আব্দুল মোক্তার
ভাদ্রের দুপুরে সূর্যের চোখা রোদ ঝাঁঝিয়ে পড়ছে মাথার ওপর। একটা জীর্ণ শাড়ি পরে উসকো-খুসকো অবস্থায় শ্মশানের দিকে তাকিয়ে রাস্তার একধারে বসে, একনাগাড়ে বকে চলেছে ভারতী। মাঝে মাঝে মাথা কুড়ে কপালে এঁকে যাচ্ছে এক রক্তাক্ত মানচিত্র। ‘তোরা আমার স্বামীকে গায়েব করেছিস। জোয়ান মেয়েটাকে ছিঁড়ে খেয়েছিস পাগলা কুকুরের মতো। আমার সাজানো সংসারটা আজ তছনছ। মেয়েটা পেটে বাচ্চা নিয়ে পাগলের মতো ঘুরছে আনাচে কানাচে, রাস্তায়। শ্মশানে, মাঠে খুঁজে বেড়াচ্ছে তার বাবাকে। নিষ্পাপ অবুঝ মেয়েটা কখনও হাসছে, কখনও কাঁদছে। ওই তো আসছে, দ্যাখ।’
‘মা তুমি এখনো বসে আছ? রান্না করবে কখন? বাবা চলে আসবে এখুনি! আমাকে নিয়ে পরীক্ষা কেন্দ্রে যাবে যে? ওই তো পরীক্ষার ঘন্টা বেজে গেল। আমি যাচ্ছি বাবা। আমি তো পরীক্ষায় পাস করে গেছি! বিয়েও হয়ে গেছে আমার! এই দ্যাখো, আমার পেটে তোমার নাতি! দাদু দাদু বলে ডাকছে কেমন! পাড়ায় সকলে বলে আমি না কি পাগলি, পেটে অবৈধ সন্তান। পাড়ার বাচ্চাগুলো ঢেলা ছুঁড়ে। তুমি এসো না বাবা। ওই তো তেড়ে আসছে লোকগুলো। ছিঁড়ে খাবে আবার।’ এভাবে বকতে বকতে চলে গেল রাস্তার ওপর দিয়ে। কোনো কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক নির্দোষ নাবালিকা, রাজনৈতিক দলাদলির চক্রব্যুহে দিন গুনছে কুমারী মায়ের অপেক্ষায়। জানে না তার জীবনের শুরু আর শেষ কোথায়। একদিন আগে যারা ছিল গ্রামে সকলের কাছে বিপদ আপদের হাতিয়ার, সুখ দুঃখের সঙ্গী, তারাই আজ ক্ষমতালোভী রাজনীতির ভোট নামক যন্ত্রের মহানুভবতায় উপেক্ষিত এক অস্পৃশ্য পরিবার। বিচারের বাণী প্রকাশ্যে কাঁদে আনাচে কানাচে, কুটিকুটি হাসে বদ্ধ কাচের ঠান্ডা ঘরে।
গ্রামের নাম ইজ্জতপুর। চারপাঁচটা পাড়া নিয়ে গ্রাম। এক পাড়া থেকে আর এক পাড়ার মাঝে রবি ফসল ও ধানের মাঠের মাঝখানে যাতায়াতের রাস্তা। খানিক দূরে বয়ে চলেছে প্রায় মজে যাওয়া এক নদী। পাশেই একটি শ্মশানকে ঘিরে ঝোপঝাড় ও গাছগাছালিতে ভর্তি। গ্রামের নামটা শুনলেই প্রথমে একটা সমীহ ভাব আপনা থেকেই না এসে পারে না। গ্রাম বা দেশের নামকরণ বিশেষ কোনো ঘটনার ঐতিহাসিক স্মৃতি বহন করে। এটা অনেকেরই অজানা নয়। সেই স্মৃতি সুখকর না মন্দ বা আদৌ নামের সঙ্গে তার সম্পর্ক আছে কি না সে বিতর্ক এড়িয়ে বলা যেতে পারে, ইজ্জতপুর গ্রামের একটা সুনাম এলাকার মধ্যে কিন্তু ছিল। বর্তমানে এই গ্রাম খবরের শিরোনামে। গ্রামের নামের সঙ্গে সুনামের গন্ধটা সারাদেশের কর্ণগোচরে না হলেও বদনামের খবরটা কিন্তু ঝড়ের গতিতে অসহায় কান্নার এক ইতিহাস।
গ্রামের এক দিন আনা দিন খাওয়া পরিবার নিধিরাম সর্দার। নবম শ্রেণি টপকানো নিধিরাম, সর্দারই বটে। সে যতই অপূর্ণ থাক তার মাধ্যমিক সহ উচ্চ শিক্ষার স্বাদ। গ্রামের কোনো সাতেপাঁচে জড়িয়েছে এমনটা হলপ করে বলতে পারবে না কেউ। একজন অসংগঠিত শ্রমিক বললে যা বোঝায় ঠিক তাই। সংসারে অভাব থাকলেও স্বভাব নষ্ট করার ঘোর পরিপন্থী। বরং মানুষের বিপদে আপদে ছুটে যাওয়া ছিল ওর জন্মগত নেশা। আর্থিক না হলেও সশরীরে পাশে দাঁড়িয়ে নিরীহ কাউকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া, কারো অনুষ্ঠান বাড়ির তদারকি, গ্রামীণ আচার অনুষ্ঠানে শারীরিক সহযোগিতা এধরনের নানা কাজে সোৎসাহ উপস্থিতি ও হৃদ্যতা এলাকায় সবার প্রিয় করে তোলে ওকে। এসব কাজকর্মের মধ্য দিয়ে ও যেন এক পরম সুখ অনুভব করে। তাই তো সবার কাছে সর্দার ভাই বলে সমাদৃত। এ নিয়ে ওর স্ত্রী ভারতী যে খুব খুশি তেমনটা নয়। যেখানে সংসারের এই হাল সেখানে রোজগারের দিকে যতটা না মানসিক দৃঢ়তা তার থেকে বেশি ওইসব কাজে। খুব স্বাভাবিক ভাবে তাই ওর স্ত্রী ক্ষুণ্ণ হলেও মানিয়ে নিয়ে স্বামীর পাশে থেকে হয়তো খানিক গর্বও অনুভব করত।
স্বাভাবিকভাবে নিধিরাম একজন সাদাসিধে সরল প্রকৃতির মানুষ। রাজনীতির ঘোরপ্যাঁচে ঢোকার মানসিকতা ছিল না কোনোদিনই। পাঁচজন যেভাবে ভোট দেয় নিধিরামও তাই। কোন দলকে দেয় সেটা হয়তো কথাবার্তা, ঠারেঠোরে জানতে পারে অনেকে। তাহলেও এ নিয়ে কারো কোনো আপত্তিও নেই। প্রায় বছর পাঁচেক আগের ঘটনা। স্থানীয় এক নেতা ওকে একদিন ডেকে বলল— আরে নিধিরাম? মানুষের এই নিঃস্বার্থ উপকার করার মানসিকতা ও বলিষ্ঠ দৃঢ়তা দেখে, সমাজকর্মী হিসাবে তোর জন্য সংবর্ধনার ব্যবস্থা করেছে আমাদের পার্টি। ওমুক দিন আমাদের যুবমোর্চার এক অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত করা হবে তোকে। উপস্থিত থাকবি ওইদিন।
—বলছিলাম যে, আমাকে আবার এসব দিয়ে কী লাভ! ক্ষুদ্র ব্যক্তি ক্ষুদ্রই থাকতে দাও। মঞ্চে ফঞ্চে ওঠা অভ্যেস নেই আমার। পা কাঁপে।
—প্রথমটা ওরকম মনে হয়। একবার উঠে গেলেই ঠিক হয়ে যাবে সব। এটা পার্টির সিদ্ধান্ত। তোরও সম্মানের ব্যাপার। সমাজে এত শিক্ষিত মান্যগণ্য থাকতে তোর নামটা বিবেচিত কেন বুঝতে পারলি তো?
কথাগুলো শুনে হঠাৎ এক ভয় মিশ্রিত আবেগী আনন্দে আচ্ছন্ন নিধিরাম। নেহাত এক নবম পাশ শ্রমিককে সম্মানিত করার কথাটা ভাবতে গিয়ে কেমন যেন একটা সন্দেহ লাগে ওর। এটার মধ্য দিয়ে সরাসরি পার্টিতে অন্তর্ভূক্তির কৌশল কি না সেটাও এড়াতে পারছে না ওর বিবেক। পার্টির যে নেতা বলেছে তার সঙ্গে অন্তরঙ্গতার কোনো খামতিও নেই ওর। অবশেষে ওদের কথা রেখে সংবর্ধনাও নিল। এবং যে সন্দেহটা ওর মধ্যে নাড়াচাড়া করছিল, সেটাই ওকে জড়িয়ে ধরল অক্টোপাসের মতো। আর নিধিরামও বেশ গর্বিত নিজেকে এক নিঃস্বার্থ ও একনিষ্ঠ কর্মী ভেবে। যেখানে সত্যিই তার ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার কোনো স্বার্থ নেই, সেটা ভাবাও কিছু অমূলক নয়। এভাবে স্থানীয় পরিচিতি ও সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার নিরিখে ধীরে ধীরে এলাকায় রাজনীতিতে তুরুপের তাস হয়ে উঠল নিধিরাম। মানুষের রাজনৈতিক নেশা আফিমের চেয়ে কম ভাবাটা বাতুলতা। রাজনীতির মঞ্চে এসে শুধু একজন বিশ্বস্ত কর্মী নয় দক্ষ সংগঠক রূপে তুলে ধরল নিজেকে। নিজস্ব চাওয়া পাওয়ার বিন্দুমাত্র স্পৃহাকে অবদমিত করে সামাজিক কাজকর্মে আরও বেশি নিয়োজিত। আর এই কাজকে ত্বরান্বিত করার একমাত্র প্লাটফর্ম হিসাবে রাজনীতির মঞ্চটাই মিশে গেল ওর রক্তে। এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু অস্বাভাবিক হল বর্তমানে প্রায় সব নেতা কর্মীদের মধ্যে এই প্রকৃতি শুধু বিরলই নয় বিপরীত ঘটনার জ্বলন্ত উদাহরণ।
চোখের সামনে ওর সহায়তায় বহু পরিবার রাজনৈতিক ভাবে নানা সুযোগ সুবিধা পেলেও ও রয়ে গেল ওর নিজের জায়গায়। ব্যবহৃত হতে লাগল ভোট সংগ্রহের মেশিন রূপে। অবশ্য ওর এতটুকুও আপসোস বা খেদ ছিল না এতে। স্বামীর কর্মকাণ্ডের তৎপরতা দেখে ভারতীর যে একটা সুপ্ত বাসনা জন্মায়নি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। সেটা স্বাভাবিকও। সঙ্গত কারণে ওর স্ত্রী খুব অভিমান ভরা বিরক্তিতে বলল— তুমি কেমন পুরুষ বল তো?
—কেন? হয়েছেটা কী?
—সংসারের হাল বুঝি নজরে পড়েনি? পার্টিগিরি করে এই চার বছরে বেশ তো অনেক মানুষকে বিভিন্ন কলকারখানা, আরো অন্যান্য জায়গায় সুযোগ করে দিচ্ছ। নিজের দিকে তাকিয়েছ? মেয়েটা বড় হচ্ছে। মাধ্যমিক দেবে এ বছর। পোশাক আশাক খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাটা করতে পারিনি ঠিকমতো। মেয়েটার দুঃখ বুঝতে পারি। আমাদের দিকে তাকিয়ে বলতে পারে না কিছু।
—ঈশ্বর চালিয়ে দেবে। তা ছাড়া তুমি তো আছ।
—নিজের কাজকর্মকে লাটে তুলে দিলে? আমার একশ দিনের কাজে সামান্য রোজগারে কীভাবে চলবে?
—তুমি আমাকে যা পারো বলো ভারতী। মানুষের ভালোবাসাটাই আমার পরম প্রাপ্তি। নিজের কাজের আবদার জানাতে পারব না আমি। তুমি ক্ষমা কর আমাকে।
ভারতী যতই বিরক্ত হোক, সংসারে যতই অভাব থাক অন্তরটা কিন্তু স্বামীর দৈনন্দিন কাজকর্মের সঙ্গী। সেও এক পরম শান্তি পায় স্বামীর আচার আচরণে। জাগতিক নিয়মে পাঁচটা সংসারের উন্নতি নজরে পড়লে ক্ষণিকের মোহে স্বামীকে দু’চার কথা শোনায় ঠিকই। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে আশ্বস্ত করে বিভিন্ন লোকের মুখে স্বামীর প্রশংসা শুনে। স্বামী তো মাতাল বা বদচরিত্রের নয়! মেয়েটা লেখাপড়া শিখে একটা কিছু পেলেই সংসারটা হয়তো দাঁড়িয়ে যাবে ঈশ্বরের কৃপায়। এই আশায় সান্ত্বনা দেয় নিজেকে। সেজন্য নিধিরামও স্ত্রীকে পেয়েছে সর্বক্ষণের আদর্শ সঙ্গী হিসাবে।
তবে একটা চাপা ভয় আড়ষ্ট করে রাখে অষ্টম পাশ ভারতীর হৃদয়কে। যেখানে বর্তমান এই রাজনীতির খপ্পরে বহু সংসার তছনছ, স্বামী স্ত্রী, পিতামাতার সঙ্গে বিচ্ছেদ, মনোমালিন্য একটা নিত্য অভ্যাসে পরিণত। আবার গণতন্ত্রের একটা সূক্ষ্ম সম্মতির সুযোগে ব্যাঙের ছাতার মতো নতুন দলের ছড়াছড়ি এবং চরকির মতো নীতি আদর্শহীন দলবদল বিষাক্ত করে তুলেছে রাজনীতির ময়দানকে। ভোট সর্বস্ব স্বার্থলোলুপ রাজনীতির বিষনখের আঁচড়ে নেতা থেকে কর্মী সবাই হিংস্র বাঘের চেয়েও ভয়ানক। খুন, সন্ত্রাস, ধর্ষণ থেকে শুরু করে সামাজিক সম্প্রীতি, সুস্থিতি এক চরম সংকটের মধ্য দিয়ে পাশবিকতার কবলে। আর এই কাজে সজ্ঞানে, অজ্ঞানে দেদার ব্যবহৃত হচ্ছে সমাজের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলো। সেটাই মাঝে মাঝে ভাবিয়ে তুলে ভারতীকে।
দেখতে দেখতে ওদের মেয়ে ফাল্গুনীর মাধ্যমিক পরীক্ষা দুয়ার গোড়ায়। উৎসাহ উদ্দীপনার শেষ নেই ওদের স্বামী-স্ত্রীর। তাকে ঘিরে ওদের অনেক স্বপ্ন। ভারতীর স্বপ্নটা কিছু বেশি। হবে নাই বা কেন! স্বামী কতটুকুই বা সময় দেয়। নিজেই তো সবসময় চোখে চোখে রাখে। তাই লেখাপড়ায় খুব ভালো না হলেও একেবারে খারাপ নয় মোটেই। স্কুলের মাস্টারও সে কথা বলেছে ওদেরকে। বাবার আর্থিক অসংগতির সঙ্গে অকাল প্রয়াণে যেটা নিধিরাম পূরণ করতে পারেনি, সংসারে হাল ধরতে হয়েছে অসময়ে, সেটাই দেখতে চায় মেয়ের মধ্যে। উচ্চ শিক্ষিত হয়ে একটা চাকরি পাবে, ভালো একটা জামাই হবে এসব নিয়ে ভারতীর সঙ্গে কত আলোচনা। এদিকে ভোটও ঘোষণার মুখে। বৃহত্তর গণতান্ত্রিক দেশে যত দিন যায় নব নব উন্মাদনার কৌশল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ল ভোট-সৈনিকরা। এমনিতেই এখন ধর্মীয় সম্প্রীতি বিনষ্টের মতো রাজনৈতিক সম্প্রীতিও অসৌজন্যের চরম শিখরে।
শীতের শেষে গ্রীষ্মের আগমনে নিম্নচাপের ভ্রুকুটি। হালকা ঝোড়ো হাওয়ার সঙ্গে ঝিরঝিরে বৃষ্টির পর আকাশ থমথমে। রাত্রি তখন প্রায় ন’টা। প্রাইভেট পড়ে বাড়ি ফিরছে ফাল্গুনী। পড়তে যাওয়ার সময় আকাশ ততটা বিপজ্জনক ছিল না। পথের মাঝে মুখে কাপড় বাঁধা জনকয়েক ওকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল শ্মশানের কাছাকাছি ঝোপঝাড়ে। ঘটনার আকস্মিকতায় অচৈতন্য হয়ে যায় সে। ওই অবস্থায় হিংস্র পশুর মতো একের পর এক যৌন অত্যাচার করে রক্তাক্ত ফেলে রেখে চম্পট দেয় ওরা। তার রক্তস্রাবের কালিতে দেশের বিকৃত মানচিত্র আঁকা হল উন্মত্ত হায়নাদের বিষনখের কলমে। ফাল্গুনীর স্বপ্নের লেখচিত্রও অস্পষ্ট হয়ে উঠল ফাল্গুনের অকাল নিম্নচাপের অন্ধকারে।
এদিকে সময়ে বাড়ি না ফেরায় নিধিরাম ফোন লাগায় প্রাইভেট মাস্টারকে। ঘন্টা দুয়েক আগে বেরিয়ে আসার কথা শুনে কপালের বলিরেখা চওড়া হয় উদ্বিগ্ন নিধিরামের। ভারতী ছলছল চোখে জানালো— ‘এই মেঘলায় যেতে মানা করলাম মেয়েটাকে। এতটা রাস্তা। সামনে পরীক্ষার দোহাই দিয়ে চলে গেল। তুমি একবার যাও খোঁজ নিতে। জানো তো বেশ কয়েকবার হুমকি দিয়েছে ওরা। তোমাকে দলে না পেয়ে বিরাট ক্ষোভ ওদের। খুব ভয় করছে আমার।’ এতদিন ওদের প্রচ্ছন্ন হুমকিকে কোনো গুরুত্বই দেয়নি নিধিরাম। হঠাৎ ভারতীর কথা ও চেহারায় অশুভ কিছু ঘটার এক আতঙ্কে আক্রান্ত সে। বেরিয়ে পড়ল মেয়ের সন্ধানে। ওর সঙ্গী পড়ুয়াদের বাড়ি সহ বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ পেল না কোনো। ওদের পাড়ার অন্য সঙ্গীরা কেউ যায়নি ওইদিন। একেই বোধ হয় নিয়তি বলে। বিপদ যেথায় ঘাড়ে তোমার, ফিরিয়ে আনে সাধ্য কাহার। উদভ্রান্তের মতো হন্যে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে রহস্যজনক ভাবে রাস্তায় দেখা ওরই এক প্রতিবেশী নান্টুর সঙ্গে। সে হালে দলবদলে অন্য শিবিরে গেলেও হৃদ্যতায় খামতি ছিল না দু’জনের। ওদের কয়েকবার হুমকির সঙ্গে নান্টুর কোনোরকম সম্পর্ককে বিন্দুমাত্র স্থান দেওয়ার ভাবনা নিধিরামের বিবেক সায় দেয়নি। সেরকম কোনো আচরণও দেখা যায়নি ওর মধ্যে। তাছাড়া ওই মুহূর্তে মেয়ের খোঁজে মস্তিষ্ক চঞ্চল, দিশেহারা অবস্থা। নান্টু কিছুটা বিস্ময়ে জানতে চাইল— এই দুর্যোগে, ঘুটঘুটে অন্ধকারে কোথায় বেরিয়েছ সর্দার ভাই?
—ফাল্গুনীকে নজরে পড়েছে?
—বাড়ি ফেরেনি সে?
—তাকে দেখেছ তুমি?
—ঘণ্টা দুয়েক আগে বাড়ি থেকে যখন বের হই তখন তো মাস্টার ছেড়ে দিয়েছে দেখেছি।
—তাহলে গেল কোথায় মেয়েটা! তুমি গেছলে কোথায়?
—মতিলালদা হঠাৎ মাথা ঘুরে পড়ে গেল। বৌদি ফোন করতে ওখানেই গেছলাম।
কথাটা শুনে নিধিরামের কেমন যেন একটা সন্দেহ হলেও সবসময় যে তাকেই খুঁজবে এমনটা হতে পারে না ভেবে মেয়ের চিন্তাই ঝাঁকুনি দিল মাথায়। বাড়িতে একবার ফোন করে জেনে নিল সে ফিরছে কি না। না পৌঁছানোর কথা শুনতেই নান্টু সহমর্মিতা দেখিয়ে বলল— চলো সর্দার ভাই, এদিক ওদিক একটু খোঁজা যাক। দিনকাল ভাল নয় মোটেই। সবই তো জানো তুমি।
মানুষ যখন চরম বিপদে দিকবিদিক শূন্য জ্ঞানহারা উদ্বেগের আঁধারে ডুবে যেতে থাকে, তখন সামান্য এক জোনাকির আলোকেই আশার দীপ ভেবে আঁকড়ে ধরে। ওর সঙ্গে মেয়ের সন্ধানে নদীপাড়ের বনবাদাড়ে ঘেরা এক নির্জন স্থানে হাজির। যেখানে ওত পেতে অপেক্ষায় ছিল ফাল্গুনীর ওপর পাশবিক অত্যাচারী মহান বীরের দল।
—আমাকে কোথায় নিয়ে এলে নান্টু? আমার মেয়ে কোথায়? আমি তো কোনো ক্ষতি করিনি তোমাদের?
—ক্ষতি! তোকে না গায়েব করলে আমাদের গলায় জল সরছে না। ভোটও পাওয়া মুশকিল।
সঙ্গে সঙ্গে নিধিরামকে অচৈতন্য করে সরিয়ে দিল অজানা ঠিকানার উদ্দেশে। ওদের পৈশাচিক রাহুগ্রাসে অস্তমিত হল নিঃস্বার্থ নিধিরামের সেবা-সূর্যের উজ্জ্বল আলোটা। যেটা ইজ্জতপুরের ঝাপসা আকাশে পুনরায় উদিত হবে কি না কেউ জানে না। একেবারে কাকভোরে জ্ঞান ফিরে পেয়ে বিধ্বস্ত মানচিত্রের চেহারায় উদাস নয়নে বোবার মতো কোনোরকমে বাড়ি ফিরে, ভারতীর ফ্যাকাশে সিঁদুর মাখা কোলে লজ্জা লুকালো ফাল্গুনী।