কাকতালীয়

অজয় দেবনাথ

ব্যস্তসমস্ত হয়ে বাস থেকে নেমেই বিবৃতি দেখতে পেল তার ব্যাগটা কাটা। জৈষ্ঠ্যের গা পুড়িয়ে দেওয়া অসহ্য দুপুরে বাসস্ট্যান্ডের এসি লাগানো যাত্রী প্রতীক্ষালয় অজ্ঞাত কারণে তালা বন্ধ। এমন প্রয়োজনীয় সময়ে বন্ধই যদি রাখবে তবে জনগণের পয়সা খরচ করে এসব করাই বা কাদের কল্যাণের উদ্দেশ্যে! বিরক্ত হয় বিবৃতি। রাস্তার পাশে একলা দাঁড়িয়ে থাকা একটি মাত্র ঝাঁকড়া কৃষ্ণচূড়ার নীচে তেরছা রোদ্দুরের ছায়ায় দাঁড়ায় সে। ব্যাগ খুলে আঁতিপাঁতি করে খুঁজে দেখে পার্স নেই, অতএব পার্সে রাখা এটিএম কার্ড, আইডেন্টিটি কার্ড, প্যান কার্ড, সেইসঙ্গে একান্ত ব্যক্তিগত কিছু কাগজপত্র কিছুই নেই। শাশ্বতর দেওয়া পার্সেলটাও নেই। তাদের অস্তিত্বের সেতু সেই বিশেষ পার্সেলটা।

বোতল থেকে একটু জল খায় বিবৃতি, তেষ্টায় নাভি পর্যন্ত শুকিয়ে গেছে যেন। ডকুমেন্টগুলো নাহয় ডুপ্লিকেট বের করে নেওয়া যাবে কিন্তু পার্সেলটা! একবার ভাবল থানায় গিয়ে একটা ডায়েরি করে। কিন্তু থানাপুলিশ মানেই দুনিয়ার ঝামেলা, দুনিয়ার প্রশ্ন। তারপর যদি এনকোয়ারি করতে বাড়ি গিয়ে ওঠে তবে তো কেল্লা ফতে।


কিন্তু শাশ্বত কী ভাববে? শাশ্বত কিছুতেই দিতে চায়নি। সে একরকম জোর করেই নিয়ে এসেছিল। এখন কী উত্তর দেবে সে! শাশ্বত জানতে পারলে একমুহূর্তেই তাদের সম্পর্কটা শেষ হয়ে যাবে, ভেঙে চুরমার যাবে তার স্বপ্ন, বদলে যাবে জীবনে বেঁচে থাকার মানে। হয়তো এরপর জীবনটাই বয়ে যাবে সম্পূর্ণ অন্যখাতে। শাশ্বতর চোখে সে ঘৃণ্য-হীন-নীচ মনোবৃত্তির একটা মেয়ে হয়ে যাবে এক লহমায়। আর পাঁচটা মেয়ের সঙ্গে কোনও তফাৎই থাকবে না তার। অনেক কষ্টে রাজি করাতে পেরেছিল, এখন শাশ্বত ভাববে সে নিছকই একটা ঠগ, জোচ্চোর। ভাববে সবটাই ছলনা, অভিনয়। পার্সেল হাতানোই ছিল মূল উদ্দেশ্য। সর্বোপরি মানুষের ওপর থেকে, সমাজের ওপর থেকে শাশ্বতর আস্থাটা সম্পূর্ণ হারিয়ে যাবে, হয়তো আর কোনদিন কাউকে বিশ্বাস করতে পারবে না। ছিছি! নিজের ওপর ধিক্কারে নিজেরই মরে যেতে ইচ্ছে করছে। অথচ…

সামনের জুলাইতে বাইশে পা দেবে এমএ ফার্স্ট ইয়ারে পড়া বিবৃতি। বাড়ি থেকে ইতিমধ্যেই বিয়ের জন্য চাপ দিতে শুরু করেছে। দিদির বিয়ে হয়ে গেছে পাঁচ বছর। তাদের মধ্যবিত্ত সংসার। বাবা বেসরকারি অফিসের চাকুরিজীবী। বিয়ের ব্যাপারে মায়ের উৎকণ্ঠাই বেশি। বরং দুই মেয়েকেই বিদায় দেবার আসন্ন শূন্যতার কথা ভেবে বাবা চিরকালই ব্যাকুল। বাবার প্রশ্রয় না পেলে হয়তো হায়ার সেকেন্ডারির পরেই বিয়ে ছাড়া গতি ছিল না। চারিদিকে ধর্ষণ নিয়ে যা চলছে যে কোনও মা-বাবাই মেয়েকে পাত্রস্থ করতে পারলে বাঁচে। অবশ্য বিয়ের আগে বা পরে, সুন্দরী বা কুৎসিত, স্বাভাবিক কিংবা বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন অথবা যে বয়সেরই হোক না কেন, মেয়েরা কতটুকু নিরাপদ সে প্রশ্ন থেকেই যায়। প্রায় গোটা পুরুষ সমাজটাই যেন মানসিকভাবে অপ্রকৃতিস্থ, পশুরও অধম হয়ে গেছে। মেয়ে মানেই ভোগ্যসামগ্রী, অবশ্য আদিমকালে মানুষের নিজস্ব চেতনা জাগ্রত হওয়ার সময় থেকেই মেয়েরা তো ভোগ্যসামগ্রীই! বৃথাই সভ্যতার বড়াই! বৃথাই প্রকৃতির শ্রেষ্ঠ জীব হওয়ার অহংকার!


নিম্নমধ্যবিত্ত ছাপোষা পরিবারের বছর ছাব্বিশের শাশ্বত বাংলায় মাস্টার্স করে এখন থিসিস করছে। লেখাপড়ায় আগাগোড়া ভালো হলেও তার পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা একদিনের জন্যেও তার চলার পথে সহযোগী হয়নি। তিন ভাইবোনের মধ্যে একমাত্র সে-ই অসম্ভব মনের জোর ও মেধা এবং অবশ্যই যুগের অনুপযোগী খাপছাড়া রকম সততায় এগিয়ে চলেছে। খাতাবই ঠিকঠাক কিনতে পারেনি। বন্ধুদের কাছে চেয়েচিন্তে, লাইব্রেরিতে বসে পড়াশোনা করে তার একার লড়াই একাই লড়েছে। হাইস্কুলে পড়ার সময় থেকে দুবেলা টিউশনি করে নিজের পড়ার খরচ চালিয়েছে, মাস্টারমশাইরাও অবশ্য যে যার মতো করে যথেষ্টই সহযোগিতা করেছেন।

কলেজজীবন থেকে সংস্কৃতিমনস্ক আর পাঁচজন গড়পড়তা বাঙালির মতোই শাশ্বতর লেখালিখিতে হাতেখড়ি। তবে শাশ্বতর কল্পনায় প্রেমের রঙিন বুদবুদ সেভাবে স্থান পায়নি। বরং কঠোর বাস্তবের কাঠখোট্টা রূপ— দরিদ্র, বঞ্চিত, নিপীড়িত মানুষের মুক্তিপথের দিশাই যেন উঁকি দেয় তার লেখায়। হয়তো তার ব্যক্তিগত জীবনেরই বাস্তব বহিঃপ্রকাশ। কমবেশি বেশকিছু লিট্ল ম্যাগাজিনে লেখা বেরোয় তার। সাহিত্য সভাতেও যায় টুকটাক। অধিকাংশ লিট্ল ম্যাগাজিন ইদানীং সৌজন্য সংখ্যা দেওয়ায় ক্ষেত্রে অনীহা প্রকাশ করায় খুব বেশি পত্রিকায় লেখা দেয় না আর। যদিও ব্যক্তিগত ভাবে লিট্ল ম্যাগাজিনের পাশে থাকারই পক্ষপাতী সে। তবে তার মতে, লেখা প্রকাশিত হলে সৌজন্য সংখ্যার ন্যায্য প্রাপক লেখক কিংবা কবি। বরং লিট্ল ম্যাগাজিনের গুণগত মান এমন হওয়া উচিত যাতে পাঠক স্বেচ্ছায় কিনে পড়তে বাধ্য হয়, দরকার নেই নিম্নমানের এত গাদাগাদা লিট্ল ম্যাগাজিনের। জনৈক বর্ষীয়ান কবির কথায়, ‘সাহিত্যের নামে জঞ্জাল।’

শাশ্বত নিজেকে ভবিষ্যতের একজন প্রতিশ্রুতিবান সাহিত্যিক বলেই মনে করে। মাত্র একবার হলেও তার লেখা বাণিজ্যিক পত্রিকায় প্রকাশের সুবাদে তার আত্মবিশ্বাসও বেড়ে গেছে অনেক। সে মনে মনে স্বপ্ন দেখে, একদিন সে বাংলার নামকরা একজন সাহিত্যিক হবে। সে চায়, তার লেখা সময়কে ছাপিয়ে অনেক দূর এগিয়ে যাক। রবীন্দ্রনাথের মতো, শেকসপিয়রের মতো যেন সে নিজের সৃষ্টির মাধ্যমে অমর হয়ে থাকতে, আর যে কিছুই নেই তার।

নিজের একক বই প্রকাশের চিন্তাও সে করেছে কিন্তু এত কবি-সাহিত্যিকের ভিড়ে কোনও প্রকাশকই টাকা ছাড়া বই ছাপাতে রাজি নয়, আর ছাপাবেই বা কেন? কে চেনে তাকে! কে কিনবে তার বই? তবু… যদি কোনও প্রকাশনা সংস্থা নিরপেক্ষ বিচারের মাধ্যমেও কোন ব্যবস্থা করত… বই ছাপানোর মতো টাকা নেই তার। আর যদি কোনদিন পর্যাপ্ত টাকা হয়ও তবু আদর্শগত কারণেই সে টাকা দিয়ে বই ছাপাবে না। এইসব চিন্তা এক-একসময়ে তাকে হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। এক-একসময় মনে হয়, ধুর! সব বেকার! সবকিছু বেকার! কিন্তু পরমুহূর্তেই মনে মনে আস্তিন গুটিয়ে বসে সে। এত সহজে ভেঙে পড়লে চলবে না। এত সহজে হার মানবে না সে। কারোর করুণা কিংবা দয়া নয়, নিজের যোগ্যতায় একদিন ঠিক নিজেকে প্রমাণ করবেই। ছোট্ট থেকে খরস্রোতা নদীর সম্পূর্ণ বিরুদ্ধ স্রোতে খাবি খেতে খেতে সাঁতার কেটেই এই অবধি এসেছে। শেষ না দেখে উপায় নেই। প্রত্যয়ে চোয়াল শক্ত হয়ে আসে তার।


বাসস্ট্যান্ড থেকে বিবৃতির বাড়ির দূরত্ব হাঁটাপথে প্রায় কুড়ি মিনিট। এই রোদ্দুরের মধ্যে হেঁটে যেতে হবে ভেবেই মনে মনে আঁতকে ওঠে। অটোতে যাবে সে উপায় নেই। রিকশায় গেলেও বাড়িতে মায়ের কাছ থেকেই টাকা চেয়ে ভাড়া দিতে হবে, সেইসঙ্গে দুনিয়ার কৈফিয়ৎ। একে তো জানে কলেজ ছুটি, কোনোরকমে ম্যানেজ করে বেরিয়েছে। অন্যকিছু আঁচ পেলেই, ‘কোথায় গিয়েছিলি? সত্যি করে বল। আর কে কে সঙ্গে ছিল? কী করে ব্যাগ কাটল? কী করে পকেটমারের পাল্লায় পড়লি? ওরা সংখ্যায় কতজন ছিল? তোর পিছন পিছন কতদূর এল? বাইকে ছিল না দৌড়ে রাস্তায় তাড়া করেছিল?’ মায়ের কাল্পনিক প্রশ্নের কথা ভেবে সে হেঁটে যাওয়াই ঠিক করল। হোক রোদ্দুর।
ছাতাটাও নেই ছাতা! পকেটমারগুলোর ছাতাটাও দরকার হল! এখন এই রোদ্দুরের মধ্যে সে যাবে কীকরে! মা নির্ঘাত ধরে ফেলবে, ‘রোদ্দুরে ঘুরে ঘুরে কালো হয়ে গেছিস, স্কিনটাই তো পুড়িয়ে ফেলেছিস।’ নিজের ওপর নিজেই বিরক্ত হয় সে। ভেবেই পায় না, নিজের মনকে কেন সে বাধ্য করতে পারে না? কেন এমন যখন-তখন যেখানে-সেখানে দিবাস্বপ্নে হারিয়ে যায়? কোথায়, কোন্ ঠিকানায়, কোন্ মোহনায় হারাতে চায় মন! কী যে হয় তার! কিছুতেই মনে পড়ে না, কোথায় কীভাবে ব্যাগটা কাটল? তবে কি নামার সময় গেটের কাছে জটলার মধ্যেই? কী জানি বাবা! পুলিশে গেলেই কি ঠিক হত?

শাশ্বতর সঙ্গে পরিচয় কলেজ লাইব্রেরিতে। বিএ ফার্স্ট ইয়ার পরীক্ষার আগে তখন নাজেহাল অবস্থা। ঠিকঠাক নোটস জোগাড় করতে পারছে না। একদিক সামলাতে গেলে অন্যদিক বেসামাল হয়ে পড়ছে। রাজ্যের বইপত্তর ঘেঁটেও ম্যানেজ হচ্ছে না। ওর অবস্থা দেখে লাইব্রেরিয়ান স্যার যেচে বললেন, ‘শাশ্বতর কাছ থেকে হেল্প নিলে হয়তো উপকার হবে।’ তিনি নিজেই শাশ্বতকে ডেকে আলাপ করিয়ে দিলেন। সেই থেকেই পড়াশোনার ব্যাপারেও শাশ্বতর ওপরে নির্ভরশীল। নিজের ভবিষ্যৎ জীবনের ব্যাপারেও সম্পূর্ণ নির্ভর করতেই চায়। কিন্তু শাশ্বত যেন অদ্ভুত! লেখাপড়া ছাড়া কোনদিকেই হুঁশ নেই। বিবৃতির মতো ডাকসাইটে সুন্দরী এতগুলো দিন প্রায় ছায়ার মতো লেগে রয়েছে সঙ্গে অথচ শাশ্বতর কোনও ফিলিংসই নেই! চক্ষুলজ্জার মাথা খেয়ে মেয়ে হয়েও একদিন নিজেই প্রোপোজ করল। শাশ্বত জাস্ট পাত্তা দিল না। কিন্তু সরাসরি অপমান না করে জানিয়ে দিল তার অর্থনৈতিক অক্ষমতার কথা, তার পরিবারের কথা। তার স্বপ্নের কথা। আগে সে লক্ষ্যভেদ করতে চায়। তারপর অন্য যে কোনও চিন্তা।

বিক্রমের সঙ্গে সেদিন ওই ঘটনাটা না ঘটলে নদীর জল অন্যদিকেই তো বইছিল। বিক্রম কলেজ ইউনিয়নের সেক্রেটারি, বড়োলোক বাপের বখাটে ছেলে, বিবৃতির প্রেমে পাগল। অথবা নিছকই ফ্লার্ট। বিক্রমের মতো চরিত্রের ছেলেরা সিরিয়াসলি প্রেম করতে পারে, এ কথা বিশ্বাস করাই মুশকিল। বিবৃতি বিশেষ কোনও গুরুত্ব না দিয়ে এড়িয়েই চলত।

সেদিন কলেজ ছুটির পর মাঠের পাশে বেঞ্চে বসে একটা নোটস বুঝিয়ে দিচ্ছিল শাশ্বত। হঠাৎই ধূমকেতুর মতো বিক্রমের আবির্ভাব। ওদের বসে থাকতে দেখে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল। শালীনতার মাত্রা ছাড়িয়ে প্রথমে বিবৃতিকে অপমানজনক কথা বলল। শাশ্বত প্রতিবাদ করায় ছোটোবড়ো জ্ঞান না করে তার অর্থনৈতিক অবস্থা, তার লেখালিখি নিয়েও অপমান করতে ছাড়ল না। এমন কথাও বলল, ‘তোর মতো রাহুর গ্রাস থেকে তুই বিবৃতিকে মুক্তি দে, আমি তোর বই ছাপিয়ে দিচ্ছি। নইলে ক-দিন পরে চোখে ছানি নিয়ে ভিক্ষে করে খেতে হবে। তোর কপালে ভিক্ষেও তো জুটবে না।’ তীব্র প্রতিবাদে সপাটে একটা চড় কষালো বিবৃতি। উৎসাহী ছেলেমেয়ের দল জড়ো হয়ে গেল। বিক্রম দেখে নেবার হুমকি দিয়ে চলে গেল।

শাশ্বত ক্ষোভে-দুঃখে-অপমানে স্তব্ধ হয়ে গেল। শুধু, বিবৃতিকে বাড়ি অবধি এগিয়ে দিতে এল। যাওয়ার পথে তাকে বলল, কলেজের ঘটনায় সে যেন কিছু মনে না করে, যেন সাবধানে থাকে আর বাড়ির কথা মতো বিয়েতে রাজি হয়ে যায়। আজকের সমাজে দাঁড়িয়ে বিক্রমের মতো ছেলেদের সঙ্গে লড়াই করার মতো টাকা বা ক্ষমতা সকলের থাকে না। সেদিন প্রথম দেখল বিবৃতি, শাশ্বত যেন তার নিজের কাছেই হেরে যাচ্ছে। একটা অসভ্য ইতরের কাছে হেরে যাওয়া সহ্য করতে পারল না সে।

পরের তিনদিন কলেজে এল না শাশ্বত। তিনদিনের দিন বিবৃতি গেল শাশ্বতর বাড়ি। শাশ্বত সম্পূর্ণ হেরে যাওয়া, নিভে যাওয়া একটা মানুষের মতো সঙ্কোচে জড়োসড়ো হয়েছিল। শাশ্বতর বদ্ধমূল ধারণা, সে যদি বিবৃতির অত কাছে না যেত তবে বিবৃতিকে এই বিপদের মধ্যে পড়তে হত না। বেশ কয়েকদিনের চেষ্টায় অনেক বুঝিয়ে-সুঝিয়ে শাশ্বতকে স্বাভাবিক করল বিবৃতি। কিন্তু বই প্রকাশের ব্যাপারে মত করাতে আরো মাসতিনেক অপেক্ষা করতে হল। অনেক সাধ্যসাধনার পর অবশেষে রাজি হল সে। বিবৃতি জানাল, তার বাবার টাকায় নয়, তারই হাতখরচের জমানো টাকায় প্রকাশ পাবে শাশ্বতর প্রথম বই।

এর মধ্যে একদিন, রাত্রি তখন এগারোটা, পাঁচ-সাতটা বাইক প্রায় আধঘণ্টা ধরে বাড়ির সামনে টহল দিচ্ছিল। মা পুলিশে ফোন করার কথা বলায় বাবা বারণ করল। বলল, ‘ওরা কোথায় কাকে টারগেট করেছে জানা নেই, আগ বাড়িয়ে উটকো ঝামেলা ডেকে আনার দরকার নেই।’ বিবৃতি দোতলার জানালা থেকে হ্যালোজেনের আলোয় পরিষ্কার দেখেছে ওই দলে বিক্রম ছিল। তবে কি…!


শাশ্বতর বাড়ি থেকে এত সাধ্যসাধনার ফসল শাশ্বতর অপ্রকাশিত বইয়ের পাণ্ডুলিপি নিয়েই আসছিল সে। ছায়াছবির মতো সমস্ত ঘটনাবলি একের পর এক সামনে ভাসছিল। ভাবতে ভাবতেই কখন রাস্তাটা পার হয়ে গেছে খেয়ালই করেনি। অভ্যাসবশত কলিং-বেল পুশ করেছে। সম্বিত ফিরল মা দরজা খোলায়। তাড়াতাড়ি ব্যাগটা সামলে কথা না বলেই ভিতরে ঢুকে পড়ল সে। তার ঘরে টেবিলের ওপর ব্যাগ আর মোবাইলটা রেখে ওয়াশরুমে গেল। ফ্রেশ হতে হবে আগে। একে পকেটমারের খপ্পর তায় এতটা রাস্তা চড়া রোদ্দুরের মধ্যে হেঁটে এসে যথেষ্টই ক্লান্ত লাগছে।
ওয়াশরুম থেকে বেরোতে বেরোতেই মোবাইলের রিং-টোন কানে এল। কাছে আসতে আসতে কেটে গেল। আবার… শাশ্বতর ফোন। ডাইনিংয়ে রয়েছে মা। ধরা যাবে না এখন। দেখেও না দেখার ভান করে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করল। ঝাঁঝিয়ে উঠল মা, ‘ফোনটা বাজছে শুনতে পাচ্ছিস না। কানের গোড়ায় ক্যানোর ক্যানোর করে ফোন বেজে যাওয়া অসহ্য।’ মা ঘরে আসতে যাচ্ছিল, মা’কে যথাসম্ভব এড়িয়ে ধরব-কি-ধরব-না করে ফোনটা ধরতে বাধ্য হল বিবৃতি। কিন্তু কী বলবে! কী করে ফেস করবে শাশ্বতকে! তার পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছিল। হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছিল। অসম্ভব ঘামছিল। সেই অবশ্যম্ভাবী মুহূর্তটা এগিয়ে আসছে। আর মাত্র কয়েক পলক দূরে যেন ক্রিমেটোরিয়ামের ফটক খুলে যাবে এক্ষুনি, তারপর সব শেষ। যেমন ঠাম্মার দেহটা ফটকের মধ্যে চলে গিয়েছিল। ঠিক সেইভাবেই তার স্বপ্ন, প্রেম, আশা, ভবিষ্যৎ স-অ-ব মুহূর্তেই শেষ হয়ে যাবে। এর থেকে মরে গেল না কেন সে? পকেটমারেরা তার ব্যাগটা না কেটে তাকে গুলি করে মেরে দিয়ে চলে যেতে পারত, কিংবা কোন গাড়ি তাকে চাপা দিয়ে, তার মাথার ওপর দিয়ে, মাথাটা এক্কেবারে থেঁতলে দিয়ে… অন্তত তাকে আজ বিশ্বাসঘাতকের বদনাম নিতে হত না। এর পর বেঁচে থাকার কোনও অর্থই নেই। সে কিচ্ছু বলবে না, শুধু চুপ করে শুনে যাবে, তারপর নিজের চলে যাবার, হারিয়ে যাবার, মরে যাবার সিদ্ধান্ত শুধু তাকে একাই নিতে হবে। কিচ্ছু জানতেও দেবে না শাশ্বতকে।

ফোনটা ধরে স্থাণুবৎ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল সে। কতক্ষণ, সে নিজেও জানে না। মনে হয় অনন্তকাল, অহল্যার মতো। আর, যেন মহাসিন্ধুর ওপার থেকে বজ্রের মতো, সাইক্লোনের মতো, আগ্নেয়গিরির বিস্ফোরণের মতো, তার জীবনের চরম, চূড়ান্ত ভয়ংকর কিছুর জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। কিন্তু শাশ্বতর গলাটা এমন লাগছে কেন! সে নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছে না! ক্ষমা চাইছে কেন শাশ্বত! ক্ষমা তো তার চাইবার কথা। সে আবার শুনতে চাইল, শাশ্বতকে আবার বলতে বলল। শাশ্বত ছাতার কথা কী বলল? তাড়াহুড়োতে বিবৃতি তার ছাতা শাশ্বতর বাড়িতেই ফেলে চলে এসেছে। আরে দূর! রাখো তোমার ছাতা! হ্যাঁ? আর একটা কী বলল? ভুলবশত নোটসের একটা প্যাকেট বিবৃতিকে দিয়েছে সে। পাণ্ডুলিপি তার কাছেই পড়ে আছে!