পুজো-পার্বণ থেকে যে কোনও আচার-অনুষ্ঠানের ক্ষণ-তিথি জানতে পঞ্জিকা আজও অধিকাংশ বাঙালির জীবনের অপরিহার্য অঙ্গ৷ তাই পয়লা বৈশাখের আগেই বাজারে এসে যায় বিভিন্ন সংস্থার পঞ্জিকা৷ এই পঞ্জিকার বিবর্তন ও নানান দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন সুস্মিতা মুখার্জী চট্টোপাধ্যায়
বাংলা বছর আরম্ভ হওয়ার বেশ কিছুদিন আগে থেকেই গুপ্ত প্রেস, পি এম বাগচী, বেণীমাধব শীল ইত্যাদি নানা ধরনের পঞ্জিকা বাজারে এসে যায়৷ সত্যি বলতে কী, পুজো-পার্বণ কিম্বা বার-তিথি-নক্ষত্র দেখা ছাড়াও পঞ্জিকার কিন্ত্ত আরও একটা আলাদা গুরুত্ব আছে বাংলা সাহিত্যে৷ অবাক হচ্ছেন? ভাবছেন, পাঁজি আবার সাহিত্য হলো কবে থেকে তাই তো? যাঁরা এমনটা ভাবেন, তাঁরা ভালো করে একদিন পঞ্জিকাটা হাতে নিয়ে পুরোটা একটু ধৈর্য ধরে পডে় ফেলুন৷ সূচনাপত্র থেকে একেবারে শেষ পাতার বিজ্ঞাপন পর্যন্ত৷ দেখবেন বাংলায় অমন রসসাহিত্য আর দ্বিতীয়টা নেই৷
তবে পঞ্জিকার বৈচিত্র্য তুলে ধরার আগে বাংলা পঞ্জিকা সম্পর্কে কয়েকটি কথা এখানে উপস্থাপন করা খুব দরকার৷ সাধারণভাবে জন্ম, মৃতু্য ছাড়া লোকজীবনের বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান করতে গেলেই ধর্মপ্রাণ মানুষ পঞ্জিকার সাহায্য গ্রহণ করেন৷ পুজো পার্বণ, অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিয়ে, শ্রাদ্ধ, ভিতপুজো, গৃহপ্রবেশ, পুকুরখনন ইত্যাদির মতো যাবতীয় কাজের সুসময় খুঁজতে শরণ নেন পঞ্জিকার৷ আবার বাংলা নববর্ষের সঙ্গে বা হালখাতার সঙ্গেও পঞ্জিকার একটা ওতোপ্রত যোগাযোগ আছে৷ সংস্কৃত ‘পঞ্চাঙ্গ’ শব্দ থেকে ‘পঞ্জিকা’ কথাটির উদ্ভব৷ বার-তিথি- নক্ষত্র-যোগ-করণ এই পাঁচ ‘অঙ্গ’ হলো পঞ্চাঙ্গ৷ পঞ্চাঙ্গের প্রথমটি হল বার অর্থাৎ শনি থেকে শুক্র— এই সাতদিনকে বোঝানো হয়৷ তিথি হলো চান্দ্রদিন৷ কোনও এক পূর্ণিমা থেকে পরের পূর্ণিমা পর্যন্ত এক চন্দ্রমাস৷ মাঝের দুই অমাবস্যাকে ধরে এই চন্দ্রমাস ১৫ করে মোট ৩০টি তিথিতে বিভক্ত৷ অর্থাৎ ২৯ দিন ১২ ঘন্টা ৪৪ মিনিট ৫/৬ সেকেন্ডের এক চন্দ্রমাসে রয়েছে ৩০টি তিথি৷ ইংরেজি বর্ষপঞ্জির মতোই বাংলা পূর্ণিমা থেকে আরম্ভ করে পরবর্তী অমাবস্যা পর্যন্ত কৃষ্ণপক্ষীয় তিথি এবং এক অমাবস্যা থেকে পরবর্তী পূর্ণিমার প্রারম্ভ পর্যন্ত শুক্লপক্ষীয় তিথি৷
ইংরেজি বর্ষপঞ্জির মতোই বাংলা পঞ্জিকাতেও রয়েছে বারোটি মাস৷ এই মাসের নামগুলো এসেছে বিভিন্ন নক্ষত্রের নাম অনুসারে৷ প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে, আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে চন্দ্র ও সূর্য পৃথিবীর গ্রহ না হলেও জ্যোতিষ বিদ্যায় এগুলোকেও গ্রহ বলা হয়৷ উল্লেখ্য, আমরা যে ইংরেজি ক্যালেন্ডার ব্যবহার করি, তাই সৌরদিন ধরে গোনা হয়৷ অর্থাৎ পৃথিবীকে ঘিরে যে ৩৬৫ দিন ৬ ঘন্টায় সূর্যকে একবার পাক খায়, সেই হিসাব ধরে এই দিনের হিসাব কষা হয়৷ কিন্ত্ত পঞ্জিকার তিথি গোনা হয় চন্দ্রমাস ধরে৷ তাই দিন আর তিথির হিসাব অঙ্কের নিয়মে কখনই মেলে না৷
ইংরেজিতে যাকে বলে ‘অ্যালম্যানাক’, ‘পঞ্জিকা’ তারই হুবহু বঙ্গীয় রূপমাত্র নয়৷ ধর্মীয় আচারাদি ও দিনক্ষণের খুঁটিনাটি হিসাব মেলাবার প্রয়োজনে ব্যবহূত এই পুস্তকটি কালের পরিক্রমায় কীকরে সব ধর্মের বাঙালির দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ হয়ে উঠল, সে কাহিনি সত্যি কৌতূহলোদ্দীপক৷
বাংলা বছরের শেষে গ্রামের জমিদারবাড়িতে কিংবা খোলা মাঠে পণ্ডিতমশাইরা হাতে লেখা পঞ্জিকা বা ‘পাঁজি’ পাঠ করে শোনাতেন ও গ্রহ-নক্ষত্রভিত্তিক জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী আসন্ন দিন কেমন কাটবে— দিতেন তার আগাম বার্তা৷ নতুন বছরের ব্রত-পার্বণ, কৃষিকাজে করণীয় বা ব্যবসা-বাণিজ্যের হালচাল সম্পর্কেও থাকত দিকনির্দেশনা৷ সুতরাং বেশ আগে থেকেই পঞ্জিকা বাঙালির মনে পাকাপাকি স্থান গড়েছে৷ মুদ্রণযন্ত্র আসার আগে পঞ্জিকা সংকলনের কাজটি করতেন পণ্ডিতেরা৷ তাঁদের হাতে লেখা পঞ্জিকাও বিক্রি হতো তখন৷ প্রতিটির দর ছিল দুই আনা থেকে এক টাকা পর্যন্ত৷ কিন্ত্ত এতে বিরূপ ফলও হয়— একেক এলাকার পণ্ডিতেরা একেক নিয়ম ও ধরনের পঞ্জিকা সংকলনের ফলে পঞ্জিকা তৈরির ক্ষেত্রে মতভেদ দেখা যায়৷ তাই আচার-অনুষ্ঠানে গোল বাধা প্রায় নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়৷
আবার তারিখ নিয়ে নানা মুনির নানা মতের কারণে প্রশাসনিক কাজকর্মে বিঘ্ন ঘটছিল৷ নদীয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র তাই বিভিন্ন এলাকার খ্যাতিমান পণ্ডিতদের আমন্ত্রণ করে এনে একটি সর্বসম্মত পঞ্জিকা নির্মাণ-প্রণালী বেঁধে দিলেন৷ পরবর্তীকালে পঞ্জিকাগুলো ওই বিধি মেনেই তৈরি হয়েছে৷ এ কারণে হাতে লেখা পঞ্জিকার মতো প্রথম দিককার মুদ্রিত পঞ্জিকাতেও ‘মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের অনুমত্যানুসারে’ কথাটি নামপত্রে ঠাঁই পেত আবশ্যিকভাবে৷
তবে যে পঞ্জিকাই হাতে তুলে নিই না কেন, সব পঞ্জিকার পণ্ডিতদের তালিকায় চোখ বোলালেই দেখা যাবে কাব্যতীর্থ, ব্যাকরণতীর্থ, জ্যোতিষতীর্থ, ন্যায়তীর্থের ছড়াছডি়৷ পাঁজির পাতায় যত তীর্থ দর্শন হবে সারাজীবন ঘুরে বেড়ালেও তত তীর্থদর্শন কোথাও হবে না৷
পঞ্জিকা নিয়ে কাজ করার অর্থ শুধু এই নয় যে কবে কোন পঞ্জিকা তৈরি হয়েছিল এই ইতিহাস ঘাঁটা৷ পঞ্জিকার বিষয়বস্তু এবং তার মধ্যে যে আচার ও সংস্কারের কথা বলা আছে সামাজিক প্রেক্ষাপটে তার গভীর বিশ্লেষণ হওয়া দরকার৷ পঞ্জিকাতে রাশিচক্রে জাতকের যে খারাপ সময় আসতে পারে তারও ইঙ্গিত দেওয়া হয়৷ আবার খারাপ সময়কে ভালো করার জন্য নানারকম বিধানও দেওয়া হয়৷
এরপর আসা যাক গণনা প্রসঙ্গে৷ পঞ্জিকা বোধহয় প্রায় সব বিষয়েই গণনা করে আগাম বলে দিতে পারে৷ এইজন্যই পঞ্জিকা এখনও বাঙালির ঘরে ঘরে সমাদৃত৷ বৃষ্টি গণনা, ব্যক্তির বার্ষিক লগ্নফল, রাশিফল, বার্ষিক রাষ্ট্রফল সবই পাওয়া যায় পঞ্জিকা থেকে৷ আবার সারা দেশের বৃষ্টি ও আবহাওয়ার হাল-হদিশও দিতে পারেন পঞ্জিকা বিশারদরা৷ বার্ষিক রাষ্ট্রফলও বিচার করা হয় পঞ্জিকা থেকে৷ ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, চীন, রাশিয়া, জাপান, ইসরাইল, আমেরিকা, ব্রিটেন— সব রাষ্ট্রের বার্ষিক রাষ্ট্রফল বাংলা পঞ্জিকায় আছে৷
পঞ্জিকার সবচেয়ে আকর্ষণীয় অংশ হলো জ্যোতিষ বিচার৷ বারবেলা আর কালবেলা, কালরাত্রি সব আছে সেখানে৷ কখন কী কাজ করা যাবে না, করলে কী কী বিভ্রাট, বাধাবিপত্তি হবে সব লেখা থাকে পঞ্জিকায়৷ অন্নপ্রাশন, উপনয়ন, বিবাহ— যেকোনো শুভ কাজেই পঞ্জিকা৷ নৌকাযাত্রা প্রসঙ্গে বলা আছে— ‘অশ্বিনী হস্তাপুষ্যা মৃগশিরা পূর্বফাল্গুনী পূর্বাষাড়া পূর্বভাদ্র অনুরাধা ধনিষ্ঠা ও শ্রবণা নক্ষত্রে, শুভ তারাচন্দ্রে, যাত্রোক্ত দিবসে, শুরু বাড়তি যোগাযোগকরণে নৌকাযাত্রা প্রশস্ত৷’—- কী বুঝলেন? এত কিছু মাথায় রেখে নৌকা চড়তে গেলে আর বোধহয় নৌকা চড়াই হবে না৷
তিথি, নক্ষত্র, বার,তারিখ, বারবেলা, কালবেলা ছাড়াও পঞ্জিকায় আরও অনেক কিছু লেখা থাকে৷ অতিরিক্ত ওজন সমস্যায় যারা ভুগছেন, তারা আর কোনও কারণে না হোক একটা করে গ্যারেন্টেড ডায়েট চার্টের জন্য পঞ্জিকা কিনতেই পারেন৷ পঞ্জিকার মতো এমন নির্মল হাস্যরসের ভাণ্ডার বাংলা সাহিত্যে আর দ্বিতীয়টি নেই৷ প্রতিদিন কী কী খাওয়া যাবে, কী কী খাওয়া যাবে না সব লেখা থাকে পঞ্জিকায়৷ যেমন ধরুন, অমুক দিনে কী কী খাওয়া নিষিদ্ধ তাও লেখা থাকে৷ যেমন— ‘নারিকেল ভক্ষণ তৈল মৎস মাংসাশী সম্ভোগ ও প্রায়শ্চিত্ত নিষেধ ও পরে অলাবু ভক্ষণ নিষেধ৷’
শুধু তাই নয়, পুরোনো পঞ্জিকার পাতায় দেখা যায় হাতঘড়ি, অস্ত্রশস্ত্র এমনকি ‘পকেট ফ্যান’-এর বিজ্ঞাপন৷ যেমন, ‘জার্ম্মান হইতে নূতন পকেটফ্যান আমদানি করিয়াছি৷ এই দারুণ গ্রীষ্মে বৈঠকখানা ও শুভবিবাহে ১টী পকেটফ্যান রাখিলে অন্য কোন পাখার আবশ্যক হয় না৷ মূল্য দুই টাকা, মাশুল ছয় আনা৷’ এভাবে দৈনন্দিন অবশ্য প্রয়োজনীয়, নতুনতর পণ্যের সঙ্গে পরিচয় ঘটানোর ক্ষেত্রে পঞ্জিকার ভূমিকা অপরিসীম৷ প্রত্যক্ষ উপযোগের তালিকা করলে দেখা যাবে, নানারকম পেটেন্ট ওষুধ, নকল গয়না, হোমিওপ্যাথি ওষুধ, ক্রীড়া সামগ্রী, কবিরাজি ওষুধ, মাথার সুগন্ধী তেল, কলম, ছিপ, ঘডি় এমনকি বিভিন্ন নার্শারির বিজ্ঞাপন পঞ্জিকার পাতায় লক্ষ্য করা যায়৷ শাকসবজি, বই কিংবা খেলাধূলার সামগ্রীর বিজ্ঞাপনও অতীতকালের পঞ্জিকায় দেখা মিলত৷ পেটেন্ট ওষুধ, বহু পরীক্ষার কষ্টিপাথর টপকানো ওষুধ থেকে স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ পর্যন্ত এখানে আছে৷ সেকালের দুই ওষুধ-প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান ‘বটকৃষ্ণ পাল অ্যান্ড কোং’ ও ‘ডি গুপ্ত অ্যান্ড কোং’ নিজেদের পণ্যের প্রচারের বাহন হিসেবে পেশাদার প্রকাশকদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বিজ্ঞাপনময় পঞ্জিকা ছাপানো শুরু করেছিলেন৷ এই ঘটনা থেকেই বোঝা যায়, তখন পঞ্জিকা অদ্ভুত সব বিজ্ঞাপনের সমাহারের জন্য জনগণের কাছে কতটাই না আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছিল৷
আসলে সেই সময় পঞ্জিকা ছিল সর্বত্রগামী৷ অক্ষর পরিচয় না থাকলেও পঞ্জিকার সাথে পরিচয় ছিল জনগনের৷ পঞ্জিকার বয়ান না বুঝলেও এর বিজ্ঞাপনের বয়ান বুঝতে অসুবিধা হতো না তাই লোকেদের৷ পঞ্জিকার হাত ধরে যখন এক লহমায় আকাশ ছোঁয়া যায়, যখন পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের সঙ্গে যোগাযোগ করা যায়, তখন পঞ্জিকা বহাল তবিয়তে বাঙালি গৃহস্থের অন্দরমহলেও সমাদৃত হয়৷ এই আপাত স্ববিরোধিতাই পঞ্জিকার প্রাণভোমরা৷ বাঙালি সমাজের পাঁজির অনায়াস গ্রহণযোগ্যতার কারণেই প্রশাসনিক, ব্যবসায়িক স্তরে তা ব্যবহূত হয়েছে বার বার৷
বাংলা পঞ্জিকাবিদদের প্রাচীন গণনা পদ্ধতি অনুসারে তৈরি অদৃকসিদ্ধ এবং আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞান পদ্ধতিতে গণনা করা দৃকসিদ্ধ এই দুই মতে বিভক্ত পঞ্জিকা আছে৷ যে গণনা পদ্ধতিতে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূত্র অনুসারে নির্ণয় করা কোনও জ্যোতিষ্কের দূরত্বের মান আধুনিক টেলিস্কোপে মাপা দূরত্বের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়, তাকে বলে দৃকসিদ্ধ বা সায়ন পদ্ধতি৷ আর যে গণনা পদ্ধতিতে মানের পার্থক্য থেকে যায় তাকে বলে অদৃকসিদ্ধ বা ‘নিরায়ণ’ পদ্ধতি৷ আমাদের বঙ্গদেশে, পঞ্জিকার তিথি গণনায় এই দু’রকম পদ্ধতির প্রচলন আছে৷ গুপ্তপ্রেস, পি এম বাগচী, বেণীমাধব শীল, মদন গুপ্ত ইত্যাদি হলো অদৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা আর বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকাই একমাত্র দৃকসিদ্ধ পঞ্জিকা৷
বাংলায় বিভিন্ন মাসের দিন সংখ্যা তিথি নক্ষত্রের সময়কাল অনুসারে পরিবর্তিত হয়৷ তাই এই পঞ্জিকার বিভিন্ন মাসের দিন সংখ্যা ২৯, ৩০, ৩১, ৩২ হয়৷ প্রাচীনকালে ভারতীয় জ্যোতিষীরা চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান, দিন রাতের হিসাব ইত্যাদি বিশেষ কিছু তথ্যের উপর নির্ভর করে কিছু কিছু সিদ্ধান্ত লিখে রাখতেন৷ প্রধানত সেখান থেকেই পঞ্জিকার ধারণা তৈরি হয়েছে৷ পরবর্তীকালে জ্যোতির্বিদ্যার উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে পঞ্জিকার গণনা পদ্ধতির পরিবর্তন হতে থাকে এবং পঞ্জিকা ক্রমে সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জডি়য়ে পডে়৷
সারা ভারতে বঙ্গাব্দ ছাড়াও বেশ কয়েকটি পঞ্জিকা ব্যবহূত হয়৷ সেগুলি হলো বিক্রম সম্ভবত, শকাব্দ, বুদ্ধ নির্বাণ-বুদ্ধাব্দ, মহাবীর নির্বাণ-মহাবীরাব্দ, বার্হস্পত্যবর্ষ, চৈতনাব্দ, কল্যব্দ, ভাস্করাব্দ, শঙ্করাব্দ, হিজরী সন, মুসলমানী মাস, ভারতের জাতীয় বর্ষপঞ্জী ইত্যাদি৷ বাংলায় গুপ্তপ্রেস, পি এম বাগচী, বেণীমাধব শীল— সব পঞ্জিকাই রঘুনন্দনের প্রাচীন সূর্যসিদ্ধান্ত গ্রন্থের নির্দেশ অনুসারে গণনা করে তৈরি করা হয়৷ অন্যদিকে, দৃকসিদ্ধ মতানুসারে প্রকাশিত বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকার গণনা ভারতীয় পঞ্চাঙ্গ অনুসারে করা হয়৷
এই বঙ্গে কীভাবে পঞ্জিকার উদ্ভব? বাঙালির কৃষ্টি ও আচারের সঙ্গে পঞ্জিকা জড়িয়ে আছে কবে থেকে?
অনুমান করা হয়, খ্রিস্টিয় ষোড়শ শতকের স্মার্ত পণ্ডিত রঘুনন্দন ও রাঘবানন্দ প্রথম বাংলা পঞ্জিকা প্রণয়ন করেছিলেন৷ সেটি পরে নবদ্বীপ পঞ্জিকা নামে পরিচিত হয়৷ তখনও পর্যন্ত বঙ্গদেশে মুদ্রণ ব্যবস্থার সূচনা হয়নি, তাই স্বাভাবিকভাবেই রঘুনন্দনের ওই পঞ্জিকা ছিল পুঁথি আকারে৷ পঞ্জিকা যুগের সূচনা থেকেই বিত্তশালী রাজা জমিদার শ্রেণী বছরের শুরুতে বাডি়তে পণ্ডিত এনে বছরের বর্ষফল ও পুজো পার্বণের দিনক্ষণ জেনে নিতেন৷ এই প্রথা দীর্ঘকাল বাংলায় চালু ছিল৷ এখনও অনেক পুরনো বনেদি বাডি়তে নববর্ষের দিন পঞ্জিকা পাঠের রেওয়াজ আছে৷ বলা হয়, রঘুনন্দনের করা পঞ্জিকার সেই ধাঁচই নানাভাবে পরিবর্তিত হয়ে আজকের পঞ্জিকার রূপ ধারণ করেছে৷
প্রথম মুদ্রিত বাংলা পঞ্জিকা কোনটি, এ নিয়েও আছে মতভেদ৷ গবেষক চিত্তরঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮১৮ সালে জনৈক রামহরির প্রকাশিত ১৫৩ পৃষ্ঠার একটি পঞ্জিকার কথা উল্লেখ করেছেন৷ নগেন্দ্রনাথ বসু সংকলিত বিশ্বকোষ-এ আবার বলা হয়েছে, কলকাতার স্যান্ডার্স কোম্পানি হলধর বিদ্যানিধিকে নিয়ে পঞ্জিকা সংকলন করিয়ে ছাপিয়ে বের করেছিল৷ তবে এসব পঞ্জিকার কোনো সন্ধান আজ অব্দি মেলেনি৷ জোড়াসাঁকো নিবাসী জনৈক দুর্গাপ্রসাদ বিদ্যাভূষণ নামের এক ব্যক্তির সংকলিত ১২২৫ বঙ্গাব্দের পঞ্জিকাটিই এযাবৎ প্রাপ্ত সবচেয়ে প্রাচীন বাংলা পঞ্জিকা বলে মনে করা হয়৷ কলকাতা জাতীয় গ্রন্থাগারে এটি সংরক্ষিত আছে৷
আগে যা ছিল প্রায় অলভ্য-দুর্লভ অথচ আবশ্যিক পুঁথি, মুদ্রণযন্ত্রের প্রসারে তা মূলত বটতলাকেন্দ্রিক বাঙালি প্রকাশকদের হাত দিয়ে জনসাধারণের অনেকটা হাতের নাগালে চলে এল৷ আর মুদ্রিত পঞ্জিকাসমূহ আগেকার হাতে লেখা পঞ্জিকার তুলনায় বেশি সহজবোধ্য ও আকর্ষণীয় করে লেখা হয়েছিল৷ ফলে পঞ্জিকা বোঝার জন্য ‘মাতব্বর’ পণ্ডিতদের ডাকার দরকারও হ্রাস পেল ক্রমে৷ ছাপা পঞ্জিকার চাহিদা উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে এসে বেড়ে গিয়েছিল৷
প্রথম দিকে শ্রীরামপুরের ‘চন্দ্রোদয় প্রেস’ থেকে প্রকাশিত পঞ্জিকাটি কুশলী ছাপার মানের জন্য দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল৷ হ্যালেডের বাংলা ব্যাকরণের হরফ-নির্মাতা পঞ্চানন কর্মকারের দৌহিত্র কৃষ্ণচন্দ্র কর্মকার ছিলেন এই প্রকাশনালয়ের মালিক৷ পরে একাধিক প্রকাশনা সংস্থা পঞ্জিকা ছাপতে উদ্যোগী হয়ে ওঠে৷ জেমস লঙের হিসাব অনুযায়ী, স্যান্ডার্স কোম্পানি ১৮৪৬ সালে একটি পঞ্জিকা বের করেছিল, যার মুদ্রণ সংখ্যা ছিল পাঁচ হাজার কপি৷ তবে এর দশ বছর পর ১৮৫৬-তে তাদের পঞ্জিকা ছাপতে হয় বিশ হাজার কপি৷ জেমস লঙের তথ্যমতে, ১৮৫৭ সালে শুধু কলকাতা শহরেই বিক্রি হয়েছিল এক লাখ পঁয়ত্রিশ হাজার কপি পঞ্জিকা৷ বিক্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কমেছিল পঞ্জিকার দামও৷ ১৮২৫-এ যে পঞ্জিকার দাম ছিল এক টাকা, তিরিশ বছর পর তার দাম দাঁড়ায় মাত্র দুই আনা৷
বর্তমানে বাজারে প্রচলিত বেশিরভাগ পঞ্জিকা প্রকাশ হয় কলকাতা থেকে৷ বেনিয়াটোলা লেন থেকে প্রকাশ হয়ে চলেছে গুপ্তপ্রেশ ফুল পঞ্জিকা৷ দুর্গাচরণ গুপ্তের বংশধরেরা এটি প্রকাশ করে চলেছেন৷ এটি প্রায় ১০০ বছর ধরে প্রকাশিত হচ্ছে৷ ৩১ নম্বর অবিনাশ কবিরাজ স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত হয় বেণীমাধব শীলের ফুল পঞ্জিকা৷
যাই হোক, পঞ্জিকার কাছে দুর্বল মানুষের প্রার্থনা কী? খুবই সামান্য এবং অতি অসামান্য৷ একটু নিরাপত্তা, একটু স্বস্তির সন্ধান৷ আর যদি তিথি নক্ষত্রের যোগাযোগে ভয়ংকর বেসামাল অবস্থা হয়, তবে তার দমন-উপশমও একমাত্র পঞ্জিকার পাতাতেই পাওয়া যায়৷ আটের দশক থেকে যে সমাজ বদলের আরম্ভ সেখানে দোকান পসরা প্রসারিত হয়েছে অনেক৷ সাম্প্রতিক পঞ্জিকার প্রবল বর্ণময় পৃষ্ঠাগুলি কম্পিউটার-গুগল-হোয়াটস্ অ্যাপের সঙ্গে মরিয়া পাঞ্জার জেদি থাবায় যা বিজ্ঞাপন আসে, তাকেই বর্ণময় করে মুদ্রিত করে চলেছে৷ আবার বর্তমান সময় থেকে আরও পঞ্চাশ বছর পরে যখন আবার কেউ পঞ্জিকার পাতা উল্টিয়ে দেখবেন, তখন হয়তো তিনি ভাববেন যে, এই সময়টা ছিল অনেকটাই বিশ্বাসের সারল্যের আর পরিতৃপ্তির৷