‘খুলির আগুনে মেঘ’

ফাইল চিত্র

সৈয়দ হাসমত জালাল

বাংলা ভাষায় কবিতার ধারাটি যেমন বৈচিত্র্যময়, তেমনই সমৃদ্ধ। তরুণ কবিরাও সে ধারাটিকে প্রশংসনীয় ভাবেই এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। দেবারতি ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থ ‘ওয়াদা ফির ওহি’ পড়তে পড়তে সে কথাই আবার নতুন করে অনুভূত হলো। দু-দশকেরও বেশি সময় ধরে বাংলা কবিতার ক্ষেত্রটিতে নিজেকে পরিচিত করতে সমর্থ হয়েছেন তিনি। শুধু তাই নয়, নিজস্ব একটি বাকভঙ্গিমা তৈরি করে নিতে পেরেছেন তিনি। খুব স্পষ্ট তাঁর উচ্চারণ। প্রেম, বিরহ, বিষাদের মতো সংবেদনার পাশাপাশি তাঁর কবিতায় স্বচ্ছন্দে উঠে আসে প্রতিবাদ। তবে সে প্রতিবাদ চিৎকৃত নয়। তা স্পষ্ট, কিন্তু বেদনাহত। তাঁর কবিতায় উঠে আসে সমসময়, আসে জীবনের জটিল বোধ, আসে দেশ। আর এসবের মধ্যে এক ধরনের আত্মমগ্নতা ও সংবেদনশীলতা তাঁর কবিতাকে পৌঁছে দেয় পাঠকের মননে, চিন্তার গভীরতায়।

‘ভয়’ কবিতায় কবি দেবারতি ভট্টাচার্য কত অবলীলায় বলতে পারেন— ‘ভয় অতি আদিম অস্ত্র, খুলেআম রক্তপাত।’ ‘খুলেআম’-এর মতো শব্দ ব্যবহার করতে তিনি দ্বিতীয়বার ভেবেছেন বলে মনে হয় না। এত স্বতঃস্ফূর্ত তাঁর এই জাতীয় শব্দের প্রয়োগ। ‘সপাং সপাং/‌খাপ খোলা তরোয়াল চমকায়।’ আর এজন্যেই তো তৈরি হয় ভয়ের আবহ। এই আবহকে তিনি ফুটিয়ে তোলেন এইভাবে— ‘খুনি কে, কে খুনি? আমি-তুমি!/‌গীতা কোরান বাইবেলের সংঘাত?’ আসলে ধর্মকে অজুহাত করেই তো এই সংঘাত। আর ‘খুলেআম রক্তপাত রক্তপাত রক্তপাত।’


‘ভয়’ শীর্ষক এই ছোট কবিতায় কী সাবলীলভাবে এই সময়, দেশ ও তার মানুষে-মানুষে, ধর্মে-ধর্মে সংঘাতজনিত ভয় ফুটিয়ে তুলেছেন তিনি।

কবিতায় ছন্দের ক্ষেত্রে খুব স্বচ্ছন্দ দেবারতি। ‘খিদে’ কবিতায় তিনি বলেন— ‘নুন জোটে না পান্তাভাত/‌ঝলসানো পেট। আগুন হালাল/‌হাড় চামড়া নোংরা কাঙাল/‌জলঢোঁড়া সাপ কচুরিপানা; ধর্ম! আদতে ও কিছু না’। বস্তুত, পেটে খিদে নিয়ে ধর্ম হয় না। খিদের কাছে খাদ্যের কোনো বাছবিচার থাকে না। তার পরেও ‘এক মুঠো তাপ বাড়িয়ে নামে গভীর রাতে/‌আনকোরা মেঘ নেভায় খিদে বৃষ্টিপাতে।’

‘আঁচড়’ কবিতায় দেবারতি বলেন, ‘খাঁচা খুলে দিলে পাখিরা উড়েই যায়, মানুষ পারে না।’ আসলে মানুষ তার মুক্তির পথ খোঁজে কালির আঁচড়ে, কবিতার ডানা ঝাপটানিতে। কিন্তু তা কি খুব সহজ! তাই তিনি লেখেন— ‘কাগজ কলম, ছাল চামড়া ছাড়িয়ে খুবলে খেল হৃৎপিণ্ড’। আর ‘মেঘ জমে জমে জখম আরও তীব্র হয়, অন্ধকার’। এরকম তীব্র ছিন্নভিন্ন মুহূর্ত আর অনুভূতির মুখোমুখি তিনি দাঁড় করিয়ে দেন পাঠককে। কিন্তু তার মধ্যে হেরে যাওয়া নেই, আছে প্রতি মুহূর্তের লড়াই আর উদ্দীপনার গহন সংকেত— ‘লকলকে জিভ/‌ধ্বসের ধ্বজা ওড়ে বুঝি:/‌এত সহজে হেরে
যাবে তুমি!’

আর এজন্যেই লিখতে পারেন তিনি ‘আসিফারা মরে না’। ‘আসিফা’ নামের সেই বালিকা, যাকে ধর্ষণ করে খুন করে ফেলেছিল কয়েকজন নরপিশাচ। বেদনাবিদ্ধ কবির কবিতায় উঠে আসে ক্রোধ, শোক রূপান্তরিত হয় শক্তিতে,‌প্রবল শ্লেষে যেন পিশাচ- পুরুষকে তিনি বলেন— ‘তোমার ভাস্কর্যক্ষমতা এখন বুঝি/‌শিশুর যোনিপথে আবদ্ধ!/‌রক্তদাগ মৃত্যুদাগ মোছাও রাষ্ট্রপ্রেম শব্দে/‌ দাঁড়াও! আসিফারা মরে না, ছিন্নমস্তা হয়’।

দেবারতির কবিতায় বারবার উঠে এসেছে এই দেশ, দেশের ঘটনাবলী, চারপাশের জীবন। সেই জীবন তিনি কুড়িয়ে নিয়েছেন তাঁর কবিতার উপকরণ হিসেবে। যেমন ‘ভ্রূণ-তারা’ কবিতাটি। ভোরবেলা ফুটপাতে পড়ে থাকা একটি ভ্রূণ যেন খসে পড়া একটি তারা। কবি লেখেন— ‘এদিক ওদিক তাকিয়ে দু-হাতে বুকের কাছে তুলে নিলাম/‌আঁচ টের পাচ্ছি, প্রাণ যায়নি এখনও/‌বাড়ি নিয়ে যাই! টবের চারাগুলিকে রোজ দু-বেলা যেরকম জল দিই/‌সেরকম ওকেও দেবো, সার দেবো/‌ঘন অন্ধকার করে দেবো। আমার পড়ার টেবিলে বেশ জ্বলবে মিটিমিটি…’। আসলে ভ্রূণ আর ‘তারা’ দুটি রূপকল্প মিশে একাকার হয়ে এমন একটি সংবেদনাময় শব্দের ও ভাবনার জগৎ গড়ে দেয়, যেখানে কিছুটা বিস্ময়ে, কিছুটা বেদনায়, আবার কিছুটা গভীর জীবনবোধে, প্রেমে-ভালোবাসায় স্তব্ধ হয়ে থাকতে হয়।

‘মুম্বাই’, ‘কামদুনি’, ‘বাদাউন’-এর নারী নির্যাতনের ঘটনায় এককার হয়ে যায় তাদের ভৌগোলিক অবস্থান, সময়, সমাজ আর দেশ। ‘ও আমার দেশ শোনো!’ কবিতায় গভীর যন্ত্রণা ফুটে ওঠে এইভাবে—‘মুখে কুলুপ এঁটে কতো কুঁকড়ানো দিন, কতো নৃশংস রাত, আর!/‌শুনেও না শোনা, দেখেও না দেখার…/‌নিজের হাতে গলা টিপে চেতনার শব বয়ে বেড়াও দিব্যি।’
চার ফর্মার এই কাব্যগ্রন্থে রয়েছে ভিন্ন স্বাদের কিছু কবিতাও যেখানে একেবারেই ব্যক্তিগত অনুভূতির গভীরে প্রেম কিংবা বিরহের কোমল স্পর্শ, কখনো-বা স্মৃতিময়তা বয়ে যায় তার পঙ্‌ক্তিমালার ভেতর। ‘মেঘ’ কবিতায় দেখা যায়— ‘এ ঘর ও ঘর মেঘ, চুন বালি খসে শুধু মেঘ/‌চোখ শিরা ফুসফুসের ভিতর মেঘ, খুলির আগুনে মেঘ/‌নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে মেঘ।/‌‘উন্মাদ দুপুর শান্ত হয়ে আসে, পুরোনো চিঠির পাতায় মেঘ’। আর এর মধ্যে ধ্বনিত হয় একটি ব্যক্তিগত আকাঙ্ক্ষা— ‘আমি ভিজব ভিজব ভিজব…।’

‘দুর্নিবার’, ‘উত্তাপ’, ‘দেহজল’, ‘চুম্বন’, ‘ক্রমশ’ বা ‘শেষ কামরা’ এই ছোট ছোট কবিতাগুলি নিয়ে আসে প্রেম-বিরহের স্মৃতিময় স্পর্শ। যেমন—‘শ্রাবণঢালা পেয়ালায় হৃৎপিণ্ড থেকে নিঃশব্দে ছলকে পড়ল/‌অসতর্ক কয়েক ফোঁটা প্রেম/‌চুমুকে চুমুকে পান/‌বিষপান…’। কিংবা ‘প্রান্তিক স্টেশন থেকে ভেসে আসে/‌আমাদের খোলস ছাড়ানো অতীত/‌ট্রেনের শেষ কামরায় এখনও লেগে রয়েছে/‌তোমার আমার
কথোপথনের গন্ধ’।

সবমিলিয়ে কবি দেবারতি ভট্টাচার্যের কাব্যগ্রন্থ ‘ওয়াদা ফির ওহি’ পাঠককে এক ভিন্নতর অভিজ্ঞতার অনুভূতিতে এবং চিত্রময়তায় আকৃষ্ট করে রাখে। চিত্রশিল্পী মুক্তিরাম মাইতির আঁকা প্রচ্ছদের বিমূর্ততা ভালো লাগে। খুব পরিচ্ছন্ন মুদ্রণ।‌প্রথম প্রকাশ জানুয়ারি,
২০২০-তে।
ওয়াদা ফির ওহি, দেবারতি ভট্টাচার্য
সপ্তর্ষি প্রকাশন, মূল্য ১০০ টাকা।