গৌরব মুখোপাধ্যায়
পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় শিশুসাহিত্য রচনার পাশাপাশি শিশুসাহিত্যের ইতিহাস লিখেছেন৷ বাংলা সাময়িকপত্রের গতিপ্রকৃতি নিয়ে লিখেছেন বৃহদায়তন গ্রন্থ৷ সে বইয়ের নাম ‘সাময়িকপত্র প্রসঙ্গে’৷ রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে, ঠাকুরবাড়ি নিয়ে তাঁর কৌতূহলের শেষ নেই৷ আলোচিত বইয়ের লেখক-পরিচিতি- অংশ থেকে জানা গেল, ঠাকুরবাড়ি-কেন্দ্রিক অন্তত চোদ্দোটি বই লিখেছেন তিনি৷ ঠাকুরবাড়ি বিষয়ক তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত বইও খুব কম নয়৷ অবনীন্দ্রনাথের একটি অমুদ্রিত-গ্রন্থ ‘স্বপ্নের মোড়ক’-এর পাণ্ডুলিপিও খুঁজে গেয়েছিলেন৷ গগনেন্দ্রনাথের বহুল প্রচারিত ‘ভোঁদড় বাহাদুর’ আদি-পাঠ ‘দাদাভায়ের দেয়ানা’ও তাঁর আবিষ্কার৷
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো একাধিক গবেষণা করলেও পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় তথাকথিত একাডেমিক বই লেখেননি৷ ঠাকুরবাড়ি নিয়ে লেখা তাঁর কোনো বই-ই তথ্য-কণ্টকিত নয়৷ তথ্য এসেছে সাবলীলভাবে, কখনো তা বোঝা হয়ে ওঠেনি৷ সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর ‘আলো-আঁধারির ঠাকুরবাড়ি’ বইটির ক্ষেত্রেও এ কথা প্রযোজ্য৷ এখন তো রবীন্দ্র-দূষণের বাড়বাড়ন্ত৷ ঠাকুরবাড়ি নিয়ে কত না মিথ্যাচারিতা৷ বড়ো মানুষকে ছোটো করে, রকমারি ভুল ধারণা তৈরি করে, আসলে আমরা আমাদের অহংকার-ঐতিহ্যকেই বিকৃত করছি৷ নব্য প্রজন্মের মনে বড়ো মানুষ সম্পর্কে ভুল ধারণা তৈরি হচ্ছে, শ্রদ্ধা হারাচ্ছে৷
ঠাকুরবাড়ির অনালোচিত ব্যক্তিত্ব, অনালোকিত ঘটনাবলি নিয়ে এই বই লিখেছেন পার্থজিৎ গাঙ্গোপাধ্যায়৷ এই বইতে হেমলতা দেবীকে নিয়ে, তাঁর সম্পাদনাকর্ম নিয়ে একটি প্রবন্ধ রয়েছে৷ ঠাকুরবাড়ির এই বধূমাতাটি আজও আড়ালে, আঁধারে রয়েছেন৷ কাদম্বরী দেবীকে নিয়ে তো গানগরের শেষ নেই৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের দাম্পত্য নিয়ে বানানো গল্প অনেক লেখা হয়েছে৷ জ্যোতিরিন্দ্রনাথের ওপর সেভাবে আলো পড়েনি৷ এ বইতে তিনি আলোকিত হয়েছেন৷ ঠাকুরবাড়ির জামাতা প্রমথ চৌধুরী৷ তিনিও তো অনেকাংশে অনালোকিত৷ পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায় নতুন করে তাঁকে চিনিয়েছেন৷ রথীন্দ্রনাথ পিতৃদেবের চরণে নিজেকে যেন উৎসর্গ করেছিলেন৷ নিজের সাহিত্যচর্চায়, বিজ্ঞানচর্চায় সেভাবে সময় দিতে পারিনি৷
রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টিকর্ম সংরক্ষণের ক্ষেত্রে প্রায় জীবন সঁপে দিয়েছিলেন৷ আড়ালে থাকার রখীন্দ্রনাথ আলোকিত হয়েছেন পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়ের কলমে৷ পিতা অন্ত-গ্রাণ, এমন সন্তান খুব বেশি দেখা যায় না৷ তিনিও তো রয়েছেন আঁধারে, আড়ালে৷ রবীন্দ্রনাথের সেজদা মাতৃভক্ত হেমেন্দ্রনাথকে আমরা কতটুকু জানি৷ সারদাসুন্দরীর হাতের পচন-ধরা ক্ষতের অস্ত্রোপচার করছিলেন তিনি৷ হেমেন্দ্রনাথ ডাক্তারি পড়তেন৷ নিজের বাহু থেকে মাংস কেটে মায়ের হাতে প্রতিস্থাপনের চেষ্টা করেছিলেন৷ তখন চিকিৎসাবিজ্ঞানের অনেক সীমাবদ্ধতা ছিল৷ অস্ত্রোপচারে সফল না হলেও মাতৃভক্তির এমন এক প্রেরণাদায়ী দৃষ্টান্ত সৃষ্টিকারী হেমেন্দ্রনাথকে আমরা ক-জন মনে রেখেছি? অভূতপূর্ব এক দৃষ্টান্ত, অথচ তা রয়েছ অন্ধকারে৷ এমন কত অজানা প্রসঙ্গের অবতারণা করেছেন পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷ রবীন্দ্রনাথের প্রিয় ভ্রাতুস্পুত্র বলেন্দ্রনাথকে আমরা কি সেভাবে মনে রেখেছি! আড়ালে থাকা বলেন্দ্রনাথ আলোকিত হয়েছেন এই বইতে৷ আড়ালেই রয়েছে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঠাকুরবাড়িতে প্রত্যক্ষ ভূমিকার কথা৷ সে প্রসঙ্গেও হৃদয়গ্রাহী আলোচনা রয়েছে৷
এ বইতে আঁধারের কথা আছে, আবার আলোর কথাও আছে৷ নানা দিকে আলো পড়েছে৷ জোড়াসাঁকোয় মধুসূদনের উপস্থিতি থেকে শুরু করে ঠাকুরবাড়ি থেকে প্রকাশিত হাতে-লেখা পত্রিকায় কত অজানা, অল্প জানা বিষয় ঘুরেফিরে এসেছে নানা প্রবন্ধে৷ অজ্ঞাত, কম আলোচিত কত না ঘটনাবলি, সেসব পড়ে বিস্মিত হতেই হয়৷ পড়তে পড়তে মনে হয়, অন্ধকার থেকে এ যেন আলোর পথে যাত্রা৷ বইটি অতি যত্নে ছাপা৷ প্রচ্ছদটিও সুন্দর, সুব্রত মাজীর আঁকা৷ ঠাকুরবাডি় নিয়ে চর্চারক্ষেত্রে এ বইটি সহায়ক শুধু নয়, অপরিহার্য হয়ে উঠবে ৷
আলো -আঁধারির ঠাকুরবাডি়, পার্থজিৎ গঙ্গোপাধ্যায়৷
সেন ব্রাদার্স, ৪৫, বেনিয়াটোলা লেন,কলকাতা ৭০০০০৯৷ ৩৫০ টাকা৷