নীলাশিস ঘোষদস্তিদার
পার্কটাতে বেশ মরশুমী ফুলগাছ-টাছ লাগিয়েছে, বেশ বাহার হয়েছে, মনে হল অম্বরের৷ চাকরিজীবনে নতুন দিল্লিতে যেতেন সংসদ মার্গের অফিসে৷ শীতে বসন্তে লু্যটিয়েন্স দিল্লির পার্কে পার্কে ফুলের বাহার দেখে দিব্যি লাগত বটে, তবে ওই পর্যন্তই৷ নিজের শখে বাগান করা বা গাছগাছালি সম্বন্ধে জ্ঞান অর্জন করা হয়নি, ইচ্ছেও জাগেনি৷ হ্যাঁ, তাঁর স্ত্রী কমলা গাছ-অন্ত প্রাণ এবং অতিথি মাত্রেই বাড়িতে কমলার করা একফালি বাগানের প্রশংসা করে৷ এইখানেও কমলা তাঁর চেয়ে এগিয়ে, বলেন তাঁর সাংবাদিক বন্ধু দীপ্যমান৷ সম্পাদক অম্বরকে সম্পাদনার কাজে তো বটেই, লেখালিখির জন্য হরহামেশা কমলার দ্বারস্থ হতে দেখেই এটা বলেন দীপ্যমান৷ ডিগ্রির হিসাবে, পেনশনের অঙ্কে, বংশগৌরবে যেমন, সাহিত্য-সংস্কৃতির প্রতিটি ধারায় কমলার বু্যৎপত্তি অম্বরের চেয়ে যে বেশি, কয়েক দশকের বন্ধুত্বে সেটা জানেন দীপ্যমান৷ এই যেমন সেদিন দিল্লির মিউজিক্যাল রিভিউতে বিদূষী অমিতা মিত্রর অনুষ্ঠান নিয়ে অম্বর যেটা লিখেছেন, তা প্রায় পুরোটাই যে কমলার লেখা তা দীপ্যমানের চেয়ে ভালো কে জানবে! গানবাজনা সম্বন্ধে অম্বরের ধারণা খুব আবছায়া৷ রাগরাগিণী সম্বন্ধে অজ্ঞ বললেই হয়৷ তবে, বিদুষী অমিতার ডাক পাওয়া মাত্রই তাঁর অনুষ্ঠান কভার করতে সবান্ধব, সপরিবার পৌঁছে গেছিলেন অম্বর৷ যৌবনে অমিতার রূপমুগ্ধদের মধ্যে অম্বরের সঙ্গে সঙ্গে দীপ্যমানও ছিলেন বটে! এখনো অমিতা ও অমিতার মত রূপসীদের সংস্পর্শে এলে তাঁদের মধ্যে যৌবন জেগে ওঠে!
দীপ্যমানের অবশ্য ধারণা অম্বরের লিবিডো তাঁদের বয়সী বিবাহিতদের তুলনায় বেশি৷ এই সেদিন প্রায় বিনা কারণে বঙ্গীয় সম্মেলনের কয়েক দশকের সেক্রেটারি ও বহুপরিচিত সমরেশ চক্রবর্তীর সঙ্গে তুলকালাম ঝগড়া করে ফেললেন অম্বর৷ সমরেশ কথায় কথায় বলছিলেন নামী গায়িকা রেবতী বসু তাঁর পরামর্শ মেনেই শুধু রবীন্দ্রসঙ্গীত গায়৷ অম্বর হঠাৎ খেপে গিয়ে লড়ে গেলেন, সমরেশ কিচ্ছু জানেন না, রেবতী তাঁর পরামর্শ না নিয়ে একটাও অনুষ্ঠান করে না, রবীন্দ্রসঙ্গীতও তাঁর কথা মেনেই করে৷ দু’জনের খানিক গজকচ্ছপ ঝগড়ার ইতি টানলেন স্পষ্টবক্তা প্রবীণ ডঃ অবনী সরকার৷ উগ্র এক রূপ আছে রেবতীর৷ তারই মোহে কলেজজীবনে নারীসঙ্গে বঞ্চিত যত বয়স্ক পুরুষ নাকি ওর ন্যাওটা হয়েছে৷ সবাইকেই ও নাকি একান্তে নিজের একমাত্র পরামর্শদাতা, বন্ধু বলে পটায় আর গড্ডলেরা ওর খ্যাতি বাড়াবার জন্য খ্যাপার মত কাজ করে যায়৷ বিশেষ কিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত না গেয়ে ওর নাকি আর উপায় নেই৷ হঠাৎ যার কন্ঠ শুনে পুরুষ বলে মনে হতে পারে, সে মিষ্টি আধুনিক বা রাগপ্রধান গাইলে মুশকিল, চাঁছাছোলা ভাষায় অবনীবাবু এমন বলায় দমে গেলেন অম্বর৷ ভদ্রলোকের সঙ্গীতবিশারদ বলে খ্যাতি আছে, আর, রেবতীকে চেনেন ওঁদের চেয়ে ঢের বেশি৷ দীপ্যমান অম্বরকে এও মনে করিয়ে দিলেন যে পত্রিকার প্রতি সংখ্যা বেরোবার আগেই রেবতী তাঁদের বারবার ফোন করে আর এযাবৎ পত্রিকার কালচারাল রিভিউ মানেই শুধু রেবতীবন্দনা৷ পরনারীর প্রতি তাঁর মোহ যে বেশি সেটা আবছা বোঝেন অম্বর৷ আসলে, কমলা তাঁর চেয়ে ঢের বেশি গুণী হলেও, তার বয়েস হয়েছে, মনোলোভন সুন্দরীও সে ছিল না, আর, সবচেয়ে বড় ঝামেলা, কমলার সঙ্গে তাঁর সম্বন্ধ হয়েইছিল তিনি বড়দি চিত্রা দাশগুপ্তর ভাই বলে!
পার্কের অন্যদিকে হই-হই করে ক্রিকেট খেলছে একদল ছেলে৷ বলটা এসে পড়ল অম্বরের কাছেই৷ প্রাতঃরাশের পর রোজই এসে বেঞ্চে বসে একটু রোদ পোয়ান তিনি৷ ছেলেগুলো বলটা চাইছে বটে, উঠে আর দেবার মত ইচ্ছে হচ্ছে না তাঁর৷ কোনও খেলাই তাঁর খুব একটা মনে ধরে না৷ ক্রিকেট নিয়ে কেন যে দেশে এত মাতামাতি তাঁর বোধের বাইরে, আর, ফুটবল ব্যাপারটাই তাঁর কাছে বিভীষিকা! তবে, যে উপন্যাসগুলো লিখেছেন বড়দির দেখাদেখি, চরিত্রে বা বিষয়বস্তুতে বৈচিত্র্য আনতে তাতে মাঝেসাঝে খেলাধুলো নিয়ে কিছু লেখার চেষ্টা করেছেন অম্বর৷ কিন্ত্ত, তাঁর পত্রিকায় লেখা জমা দেয় যারা, তারাও কোনোদিন উপন্যাসের উদ্বাহু প্রশংসা যে করল না, তার কারণগুলির মধ্যে কি এও থাকতে পারে যে খেলাধুলোর ব্যাপারটাও বালখিল্যতা হয়ে গেছে, অজ্ঞানতা ধরা পড়ে গেছে? অম্বর প্রায়ই ভাবেন এটা৷ বলটা ছুঁড়ে দিল পাশ দিয়ে জগিং করতে করতে যাওয়া যুবক অনিমেষ৷ তারপর গুড মর্নিং জানিয়ে ঝকঝকে হেসে চলে গেল জগ করতে করতে৷ গা জ্বলে গেল অম্বরের৷ ছোকরা ভালো চাকরি করে, অনেক জ্ঞান ও গুণ আছে৷ কলকাতার পত্রিকায় বড়দির নাম ভাঙিয়েও আজ অবধি অম্বর কিছু লিখে উঠতে পারলেন না, আর এ ব্যাটাচ্ছেলে এদিক সেদিক লিখেই যাচ্ছে৷ অম্বরের পত্রিকায় এক-দু’বার লেখা দিয়েছিল পত্রিকার মালিক ও প্রধান সম্পাদক সুরেশ সরকারের আহ্বানে৷ গায়ের জ্বালা মিটিয়ে এন্তার কলম চালিয়েছিলেন অম্বর৷ তালগোল পাকানো লেখা ছাপার অক্ষরে দেখে ছোকরা আর লেখা দেয়নি৷
এবার আসাম থেকে অপরাজিত গুহর পাঠানো প্রবন্ধের প্রুফটা পাণ্ডুলিপির সঙ্গে মিলিয়ে পড়তে থাকলেন অম্বর৷ আসন্ন জীবনানন্দ দাশ সংখ্যার জন্য একটা প্রবন্ধ পাঠিয়েছেন৷ কমলা সচরাচর পড়ে জানিয়ে দেয় কেমন লেখা৷ তার ধারণা, এই মানের প্রবন্ধ এবার একটাও নেই, এমনকি কমলা আগেও পড়েছেন কিনা সন্দেহ৷ কমলার বাছাই করা হলে লেখা সোজা কম্পোজিংয়ে চলে যায়৷ প্রুফ দেখার ধকল নেন অম্বর৷ পড়তে পড়তে অম্বর বুঝলেন, তাঁর জ্ঞানগম্যির পরিধির বাইরের অজস্র তথ্য এবং বিশ্লেষণ আছে প্রবন্ধটায়৷ মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে না কী যেন বলে! বুঝে উঠতেই ঈর্ষায় দীর্ণ হয়ে গেল তাঁর মন৷ বহির্বঙ্গের সেরা লিখিয়েদের জন্য পুরস্কার চালু করেছে ঝাড়খণ্ডের এক পত্রিকা৷ প্রবন্ধর পুরস্কারটা কি অপরাজিত নিয়ে নেবেন?
ঠিক এই সময় সুরেশবাবুর ফোনটা এলো৷ একথা সেকথার শেষে এই সংখ্যায় যেন বড়দির লেখা অবশ্যই থাকে, দাবী করে ফোন ছাড়লেন৷ সত্যি তো, পত্রিকা প্রকাশের সাহস সুরেশ পেয়েছিলেন তো বড়দির মত দুয়েকজনের ভরসাতেই৷ চিন্তায় পড়ে গেলেন অম্বর৷ নামী অর্থনীতিবিদ, প্রাবন্ধিক ও ঔপন্যাসিক চিত্রা দাশগুপ্তর লেখা না থাকলে প্রশ্নচিহ্ন তো জাগেই৷ মুশকিল হয়েছে, পরপর দুটো সংখ্যায় বড়দির দুটো প্রবন্ধর সামান্য কিছু ভুলত্রুটি নিয়ে লম্বা লম্বা সমালোচনামূলক চিঠি লিখেছেন আরও দুই নামী ব্যক্তিত্ব৷ অন্যরা যতই সহ-সম্পাদক অম্বরের নিরপেক্ষতার প্রশংসা করুক, বড়দি কি আর বোঝেননি এর পিছনে কী আছে! একজন, অধ্যাপক বিজয়ব্রত লিখেই ফেলেছেন তাঁকে দিয়ে ওই চিঠি লেখানোর জন্য দিনের পর দিন তাগাদা দিয়েছেন চিত্রারই ভাই, অম্বর৷ অম্বর খেয়াল করেননি, কিন্ত্ত, ছাপা হবার পর চিঠিতে কথাটা কমলার চোখ এড়ায়নি, বড়দিরও না৷ বড়দি তো জানেন, ছোটবেলা থেকে এই কনিষ্ঠ ভাইটি তাঁর নামডাকে কতটা ঈর্ষান্বিত ছিল, সক্ষম না হয়েও লেখালিখিতে নেমেছে তাঁর সঙ্গে পাল্লা দিতে৷ সিবলিং রাইভ্যালরি বলে একে, কমলা একবার বলেছিল অম্বরকে৷ তবে, ঝামেলা হয়েছে এই যে, বড়দি গতসংখ্যায় লেখা দেননি, এবারও দেবেন কিনা সন্দেহ আছে৷ গতিক সুবিধের নয়, জানেন অম্বর৷ সুরেশ যে তাঁকে সহ-সম্পাদক করে রেখেছেন, গাধার খাটনি খাটতে পারেন বলে শুধু নয়, অম্বর চিত্রার ভাই বলেও৷
প্রুফটা পড়ে ঝিম হয়ে রইলেন অম্বর৷ অপরাজিত অসুস্থ শুনেছেন৷ এমন প্রবন্ধ লিখল কীভাবে? পুরস্কারটা যে পাবেই তাতে সন্দেহ থাকছে না অম্বরের৷ শরীর জ্বলতে লাগল তাঁর৷ পারস্পরিক পিঠ চুলকানি গোষ্ঠীর সদস্য হয়ে এদিক সেদিক অন্য পত্রিকার সম্পাদকদের সঙ্গে লেখার আদান প্রদান আছে তাঁর, খুচখাচ পুরস্কার দেওয়া-নেওয়াও৷ কিন্ত্ত, ঝাড়খণ্ডের ‘সূর্যতোরণ’ পত্রিকার দেওয়া বহির্বঙ্গের সেরা প্রাবন্ধিকের পুরস্কারের মতো কোনও কিছুর ধারে কাছে তিনি আসেননি৷ এর মধ্যে আবার ফোন এল কম্পোজারের থেকে৷ অপরাজিতর প্রবন্ধের লেখকের নাম বাদ রয়ে গেছে, কী লিখবে জানতে চায়৷ নাম লেখা নেই? উত্তর না দিয়ে ঝাঁঝিয়ে জানতে চাইলেন অম্বর৷ কম্পোজার ছেলেটি নতুন, জানাল, ভুলে গেছে৷
ঠিক এই সময় আরেকটা ফোন এল, সুরেশের৷ আসাম থেকে বিরাট দুঃসংবাদ এসেছে৷ দীর্ঘ অসুস্থতার পর পৃথিবীর মায়া কাটিয়ে চলে গেছেন অধ্যাপক অপরাজিত গুহ৷ একটা অবিচুয়ারী লিখতে হবে৷ ফোন রাখার পর স্তম্ভিত হয়ে খানিক বসে রইলেন অম্বর৷ তারপর, মনের কোণে ফস করে জেগে উঠল এক আদিম রিপু৷ পাণ্ডুলিপিটা বার করে নামটা কাটলেন, তারপর কাঁপা হাতে কম্পোজারকে ফোন করে অপরাজিতর প্রবন্ধের লেখক হিসাবে অম্বর দাশগুপ্তর নামটা দিয়ে দিতে বললেন৷