• facebook
  • twitter
Saturday, 26 April, 2025

‘বসন্তের চলনবিল ঝরা পাতার দলে’

‘আশ্বিনের রোদ মুখ দেখে কাশবনের আয়নায়। আগুনরঙা কপাল শীতল করব বলে আমি এই কিছুক্ষণ আগে এসে বসেছি তার নৈর্ঋত কোণে।’

প্রচ্ছদ চিত্র

সৈয়দ হাসমত জালাল

দীর্ঘ তিন দশক ধরে কবিতাচর্চায় নিমগ্ন কবি সুজিত রেজ ইতিমধ্যেই যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন। ২০২১ সালে প্রকাশিত তাঁর কাব্যগ্রন্থ ‘চলনবিলের নৈর্ঋত কোণে’। কবি জানিয়েছেন, চলনবিল তাঁর কোনো কল্পনার বিলাস নয়। শৈশব থেকে যৌবন অবধি তাঁর দেখা এক গভীর ও প্রশস্ত জলাভূমি এই চলনবিল। তার পাড়ে যেমন পায়ে হেঁটে ঘুরেছেন, সেখানেই তেমনি ভরা ভাদ্রের বর্ষায় তাঁর সন্তরণ। বাবলা-ভাঁটের ঝোপ, সাপ ও ভূতের ভয়, ঘাটজালে ধরা-পড়া মাছের লাফ— এসব নিয়েই এক রহস্যময় জগৎ তৈরি হয়েছিল কবির কল্পনাজগতে। পরিণত বয়সে সেই চলনবিল ফিরে এসেছে তাঁর কবিতায় তাঁর স্মৃতি স্বপ্ন মনন ও অভিজ্ঞতায় জারিত হয়ে।

‘আশ্বিনের রোদ মুখ দেখে কাশবনের আয়নায়। আগুনরঙা কপাল শীতল করব বলে আমি এই কিছুক্ষণ আগে এসে বসেছি তার নৈর্ঋত কোণে।’ কবির স্মৃতিলালিত অনুভবের ভেতর থেকে উঠে আসে এরকম চিত্রকল্প। বোঝা যায়, বর্তমান সময়ের নাগরিক জীবনের চেয়েও এই জগৎ তাঁর অনেক বেশি আপন। ‘চলনবিল’ কবিতাতেও কবি চমৎকার ছবি আঁকেন এইভাবে— ‘চলনবিলে দুগ্গার ঠাট উবু হয়ে শুয়ে আছে অস্থায়ী বেঘাটে। কার্তিকের হাত, সরস্বতীর বীণা দক্ষিণ-বামে চিঁড়ে-চ্যাপ্টা। এক হাঁটু জলে ঠায় দাঁড়িয়ে মাগুরচোর বিড়ি দিয়ে কান খোঁটে।’ অত্যন্ত বিশ্বাস্য এই ছবি। কবি পাঠককে নিয়ে যান এক পুরনো গ্রামীণ নস্টালজিয়ার ভেতর— ‘বিজয়া সেরে, পারুলকাকির মেয়ে শ্বশুরবাড়ি যেতে যেতে/‌ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে, হাতে তার শলাখাঁচা, জোড়া টিয়া তাতে।’ এই গ্রামজীবনের আখ্যান মিশে থাকে চলনবিলের জলে। সেখানে ‘তিরতির করে কাঁপে কথা-কথিকার জপমালা।’

বাস্তব জীবনে বহু প্রতিকূলতার সঙ্গে লড়াই করতে করতে অনেক সময় হারিয়ে যায় মানুষের বিবেক-বোধ। ‘আর্জি’ কবিতায় সুজিত লেখেন— ‘আমার বিবেক মাছরাঙা ছোঁ মেরে নিয়ে চলে গেছে।’ তিনি বলেন— ‘ভালোই হয়েছে। বিবেক নিয়ে আর কী হবে? সে তো পাঁচ পয়সায় বিকোয়। ছাগলের মতো গুঁড়ি বৃষ্টিতেই ছুঁটে পালায়।’ এখানে মাছরাঙাটি প্রতীকের মতো ঘুরে ঘুরে আসে। তাকে তিনি বলেন— ‘ওগো মাছরাঙা, তুমি আমার বিবেক খাও, চোখ খাও; শামুক-গুগলিদের ভাগ দাও।

দূরত্বে থেকে জীবনকে দেখার মতো এক হালকা ঔদাসীন্য ভেসে বেড়ায় কবি সুজিত রেজের কবিতার পঙ্‌ক্তির ভেতর। তাই ফসল ফলবে না জেনেও তাঁর এই ‘শস্যকুসুম রচনার নিরলস প্রবৃত্তি।’ কোনও দুয়ার খোলা থাকবে না জেনেও ‘সারারাত্তির দুয়ারে-দুয়ারে কড়া নাড়ার বসন্তবিলাস।’

এই বইটিতে বেশ কয়েকটি কবিতা আছে যা নিপুণ ছন্দে গ্রথিত। যেমন ‘বাসন্তী’ কবিতায়— ‘পলাশ বুকে অশোক ভাসে দুলকি চালে/‌ পদ্মপাতায় দোল খেয়ে যায় সজনে সকাল/‌ খেজুরকাঁটায় বসে সময়ের দাঁড়কাক/ কর্কশ তার গলা কুচো চিংড়ির মতো কাঁপে।’
এই চলনবিল মিশে আছে কবির স্মৃতি-সত্তায়। সেখান থেকে তিনি যেন খানিকটা স্বেচ্ছায় বেরোতেও চান না। তাঁর স্মৃতির উপকরণগুলি কখনও কখনও একটু এদিক-ওদিক করেন। যেমন ‘টোকা’ কবিতায় চোখে পড়ে এরকম পঙ্‌ক্তি— ‘বিশেষ করে চালের টোকাটা এমন জায়গায় রাখি, যাতে আমার চোখে-চোখে থাকে। এবং জানালা দিয়ে চলনবিলের আলো এসে পড়ে।’ এরকম বহু চিত্রকল্প মিশে আছে কবিতার পরতে পরতে, যা কখন অলক্ষ্যে তৈরি করে দেয় এক মায়াবী পরাবাস্তবের জগৎ। এক আশ্চর্য মায়াময় আলো ছড়িয়ে থাকে কবিতার ভাবনা ছাড়িয়ে।

চলনবিলের নৈর্ঋত কোণে
সুজিত রেজ
প্রচ্ছদ: বৈদেহী রেজ
প্রকাশক: এবং অধ্যায়
মূল্য: ৮০ টাকা