচকুনর আর ওর বউয়ের বাচ্চা-টাচ্চা নেওয়ার ইচ্ছে আছে বলে আমাদের মনে হয় না, তুমিও জানো, আর এই বাডি়তে সন্তান না আসার বোধহয় কোনো অভিশাপ রয়েছে, তাই এই ভেবে ঘর খালি করে রেখো না, এভাবে বললাম বলে আবার কিছু মনে করো না দিদি৷’

রান্নাঘর থেকে তেলের গন্ধ আসছে, মাছের কোন একটা পদ বসানো রয়েছে, খুব ঝাঁঝালো গন্ধ আসছে ওখান থেকে, চোখে জল আসে শ্যামলীর৷ রান্নাঘরের দিকে দৌডে় যায়৷

শ্যামলী বাদে এই বাডি়র বাকি দুই বউ অর্থাৎ মিলি আর চৈতি দুজনেই সন্তানহীন৷ বাডি়তে এই নিয়ে কম অশান্তি হয়নি৷ তবে সেসব চাপা অন্ধকারের মত মজুমদার ভিলার ইট, কাঠ-পাথরে ঘুমিয়ে থেকেছে৷ শ্যামলী যখন সন্তানসম্ভবা হয় তখন দুই দেওরের বিয়ে হয়নি, কতবার পুচকুনের দুধ গরম করতে বসিয়ে দেওর, শাশুডি় সকলকে ভাত বেডে় দিতে গিয়ে দেখেছে দুধ ফুটে সব জ্বলে গেছে৷ আবার নতুন করে সব করতে হয়েছে৷ বিষয়টা শাশুডি়র নজরে এসেছিল, দুই বউকে সকালের রান্নার দায়িত্বটা শাশুডি়ই দেন৷ পুচকনকে ছেডে় সকালের দিকটা আর রান্না ঘরে ঢুকতে হয়নি শ্যামলীকে৷

দুপুরের দিকে বাডি়র একমাত্র নাতিকে বেশ খানিকটা বড় বয়স পর্যন্ত তেল মালিশ করে দিতেন সৌদামিনী, একদিন ছাদে জামা কাপড় তুলতে গিয়ে শ্যামলী শুনতে পেয়েছিল ‘আমার বাকি দুই বৌমার তো এখনো কোনো ছেলেপুলে হলো না গুরুদেব, একটা কোন ব্যবস্থা আপনাকে করতে হবে, আপনার মত করে বাডি়ঘরের বাস্তু কে বোঝে বলুন তো! আপনাকে পরের সপ্তাহেই একদিন আসতে হবে এখানে৷’ শাশুডি় ফোনে কথা বলছে৷

পুচকুন তখন তেল মেখে ঠাকুমার শাডি় নোংরা করে দেবার ভয় দেখানোর খেলায় মেতেছে৷ শ্যামলী যে ছাদে এসে জামা কাপড় তুলছিল সেটা সৌদামিনী দেবী দেখতে পাননি, সেদিন হঠাৎ করে আকাশে মেঘ দেখতে পেয়েছিল শ্যামলী, ঘন কালো চুলের মত মেঘ৷ সন্ধ্যেবেলায় খুব বৃষ্টি হয়েছিল৷


—‘কী ছেলেমানুষী শুরু করলে বলো তো তুমি? আলমারি নিয়ে তুমি এমন অদ্ভুত ব্যবহার করছ কেন? মা যতদিন বেঁচে ছিল মায়ের এই আলমারির চাবি তো তোমার কাছেই থাকত, এখন সকলে মিলে যখন মায়ের ব্যবহার করা কিছু কিছু আসবাবপত্র নিজেদের ফ্ল্যাটে নিয়ে যাচ্ছে আর সকলে চাইছে এই আলমারিটা তুমি নিয়ে যাও, সেই চাওয়াটা অযৌক্তিক কিছু নয়, তুমি এটা নিয়ে এরকম অদ্ভুত আচরণ করছ কেন?’
অভয়ের কথায় ক্ষোভ স্পষ্ট৷ সন্ধ্যেবেলায় এই সময়টায় আজকাল বাডি়তে থাকে অভয়৷ বাকি সময় ব্যবসার কাজে বাইরে৷ স্বামীর মুড বুঝে আলমারি না নেওয়ার কথাটা পেডে়ছিল শ্যামলী৷ আপাতত প্রতিক্রিয়ার ঝাঁঝে শ্যামলীর ভেতরটা জ্বলছে৷ মজুমদারভিলা প্রোমোটারের হাতে যাচ্ছে৷ প্রায় সাত বছর হয়ে গেছে সৌদামিনী দেবী চলে গেছেন৷ বাডি়টার বুক জুডে় শুধু শ্যাওলা৷ সবুজ রঙের আস্তরণ৷ এই বাডি় থেকেই শ্যামলীর ছেলের বিয়ে হয়৷ ছেলের বিয়ের পর শ্যামলী প্রথম কথাটা অভয়ের কানে তোলে ‘এত বড় বাডি়, কম ঝামেলা নাকি!’ সম্পর্কগুলোর ভেতরেও অজস্র ফাটল৷ সকলে সহজেই সহমত হয়৷ উত্তর কলকাতার ব্যস্ত বুকে এমন তিনতলা বাডি়র জন্য উপযুক্ত প্রোমোটার পেতে তেমন কষ্ট করতে হয়নি তিন মজুমদার ভাইকে৷ বাডি়র আসবাবপত্র অধিকাংশই দেহ রেখেছে৷ সেসব আপাতত আস্তাকুঁডে় যাওয়ার অপেক্ষায়৷ প্রোমোটারের দেওয়া তিনটে ফ্ল্যাটে এই বাডি়র মজবুত কয়েকটা আসবাবপত্র যাবে৷ সকলেই নিজের মতো কিছু না কিছু বেছে নিয়েছে৷ এই আলমারিটা নিয়েই যত গন্ডগোল৷ শাশুডি়র সবচেয়ে কাছের ছিল তার বড় বউ শ্যামলী, তাই আলমারিটা তার কাছেই যাক এমনটাই চাইছে সবাই৷ শুধু শ্যামলী চাইছে না৷ ওর ভেতর পাহাডে়র মতো স্মৃতিরা লাভা উগরে দেয়৷

কত বছর আগের কথা৷ তবুও ধ্রুবতারার মতো স্পষ্ট মনে আছে৷ সেদিন সন্ধ্যেবেলা গুরুদেব এসেছিলেন৷ ‘সৌদামিনী এই বাডি়টাতে বড় বেশি অন্ধকার, তুই বাগানে বেশি করে ফুল-গাছ লাগা, আর এই বাডি়তে কোন কাচের শিশিতে আতর বা কোনো সুন্দর গন্ধওলা শিশি রাখবি না, বিশেষ করে বাডি়র কোনো আলমারিতে যেন ওইসব গন্ধগুলা শিশি না থাকে, ওতে অমঙ্গল হবে৷ এই অমঙ্গল কাটলে তবেই তোর বাকি দুই বৌমার কোল জুডে় সন্তান আসবে৷’ শ্যামলীর কানে বাজ পড়ার মতো করে কথাগুলো বেজেছিল৷ গুরুদেবের এইসব কথায় গোপনে হাসির তুফান তুলেছিল চৈতি আর মিলি৷ সে কথা শাশুডি়র কানে পৌঁছতে বেশি সময় নেয়নি৷ তবুও নিজের মতো করে চেষ্টা করেছিলেন সৌদামিনী৷ ফুলগাছের চারা এনে বড় বৌমাকে দিতেন৷ কয়েকদিনের মধ্যেই রোদে পুডি়য়ে দেওয়ার তাপ যেন সব গাছকে ছারখার করে দিত৷ চন্দ্রমল্লিকা, জবা, গাঁদা সব ফুলগাছ একসঙ্গে মরে যেতে লাগল৷ কোন এক অজ্ঞাত কারণে সৌদামিনী দেবীর আলমারি থেকে ফুরফুরে সেন্টের গন্ধ বেরোত৷ যদিও মায়ের কথায় বাডি়র বাকি দুই ছেলে নিজেদের ঘরে আর কখনো গন্ধওলা কাচের শিশি বা আতর রাখেনি৷


—‘দেখো মলি এই নিয়ে রোজ রোজ অশান্তি আর ভালো লাগছে না, কাল সব জিনিসপত্র ফাইনালি শিফট হবে, কত কাজ বলো তো এই সময়, আলমারি নিয়ে তোমার এই পাগলামো আমি আর নিতে পারছি না৷ এখন মনে হচ্ছে ওটা একটা অভিশপ্ত আলমারি৷ আর অশান্তি করোনা৷ আমায় একটু বেরোতে হবে৷’
অভয়ের কথাগুলো তীরের মতো এসে শ্যামলীর বুকে বিঁধছিল৷ অভয় উল্টোদিকে ফিরে বসে কিছু কাগজপত্র গুছোচ্ছিল, বাইরে বেশ মেঘ করেছে৷ অভয়ের পিঠের উপর আছডে় পডে় শ্যামলী৷

—‘আলমারিটা আমাদের ফ্ল্যাটে ঢোকালে আমাদের ঘরে আর কোনদিন কোন বাচ্চা আসবে না, তোমার ছেলে বৌমা আর বাবা-মা হতে পারবে না৷ চৈতি আর মিলি যাতে কোনদিন মা হতে না পারে তাই তোমার দেওয়া সব আতর, গন্ধতেলের শিশি, এমনকি তোমার এনে দেওয়া দুটো সেন্টের শিশিও আমি মায়ের আলমারিতে রেখে দিয়েছিলাম, যাতে গুরুদেবের কথামতো এই বাডি়র অমঙ্গল কোনোদিন না কাটে! তোমার মনে আছে বাগানের সব ফুলগাছ মরে যাচ্ছিল, আমি মেরে দিতাম সব৷ আমি আসতে দিইনি ওদের বাচ্চা৷ তুমি ঠিক বলেছ ওই আলমারিটা অভিশপ্ত৷ ওই আলমারি গোছাতে গিয়েই মায়ের স্ট্রোক হলো, ওটা তুমি ফেলে দাও৷’

বাইরে বৃষ্টির শব্দ আর শ্যামলীর কথাগুলো ঝোড়ো হাওয়ার মত করেই মিশে যাচ্ছিল৷ শ্যামলীর শরীরটা মাটিতে মিশে যাচ্ছে৷ অভয় কোনমতে তুলে ওকে বসায়৷ খানিকক্ষণ সব চুপচাপ৷

—‘শান্ত হও মলি, মেজ আর ছোটর পরিবারে সন্তান না আসার নানা কারণ থাকতে পারে, মা তো পরিবারের সম্মানের কথা ভেবে ওদের ঠিকমতো ডাক্তার দেখাতেও দেয়নি, এসব বাস্তু-টাস্তুর বিষয়ে আমার কিছু জানা নেই৷ আর নিজের ছেলে বউয়ের ব্যক্তিগত ব্যাপারে এত বেশি ঢুকে পড়ো না যাতে সম্পর্কগুলোয় শুধুই অন্ধকার লেগে থাকে৷ এসব কথার আর কোনোদিন বোলো না, এগুলো কেউ জানতে পারুক আমি চাই না৷’
শ্যামলীর শক্ত করে ধরা দুটো হাত ছাডি়য়ে কাগজপত্র নিয়ে বাইরে বেরিয়ে যায় অভয়৷ ছায়ামানবের মতো৷ শ্যামলীর ভেতরটা হাহাকারে ওলট-পালট হচ্ছে৷ শামুকের মতো পা টেনে টেনে শ্যামলী সৌদামিনী দেবীর ঘরের আলমারিটার সামনে এসে দাঁড়ায়৷ আলমারিটা যেন একটা অলৌকিক মানুষ৷ তার মুখটা বায়োস্কপের পর্দার মতো বদলে বদলে যাচ্ছে৷ চৈতি, মিলি সকলকে দেখতে পাচ্ছে ও৷ নিজের চোখ চেপে ধরে৷ অনেকক্ষণ পরে আবার তাকায়৷ আলমারির মধ্যে শ্রেয়ার মুখটা
ভেসে ওঠে৷